ইলিয়াস মশহুদ ::
যদি প্রশ্ন করা হয়, পৃথিবীর সবচে’ বেশি পঠিত কিতাব কোনটি? উত্তর হবে- আল কুরআন। যদি প্রশ্ন করা হয়, পৃথিবীর সবচে’ প্রাচীন কিতাব কোনটি, যা আবহমান কালেও বিদ্যমান? উত্তর হবে- মহাগ্রন্থ আল কুরআন। আত্মস্থ করে সংরক্ষিত এবং কিয়ামত অবধি যে কিতাব থাকার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে, এর পঠন-পাঠন হবে, এমন গ্যারান্টিযুক্ত কিতাবটির নাম কি? একই উত্তর; মহাগ্রন্থ আল কুরআন। যুগের বিবর্তনে ভাষার পরিবর্তন হয়, বই কিতাবে প্রাচীন, আধুনিক, সাধু, চলিত ভাষার সংমিশ্রণ হয়, নানান কিসিমের তাহরিফ-তাবদিল সাধিত হয়, কিন্তু যে কিতাবটি তার সূচনা থেকে আজ পর্যন্ত এবং কিয়ামত তক্ কোনো রকম তাবদিল, তাহরিফ, বিকৃতি ছাড়াই সাড়ে চৌদ্দশত বছর পরও স্বহালতে বহাল; একটি নুক্বতাও যার হেরফের হয়নি, এমন কিতাবের নাম কি? ঐ একই উত্তর হবে- মহাগ্রন্থ আল কুরআন।
কুরআনে কী আছে- এমন প্রশ্ন যদি কেউ করে, তবে উত্তরে এমনটাই বলা যুক্তিযুক্ত হবে যে, কী নেই কুরআনে?
পৃথিবীর সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাগ্রন্থ পবিত্র আল কুরআন। কুরআন শব্দের অর্থ: পাঠ করা, যা পাঠ করা হয়। আর পরিভাষায়- আল্লাহ তায়ালা জিবরাঈল আলাইহিস সালামের মাধ্যমে সুদীর্ঘ ২৩ বছরে মানব জাতির হেদাহয়াতের জন্য রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওহয়াসাল্লামের উপর যে কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, তার নাম আল কুরআন। এটি অবতীর্ণ হয়েছে বিশ্বমানবতার মুক্তি, সৎ আর সত্যের পথ দেখানোর জন্য। অন্ধকারাচ্ছন্ন এক বিভীষিকাময় জাহেলি সমাজে কুরআন এনেছিল আলোকময় সোনালি সকাল। কুরআন আল্লাহ্র বাণী। সৃষ্টিকূলের ওপর যেমন স্রষ্টার সম্মান ও মর্যাদা অপরিসীম, তেমনি সকল বাণীর ওপর কুরআনের মর্যাদা ও শ্রেষ্ঠত্ব অতুলনীয়। মানুষের মুখ থেকে যা উচ্চারিত হয়, তার মধ্যে কুরআন পাঠ সর্বাধিক উত্তম।
সব ধরনের জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস মহাগ্রন্থ আল কুরআন। এর অধ্যয়ন, অনুধাবন ও অনুসরণের মধ্যেই নিহিত রয়েছে মানুষের কল্যাণ। পবিত্র কুরআনের সূরা কালামের ৫২ নম্বর ও সূরা তাকবিরের ২৭ নম্বর আয়াতে এরশাদ করা হয়েছে- ‘কুরআন তো বিশ্ববাসীর জন্য উপদেশ বৈ আর কিছু নয়।’ পবিত্র কুরআনুল কারিমে আরও এরশাদ হয়েছে- ‘আমি তোমাদের প্রতি একটি কিতাব অবতীর্ণ করেছি, এতে তোমাদের জন্য উপদেশ রয়েছে; তোমরা কি বোঝ না!’ [সূরা আম্বিয়া, ২১. ১০]
মানব জাতির কল্যাণের আকর এ গ্রন্থ আমাদের বেশি বেশি পাঠ করা উচিৎ, নয়ত আমরা এর উপদেশাবলী গ্রহণ করতে পারব না। এ ঐশী গ্রন্থ বারবার পাঠের মাধ্যমে মানুষ তার স্রষ্টার নির্দেশনাবলী সম্পর্কে অবহিত হতে পারে এবং সর্বদা স্মরণ রাখতে পারে। সূরা জুমার ২৩নং আয়াতে আল্লাহ তায়ালা এরশাদ করেন, ‘আল্লাহ অবতীর্ণ করেছেন উত্তম বাণী সংবলিত কিতাব, যা সুসামঞ্জস্য এবং যা পুনঃপুনঃ আবৃত্তি করা হয়।’ এ আয়াতে আল্লাহ নিজেই সাক্ষী দিয়েছেন, কুরআন সর্বোত্তম এবং তিনি এটি বারবার পাঠের প্রয়োজনীয়তাও তুলে ধরেছেন।
