বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ৮:৪৫
Home / অনুসন্ধান / আলেম সমাজ দেশ প্রেমিক ও মুক্তিযুদ্ধা

আলেম সমাজ দেশ প্রেমিক ও মুক্তিযুদ্ধা

Ehsan Bin _Komashishaএহসান বিন মুজাহির ::

ষোল ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবস। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমাদের এই দেশ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী থেকে মুক্ত হয়ে বাংলার হৃদপিন্ডে টকটকে লাল স্বাধীনতার সূর্য উদ্ভাসিত হয়। সবুজ-শ্যামল স্বাধীন দেশ হিসেবে পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান পেয়েছে হিজল তমাল, তরুলতা আর সবুজ শ্যামলতায় ঘেরা রূপসী বাংলাদেশ। বিশ্বের দরবারে আমাদের আত্মপরিচয় ঘটেছে স্বাধীন জাতি হিসেবে। স্বাধীনতা প্রতিটি জাতির গৌরব ও অহংকারের বিষয়। মাতৃভূমি বাংলাদেশ দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যদিয়ে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভ করে।
’৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধ ছিল জালিমের বিরুদ্ধে মজলুমের। পাকিস্তানিরা ছিল জালিম আর এদেশের নিরীহ মানুষ ছিল মজলুম। সুস্থ-বিবেকসম্পন্ন কোনো মানুষ কখনও জালিমের পক্ষাবলম্বন করতে পারে না। মজলুমকে সাহায্য করা, তাদের পক্ষে কথা বলা এটাই মনুষ্যত্বের পরিচয় এবং ঈমানী দায়িত্ব। আর সে ঈমানী দায়িত্ব পালনেই আলেম সমাজ এদেশের মুক্তিকামী মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে দেশের মানুষকে পাকিস্তানি জালিম শাসকদের কবল থেকে মুক্ত করেছিলেন। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর জুলুমের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। রাজপথে যুদ্ধ করেছেন। কাজ করেছেন দেশ-প্রেমিক হয়ে। অসংখ্য উলামায়ে কেরাম তাদের জানমাল, সর্বশক্তি দিয়ে এ দেশের মজলুম জনগণের স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে উলামায়ে কেরামদের অবদান অনস্বীকার্য। নিম্নে উলামায়ে কেরামগণের নাম ও তাদের অবদানের কথা সংক্ষিপ্তভাবে তুলে ধরা হলো। ‘৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে উলামায়ে কেরামরাই ছিলেন মুক্তিকামী মানুষের সিপাহসালার। বাংলাদেশের বিখ্যাত আলেম ও বুজুর্গ আল্লামা মোহাম্মদুলাহ হাফেজ্জি হুজুর (রহ.) সে সময় স্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, ‘এ যুদ্ধ ইসলাম আর কুফরের যুদ্ধ নয়, এটা হলো জালেম আর মজলুমের যুদ্ধ। পাকিস্তানিরা জালেম, এদেশের বাঙালিরা মজলুম। তাই সামর্থ্যেরে আলোকে সকলকেই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে হবে এবং এটাকে প্রধান কর্তব্য বলে মনে করতে হবে।’ এ দেশের শ্রেষ্ঠ বুজুর্গ ফেদায়ে মিলাত আল্লামা হযরত হোসাইন আহমদ মাদানী (রহ.)-এর বিশিষ্ট খলিফা, আধ্যাত্মিক রাহবার আলামা লুৎফুর রহমান বর্ণভী ছিলেন একজন দূরদর্শী সিপাহসালার। তিনি তখন পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন না করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং বিপদগ্রস্ত বাঙালিদের সাহায্য-সহযোগিতা করেছিলেন।
