রেললাইনের ঐ বস্তিতে, বাসস্ট্যান্ডের ওপাশে, গাছতলায় কিংবা ব্রিজের রেলিংয়ে লুঙ্গি অথবা গামছা দিয়ে শরিরটা মুড়িয়ে শুয়ে আছে কত ছিন্নমূল মানুষ আর পথশিশু। একটি উষ্ণ কাপড়ের অভাবে শীতের সাথে আলিঙ্গন করে রাত্রিযাপন করছে। অথচ, আমি-আমরা আর আপনারা যারা আছেন বিত্তবানরা তারা হয়তো গেলো বছরের শীত সিজনের পোশাকটা থাকা সত্তেও আরেকটা কেনার ইচ্ছে করছেন। কেউ আবার হাজার খানেক টাকা দিয়ে কিনেও নিয়েছেন। সে যাই হোক পুরনোটা দিয়ে আপনি পারেন অসহায়-দরিদ্র আর ছিন্নমূল শীতার্ত মানুষগুলোকে হাড় কাঁপানো শীত থেকে বাঁচাতে।
শুধু ইসলামই নয়, প্রতিটি ধর্মে মানবসেবার গুরুত্ব রয়েছে। ইসলাম ধর্ম তাঁর অনুসারীদের জন্য একে একটি ইবাদত হিসেবে গণ্য করে।
প্রকৃতির আবর্তন-বিবর্তন, পরিবর্তন ও বিরূপ প্রভাব মহান আল্লাহ তাআলার শ্রেষ্টত্বের প্রমাণ এবং এর মধ্যেও মহান আল্লাহর আনুগত্যের আহ্বান ধ্বনিত হয় ‘যেহেতু আসক্তি আছে কুরাইশদের/ গ্রীষ্ম ও শীতকালে দূরে সফরের/ তারা করুক তবে তাঁর ইবাদত/ কা’বার প্রভুর দেওয়া নির্ধারিত পথ..’ (কাব্যানুবাদ, সুরা-কুরাইশ: ০১-০৩)। এ শাশ্বত ঘোষণায় বোঝা যায় ‘গ্রীষ্ম-শীত’ সবই মহান আল্লাহর হুকুম এবং সর্বাবস্থায় তাঁরই ইবাদত করা বান্দার কর্তব্য।
আবহাওয়ার পরিবর্তন ও ঋতু পরিক্রমায় শীত জনজীবনে বিরূপ প্রভাব বিস্তার করে। যা খুবই কষ্টকর ‘উত্তরিয়া শীতে পরাণ কাঁপে থরথরি / ছিড়া বসন দিয়া মায় অঙ্গ রাখে মুরি’ (মৈমনসিংহ গীতিকা: ‘মলুয়া’)। পৃথিবীর আহ্নিকগতির কারণে দিন-রাত্রি এবং বার্ষিকগতির প্রভাবে ঘটে ঋতুচক্রের পরিবর্তন এর সবই কিন্তু হয় মহান আল্লাহর নির্দেশে ‘তিনিই রাতকে দিনে এবং দিনকে রাতে পরিবর্তন করেন, তিনি সূর্য ও চাঁদকে নিয়ন্ত্রণ করছেন; প্রত্যেকেই এক নির্দিষ্টকাল আবর্তন করে… (সুরা-ফাতির-আয়াত-১৩)। ফলে বছর ঘুরে আসে শীত, গ্রীষ্ম ও বর্ষাকাল।
মহানবী সা.’র একটি হাদিসের বর্ণনা থেকে জানা যায় : ‘দোযখ যখন শ্বাস ছাড়ে তখন পৃথিবী উষ্ণ-উত্তপ্ত হয়ে ওঠে আবার যখন প্রশ্বাস নেয় প্রবল শৈত্যে আচ্ছন্ন হয় শান্তির পৃথিবী’! শীতের কারণে, বায়ুমন্ডলে তাপমাত্রা ও আদ্রতা হ্রাস পায়। আবার দিবাভাগে সূর্যের ক্ষীণতাপে বাষ্পীভূত জলীয় কণা কুয়াশায় রূপান্তরিত হয় এবং কখনো বা রাতের তাপমাত্রা বেশি কমে যাবার কারণে কেনো কোনো অঞ্চলে ঘটে তুষারপাত। এমন বিরূপতায় প্রকৃতি হয়ে ওঠে উষর-ধূষর রূক্ষ । এতে বয়স্ক