কুরআন তেলাওয়াতের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে রাসূল সা. বলেছেন, তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি সর্বশ্রেষ্ঠ, যে আল কুরআন নিজে শেখে এবং অন্যকে শেখায়’ [বোখারি]
অন্য হাদিসে এসেছে- ‘তোমরা কুরআন পাঠ করো, কেননা কেয়ামতের দিন কুরআন তার সাথীদের জন্য সুপারিশকারী হবে।’ [মুসলিম]
অন্যদিকে হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘যে ব্যক্তি কুরআন পড়ানো এবং তেলাওয়াতের কারণে আমার কাছে কিছু চাইতে পারল না, আমি তাকে প্রার্থনাকারীরচে’ও বেশি দান করি।’
পবিত্র কুরআনে মানুষের জীবন চলার পথের দিশা দেয়া হয়েছে। মানুষের ব্যক্তি, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবন কেমন হবে; তার আলোকপাত রয়েছে কুরআনুল কারিমে। ইহলৌকিক ও পারলৌকিক উভয় জীবনের কল্যাণের পথ বাতলে দিয়েছে মহাগ্রন্থ আল কুরআন। তাই কুরআনকে বেশি বেশি করে পাঠ করতে হবে, বুঝতে হবে, হৃদয়ঙ্গম করতে হবে, আত্মস্থ করতে হবে। কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী নিজেকে গড়তে হবে। তাহলেই আমরা ইহ-পরকালে সফল হতে পারবো। আল্লাহ আমাদের কুরআন পড়ার ও অনুধাবন করার তৌফিক দান করুন। নিচে পয়েন্ট আকারে কিছু ফযিলত বর্ণিত হচ্ছে।
কুরআন আল্লাহর কিতাব :
আল্লাহ তায়ালা যুগে যুগে মানবতার হেদাহয়াতের জন্য যেসব কিতাব অবতীর্ণ করেছেন, সেগুলোকে আসমানী কিতাব বলা হয়। আল কুরআন হলো সর্বশেষ আসমানী কিতাব; যা বিশ্বমানবতার জন্য অবতীর্ণ করা য়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন : ‘‘নিশ্চয় এ কুরআন বিশ্ব জাহানের পালনকর্তার পক্ষ থেকে অবতীর্ণ করা হয়েছে।’’ [সূরা শু‘আরা- ১৯২]
কুরআন তেলাওয়াতের গুরুত্ব বোঝাতে গিয়ে রাসূল সা. বলেছেন, ‘তোমাদের মধ্যে ওই ব্যক্তি সর্বোত্তম, যে নিজে কুরআন শিখে এবং অন্যকে শিখায়।’ [বোখারি]
হাদিসে কুদসিতে আল্লাহ রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘যে ব্যক্তি কুরআন পড়ানো এবং তেলাওয়াতের কারণে আমার কাছে কিছু চাইতে পারল না, আমি তাকে প্রার্থনাকারীরচে’ও বেশি দান করি।’
রাসূল সা. এরশাদ করেন, ‘যে হৃদয়ে আল কুরআনের কোনো অংশ নেই, সে হৃদয় বিরান গৃহের ন্যায়।’
কুরআন শিক্ষার গুরুত্ব :
কুরআন শিক্ষা ফরয : প্রত্যেক মুসলিমকে কুরআন পড়া জানতে হবে। যে নিজেকে মুসলিম হিসাবে দাবী করবে তাকে অবশ্যই কুরআন শিক্ষা করতে হবে। কুরআন শিক্ষা করা এতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় যে, আল্লাহ তায়ালা কুরআন শিক্ষা করা ফরয করে দিয়েছন। আল্লাহ তায়ালা বলেন: ‘পড়ো তোমার প্রভুর নামে, যিনি সৃষ্টি করেছেন’ [সূরা আলাক্ব : ১]
কুরআন শিক্ষায় কোন প্রকার অবহেলা করা যাবে না। উম্মাতকে কুরআন শিক্ষার নির্দেশ দিয়ে হযরত ইবনে মাসউদ রা. বলেন, ‘তোমরা কুরআন শিক্ষা করো এবং তিলাওয়াত করো’ [মুসান্নাফে আবী শাইবাহ- ৮৫৭২]।
