দিনকাল রিপোর্ট : দেশের বহুল আলোচিত রাজনীতিক, বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী, বিএনপি স্থায়ী কমিটির সদস্য, সাবেক মন্ত্রী ও উপদেষ্টা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর বিরুদ্ধে সরকারের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় বিচার শুরু হলে ট্রাইব্যুনালে দেয়া টানা নয় কার্যদিবসে ইংরেজিতে দেয়া দীর্ঘ এক জবানবন্দী দিয়ে আলোড়ন তৈরি করেন। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তিনি দেশের বাইরে ছিলেন, তার পক্ষে বর্তমান ও কয়েকজন সাবেক বিচারপতি এবং কয়েকজন বিদেশি মন্ত্রীর সাক্ষ্য দেয়ার জন্য আবেদন করলেও তা আদালত খারিজ করে দেয়। ট্রাইব্যুনালের দেয়া রায়ে ফাঁসির আদেশ আপিল ও রিভিউয়ে বহাল থাকায় দ্রুতই তার ফাঁসি কার্যকর করতে যাচ্ছে সরকার।
আদালতে দেয়া তার জবানবন্দীর সংক্ষিপ্ত অনুবাদের বিবরণ এখানে দেয়া হলো। ‘আমার নাম সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। জন্ম ১৩ই মার্চ ১৯৪৯। আমার কাজিনদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মাঈনুর রেজা চৌধুরী, সাবেক প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হোসেন, আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য সাবের হোসেন চৌধুরী, ফজলে করিম চৌধুরী, আওয়ামী লীগ নেতা সালমান এফ রহমান প্রমুখ। আমার বাবার নাম এ কে এম ফজলুল কাদের চৌধুরী। তার সূত্রেই আমি এ মামলার আসামি হয়েছি। তাই তার ব্যাপারে তো বিস্তারিত বলতেই হবে।
এখানে একজন প্রফেসর সাক্ষ্য দিয়ে গেছেন যিনি ৪০ বছর ধরে নিজের জন্মস্থান নিয়ে মিথ্যা বলছেন। ফজলুল কাদের চৌধুরী ১৯১৯ সালের ২৬শে মার্চ জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তিনি নোয়াখালী জিলা স্কুল, বরিশাল বিএম কলেজ এবং কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে শিক্ষাজীবন অতিবাহিত করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র থাকাকালে তিনি থাকতেন কারমাইকেল হোস্টেলে। মেধাবী এবং এলিট পরিবারের শিার্থীরা সে হোস্টেলে থাকতেন। ফজলুল কাদের চৌধুরী দু’বার ওই হোস্টেলের নির্বাচিত ভিপি ছিলেন।
ফর্মাল চার্জে আমার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে তার প্রতিটি লাইনের জবাব আমি দেব। তারা নবাব সিরাজউদ্দৌলা থেকে শুরু করেছেন আমি এটা নিশ্চিত করতে পারি আমি সিরাজউদ্দৌলার আগে যাব না। আমার বিরুদ্ধে উত্থাপিত ফর্মাল চার্জে বলা হয়েছে, দ্বিজাতিতত্ত্বের কারণে উপমহাদেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাত হয়েছে। এ বক্তব্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য অবমাননাকর। কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের লেখা ২৮৮ পৃষ্ঠার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর ত্যাগ, তিতিক্ষার বর্ণনা করা হয়েছে।
প্রসিকিউশন যে প্রস্তাব দিয়েছে তা বাংলাদেশের সীমানা উঠিয়ে দেয়ার প্রস্তাব। এটা খুবই প্রলুব্ধকর। বাংলাদেশের সীমানা উঠিয়ে অন্য কোনো ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সঙ্গে এক হয়ে যাওয়ার জন্য এ প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। এটি আমাদের সংবিধানের লঙ্ঘন। কারণ ধর্মের ভিত্তিতে যে বিভক্তি হয়েছিল সে পূর্ব পাকিস্তানের সীমানাই সংবিধান অনুযায়ী বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সীমানা। আর বাংলাদেশের বিচারপতিদের সংবিধান রক্ষার শপথ নিতে হয়েছে।
দেশে ফেরার তিন মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধু মিত্রবাহিনীর সদস্যদের দেশ ত্যাগ করিয়েছিলেন। এটাই তার জীবনের এক মহত্তম ঘটনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জার্মানি এবং জাপান যা করতে পারেনি বঙ্গবন্ধু তা করেছিলেন। উত্তরাধিকার সূত্রে আমি এ মামলার আসামি হয়েছি। আজ চাচার (বঙ্গবন্ধু) বই নিয়ে এসেছি। আমার বাবা ফজলুল কাদের চৌধুরীর সঙ্গে তার কী সম্পর্ক ছিল? আমি সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী কে তা তো এখানে বলতেই হবে।
আমি শুধু নিজের জীবন রক্ষার জন্যই এখানে লড়াই করছি না, আমি আমার মর্যাদা রক্ষার জন্যও এখানে লড়াই করছি। ৩৩ বছর ধরে সংসদে আছি। ছয়বার জনগণের কাছে পরীক্ষা দিতে হয়েছে আমাকে। ১৯৭৮ সালের শেষদিকে আমি রাজনীতিতে এসেছিলাম। প্রসিকিউশন দ্বিজাতিতত্ত্বের বিরোধিতা করে যে প্রস্তাব দিয়েছে তা দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রতি একধরনের বিদ্রুপ। যে তত্ত্বের জন্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ত্যাগ স্বীকার করেছিলেন। এ প্রস্তাব বাংলাদেশকে বলকান এবং সিকিম বানানোর প্রস্তাব। এ প্রস্তাবের মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে চ্যালেঞ্জ করা হয়েছে। দ্বিজাতিতত্ত্বের সুবিধাভোগী কিছু বিখ্যাত ব্যক্তির নাম রেকর্ডে থাকা প্রয়োজন। এ সম্পর্কে বিখ্যাত আইনজ্ঞ যাদের নাম আমি স্মরণ করতে পারি তাদের মধ্যে রয়েছেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মোস্তাফা কামাল, সাবেক প্রধান বিচারপতি কামাল উদ্দিন, সাবেক প্রধান বিচারপতি আবদুস সাত্তার, ব্যারিস্টার রফিক-উল হকসহ অনেকের কথা। যাদের প্রত্যেককে নিয়ে এ জাতি গর্বিত।’
এ বক্তব্যের ব্যাপারে প্রসিকিউশনের আপত্তির জবাবে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, ‘দ্বিজাতিতত্ত্ব আমাদের জন্য কীভাবে সুফল বয়ে এনেছে তা বোঝানোর জন্যই এটা বলা প্রয়োজন। আমাদের চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুকে নিয়েও আমি গর্বিত। তিনিও দ্বিজাতিতত্ত্বের ফসল।’ সালাউদ্দিন কাদের বলেন, ‘একজন বিখ্যাত রাজনৈতিক দার্শনিক (জওহরলাল নেহেরু) তার নিজের সম্পর্কে বর্ণনা করেছেন এভাবে- সংস্কৃতিগতভাবে আমি মুসলিম, শিক্ষাগত দিক থেকে ইংরেজ এবং দুর্ভাগ্যজনিত জন্মগত কারণে হিন্দু। সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, আমি জন্মসূত্রে চট্টগ্রামী। এটা কোনো দুর্ঘটনা নয়। মতিলাল নেহেরুর ছেলের মতো আমি নিজেকে দুর্ভাগাও মনে করি না।
চট্টগ্রাম কখনোই নবাব সিরাজউদ্দৌলার শাসিত অঞ্চলের অংশ ছিল না। আমি সিরাজউদ্দৌলাকে স্বীকার করি না। আমরা চট্টগ্রামের মানুষ। আমাদের নিজস্ব ভাষা এবং নিজস্ব সংস্কৃতি রয়েছে। সারা দুনিয়াতেই এখন মুসলিমদের ওপর নির্যাতন চলছে। সোমালিয়া, বসনিয়া, গুজরাট, ফিলিস্তিন সারা দুনিয়ায় এখন মুসলমানরা নির্যাতনের শিকার। মুসলিমদের প্রতি আমার কমিটমেন্টের কোনো রাজনৈতিক সীমানা নেই।’
নিজেকে বঙ্গবন্ধুর এক নিকটজন দাবি করে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, ‘১৯৭৪ সালে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় তখনকার সংসদ সদস্য আবদুল কুদ্দুস মাখনের সুপারিশে বাংলাদেশের পাসপোর্ট পেয়েছিলাম। বাংলাদেশের জনগণ এবং মুসলিম উম্মাহর পক্ষে আমার অবস্থান। কোনো বিশেষ ব্যক্তিবর্গ বা দলের বিরুদ্ধে আমার অবস্থান নেই।’ তিনি বলেন, ধারণা এবং বাস্তবতার মধ্যে অনেক সময়ই বড় ফারাক থাকে। এ প্রসঙ্গে তার বন্ধু ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী যশোবন্ত সিংহের বাংলাদেশ সফরের সময় ঘটে যাওয়া এক কৌতূহলোদ্দীপক ঘটনার বর্ণনা দেন তিনি।
একপর্যায়ে চিফ প্রসিকিউটর গোলাম আরিফ টিপুকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘মরেই তো যাব। কিছু রেকর্ডে রেখে যাই।’ সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, ‘পছন্দ সূত্রে আমি একজন বাংলাদেশি, জন্মসূত্রে নয়। আমি যখন পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শেষ বর্ষের ছাত্র ছিলাম তখন সেখানে একটি সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে এসেছিলেন বিচারপতি স্যার জাফর উল্লাহ খান। যিনি আন্তর্জাতিক আদালতের বিচারক ছিলেন। ভারতের পূর্ব পাঞ্জাবে জন্ম নেয়ায় তার দেশপ্রেম নিয়ে একজন ছাত্র প্রশ্ন তুলেছিল। জবাবে তিনি বলেছিলেন, তুমি পাকিস্তানি কারণ তোমার মা পাকিস্তানি। যখন আমি নিজ পছন্দের কারণে পাকিস্তানি।’
সালাউদ্দিন কাদের বলেন, ‘১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর আমি লন্ডনের বাসিন্দা ছিলাম। ১৯৭৪ সালের এপ্রিল মাসে আমি ঢাকায় আসি। বৃটিশ ভ্রমণ ডকুমেন্ট নিয়ে আমি ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন বিভাগে প্রবেশ করেছিলাম। আমি সে বৃটিশ ডকুমেন্ট ইমিগ্রেশন বিভাগে জমা দিয়েছিলাম এবং তখনকার একজন সংসদ সদস্যের সুপারিশে বাংলাদেশের পাসপোর্ট পেয়েছিলাম। সে সময় বাংলাদেশি পাসপোর্ট পাওয়ার ক্ষেত্রে সংসদ সদস্যের সুপারিশ বাধ্যতামূলক ছিল। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনায় আবদুল কুদ্দুস মাখনের সুপারিশে সে পাসপোর্ট পেয়েছিলাম। এটা রেকর্ডে থাকা প্রয়োজন যে, ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের আগে পূর্ব পাকিস্তানে জন্ম নেয়া বহু মানুষ আর বাংলাদেশে ফিরেননি।’
তিনি বলেন, ‘১৯৭৩ সালে লিঙ্কন্স ইন থেকে আমি বার এট ল’ পরীার প্রথম পর্ব শেষ করি। ১৯৭৪ সালে আমি দ্বিতীয় পার্টের পরীক্ষার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম এবং কাউটস অ্যান্ড কোম্পানিতে কাজ করছিলাম। এরই মধ্যে ১৯৭৩ সালের ১৮ই জুলাই আমার পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়।’
সালাহউদ্দিন কাদের বলেন, প্রসিকিউশনের বর্ণনামতো চুপিচুপি আমি বাংলাদেশে ফিরিনি। প্রসিকিউশন যেমনটা দাবি করেছে সে সময়ে অর্থাৎ ১৯৭৪ অথবা ’৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার সময় পর্যন্ত আমি কখনোই আত্মগোপনে ছিলাম না। ১৯৭৪ সালের অক্টোবরে আমি কিউসি শিপিং লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে আমার কার্যক্রম শুরু করি। ১৯৭৪ সালের অক্টোবর থেকে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত আমি বেশ কয়েকবার ব্যবসায়িক কারণে বিদেশ সফরে গিয়েছিলাম। এটাও সত্য, আমাদের রাজনীতির ইতিহাসের কালো দিন ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট আমি দেশের বাইরে ছিলাম। ১৫ই আগস্টের মর্মান্তিক ঘটনা প্রতিরোধে কিছু করতে না পারা আমার এবং আমার পরিবারের সদস্যদের জন্য খুবই দুঃখের বিষয়। প্রেসিডেন্টের জীবন বাঁচানো যাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব ছিল, আজ ৩৮ বছর পর আমরা তাদের মায়াকান্না দেখছি।’
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, ‘আমার মরহুম পিতা এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যকার সম্পর্ক বঙ্গবন্ধু নিজে তার আত্মজীবনীতে বর্ণনা করেছেন। যে জাতীয় ঐতিহ্য (বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী) বঙ্গবন্ধুর এক নিকটজনের এ নিপীড়নমূলক বিচারে প্রদর্শনী হিসেবে গ্রহণ করতে প্রসিকিউশন অস্বীকৃতি জানাচ্ছে। আমি আমার জীবনে প্রথমবার গ্রেফতার হয়েছিলাম ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডের পর। খোন্দকার মুশতাক আহমাদের এক ঘনিষ্ঠ সহযোগীর অভিযোগের ভিত্তিতে। যিনি আমার পিতার ধানমন্ডির বাড়ি দখল করেছিলেন।’মুসলমানদের বন্ধন-মুক্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবদানের কথা উল্লেখ করে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, ‘আমিও সেই মুসলিম উম্মাহর সদস্য।’
সালাহউদ্দিন কাদের বলেন, ‘এটা আমার বিশ্বাস যে ধারণার সঙ্গে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই বাস্তবতার ফারাক থাকে।’ এ প্রসঙ্গে রেকর্ডেড জবানবন্দীর বাইরে তিনি বলেন, ‘আমার সম্পর্কে ধারণা থেকে অনেক কথা বলা হয়। অনেকে হয়তো আমার নাম শুনলেই ভেবে বসেন পাকিস্তানের কথা, ভাবেন আমি এন্টি ইন্ডিয়ান।’ সালাহউদ্দিন কাদের বলেন, ‘জর্জটাউন স্কুল অব ফরেন সার্ভিসে পড়ার সময় যশোবন্ত সিং আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন। আমি এবং আমার স্ত্রী তার পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি। এক সময় তিনি ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হন। ৯০-এর দশকে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারি বাজপেয়ীর সঙ্গে যশোবন্ত সিংও বাংলাদেশ সফরে এসেছিলেন। সে সময় আমার অফিসের স্টাফরা আমাকে না জানিয়ে এক ঝুড়ি আম যশোবন্ত সিংয়ের কাছে পাঠানোর জন্য রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। আমের ঝুড়ির সঙ্গে একটি ভিজিটিং কার্ডও দেয়া হয়। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সঙ্গে সঙ্গে রেড অ্যালার্ট জারি করে। আমাকে ফোন করে জানতে চাওয়া হয় ঝুড়িতে কোনো বিস্ফোরক দ্রব্য আছে কি না?’
তিনি বলেন, ‘কাজী নজরুল ইসলামকে এ দেশে ফিরিয়ে নিয়ে আসা এবং তাকে জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া বঙ্গবন্ধুর কোনো সাম্প্রদায়িক সিদ্ধান্ত ছিল না। বরং এর মাধ্যমে দ্বিজাতিতত্ত্বের প্রতি বঙ্গবন্ধুর অঙ্গীকারই প্রকাশ পেয়েছে। সালাহউদ্দিন কাদের বলেন, সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক বাংলাদেশি হত্যার বিরুদ্ধে আমার প্রকাশ্য অবস্থান রয়েছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর পরাজয়কে তিনি বর্ণনা করেন জনগণের ইচ্ছার কাছে শক্তির পরাজয় হিসেবে। রাজনীতিবিদদের ওপর নির্যাতনের সংস্কৃতির বর্ণনা দিয়ে তিনি বলেন, ‘রাজনৈতিক নিপীড়নের শিকার হিসেবে আমি এখানে দাঁড়িয়েছি।’
কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের সবাই জানে আমার মুখে যা আসে তাই আমি সামনাসামনি বলে ফেলি। আমার দোষ একটাই আমি পুরো পলিটিশিয়ান।’ তার দীর্ঘ জবানবন্দীতে প্রসিকিউশনের আপত্তির জবাবে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, ‘প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সমসাময়িক সময়ে খেলাফত আন্দোলনের নেতা মাওলানা মোহাম্মদ আলী ও মাওলানা শওকত আলীকে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়েছিল। ওই মামলায় ডিফেন্স সাক্ষী হিসেবে মাওলানা মোহাম্মদ আলী ২ মাস ২৪ দিন নিজের পক্ষে দাঁড়িয়ে জবানবন্দী দিয়েছিলেন। তখন আমরা পরাধীন ছিলাম। অথচ এখন স্বাধীন বাংলাদেশে মাত্র তিনদিন জবানবন্দি দেয়ার পরই আমাকে টাইম ম্যানেজমেন্টের কথা শোনানো হচ্ছে।’ তিনি বলেন, ‘হতে পারে এটাই আমার জীবনের শেষ বক্তৃতা। ফাঁসি দেয়ার দেবেন, কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু আমাকে আমার কথা বলতে দিতে হবে। পুরনো এক প্রবাদ বাক্যের উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যদি তুমি কাউকে হত্যা করতে না পারো তবে তাকে একটি খারাপ নাম দাও।’
সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, ‘এ মামলায় প্রসিকিউশনের আনা হাজারো মিথ্যার মধ্যে একটাই সত্য আমি মরহুম এ কে এম ফজলুল কাদের চৌধুরীর ছেলে। তিনি বলেন, ফর্মাল চার্জে প্রসিকিউশন আমার পিতাকে সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি হিসেবে উপস্থাপন করেছে। তাকে বর্ণনা করা হয়েছে হিন্দুবিরোধী ব্যক্তি হিসেবে। তার অর্জনকে অস্বীকার করা হয়েছে। কলকাতার জনপ্রিয় ছাত্রনেতা হিসেবে আমার পিতার রাজনৈতিক অনুসারীদের মধ্যে ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। নিজের আত্মজীবনীর বহু স্থানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সে কথা বলেছেন। এ মামলা চলাকালীনই যে আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছে।’ স্যামুয়েল জনসনকে স্মরণ করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, ‘সত্য এমন এক গাভী যা প্রসিকিউশনকে দুধ দেয়নি যে কারণে তারা ষাঁড়ের কাছে গেছে দুধের জন্য। আমার পিতা এবং আমাকে নিয়ে ফর্মাল চার্জে যে অকল্পনীয় কল্পকাহিনী তৈরি করা হয়েছে, যা কল্পকাহিনীর লেখকদের কল্পনাকে হার মানায় তার জবাব দেয়ার মধ্যেই আমি আমার জবানবন্দী সীমাবদ্ধ রাখব। দর্জিদের মতো নিজের ইচ্ছামতো ইতিহাস তৈরির প্রবণতা মানুষের মধ্যে রয়েছে, তবে সুখের বিষয় হলো ইতিহাস তা অনুমোদন করে না।’
মুক্তিযুদ্ধ শুরুর পূর্ববর্তী সময়ে তার নিজের এবং তার পিতা ফজলুল কাদের চৌধুরীর ভূমিকার বিশদ বর্ণনা দেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী। আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘সে সময় আমার ধানমন্ডির বাসায় নিয়মিত আসতেন শেখ কামাল, তোফায়েল আহমেদ, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, সিরাজুল আলম খান, আবদুল কুদ্দুস মাখন, সালমান এফ রহমান, শাজাহান সিরাজসহ অনেকে। ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে আসাদকে যখন হত্যা করা হয়, তখন তার ১০ ফুট দূরত্বের মধ্যেই ছিলাম। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক সমাবেশেও অংশ নিয়েছিলাম। ওই সমাবেশে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণাকে স্বাধীনতার ঘোষণা বলে দাবি করা হয়ে থাকে। যদি তাই হয় তবে আমি দাবি করতে পারি আমি মুক্তিযুদ্ধের একজন সমর্থক ছিলাম। ১৯৬০ সালে যখন আমি ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম, তখন থেকে আমি নিজস্ব পদ্ধতির জীবনযাপন করতাম, যা আমার পুরো শিক্ষাজীবনেই বহাল ছিল। যার মধ্যে সাদিক পাবলিক স্কুল, নটর ডেম কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নের সময় অন্তর্ভুক্ত ছিল।’
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়নের নেতাদের সঙ্গে তখন আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। যদিও আমি নিজে কখনও কোনো ছাত্র সংগঠনের সদস্য ছিলাম না। আমার বন্ধুদের সঙ্গে ’৬৯ সালে আমি আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলাম। সে আন্দোলনের একটি ধানমন্ডি অধ্যায়ও ছিল। আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা প্রায়ই আমার ধানমন্ডির বাসায় মিলিত হতেন। ছাত্রলীগ এবং ছাত্র ইউনিয়নের বন্ধুদের সঙ্গে আমিও ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চের রেসকোর্স ময়দানের ঐতিহাসিক সমাবেশে অংশ নিয়েছিলাম। সেখানে ঐতিহাসিক বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আকাঙ্খাই ব্যক্ত করেছিলেন। এটা দাবি করা হয়ে থাকে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ কার্যত স্বাধীনতার ঘোষণা।
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস সময় বাংলাদেশে ছিলেন না বলে দাবি করেন সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী।’ তিনি বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে আনা এসব অভিযোগ কল্পকাহিনী, আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ, যা তৈরি করেছে। রাউজানে তিনটি নির্বাচনে আমি পরীক্ষা দিয়েছি। প্রতিবারই আমি আমার প্রতিপক্ষকে পরাজিত করেছি। এ অভিযোগের প্রত্যক্ষদর্শী দাবি করেননি যে তিনি আমাকে অতীতে দেখেছেন। রাজনৈতিক কারণে আমাকে এ বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছে। এ নিয়ে আমার মনে কোনো সন্দেহই নেই যে, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে ব্যাপকমাত্রার গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। এ ভূমির এক সন্তান হিসেবে এবং যেহেতু আমি ভারত থেকে আসা উদ্বাস্তু নই, তাই সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বিভক্ত সীমানায় সৃষ্ট বাংলাদেশের প্রতি আমার প্রেম এবং আনুগত্য শর্তহীন। আমার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নিপীড়নের স্পন্সর হচ্ছেন ধর্মনিরপেতার ছায়ায় আশ্রয় নেয়া কিছু হতাশ সমাজতন্ত্র প্রেমিক। তারা জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ এবং বিপক্ষের শক্তিতে বিভক্ত করতে চান। এ অপচেষ্টার অংশ হিসেবেই মুসলিম উম্মাহর নেতাদের নানা অভিযোগে অভিযুক্ত করা হয়েছে। এ অপচেষ্টার শিকার হিসেবে আমি এ ট্রাইব্যুনালে দাঁড়িয়েছি। বিশ্বাসী এবং অবিশ্বাসীদের এ বিভক্তির সময়ে আমি প্রতিনিধিত্ব করি হুমকির মুখে থাকা বিশ্বাসীদের এবং আমি নিজেও বিশ্বাসী। এজন্য আমি অবিশ্বাসীদের টার্গেট হয়েছি, যারা প্রথাগতভাবেই আমার রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি বলেন, তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে আবারও বলছি, ১৯৭১ সালের ২৯ শে মার্চ থেকে ১৯৭৪ সালের ২০ শে এপ্রিল পর্যন্ত আমি বাংলাদেশে ছিলাম না।’ জবানবন্দী শেষে প্রসিকিউটর জেয়াদ আল মালুম জেরায় সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর কাছে জানতে চেয়েছিলেন, তিনি এতদিন যা বলেছেন তা জেনে-বুঝে বলেছেন কি না? জবাবে সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বলেন, ‘আই অ্যাম সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী অব বাংলাদেশ। যখন যা বলি জেনে-বুঝে এবং অর্থপূর্ণতাসহ বলি।’ সূত্র : দৈনিক দিনকাল