ও শিশুসহ সব মানুষের সহনমাত্রা ছাড়িয়ে দেখা দেয় সর্দি-কাশি, জ্বর, হাপানি, পেটেরপীড়াসহ নানন জটিল রোগশোক। দৈনন্দিন কর্ম পরিবেশে ছন্দপতনের কারণে খেটে খাওয়া মানুষের কাজের সুযোগ ও সক্ষমতা কমে আসে। শীত নিবারণের সামান্য কাপড় ও দূর্যোগকালে খাবারের অভাবে কষ্ট পায় অসংখ্য ‘বনী-আদম’। তাই সামর্থ্যবানদের কর্তব্য হলো মানবসেবার ব্রতে এগিয়ে আসা এবং শীতার্তদের পাশে দাঁড়ানো। কারণ, বাংলাদেশে শীত আসে কষ্টের বার্তা নিয়ে। আমাদের গ্রামীণভাবনায় উচ্চারণ ‘পৌষ গেল,মাঘ আইল-শীতে কাঁপে বুক/ দুঃখীর না পোহায় রাতি হইল বড় দুঃখ’ শীতার্তসহ বিপন্ন সব মানুষের পাশে দাঁড়ানো ইসলামের অনুপম আদর্শ। মহান আল্লাহ্ বলেন ‘তারা আল্লাহর প্রেমে উজ্জীবিত হয়ে দরিদ্র, ইয়াতিম ও বন্দীদেরকে খাদ্য দান করে’ (সুরা-দাহার, আয়াত-০৮)।
মানবসেবায় ত্র“টি হলে কেয়ামতের দিন আল্লাহর সম্মুখে প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে। জিজ্ঞাসিত হতে হবে বস্ত্রহীনদের বস্ত্র সম্পর্কে, ক্ষুধার্তদের ক্ষুধা সম্পর্কে। মানবসেবা, মানবকল্যাণ এবং জনহিতকর কাজকে গুরুত্ব প্রদান করেছে ইসলাম। ইসলামে মানবসেবা বা পরোপকারকে সর্বোত্তম গুণ হিসেবে বিবেচিত হয়েছে। পবিত্র কোরআনের সূরা বাকারায় আল্লাহতায়ালা ইরশাদ করেছেন, ‘যদি তোমরা দান-সদকাহ বা সাহায্য-সহযোগিতা প্রকাশ্যে কর তাও ভালো। আর যদি এমন কাজ গোপনে বা অপ্রকাশ্যে কর, তা আরও ভালো””। কোরআনুল কারিমের আরেক সূরা কাসাস-এর ৭৭ নম্বর আয়াতে আল্লাহপাক ইরশাদ করেছেন, “তোমরা পৃথিবীবাসীর প্রতি তেমনি অনুগ্রহ কর যেমনি আমি তোমাদের প্রতি অনুগ্রহ করেছি”। প্রতি বছর অনেক অসহায় মানুষ শীতের এই নির্মম কষ্টে মারা যায়। রাজপথের এসব মানুষের একবেলা খাবারের ঠিক নেই তারা কীভাবে শীতবস্ত্র পরিধান করবে বর্তমানের এই সময়ে? তারা রাত কাটায় পথে-প্রান্তরে, তাদের শিশুদের নিজেদের বুকের ভিতর নিয়ে শীতের রাত পাড়ি দেয়। একজন মুসলমান হিসেবে মানবকল্যাণমূলক কাজে জড়িত থাকা, মানবসেবায় নিজেকে নিয়োজিত রাখা ইমানি দায়িত্ব। মানবসেবার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন সাহাবায়ে কেরাম রা.।
