হাকীম সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ ::
আইয়ূব খানের সামরিক সাশনের ১০বছরে নেজামে ইসলাম একেবারে দুর্বল হয়ে পড়ে। ৭০’র নিবার্চনে তেমন গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করতে পারেনি। ৭১ সালে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম মুক্তিযোদ্ধের স্বপক্ষে সাহসী ভূমিকা রেখে জনমত তাদের পক্ষে নেয়ার জোরালো চেষ্টা করলেও নেজামে ইসলাম তা করতে পারে নি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিচ্ছিন্নভাবে নেজামে ইসলাম তাদের সংগঠনিক তৎপরতা চালালেও একসময় খেলাফত আন্দোলনের গণ-স্রোতে হারিয়ে যায়। বর্তমানে ঐতিহ্যবাহী এই দলটি তিন ভাগে বিভক্ত। মুফতি ইজহারুল ইসলাম, আব্দুল লতিফ নেজামী ও এডভোকেট আব্দুর রকিব। তিনজনই নেজামে ইসলামের কেন্দ্রীয় সভাপতি আবার ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যন হিসেবেও নিজকে দাবী করছেন।
আশির দশকের প্রথম দিকে হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.’র নেতৃত্বে গঠিত হয়েছিল খেলাফত আন্দোলন। সংগঠনটির আত্মপ্রকাশ ছিল ইসলামি রাজনৈতিক অঙ্গণের এক সাড়া জাগানো ঘটনা। এমনকি অন্যান্য সকল ধারর রাজনৈতিক দলকেও হার মানিয়েছিল খেলাফত আন্দোলন নামক সংগঠনটি। ১৯৮১ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশ নিয়ে এ সংগঠনের রাহবার হযরত হাফেজ্জী হুজুর রাহ. বিপুল ভোট পেয়ে তৃতীয় স্থান অর্জন করেছিলেন। জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম ও জামাতে ইসলামী থেকে বিচ্ছন্ন হয়ে আসা যুব শিবিরের একটি অংশসহ ভিবিন্ন ইসলামি সংগঠন, অনেক প্রবীণ উলামা মাশায়েখ হাফেজ্জী হুজুরের ডাকে নজিরবিহীন সাড়া দিয়েছিলেন।
খেলাফত আন্দোলনের সাথে একাত্মততা ঘোষণা করেছিলেন দেশের সকল শীর্ষ আলেম ও দ্বীনদার বুদ্ধিজীবিরা। পাকিস্তান যুগ থেকে চলে আসা সকল ইসলামি সংগঠন একীভুত হল হযরত হাফেজ্জী হুযুরের নেতৃত্বে খেলাফত আন্দোলনে। রাজনৈতিক অঙ্গনে দলমত নির্বিশেষে সকলেই সক্রিয় হয়ে উঠলেন।
ইসলামি রাজনীতির বিইরে ডান ও বাম ধারার অনেক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বও হাফেজ্জী হুযুরের সাথে আন্দোলনের ময়দানে শরীক হন। কল ইসলামি সংগঠনের ঐক্যের এই খবর সমগ্র দেশে ভিন্ন মাত্রার প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছিল। বিশেষ করে হাফেজ্জী হুজুর তাওবার রাজনীতির যে ডাক দিয়েছিলেন, তাতে গোটা জনপদ প্রকম্পিত হয়েছিল। তখন সামরিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে দেশে কুরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে খেলাফত রাষ্ট্র ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে দেশের জনগণ ব্যাপক আশাবাদী ও উত্সাহী হয়ে উঠেছিল। এমনকি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও এ ব্যাপারে যথেষ্ঠ আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। ইসলামি নেতৃবৃন্ধ সেসময় সকল মতভেদ ভুলে গিয়ে আল্লাহর জমিনে একমাত্র আল্লাহর দ্বীনকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য খেলাফত আন্দোলনের পতাকাতলে সমবেত হয়েছিলেন। সফল একটি ইসলামি বিপ্লবের জন্য শপথ গ্রহণ করেছিলেন, সবাই একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাংলাদেশের ইসলামি রাজনীতির আরেক নব যুগের সূচনা করেন।
নেতৃবৃন্ধ সকল মতপথকে লাথি মেরে সার্বক্ষনিক ইসলামি গণবিপ্লবের জীবন ধারণের বয়াত গ্রহণ করেছিলেন মহান নেতা হাফেজ্জী হুজুরের কাছে। তাগুতের বিরুদ্ধে আপোষহীন লড়াইয়ের শপথে উজ্জীবিত হয়ে উঠেছিল তখন ইসলামি সমাজ বিপ্লবের কর্মীরা। যে শপথের পতিক্রিয়ায় দেশের সকল তাগুতী শক্তির হৃদকম্পন শুরু হয়েছিল। শুকিয়ে গিয়েছিল তাদের কলিজার পানি।
হতাশার তিমিরে আচ্ছন্ন, বিভ্রান্তির চোরাবালিতে হারিয়ে যাওয়া সমস্যার অক্টোপাসে জর্জরিত মানবতা মুক্তির আনন্দে নেচে উঠেছিল। আশার সঞ্চার হয়েছিল সর্বস্থরের ধর্মপ্রাণ মানুষের মাঝে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় যে, খেলাফত আন্দোলন শুরু হওয়ার অল্প দিনের মধ্যেই হাফেজ্জী হুযুরের আশে পাশে থাকা মুষ্ঠিমেয় কয়েকজন স্বার্থবাজ ব্যক্তি সংগঠন ও আন্দোলনকে শৃঙ্খলা ও নিয়মতান্ত্রিকতার ভীতের ওপর দা্ড় করানোর পথে অন্তরায় হয়ে বসেন। হাফেজ্জী হুযুরের উপস্থিতিতে মজলিসে শুরার বৈঠকে পরামর্শের ভিত্তিতে গৃহীত সিদ্ধান্ত সমূহকে তারা নিজেদের খেয়াল-খুশি মতো রদবদল করে হাফেজ্জী হুযুরের নামে জনগণের সামনে উপস্থাপন করতে শুরু করেন। বিশেষ করে তাঁর অসুস্থতাকালীন সময়ে তারা ভয়ংকর এবং নষ্ট এক খেলায় মেতে উঠেন হয়রত হাফেজ্জি হুযুর ও তার প্রতিষ্টিত খেলাফত আন্দোলনকে নিয়ে। এসকল কারণেই ক্ষোভ ও অসন্তুষ ক্রমেই দানা বেধে উঠতে থাকে। এক পর্যায়ে জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, নেজামে ইসলাম, ইসলামী যুব শিবির প্রভৃতি সংগঠনের নেতা-কর্মীরা হাফেজ্জী হুযুরের নেতৃত্ব থেকে পৃথক হয়ে স্ব-স্ব অবস্থানে চলে গেলেন। দূরে সর দাড়ালেন শীর্ষ অনেক আলেম ও বুদ্ধিজীবি। টুকরো টুকরো হয়ে গেল মুসলিম ঐক্যের এক মহান মিশন খেলাফত আন্দোলন। বর্তমানে দলটির অস্থিত্ব থাকলেও তা কয়েক খণ্ডে বিভক্ত।
চলবে…