এক. ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন মেয়র আনিসুল হক রবিবার তেজগাঁও অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড উচ্ছেদ অভিযান চালাতে গিয়ে সাড়ে তিন ঘণ্টা অবরুদ্ধ ছিলেন। তাও আবার শত শত র্যাব-পুলিশ, রায়টকার, জলকামান দিয়ে ঘিরে রাখা বাংলাদেশ ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান ড্রাইভার্স ইউনিয়নের অফিসের ভিতরেই অবরুদ্ধ হয়ে ছিলেন মেয়র আনিসুল হক। অভিযানের প্রতিবাদে পুরো এলাকায় ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগ করে মুষ্টিমেয় শ্রমিক। মেয়রের প্রটোকলে থাকা গাড়িও রেহাই পাইনি। যদিও মেয়র কয়েক মাস ধরেই আলটিমেটাম দিয়ে রেখেছিলেন এই উচ্ছেদ অভিযানের ব্যাপারে। বেশ কয়েকবার সতর্কও করেছিলেন। ২০ দিন আগে ভ্রাম্যমাণ আদালত পাঠিয়ে অবৈধ স্থাপনা সরাতে ২৭ নভেম্বর পর্যন্ত সময়ও বেঁধে দিয়েছিলেন। তবুও কেন সরল না এই অবৈধ ট্রাকস্ট্যান্ড? মেয়র সাহেব যতই বলুন না কেন ‘আপনাদের জন্য কাজ করছি, আমার জন্য নয়’ কিন্তু তারপরও গুটিকয়েক ট্রাক ড্রাইভার কী করে তাদের অফিসের ভিতরেই এভাবে সরকারদলীয় একজন মেয়রকে অবরুদ্ধ করে রাখতে পারে? এত গোলাগুলি, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের পরও কেউ আটক হলো না কেন? মেয়রকে অবরুদ্ধ করা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ, সরকারি কাজে বাধাদানের অভিযোগে একজনকেও গ্রেফতার করা হলো না কেন? কারও বিরুদ্ধেই কেন গাড়ি পোড়ানোর কোনো মামলা দেওয়া হলো না? ‘আগুন সন্ত্রাস’ আখ্যা দিয়ে ইউনিয়নের নেতাদের কোমরে রশি বেঁধে কোর্টে চালান দেওয়া হলো না কেন? কারণ এদের নেতা তো সরকারের প্রভাবশালী এক মন্ত্রী। যিনি পুরো পরিবহন সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করেন। মিশুক-মনির কিংবা নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের সহধর্মিণী যে-ই রাস্তায় গাড়ি চাপা খেয়েই মরুক না কেন চালকদের বড়ভাই আছেন না, ব্যস তাদের কোনো ভয় নেই। মন্ত্রীর কল্যাণে চালকদের ‘গরু-ছাগল চিনলেই’ ড্রাইভিং লাইসেন্স পাওয়ার যোগ্যতা অর্জিত হয়ে যায়। মহাসড়কে প্রবলগতিতে ট্রাক চাপা দিয়ে কাউকে মেরে ফেললেও সড়ক দুর্ঘটনার বিচার চাওয়া যায় না। আইন পরিবর্তন করে বলা হয় মহাসড়কে কেউ মরলে একে হত্যা বলা যাবে না। দণ্ডবিধির ৩০২ ধারায় বিচার করা যাবে না। বরং এটাকে নিছক একটা দুর্ঘটনা হিসেবেই দেখতে হবে। মেয়র আনিসুল হক কি এগুলো কিছুই জানেন না? তিনি কি জানতেন না এমনটা ঘটতেও পারে? তাই তো তিনি রবিবার অভিযানে যাওয়ার আগের দিন বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানিয়ে দেন আগামীকালের অভিযানে তার সঙ্গে থাকবেন নৌপরিবহন মন্ত্রী শাজাহান খান। সঙ্গে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ আরও তিনজন মন্ত্রীর উপস্থিত থাকার ঘোষণাও দেন তিনি। মেয়র সাহেব ঘটনাস্থলে পৌঁছামাত্রই