নূর উদ্দীন মুহাম্মদ ইয়াহইয়া ::
১৬ই ডিসেম্বর ২০১৫ ইংরেজি। মহান বিজয় দিবস। বিজয় দিবস উপলক্ষে মাদরাসা বন্ধ। আমরা নৈসর্গিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি রাঙামাটি যাবো বলে সিদ্ধান্ত নিলাম।
রাঙামাটি পার্বত্য চট্টগ্রামেরর একটি পাহাড়ি জেলা। পাহাড়, নদী ও লেকবেষ্টিত একটি বৈচিত্র্যময় জনপদ। যেখানে চাকমা, মারমা, তঞ্চঙ্গ্যা, ত্রিপুরা, মরং, বোম, রাখাইন, খুমি, খেয়াং, চাক, পাংখোয়া, লুসাই, সুজে, সাওতাল সর্বোপরি বাঙলীসহ ১৪টি জনগোষ্টির বসবাস। এছাড়াও এখানে আসামীয়া ও গুর্খা সম্প্রদায়ও বাস করে। রাঙামাটির উত্তরে ভারতের ত্রিপুরা ও মিজোরাম, দক্ষিণে বান্দবান, পূর্বে মিজোরাম ও মায়ানমারের চিন প্রদেশ, পশ্চিমে চট্টগ্রাম ও খাগড়াছড়ি। এ জেলা আয়তনের দিকদিয়ে দেশের সর্ববৃহৎ জেলা। দেশের একমাত্র রিকশাবিহীন শহর। আমি, মাওলানা জয়নুল আবেদীন, হাফিজ সাইফুর রহমান ও মাহবুবুর রহমান। সকাল আটটায় রওয়ানা দেই। হাটহাজারী বাস স্ট্যান্ড থেকে একটি সিএনজি রিজার্ভ নেই। হাটহাজারী থেকে রাঙামাটি প্রায় ৫০ কিলোমিটার। সিএনজি এতোদূর একটানা যায় না। তাই মধ্যখানে রানীরহাটে আমাদের অন্য একটি সিএনজিতে বদল করে। প্রায় দুই ঘণ্টা পাহাড়ী আঁকাবাঁকা রাস্তা মাড়িয়ে আমরা পৌঁছাই রাঙামাটি শহরের বনরূপায়। ওখান থেকে আরো একটি সিএনজি নিয়ে বিশ/পচিশ মিনিটে পৌঁছে যাই রাঙামাটি শহরের শেষপ্রান্তে কাপ্তাই হ্রদের উপর নির্মিত ঝুলন্ত সেতুর গেটে। ১০টাকার টিকিট কেটে ভেতরে প্রবেশ করি। ৩৩৫ ফুট দীর্ঘ মনোহারা ঝুলন্ত সেতু। মধ্যখানে খুঁটি ব্যতিত বড় বড় তার দিয়ে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে। পর্যটকদের জন্য খুবই দৃষ্টিকাড়া ও আকর্ষনীয় স্থান এটি। এ ব্রীজেন নাম শুনে নি বা ছবি দেখে নি- এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। ব্রীজটি এলাকাকে আরো বেশি সুন্দর ও দৃষ্টিনন্দিত করে তুলেছে।
পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ ও অপূর্ব নির্মানশৈলীর কারণে এ সেতুটি ‘সিম্বল অব রাঙামাটি’ নামে পরিচিতি পেয়েছে। সেখানে গিয়ে আমরা পরিচিত আরো অনেককে পেয়ে যাই। সবাই মিলে আমরা দুটো ট্রলার ভাড়া করি। এখান থেকে ট্রলার ছাড়ে বেলা এগারোটায়। আমরা যাত্রা শুরু করি কাপ্তাই হ্রদের বুক চিরে।
