বিজলীর ন্যায় দ্রুত গতিতে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেল দুটি সপ্তাহ। সফরটি যদিও আব্বার অসুস্থতাকে কেন্দ্র করে ছিল, তারপরও শত ব্যস্ততার ফাঁক-ফোকরে অনেক বিষয় দৃষ্টির আড়ালে আর থাকে নি। ইসলামি শিক্ষা ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে দেখা গেল বিশাল এক স্বীকৃতির; সংস্কার, পরিবর্তন, পরিমার্জন, আধুনিকায়ন এবং এর পদ্ধতিতে এসেছে এক বিরাট বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তবে হ্যাঁ, বাস্তবের চেয়ে কাগজেই বেশি; চমৎকার লিফলেট, বর্ণীল বিজ্ঞপ্তি আর আকর্ষণীয় উপস্থাপনার পোস্টার-ব্যানারে আচ্ছাদিত হয়ে আছে পুরো সিলেট। এমন yচিত্র সিলেটের সর্বত্র দেখা যায়।
সচেতন অভিভাবকদের সাথে কথা বললেই বেরিয়ে আসে হতাশা আর অভিযোগের অন্তহীন ফিরিস্তি। যুগোপযোগি এবং উন্নত শিক্ষার সেবা দানে রাস্তার মোড়ে মোড়ে গড়ে ওঠা দৃষ্টিনন্দন আধুনিক ইসলামি প্রতিষ্ঠানগুলোর ভুমিকা প্রশ্নবিদ্ধ। অভিভাবকদের সবার কথা প্রায় এক: ‘এগুলো সব শুধু কাগজে, বাস্তবের সাথে এর আদৌ কোন মিল নেই, শিক্ষা বা সেবার চেয়ে এগুলোতে পয়সা কামানো-ই মুখ্য।’
স্বভাবত নিরাশার পিছনে আশা আর আঁধারের পেছনে আলো খুঁজতে আমি ভালোবাসি। কবি যেমনটি বলেন:
“পাড়ি দাও স্রোত কঠিন প্রয়াসে অকুতোভয়, এই নিশীথের তীরে হবে ফের সূর্যোদয়”
এর অর্থ এই নয় যে, আমি বিভিন্ন ক্ষেত্রে ছড়িয়ে থাকা অনিয়ম, অসঙ্গতি অস্বীকার করছি, বরং এগুলো যে কাগজেই সীমাবদ্ধ, তা আমার পক্ষে স্বীকার করে নিতে কোন ধরনের সংকোচ নেই।
তবে বাস্তবতা হল, এক সময় ইসলামি শিক্ষা এবং আধুনিক শিক্ষার সমন্বয় নিয়ে কথা বলাও ছিল অপরাধ। বাংলা এবং ইংরেজি শিক্ষায় গুরুত্বারোপ করার কথা বললে ‘কেবলা চেঞ্জের প্রশ্ন’ জুড়ে দেওয়া হতে। আমার মনে আছে, একবার একটি প্রতিষ্ঠান কোন বোর্ডের আওতাধীন হয়ে শিক্ষা কার্যক্রম চালাবে- এ নিয়ে কার্য্য নির্বাহী পরিষদে আলোচনা চলছিল, এক পর্যায়ে একজন মাদরাসাকে এমন একটি বোর্ডের আওতায় যেতে প্রস্তাব দিলেন, যেখানে উর্দুর চেয়ে তুলনামূলকভাবে বাংলা এবং ইংলিশকে অধিক গুরুত্বারোপ করা হয়। সাথে সাথে উপস্থিতদের মধ্য থেকে এজন প্রভাবশালী ব্যক্তি বলে উঠলেন: “আমরা মাদরাসাকে কেবলামুখী করতে চেষ্টা করছি, আর ওরা লন্ডনমুখী করতে চেষ্টা করছে”, “ক্বেবলা চ্যাঞ্জ করা প্রয়োজন।”