শুরু হয়ে যায় চতুর্মুখী সংঘর্ষ। শেষমেশ সাড়ে তিন ঘণ্টা অবরুদ্ধ থাকার পর উদ্ধার করা হয় মেয়রকে। সরকারের সংশ্লিষ্ট প্রভাবশালী মন্ত্রীরা ঘটনার দিন কেন আসেননি? মেয়র ঘটনাস্থলে পৌঁছামাত্র পুলিশকে অহেতুক ঢিল মেরেছিল কারা? শ্রমিক মৃত্যুর গুজবটা ছড়াল কারা? কোন অদৃশ্য শক্তির ইন্ধনে ট্রাক ড্রাইভাররা এত বড় সাহস দেখাতে পারল? এসব প্রশ্নের উত্তর কারও অজানা থাকার কথা নয়।
দুই. হঠাৎ করেই একজন অরাজনৈতিক ব্যবসায়ী নেতাকে ঢাকা উত্তরের মেয়র পদে নমিনেশন দেওয়ার পর থেকেই আওয়ামী লীগের একটি শক্তি উঠেপড়ে লাগে আনিসুল হকের বিরুদ্ধে। নির্বাচনী প্রচারণা থেকে শুরু করে মেয়র হওয়ার পরও প্রচণ্ড প্রতিরোধের শিকার হতে হয়েছে আনিসুল হককে। একমাত্র প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত অনুকম্পা ছাড়া দলের কারও কাছেই পাত্তা পাননি তিনি। কিন্তু একটি বিতর্কিত নির্বাচনে বিজয়ী ঘোষিত এই মেয়র জনগণের প্রকৃত ভোট না পেলেও তার সততা, নিষ্ঠা ও সাহসিকতার কারণে কয়েক মাসের মধ্যেই জনগণের বিপুল সমর্থন আদায় করে নেন। দায়িত্ব নিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি তার নায়কসুলভ চেহারার পতন ঘটিয়েছেন। চুলগুলো পেকে মাথা এখন সাদা-কালো। কিন্তু নগরবাসীকে স্বপ্ন দেখাতে পেরেছেন হাজারো রঙের। পান্থপথের মোড়ে ভবন ধসের ঘটনায় সারা রাত ঠায় দাঁড়িয়ে থেকেছেন। সকাল ৯টার মধ্যে করপোরেশনের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের অফিসে হাজিরা নিশ্চিত করেছেন। আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি দিয়ে তিনি উত্তর সিটিকে সাজাতে কয়েক দিনের মধ্যেই বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, পয়ঃনিষ্কাশন, অবৈধ বিলবোর্ড উচ্ছেদ, ২৭ ঘণ্টার মধ্যে কোরবানির পশুর বর্জ্য অপসারণ, পাবলিক টয়লেট, হকারমুক্ত ফার্মগেট, অবৈধ দোকান ও স্থাপনামুক্ত মহাখালী, মহাসড়কে ইউলুপ পদ্ধতির প্রবর্তনসহ নগরবাসীর স্বাস্থ্য ও বিনোদনের বেশ কিছু কার্যকরী কৃতিত্ব দেখাতে পেরেছেন। অথচ নগরবাসীর মন জয় করতে পারলেও প্রচণ্ডভাবে ব্যর্থ হয়েছেন নিজ দলের নেতাদের মন জয় করতে।
তিন. আসলে অবৈধ দখলদারদের হাতে পুরো ঢাকা শহর জিম্মি হয়ে আছে। রাস্তার ওপর বাজার থাকায় ট্রাকচালকরা বাজার উচ্ছেদের জন্য প্রতিনিয়ত গালাগাল করে। অথচ তাদের অবৈধ স্ট্যান্ড উচ্ছেদ করতে গেলে মেয়রকে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। এরা ট্রাক ড্রাইভার নয়, এরা রাজনৈতিক মাস্তান। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে আমাদের জাতীয় রাজনীতিতে এরকম দখলদারিত্ব এক প্রধান বৈশিষ্ট্যে রূপলাভ করে। নেতারা সরকারি জায়গা দখল করে বস্তি, বাজার, মার্কেট, টেম্পো-বাসস্ট্যান্ডসহ দলীয় কার্যালয় পর্যন্ত গড়ে তোলে। এগুলোর নিয়মিত দেখভালের জন্য জন্ম নেয় শত শত চাঁদাবাজ-মাস্তান। স্থানীয় নেতা-চাঁদাবাজ-মাস্তান থেকে শুরু করে পুলিশ-প্রশাসন-দল সর্বক্ষেত্রেই এ চাঁদার টাকার রয়েছে বিশাল ভাগ। আর বস্তিগুলো যেন একেকটা বিশাল ভোটব্যাংক। নগরের পার্কিং স্পট তারাই ভাড়া দেয়। ফুটপাথের দোকান তাদেরই দখলে। মাসোয়ারা তারাই তোলে। সিটি করপোরেশনের বাজার-মার্কেট-দোকানে অলিখিত বরাদ্দপত্র এদের ভাগ্যেই জোটে। দলীয় মাস্তান ছাড়া রাস্তা তৈরির কাজ অন্য কারও পাওয়ার সাধ্য নেই। ক্যাডারদের ভয়ে সৎ ঠিকাদাররা টেন্ডার বাক্সের ধারেকাছেই ভিড়তে পারেন না। যুবলীগ-ছাত্রলীগের কতজন যে বিগত সাত বছরে টেন্ডার দখল করতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছে তা বলা মুশকিল। সারা দেশে রেলের কত সহস্র একর জায়গা যে আজ নেতাদের পেটে চলে গেছে তার হিসাব রাখে কে? রাজনীতি করলে যেন এগুলোর গায়েবি হকদার তারাই! কিন্তু দখলদার দুষ্কৃতবাজরা যতই বেপরোয়া ও শক্তিশালী হোক না কেন রাজধানীকে দখলমুক্ত করতেই হবে। আনিসুল হক হয়তো এখন উপলব্ধি করছেন কেন তিনি নোংরা রাজনীতিতে নামলেন। কিন্তু ময়লা-আবর্জনা পরিষ্কারের জন্য কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতেই হবে।
চার. বাস-ট্রাক মালিক-ড্রাইভার, পরিবহন শ্রমিক ও নেতাদের ভয়ে সরকার নিজেই যেন সন্ত্রস্ত। এ খাতে দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী জনাব ওবায়দুল কাদের। কিন্তু পরিবহন সেক্টরে তারও কোনো নিয়ন্ত্রণ বা ক্ষমতা নেই। তিনি নিছক একজন ‘কথা মন্ত্রী’। ওবায়দুল কাদের মানুষকে অভয় বাণী শোনান, রাস্তায় নেমে পড়েন যখন তখন। আর তাই মেয়র আনিসুল হকের অ্যাকশনে প্রলুব্ধ হয়ে গত মাসে তিনি বিআরটিএর ভ্রাম্যমাণ আদালতকে নামিয়েই দিলেন রাস্তায়। সারা দেশে মাত্র একজন হেলপারের বিরুদ্ধে বাসে ভাড়ার তালিকা না থাকার অপরাধে ব্যবস্থাও নিলেন। ফলাফল, সাত ঘণ্টা বাস চলাচল বন্ধ। শ্রমিক নেতা সরকারের এক মন্ত্রীকে বিবিসি প্রশ্ন করলে তিনি সাফ জানিয়ে দিলেন, ‘পরিবহন খাতে জবাবদিহি ও নিয়ন্ত্রণ বজায় রয়েছে’। আসলে আইন প্রণেতা আর মন্ত্রীরাই যেখানে শ্রমিক নেতা ও বাস-ট্রাক মালিক, সেখানে গণমানুষের ভোগান্তি তাদের দৃষ্টিগোচর হবে কী করে? সরকার যে ভাড়া নির্ধারণ করে দেয় তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া নির্ধারণ করে দেন বাস মালিকরা। সরকার তাদের কিছু বলতে ভয় পায়, কারণ বাসমালিক ও পরিবহন শ্রমিক-নেতারা সংগঠিত। কিন্তু বেচারা নিরীহ জনগণ তো আর সংগঠিত নয়। প্রতিবাদ করলেই ইউনিয়নের নেতা-মাস্তান, ড্রাইভার, হেলপার, কন্ডাক্টর আর শ্রমিকদের হাতে খেতে হয় গণধোলাই। তাদের হাতে রক্ষা নেই নায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন, প্রাবন্ধিক সৈয়দ আবুল মকসুদ, অধ্যাপক আবদুল্লাহ আবু সাঈদ কিংবা এমনকি মন্ত্রী হওয়ার আগ পর্যন্ত তারানা হালিমেরও। আর আজ উত্তরের মেয়র আনিসুল হকের অবস্থা তো সবাই দেখল। তাই হতভাগা জনগণ সব কিছু মেনে নিতে যেন বাধ্য। কারণ তাদের পক্ষে কথা বলার তো আর কেউ নেই!
পাঁচ. প্রধানমন্ত্রীর আনুকূল্য পাওয়া দলীয় মনোনয়নের একজন মেয়রকে অসহায়ের মতো ড্রাইভারদের অফিসে অবরুদ্ধ করে রাখা হলো তাতে এটা একেবারেই পরিষ্কার যে, দেশে পরিবহন খাতে সরকারের কোনোই নিয়ন্ত্রণ নেই। যেখানে একজন হেলপারকে ধরার মাশুল হিসেবে ৭ ঘণ্টা বাস চলাচল বন্ধ করে রাখা হয় সেখানকার হালহকিকত কী তা সহজেই বোধগম্য। দীর্ঘদিন ধরেই জনগণ তাদের হাতে জিম্মি। তারা কোনো রকম নিয়মকানুনের তোয়াক্কা না করে যাত্রীদের ওপর চড়াও হয়। দীর্ঘদিনের এ সমস্যা এখন সংকটে রূপ নিয়েছে। তবে প্রশ্ন হচ্ছে, তাদের নিয়ন্ত্রণ করা, নিয়মনীতির মধ্যে আনা ও দেখভালের দায়দায়িত্ব যাদের, তাদের কোনো মাথাব্যথা নেই কেন? আর এসব জঞ্জাল পরিষ্কার করতে নগরের মেয়রকে কেন এত খেসারত গুনতে হবে? অন্যদিকে ট্রাক ড্রাইভারদের অভিযোগ, লীগের ছেলেপুলেদের টাকা না দিলে নাকি স্ট্যান্ডে দাঁড়ানো যায় না। তাই তারা রাস্তা দখল করেই স্ট্যান্ড বানিয়ে নেয়। জনস্বার্থসংশ্লিষ্ট এত বড় একটি বিষয়ে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলের উদাসীনতা, নির্বিকারত্ব অবশ্যই প্রশ্নবোধক। এ অবস্থা চলতে পারে না। এ ব্যাপারে সরকারের কি কিছুই করার নেই?
ছয়. শেখ হাসিনা ঢাকা উত্তর সিটির মেয়র হিসেবে আনিসুল হককে কেন বেছে নিলেন? তিন টার্মের শাসনামলে আনিসুল হকের মনোনয়নটা সম্ভবত শেখ হাসিনার সবচেয়ে বড় দুরদর্শিতার প্রমাণ। একজন সৎ, সাহসী ও পরিশ্রমী মানুষকে দিয়ে ঢাকা সিটি সাজাতে চেয়েছেন তিনি। রাজধানীর উন্নয়ন না হলে আর রাজধানীর সমস্যার সমাধান না হলে সরকারের সব অর্জনই বৃথা- এ কথা মনে করেই কি তিনি আনিসুল হককে বেছে নিলেন? আসলে কারণ যেটাই হোক, লোকে জানে আনিসুল হক স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর নিজের লোক। আনিসুল হকও তাই বলেন। অনেক দিন পর নগরবাসী তাদের প্রত্যাশিত একজন মেয়রের দেখা পেয়েছে। হোক না সেটা বিতর্কিত নির্বাচনের মেয়র। তবুও তার নিষ্ঠা, পরিশ্রম ও সততার কারণে মানুষ তাকে ভোট না দিলেও এখন সমর্থন দিচ্ছে ঠিকই। তিনি নগরবাসীকে একটি স্বপ্ন দেখাতে পেরেছেন। অথচ আমরা বারবার এসব স্বপ্নের দ্বারা প্রতারিত হয়েছি। তবুও আমরা স্বপ্ন দেখতে হাল ছাড়িনি। আমাদের স্বপ্নগুলো কেমন করে যেন ফলে যাচ্ছিল অনেক দিন পর। আর এ কারণেই আমরা আহত হই এই স্বপ্নচারীদের অবরুদ্ধতায়। নির্ভীক মানুষরা পরাস্ত হয় না কখনো। তাই অনুরোধ করি, আনিসুল হক, আপনি থামবেন না প্লিজ। ঢাকা সিটি করপোরেশনের ইতিহাসে দুঃসাহসিক ঘটনা ঘটিয়ে কলমের এক খোঁচায় পৌনে দুইশত কর্মকর্তা-কর্মচারীকে বদলি করে দুঃসাহস দেখাতে পেরেছেন। ভয় না পেয়ে অকপটে স্বীকার করেছেন ‘আমার বুদ্ধি কম কিন্তু সাহসটা বেশি’। আর আপনার এই সাহসটাই আমরা দেখতে চাই।
লেখক : সুপ্রিমকোর্টের আইনজ্ঞ ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ।
ই-মেইল : drtuhinmalik@hotmail.com