সোমবার, ২৮শে এপ্রিল, ২০২৫ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ সকাল ৯:২২
Home / অনুসন্ধান / গানের দেশ এবং ধানের দেশের গল্প

গানের দেশ এবং ধানের দেশের গল্প

ফরিদ আহমদ রেজাফরীদ আহমদ রেজা ::

সুনামগঞ্জের সুনাম আছে। এ সুনাম মাটি এবং মানুষের। ভাটির দেশ সুনামগঞ্জের সুনাম বহুবিধ কারণে। জোছনার শহর সুনামগঞ্জ। ধানের দেশ সুনামগঞ্জ। গানের দেশ সুনামগঞ্জ। মাছ ও পাখির দেশ সুনামগঞ্জ। সুনামগঞ্জে অনেক ক্ষণজন্মা মনীষীর জন্ম হয়েছে। তাদের খ্যাতি দেশ-বিদেশের সর্বত্র।
সুনামগঞ্জের দার্শনিক কবি হাসন রাজার নাম শুনেনি বাংলাভাষী এমন মানুষ পৃথিবীতে খুঁজে পাওয়া কঠিন। তাঁর গানের কলি, ‘লোকে বলে, বলে রে, ঘর-বাড়ি বালা নায় আমার; কি ঘর বানাইমু আমি শূন্যেরও মাজার’ অথবা ‘না লইলাম আল্লাজির নাম রে, না খরলাম তার খাম’ দেশ-বিদেশের বাঙালি নারী-পুরষের মুখে মুখে শোনা যায়।
রবীন্দ্রনাথ ১৯৩০ সালে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘দ্যা রিলিজিয়ন অব ম্যান’ শীর্ষক বক্তৃতায় হাসন রাজার গান এবং দর্শনের কথা উল্লেখ করেছেন। সুনীল গঙ্গোপধ্যায় ‘হাসন রাজার বাড়ি’ শীর্ষক কবিতা লিখে হাসন রাজার বন্দনা করেছেন। তাঁর কবিতায় আছে,
‘গাঁয়েতে এয়েছে এক কেরামতি সাহেব কোম্পানি
কত তার ঢ্যাঁরাক্যাড়া – মানুষ না পিপীলিকা, যা রে ছুটে যা
যা রে যা দ্যাখ গা খোলা হুরীর নাচন আর ভাঁড়ের কেরদানি
এখানে এখন শুধু মুখোমুখি বসে রবো আমি আর হাসন রাজা।
আলাভোলা হাওয়া ঘোরে, তিলফুলে বসেছে ভোমর
উদলা নদীটি আজ বড়ই ছেনালি
বিষয় বুঝলে দাদা, ভুলাতে এসেছে ও যে দুলায়ে কোমর
যা বেটি হারাজাদী, ফাঁকা মাঠে দিব তোর মুখে চুনকালি।
কও তো হাসন রাজা, কী বৃত্তান্তে বানাইলে হে মনোহর বাড়ি?
শিয়রে শমন, তুমি ছয় ঘরে বসাইলে জানালা
চৌখুপ্পি বাগানে এতো বাঞ্ছাকল্পতরুর কেয়ারি
দুনিয়া আন্ধার তবু তোমার নিবাসে কত পিদিমের মালা।
জানুতে ঠেকায়ে থুতনি হাসন চিন্তায় বসে
মুখে তার মিটিমিটি হাসি
কড়ি কড়ি চক্ষু দুটি ঘুরায়ে ঘুরায়ে দেখে জমিন আশমান
ফিসফিসিয়ে কয়, বড় আমোদে আছি রে ভাই, ছয়টি ঘরেতে ঐ যে
ছয় দাসদাসী
শমন আসিলে বলে, তিলেক দাঁড়াও, আগে দেখে লই
পঙ্খের নকশায় পইড়লো কিনা শেষ টান।’
[হাসন রাজার বাড়িঃ সুনীল গঙ্গোপধ্যায়]
‘লক্ষণছিরি জামিদারী’ আর ‘সোনার রামপাশা’ ছেড়ে হাসন রাজা এখন না ফেরার দেশে। ‘হাসন রাজা মইরা গেলে মাটি অইবো বাসা’। ঠিকই তিনি জরাজীর্ণ মাটির কবরে শুয়ে আছেন। কিন্তু রেখে গেছেন সমৃদ্ধ উত্তরাধিকার এবং প্রতিভাবান উত্তরাধিকারী। অকাল প্রয়াত নন্দিত কবি মুমিনুল মউজদীন হাসন রাজার এক প্রপৌত্র। কয়েক বছর আগে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি ইন্তেকাল করেন। জনপ্রতিনিধি হিসেবেও তাঁর জনপ্রিয়তা ছিল অনেকের ঈর্ষার বিষয়। সুনামগঞ্জের মানুষ তাঁকে তিনবার পৌর চেয়ারম্যান হিসেবে নির্বাচিত করে। সুনামগঞ্জের মাটি ও মানুষের প্রতি তাঁর ভালবাসা ছিল অপরিসীম।