আড়াইহাজার থানার কমান্ডার মরহুম শামসুল হকের অধীনে আল্লামা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী (রহ.) মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘১৯৭১ সালে যখন আমি লালবাগ মাদরাসার ছাত্র তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেল। যুদ্ধ শুরু হলে আমার মাদরাসা বন্ধ হয়ে যায়। তখন আমি হাফেজ্জি হুজুর (রহ.)কে প্রশ্ন করলাম; হুজুর এ যুদ্ধে আমাদের ভূমিকা বা কর্তব্য কি? তখন হুজুর আমাকে বললেন পাকিস্তানি জালিম হানাদার বাহিনীর জুলুম থেকে এ দেশের মানুষকে রক্ষা করা অবশ্যই তোমার-আমার সকলের কর্তব্য। তাই বসে থাকার আর সময় নেই, জালিমদের কবল থেকে মজলুমদের বাঁচানোর জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ কর। এ দেশের নিরীহ জনগণকে সহযোগিতা করা আমাদের ঈমানী দায়িত্ব।’ আর সেই সময় হাফেজ্জি হুজুর (রহ.) বলেছিলেন, ‘হুব্বুল ওয়াতান মিনাল ঈমান অর্থাৎ দেশপ্রেম ঈমানের অঙ্গ’।
হযরত মাওলানা মুফতি মাহমুদ (রহ.) ও বাঙালি মুসলমানদের পক্ষে ছিলেন। তার বক্তব্য ছিল বাঙালিদের পক্ষে। মাওলানা আব্দুস সালাম বলেন, ‘৭১ সালে করাচি ইউসুফ বিন নুরী মাদরাসার ছাত্র মুফতি মাহমুদ সাহেব মাদরাসায় এলে তাকে এক নেতা শেখ মুজিব সম্পর্কে বলেছিল, শেখ মুজিব গাদ্দারকে গ্রেফতার করে আনা হয়েছে। তাকে এখনই হত্যা করা হবে। তখন মুফতি সাহেব হুজুর রাগান্বিত হয়ে বলেছিলেন, শেখ মুজিব গাদ্দার নন; তিনি একজন দেশপ্রেমিক মুসলমান।
মুফতি মাহমুদ (রহ.) ১৩ মার্চ এক বক্তব্যে পরিষ্কার ভাষায় পাকিস্তানের ইয়াহইয়াা খানের ভুট্টোর নীতিকে ভুল আখ্যা দিয়ে শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর আহ্বান জানান।
স্বাধীনতা সংগ্রামে অবিসংবাদিত মুসলিম নেতা বিশ্বের প্রখ্যাত আলেম আওলাদে রাসুল সাইয়্যেদ আসআদ আল মাদানী (রা.)-এর ভূমিকা অবিস্মরণীয়। যখন পাকিস্তানি বাহিনী এ দেশের নিরীহ মানুষের ওপর বর্বরোচিত হামলা চালালো তাৎক্ষণিকভাবে তিনি পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা ও প্রতিবাদ জানালেন এবং নিরীহ বাঙালিদের পক্ষে জোরালো বক্তব্য রাখলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে উলামায়ে কেরামদের ভূমিকা তথা অবদান দেখে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর আবদুল জলিল হযরত হাফেজ্জি হুজুর (রহ.)-এর হাতে বাইয়াত তথা মুরিদ হয়ে গেলেন। তিনি বাইয়াত হওয়ার পর তাকে তাঁর ভক্ত ও শিষ্যরা প্রশ্ন করলো আপনি একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে কীভাবে হাফেজ্জি হুজুরের মতো রাজাকার এক ব্যক্তির কাছে মুরিদ হলেন। জবাবে তিনি বলেছিলেন, ‘হজরত হাফেজ্জি হুজুর (রহ.) কোনো রাজাকার নন, তিনি শ্রেষ্ঠ আলেম এবং সত্যিকার একজন দেশপ্রেমিক’।
ইতিহাস অনুসন্ধান করতে গিয়ে জানা যায়, স্বাধীনতা সংগ্রামে সংগঠক হিসেবে এবং এদেশের মানুষকে মুক্তিযুদ্ধে উৎসাহ ও সহযোগিতায় আলেম সমাজের ভূমিকাই সবচেয় বেশি। কারণ সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছেন অসংখ্য কওমী উলামায়ে কেরাম ও পীর-মাশায়েকগণ। তাদের মাঝে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন আল্লামা হাফেজ্জি হুজুর (রাহ.), আল্লামা আসয়াদ মাদানী (রহ.), আল্লামা লুৎফুর রহমান বরুণী (রহ.), চরমোনাইর পীর ফজলুল করীম রাহ, আল্লামা কাজী মু’তাসিম বিল্লাহ, আল্লামা মুফতি নুরুল্যাহ (রহ.) আল্লামা এমদাদুল হক আড়াইহাজারী (রহ.), আল্লামা শামসুদ্দিন কাসেমী (রহ.) প্রমুখ।

লেখক: সাংবাদিক, কলামিস্ট ও আলেম

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...