আলহামদুলিল্লাহ, এবার যা দেখলাম সিলেট শহরে প্রায় প্রতিটি পাড়ায় পাড়ায় নতুন ভাবধারায় গড়ে উঠেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। দুটি প্রতিষ্ঠান আমি নিজেই পরিদর্শন করে আসলাম। সেখানকার ছাত্ররা মাদরাসায় পড়ে তাদের আসাতেযায়ে কেরামের তত্বাবধানে থেকে সরকারী শিক্ষা ক্যারিকুলামের ‘সমাপনী’ পরিক্ষায় অংশগ্রহণ করে ভালো ফলাফল অর্জন করেছে। এ সকল নতুন ধারার ইসলামি শিক্ষা ব্যবস্তায় আরবী, বাংলা এবং ইংলিশ প্রয়োজন অনুপাতে যথাযত গুরুত্ব পাচ্ছে। বিশেষত হিফজ ক্লাসের ছাত্রদের তিলাওয়াত শুনে বুঝার উপায় নেই যে, সে বাংলাদেশী না আরবী? বিশুদ্ধ উচ্চারণ আর হৃদয়ের গভীর নিসৃত মধুর তিলাওয়াত শুনে এমনিতেই কালামে পাকের সম্মান আর মুহাব্বাতে মন ভরে উঠে। প্রতিষ্ঠান গুলোর প্রসপেক্টাস দেখলে একথা বুঝার আর বাকি থাকে না যে, ধার্মিক এবং সচেতন অভিভাবকদের চাহিদা, সময়ের তাগিদ-ই মাদ্রাসা কতৃপক্ষকে বাধ্য করেছে ঐসকল যুগপোযোগী ব্যস্থাপনা প্রতিষ্ঠান করতে। কতৃপক্ষ এ কথা ভালোভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, আমাদেরকে এখন ধর্মীয় এবং ইহকালীন জীবনে প্রয়োজন পূরণে এগিয়ে আসা ছাড়া কোন উপায় নেই।
আর তাই প্রতিষ্ঠান সমূহের পরিচিতিপত্রে মাদ্রাসার লক্ষ্য, ভবিষ্যত পরিকল্পনা, শিক্ষাদান পদ্ধতি, বাচ্চাদের বিনোদনের জন্য বিভিন্ন আয়োজনে রয়েছে বিস্তর বিবরণ, যা সত্যিই প্রশংসনীয়।
এক অর্থে যদিও চাহিদার তুলনায় এগুলো কিছুই না, কিন্তু অন্য অর্থে বিবেচনা করলে দেখা যাবে অনেক কিছু। কারণ ইংরেজিতে একটা কথা আছে- practice makes perfection (ধারাবাহিক চর্চার মাধ্যমেই উৎকর্ষতা সাধিত হয়।) যে কোন জিনিস শুরু করলে পরে এর বিভিন্ন দুর্বলতা সামনে আসে, অতঃপরে ধীরে ধীরে সংশোধন, সংযোজনের মাধ্যমে অর্জিত হয় তার কাঙ্খিত লক্ষ্য। এই সকল প্রতিষ্ঠানের সফলতার সাথে জড়িত রয়েছে ভবিষ্যত প্রজন্মের ভাগ্য। এসবের সফলতা হয়ত বাধ্য করবে অন্যদেরকেও ভাবতে।
এখন দরকার শুধু নতুন এই ভাবধারায় গড়ে ওঠা মাদরাসাগুলোর মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক উন্নয়ন; সময় সময় উন্মুক্ত আলোচনা সভার আয়োজন, শিক্ষা-দীক্ষার মানোন্নয়ন এবং নিয়ন্ত্রণের জন্য একটি কন্ট্রোলিং কাঠামো গড়ে তুলা। চলবে …..
লেখক : গবেষক, প্রাবন্ধিক, খতিব ও ইসলামি শিক্ষাবিদ।