কাপ্তাই হ্রদ পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি জেলার একটি কৃত্রিম হ্রদ। কর্ণফুলি পানিবিদ্যুৎ কেন্দ্রের জন্য কর্ণফুলি নদীর উপর কাপ্তাই বাঁধ নির্মান করা হলে রাঙামাটি জেলার ৫৪ হাজার একর জমি পানিতে ডুবে যায় এবং হ্রদের সৃস্টি হয়। মূল লেকের আয়তন ১,৭২২ বর্গ কিলোমিটার। পেদা টিং টিং কাপ্তাই হ্রদের চারিদিকে কেবল পাহাড় আর হ্রদ। যেনো প্রকৃতির মাঝে আপনি এক আগন্তুক মাত্র। বুনো প্রকৃতি ছাড়া এখানে আর কিছু আশা করা যায় না। কিন্তু আপনি অবাক হবেন, যখন পথে কোনো একটি টিলার উপর দেখবেন ‘পেদা টিং টিং’। এমন এক পরিবেশ যেখানে আপনি একগ্লাস খাবার পানি পাবেন না, সেখানে ‘পেদা টিং টিং’ আপনার জন্য চা, কফি আর চিকেন ফ্রাই নিয়ে অপেক্ষা করছে। সত্যিই অবাক হবার মতো ব্যাপার। পেদা টিং টিং একটি চাকমা শব্দগুচ্ছ। যার অর্থ পেট টান টান। অর্থাৎ মারাত্মকভাবে খাওয়ার পর পেটের যে টান টান অবস্তা হয়, তাকেই বলা হয় ‘পেদা টিং টিং’। এটা কাপ্তাই হ্রদের ভাসমান একটা পাহাড়ে অবস্তিত।
সুবলং ঝর্ণা রাঙামাটি জেলার বরকল উপজেলার সুবলং এর পাহাড়ি ঝর্ণা ইতিমধ্যে পর্যটকদের কাছে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করেছে। এই ঝর্ণার নির্মল জলধারা পর্যটকদের হৃদয়ে এক ভিন্ন অনুভূতির কাঁপন তুলে। ভরা বর্ষায় মূল ঝর্ণার জলধারা ৩০০ ফুট উচু থেকে নিচে আছড়ে পড়ে। এবং অপূর্ব সুরের মূর্ছনায় পর্যটকদের সযত্নে মুগ্ধ করে। এ অপরূপ দৃশ্য স্বচক্ষে না দেখলে কল্পনায় সে ছবি আঁকা কি সম্ভব! এখান থেকে আমাদের ট্রলারটা ঘুরে যায়। আমরা পৌঁছি ‘চাং পাং রেস্টুরেন্টে। চাং পাং রেস্টুরেন্ট বরকল উপজেলার এটি আরেক আকর্ষন। রাঙামটি ঘুরতে এসে যদি ভিন্ন স্বাদের অাদিবাসীদের বিশেষ বিশেষ খাবার খেতে চান তাহলে যেতে পারেন ‘চাং পাং রেস্টুরেন্টে’। এখানে আপনি রাঙামাটির ঐতিহ্যবাহী খাবার কাচকি ফ্রাই, বেমবো চিকেন, কলাপাতা রুই, মাছভর্তা ইত্যাদি খেতে পারবেন। চাং পাং এটিও চাকমা শব্দ। ‘চাং’ অর্থ চাই আর ‘পাং’ অর্থ পাই। অর্থাৎ যা চাই তা পাই। সেখানে ছোট একটা রুমে আমরা কয়েকজন জুহরের দু’রাকাত কসর নামাজ আদায় করি। আসার পথে আরো একটি ঝর্ণা দেখতে পেলাম। বেশী উঁচু না, ২০/২৫ ফুট হবে। তবে পানির বেগ অনেক।
রাঙামাটির তাঁত বস্ত্র চাকমা, রাখাইল, টিপরা ইত্যাদি উপজাতিরা নিজাদের পরনের কাপড় নিজেরাই বুনে। তাদের তৈরি বিভিন্ন তাঁত বস্ত্র এখানে বেশ জনপ্রিয়। তাই হ্রদের উভয়দিকে গড়ে উঠেছে নানা বস্ত্র বিপনী। পরিবার বা কোনো ঘনিষ্টজনের জন্য নিয়ে যেতে পারেন আদিবাসীদের তাঁতে তৈরি পিনন- খাদি চাদর, সেলোয়ার-কামিজ, শাড়ি, ব্যাগ ইত্যাদি। আমি একটা নকশী চাদর ৪০০ টাকা দিয়ে নিয়েছি। যা আপনি মার্কেট থেকে কিনতে গেলে ৮০০ থেকে ১২০০ টাকা গুনতে হবে। এরপর আমরা চলে আসি বৌদ্বের তীর্থস্থান রাজবন বিহারে। রাজবন বিহার বা বৌদ্ব বিহার রাজবাড়ির পাশেই আন্তর্জাতিক খ্যাত এই বৌদ্ব ধর্মীয় প্রতিষ্টানটি অবস্তিত। এখানে অবস্তান করেন বৌদ্ব আর্য পুরুষ শ্রসক বুদ্বু শ্রীমৎ সাধননান্দ মহাস্থবির বনভান্তে। এই বৌদ্ব বিহারে প্রত্যেক বছরে কঠিন