কুরআনের আয়নায় নিজেকে প্রতিবিম্বিত করার মধ্যে যে কী বরকত, তা আমরা ভালোকরেই জানি। তবু আমরা পিছিয়ে পড়ছি এটি পাঠ বা তেলাওয়াতের ক্ষেত্রে। ইতিহাস এটা স্বীকৃতি দেয় যে, মাত্র ২৩ বছরে গোটা আরব জাহানের বর্বর একটা জাতিকে কত দ্রুত সভ্যতার আলোয় বদলে দেওয়া হয়েছিল। আর এটা সম্ভব হয়েছিল আল-কুরআনের বদৌলতে। আসুন, সেই কুরআনের কিছু ফযিলত হিসাব মিলিয়ে নিই-
কুরআন পাঠের প্রতিদান : রাসূল সা. বলেন, যে ব্যক্তি পবিত্র কুরআনের একটি অক্ষর পড়বে, সে একটি নেকী পাবে। আর একটি নেকী দশটি নেকীর সমপরিমাণ। (তিরমিযি)
কুরআন শেখা ও তাতে দক্ষতা লাভ করার ফযিলত :
নবী করীম সা. বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করবে, তা মুখস্থ করবে এবং এর (বিধি-বিধানের) প্রতি যত্নবান হবে, সে উচ্চ-সম্মানিত ফেরেশতাদের সাথে অবস্থান করবে। আর যে ব্যক্তি কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও কুরআন পাঠ করবে এবং তার সাথে নিজেকে সম্পৃক্ত রাখবে, সে দ্বিগুণ ছওয়াবের অধিকারী হবে। [বুখারী, মুসলিম]
অন্যত্র তিনি আরও বলেন, কিয়ামত দিবসে কুরআন অধ্যয়নকারীকে বলা হবে, কুরআন পড়ো এবং উপরে উঠো। যেভাবে দুনিয়াতে তারতীলের সাথে কুরআন পড়তে, সেভাবেই পড়। যেখানে তোমার আয়াত পাঠ করা শেষ হবে, জান্নাতের সেই সুউচ্চ স্থানে হবে তোমার বাসস্থান। [তিরমিযি]
ইমাম খাত্তাবী রাহ. বলেন, হাদিসে এসেছে যে, জান্নাতের সিঁড়ির সংখ্যা হচ্ছে কুরআনের আয়াতের সংখ্যা পরিমাণ। কুরআনের পাঠককে বলা হবে, তুমি যতটুকু কুরআন পড়েছ, সে পরিমাণ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠো। যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ কুরআন পড়েছে, সে আখেরাতে জান্নাতের সবশেষ সিঁড়ির পর্যন্ত পোঁচবে। যে ব্যক্তি কুরআনের কিছু অংশ পড়েছে, সে ততটুকু উপরে উঠবে। অর্থাৎ, যেখানে তার পড়া শেষ হবে সেখানে তার সওয়াবের শেষ সীমা হবে।
যার সন্তান কুরআন শিক্ষা করবে তার প্রতিদান :
নবী করীম সা. বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করবে, শিক্ষা করবে ও তদানুযায়ী আমল করবে; তার পিতা-মাতাকে এমন দু’টি পোশাক পরিধান করানো হবে, যা দুনিয়ার সকল বস্তুচে’ও অধিক মূল্যবান। তারা বলবে, সে কোন্ আমলের কারণে আমাদেরকে এতো মূল্যবান পোশাক পরানো হয়েছে? বলা হবে, তোমাদের সন্তানের কুরআন গ্রহণ করার কারণে। [হাকিম]
পরকালে কুরআন সুপারিশ করবে : রাসূল সা. বলেন, তোমরা কুরআন পাঠ করো, কেননা কিয়ামত দিবসে কুরআন তার পাঠকের জন্য সুপারিশকারী হবে। [মুসলিম]
অন্যত্র বর্ণিত হয়েছে, আল্লাহ্র রাসূল সা. বলেন, কিয়ামতের দিন সিয়াম ও কুরআন বান্দার জন্য আল্লাহর কাছে সুপারিশ করবে। [আহমদ, হাকিম]
কুরআন নিয়ে আলোচনার জন্য একত্রিত হওয়ার ফযিলত :
রাসূল সা. বলেন, কোনো সম্পদ্রায় যদি আল্লাহ্ কোনো ঘরে একত্রিত হয়ে কুরআন পাঠ করে এবং তা পরস্পরে শিক্ষা লাভ করে, তবে তাদের ওপর প্রশান্তি নাযিল হবে। আল্লাহর রহমত তাদেরকে আচ্ছাদিত করবে এবং যতক্ষণ পর্যন্ত তারা কুরআন নিয়ে মশগুল থাকবে, ততক্ষণ ফেরেশতারা তাদেরকে ঘিরে রাখে। আল্লাহ্ তাঁর নিকটস্থ ফেরেশতাদের সামনে তাদের কথা আলোচনা করেন। [মুসলিম]