‘এ শহর ছেড়ে আমি পালাবো কেথায়
যে দিকে তাকাই দেখি সারাটি ভূবনময়
আলো আর মৃত্তিকার বুকের ভেতর তোমার দু চোখ
সুরভিত শস্যময় দু চোখ
কখনো বৈশাখ আসে সোমত্ত ঝড়ের চিঠি নিয়ে
আবার ফাল্গুন এলে একগুচ্ছ কুমারীর কলহাস্য
ঝরে পড়ে শহরের আনাচে কানাচে
মৃত্যুক্ষুধা ভালোবাসা খেলা করে উত্তর হাওয়ায়।
সে শহর ছেড়ে আমি পালাবো কোথায়!’
(মুমিনুল মউজদীনঃ ভালোবাসার শহর)
সেবা, কবিতা ও গান দিয়ে মুমিনুল মউজদীন সুনামগঞ্জকে মাতিয়ে রেখেছিলেন। পুর্ণিমার রাতে শহরের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দিয়ে শহরবাসীকে চাঁদের আলো উপভোগ করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। জোছনার সাথে মিতালীর মাধ্যমে মুমিনুল মউজদীন দেশবাসীর প্রশংসা কুড়িয়েছেন।
হুমায়ূন আহমদ জোছনার নাগাল পাননি। ‘আমার ভাঙ্গা ঘরে, ভাঙ্গা বেড়া, ভাঙ্গা চালের ফাঁকে/ অবাক জোছনা ঢুইকা পড়ে হাত বাড়াইয়া ডাকে। হাত বাড়াইয়া ডাকে কিন্তু মুখে বলে, না/ আমার কাছে আইলে বন্ধু আমারে পাইবা না।’ তাই তিনি জোছনা উপভোগ করতে সুনামগঞ্জে ছুটে আসেন। কথাশিল্পী হাসনাত আব্দুল হাই এক সময় স্থানীয় সরকারের সচিব হিসেবে দেশের সকল পৌর চেয়ারম্যানদের সভায় মুমিনুল মউজদীনের দৃষ্টান্ত অনুসরণের পরামর্শ দেন। জনৈক চেয়ারম্যান তখন বলেন, ‘সুনামগঞ্জে চুরি-ছিনতাইয়ের ভয় নেই। তাই মুমিনুল মউজদীন রাস্তার বাতি নিভিয়ে দিয়ে জোছনা উপভোগ করতে পারেন। কিন্তু আমাদের শহর সে রকম নয়। আমরা বাতি নিভালে বিপদে পড়ে যাবো।’
এখনো সুনামগঞ্জ এবং দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষের কাছে মুমিনুল মউজদীনের স্মৃতি জীবন্ত হয়ে আছে। অবশ্য শুধু হাসন রাজা বা তাঁর উত্তরাধিকার নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে সুনামগঞ্জ সম্পর্কে আলোচনার শুরু বা শেষ করা সম্ভব নয়। সুনামগঞ্জের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের আলোচনায় আরো অনেক বিষয় এবং বহু প্রতিভার কথা আমাদের বলতে হবে।
চলবে ….

হাসন রাজা

মুমিনুল মউজদীন

মাঠে পাকা ধান (সৌজন্য: মিলু কাশেম)

About Islam Tajul

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি কল্যাণ ট্রাস্ট- বাস্তবতা ও প্রয়োজনীয়তা

খতিব তাজুল ইসলাম: ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...