চীবের দানোৎসবে লক্ষাধীক মানুষের সমাগম ঘটে। এটি বর্তমানে বাংলাদেশে বৌদ্বদের প্রধান ধর্মীয় প্রতিষ্টান। সর্বমোট ২২ একর ভূমির উপর প্রতিষ্টিত হয় রাজবন বিহার। ১৯৭৭ সালে বনভান্তে লংদু এলাকা থেকে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য রাঙামাটি আসেন। বনভান্তে ও তার শিষ্যদের বসবাসের জন্য ভক্তকূল এই বিহারটি নির্মান করে দেন। এখানে আছে একটি প্রার্থনালয়, একটি প্যাগোভা, বনভান্তের আবাসস্থল ও তার ভোজনালয়। বনভান্তের জন্ম রাঙামাটি সদর উপজেলার মোরঘোনা পল্লীতে ১৯২০ সালের ০৮ জানুয়ারি। ৩০ জানুয়ারি ২০১২ ইংরেজীতে বিকালে ৯২ বছর বয়সে সে মারা যায়। বর্তমানে তার শবদেহ পেটিকাবদ্ধ রাখা আছে। এছাড়াও এখানে আছে দুইটি মন্দির সেখানে রয়েছে গৌতম বুদ্বসহ হাজারো ছেটোবড়ো পিতলের মূর্তি। বনভান্তের শবদেহের পাশেই তৈরি করা হয় মম দিয়ে চেয়ারে বসা অবস্থায় বনভান্তের এক মূর্তি। আরো রয়েছে বৌদ্ব পাঠাগার ও অষ্টমার্গ। তবে আপনি বৌদ্ব বিহারে মাথায় টুপি পরে বা বোরকা পরে প্রবেশ করতে পারবেন না। জায়গায় জায়গায় নোটশ টানানো আছে- ” ভিক্ষু ব্যতিত টুপি ও বোরকা পরে প্রবেশ নিষেধ “। একজনকে জিজ্ঞেস করলাম, ভিক্ষু কী? সে জানালো, ভিক্ষু হলো যারা নিজের জীবন-যৌবনকে বিসর্জন দিয়ে উপাসনালয়ের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করে দিয়েছে তারাই হলো ভিক্ষু। ঘাড় হলুদ রঙের একটা কাপড় পরে এভাবে শ’খানিক ভিক্ষু এখানের সবকিছু দেখা-শুনা করছে।
বৌদ্বদের এই অবস্তা দেখে মনে অনেক আফসোস আসলো, আমরা এতোসব মুসলান থাকতে ওরা নির্ঘাত চলে যাচ্ছে জাহান্নামে। অথচ তারাও স্রস্টাকে পেতে চায়। নিজেকে তখন খুব অপরাধী মনে হচ্ছিলো..! সেখান থেকে ফিরে আমরা ট্রলালের উপর আসরের নামাজ আদায় করি। পাশ্ববর্তী রাজবাড়িও ঘুরে আসলাম। একাধারে সাত ঘণ্টা ট্রলারে ভ্রমনের পর মাগরীবের আজানের সময় আমরা ঘাটে নামলাম। ক্লন্ত, শ্রান্ত বদন নিয়ে তৃপ্ত মনে আমরা হাটহাজারীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেই। আপনিও রাঙামাটি আসতে পারেন যে কোনো ঋতুতে। কারন, প্রতি ঋতুতেই রাঙামাটির সৌন্দর্য বদল করে হয়ে ওঠে নতূন এক রাঙামাটি। হ্রদ ভ্রমনের সময় চোখে পড়বে দুই পাশে খাড়া পাহাড়। ছবির মতো আধিবাসীদের গ্রামগুলো আপনাকে হাতছানি দিয়ে ডাকবে। পানকৌড়ি, বক ও ডুবুরি পাখিসহ দেখা মিলবে বহু প্রজাতির পাখির। দ্বিপের মতো জেগে উঠি পাহাড়ের শীর্ষে ছায়াঘেরা মাচাং মন ভরিয়ে দিবে। আর দেরী কেনো, চাকমা ভাষায় বলতে হয়- “রাঙামাটি বেরেচ্ চি” মানে রাঙামাটি বেড়িয়ে যান।
লেখক : শিক্ষার্থী, ইফতা প্রথম বর্ষ, দারুল উলূম হাটহাজারী, চট্টগ্রাম। ফাযিল : জামেয়া রেঙ্গা [৪৮তম ব্যা্চ]