প্রচণ্ড এক শীতের রাতে বিখ্যাত সাহাবি হজরত আবুদ্দারদা রা.’র বাড়িতে কিছু লোক মেহমান হলেন। তিনি গরম খাবার দিয়ে তাদের মেহমানদারি করলেন। যখন ঘুমানোর সময় হলো তখন মেহমানরা দেখলেন যে, সে কক্ষে লেপ বা কম্বল নেই। তাদের একজন বললেন, আমি আবুদ্দারদা রা.’র কাছে তা বলি। অপরজন বাধা দিলেন। কিন্তু তিনি গিয়ে হজরত আবুদ্দারদা রা.’র কামরার দরজায় দাঁড়িয়ে দেখতে পেলেন যে, তিনি শুয়ে পড়েছেন এবং তার গায়ের ওপর একটিমাত্র পাতলা কাপড়, যা ঠাণ্ডা প্রতিহত করতে পারে না। তিনি আবুদ্দারদা রা. কে লক্ষ্য করে বললেন, আমরা যেমন শীতের কাপড় ছাড়া রাতযাপন করছি, আপনাকেও তো তেমনি দেখছি। হজরত আবুদ্দারদা রা. বললেন, আমাদের অন্য একটি বাড়ি আছে। আমরা যা কিছু সংগ্রহ করতে পারি তা সেখানে পাঠিয়ে দিই। এ বাড়িতে কিছু অবশিষ্ট থাকলে তা অবশ্যই তোমাদের কাছে পাঠিয়ে দিতাম। আর ওই বাড়িতে যাওয়ার পথ বড় দুর্গম। হালকা ও বোঝাহীন ব্যক্তি বোঝাবাহী ভারী ব্যক্তির চেয়ে অনেক সহজে সেই পথ অতিক্রম করতে পারবে।
আর্তমানবতার সেবায় উত্সাহ দিয়ে প্রিয়নবী সা. বলেন, মানুষের মধ্যে সে-ই উত্তম যার দ্বারা মানবতার কল্যাণ সাধিত হয়। বিপন্ন মানবতার কল্যাণে বিশ্বনবী, মানবতার কান্ডারী, আমার প্রিয়নবীর সা.’র আদর্শ। আর মানব কল্যাণের মাধ্যমে জান্নাতি সুখ লাভ করা যায়। এজন্যই প্রিয়নবী সা. বলেন ‘যে কোন মুসলমান কোন মুসলমানকে বস্ত্রহীন অবস্থায় বস্ত্র দান করলে, আল্লাহ্ তাকে জান্নাতে সবুজ বর্ণের পোষাক পরাবেন…খাদ্য দান করলে তাকে জান্নাতের ফল খাওয়াবেন… পানি পান করালে…’ (আবু দাউদ শরীফ)। মানুষের অবাধ্যতা ও পাপের কারণেই, মহান আল্লাহ্ মানুষকে শাস্তি দেন। কখনো কখনো মারাত্মক প্রাকৃতিক বিরূপতা নিয়ে এজন্যই দেখা দেয় খরা, বন্যা, ঝড়, জলোচ্ছাস, তাপ অথবা শৈত্য প্রবাহ। এ গুলোই মহান আল্লাহর পরীক্ষা, যামানুষের কর্মদোষের ফলে শাস্তি হয়ে নেমে আসে । তাই পবিত্র কুরআনের সতর্কবাণী ‘ভূমিতে ও পানিতে সব জায়গায়/ মানুষের কুকাজ অশান্তি ছড়ায়।/ যেমন কাজ তারা থাকে করিতে /আল্লাহ্ চান ফলে শাস্তি দিতে..‘(কাব্যানুবাদ, সুরা-রূম, আয়াত-৪১)। এ মূহূর্তে সচ্ছল মানুষের কর্তব্য- ময়মনসিংহ, সিলেট, রংপুর, রাজশাহী, যশোর, কুষ্টিয়াসহ দেশের শীতার্ত বিপন্ন সব মানুষের পাশে দাঁড়ানো। সামান্য কিছু শীতবস্ত্র, একটি কমদামী কম্বল, অল্প কিছু গরম খাবার অথবা প্রয়োজনীয় ওষুধ অসংখ্য ‘বনী-আদমে’র জন্য হতে পারে জীবন রক্ষার উপায় এবং ইংরেজি নববর্ষে আমাদের শ্রেষ্ট উপহার। মহান আল্লাহ্ শীতার্ত ও বিপন্ন মানুষগুলোকে নিরাপদে রাখুন, আমিন।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট