(ধারাবাহিক)
অন্যান্য ঐতিহাসিক যুগের চেয়ে ক্রুসেডের সময়কার ঘটনাগুলোতেই মুসলিম ও খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সম্পর্ক ও বৈশিষ্ট্য সবচেয়ে বেশী অনুরণিত হয়। পবিত্র ভূমি (জেরুজালেম) নিয়ে উভয় পক্ষের যুদ্ধগুলো পরবর্তী কয়েক শতাব্দী ধরে ইউরোপ ও দক্ষিণ-পশ্চিম এশিয়ার রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় পট পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে। সেই সময়কার বীরত্ব, সাহসিকতা ও সংকল্পের গল্পগুলো আজও কিংবদন্তী হয়ে আছে। ইসলামের হারানো ইতিহাস ধাপে ধাপে আলোচনার মাধ্যমে ক্রুসেডের উৎপত্তি, যুদ্ধসমূহ এবং এর ফলাফলগুলো বিশ্লেষণ করবে।
মুসলিম বিশ্ব নানা রাজনৈতিক জটিলতার মধ্য দিয়ে একাদশ শতাব্দী পার করছিল। ৮ম শতাব্দীর মাঝামাঝিতে যাত্রা শুরু করা আব্বাসীয় খেলাফতের স্বর্ণযুগ তখন শুধুই অতীত, আর খেলাফত পরিচালনার দায়িত্বভার ছিল নামেমাত্র কিছু পুতুল খলিফার উপর। প্রকৃত ক্ষমতা ছিল সেলজুকদের মতো যুদ্ধবাজ তুর্কিদের হাতে। সেলজুকরা আনাতোলিয়া (বর্তমান তুরস্কের এশীয় অংশ) তে সুলতানাতে রুম প্রতিষ্ঠা করে, এছাড়াও তাদের শাসনাধীন ছিল সিরিয়া, ইরাক এবং পারস্য। কিন্তু এগুলো কোন ঐক্যবদ্ধ রাস্ট্রের অন্তর্ভুক্ত ছিলনা। প্রতিটি অঞ্চল (বা প্রতিটি শহরও) নিজস্ব আমির বা গর্ভনর দ্বারা পরিচালিত হতো। আর এই আমিরগণ প্রায়শই পার্শ্ববর্তী আমিরদের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত হতো। অন্যদিকে সেলজুকদের প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল উত্তর আফ্রিকায় ইসমাঈলী শিয়া নিয়ন্ত্রিত ফাতিমিদ সাম্রাজ্য। ফাতিমিদরা প্রায়শই সুন্নী অধুষ্যিত সেলজুক অঞ্চলগুলো দখলের পায়তারা করত এবং তাদের সংঘাতগুলো সাধারণত পবিত্র শহর জেরুজালেমের কাছেই সংঘটিত হতো।
এ ধরণের রাজনৈতিক অনৈক্য ও অস্থিতিশীলতার মাঝেও সেলজুকরা বাইজেন্টাইন ভূমিতে তাদের দখল বিস্তৃত করা অব্যাহত রেখেছিল। ১০৭১ খ্রিস্টাব্দে মানজিকার্ত এর যুদ্ধে তুর্কিরা বাইজেন্টাইন রোমানদের পরাহত করে আনাতোলিয়ায় রোমানদের প্রায় সকল অঞ্চল নিজেদের কর্তৃত্বে নিয়ে আসে। ফলে সেলজুক শাসনাধীন এলাকা বাইজেন্টাইনের বিখ্যাত শহর কনস্ট্যান্টিনোপল (বর্তমান ইস্তানবুল) এর সীমানা পর্যন্ত পৌঁছায়। ১০৯৫ খ্রিস্টাব্দে বাইজেন্টাইন সম্রাট অ্যালেক্সিয়স দিন দিন শক্তিশালী হয়ে ওঠা তুর্কিদের প্রতিহত করার উদ্দেশ্যে সহযোগিতা কামনা করে রোমের ক্যাথোলিক পোপ দ্বিতীয় আরবানকে একটি চিঠি দেন। এই চিঠি পরবর্তীতে সহযোগিতা আনয়ন ছাড়াও অনেক কিছু করেছিল যা ইতিহাসের মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
সহযোগিতা চেয়ে পাঠানো চিঠিটি পোপ আরবান একটা বিরাট সৈন্যবাহনী একত্র করে মুসলিম এলাকাগুলো নিজের দখলে আনার একটি অজুহাত হিসেবে গ্রহণ করেন। তিনি পবিত্র ভূমিতে ল্যাটিন সাম্রাজ্যের গোড়াপত্তন এবং মুসলিম বিশ্বের রাজনৈতিক ও সামরিক শক্তি নিঃশ্বেষ করে দেয়ার স্বপ্নে বিভোর ছিলেন। ক্লারমন্ট কাউন্সিলে পোপ আরবান সৈন্যবাহিনী জড়ো করে পবিত্র ভূমির দিকে এগিয়ে যাওয়ার জন্য ক্যাথলিকদের উত্তেজিত করে তোলেন। পরে নিয়োগ দেয়া হয় মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধসহ ৩০,০০০ এরও বেশী যোদ্ধাকে, যারা কনস্ট্যান্টিনোপল অভিমুখে রওয়ানা দেয়।
প্রথম যে মুসলিমরা ক্রুসেডারদের সাথে লড়াই করে তারা ছিল আনাতোলিয়ার তুর্কিরা। সুলতানাতে রুমের একজন সেলজুক আমির ‘কিলিজ আরসালান’ তার অঞ্চল দিয়ে পার হতে থাকা ক্রুসেডারদের সাথে কিছু যুদ্ধে জয়লাভ করতে সমর্থ হন। কিন্তু ক্রুসেডার বাহিনীর আকার ছিল তুর্কিদের তুলনায় বিশাল, ফলে তাদের জন্য এ লড়াই চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠে। ক্রুসেডাররা আনাতোলিয়া হয়ে যাওয়ার সময় প্রয়োজনীয় রসদের জন্য আনাতোলিয়ার গ্রামাঞ্চলে লুটতারাজ চালায়, যদিও সেখানকার বেশীরভাগ অধিবাসীই ছিল খ্রিস্টান।
১০৯৭ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে ক্রুসেডাররা দুর্গ-শহর অ্যান্টিয়কে পৌঁছে যায়, যা বর্তমানে দক্ষিণ তুরষ্কে সিরিয়া সীমান্তের খুব কাছে একটি শহর। এই শহরের সেলজুক আমির ‘ইয়াঘি-সিয়ান’ তার ৬,০০০ সৈন্যের বাহিনী নিয়ে শহর সুরক্ষার দায়িত্বে ছিলেন। সাধারণভাবে দেখলে ৩০,০০০ ক্রুসেডার সৈন্যের বিপরীতে ৬,০০০ তুর্কি সৈন্য ছিল নিতান্তই নগণ্য। কিন্তু অ্যান্টিয়ক শহরটি ছিল প্রায় অজেয়। মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য শহরের তুলনায় এই শহরটির শক্তিশালী দালান, এর সাথে নদী, পাহাড় এবং ঢালু উপত্যকা দিয়ে ঘেরা থাকায় বর্হিশত্রুর আক্রমণ থেকে সবচেয়ে সুরক্ষিত ছিল। ক্রুসেডারদের যাত্রা অ্যান্টিয়কের দালানের সামনেই শেষ হয়ে যেত যদিনা মুসলিমদের ভেতর দু’টি জিনিষ না থাকতোঃ অনৈক্য ও বিশ্বাসঘাতকতা।
ইয়াঘি-সিয়ান পার্শ্ববর্তী শহরগুলোর আমিরদের কাছে ক্রুসেডারদের বিরুদ্ধে সাহায্য চেয়ে বার্তা পাঠান। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে তৎকালীন তুর্কি আমিরদের অবস্থা ছিল ‘যার যারটা সে সে বুঝবে’ এমন। নিজেরা হুমকির সম্মুখীন না হওয়া পর্যন্ত প্রতিপক্ষ আমিরকে সাহায্য করাটা ছিল তাদের জন্য অস্বাভাবিক। এর ফলে সিরিয়ার সকল আমির ইয়াঘি-সিয়ানের সাহায্যের আবেদন উপেক্ষা করেন। তাদের অনেকের ইচ্ছে এমনও ছিল যে অ্যান্টিয়ক ক্রুসেডারদের দখলে চলে গেলে তাদের জন্য লাভজনকই হবে কেননা ইয়াঘি-সিয়ান তখন দৃশ্যপটের বাইরে চলে যাবেন। এতকিছুর পরও অ্যান্টিয়কের পক্ষে ক্রুসেডারদের পরাহত করা সম্ভব হতো, কিন্তু তা আর হয়ে উঠেনি শুধুমাত্র অ্যান্টিয়ক শহরের ভেতরে অবস্থানকারী একজন ব্যক্তির জন্য।
ক্রুসেডারদের অবরোধের সময় ফিরুজ নামক এক অস্ত্র প্রস্তুতকারী অ্যান্টিয়কের টাওয়ার প্রতিরক্ষার দায়িত্বে ছিল। কালোবাজারী ব্যবসার অপরাধে ইয়াঘি-সিয়ান তাকে বিরাট অংকের জরিমানা করেন। প্রতিশোধ-পরায়ণ ফিরুজ ভেবে দেখলো ক্রুসেডারদেরকে গোপনে শহরে প্রবেশের ব্যবস্থা করে দেয়াই হবে ইয়াঘি-সিয়ানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেয়ার সবচেয়ে কার্যকরী পন্থা। ১০৯৮ খ্রিস্টাব্দে অবরোধের ২০০ দিন পার হয়ে যাওয়ার পর এক গভীর রাতে ফিরুজ ক্রুসেডারদেরকে তার কক্ষের জানালা বেয়ে উঠে আসার সুযোগ করে দেয়। ক্রুসেডাররা ভেতরে ঢুকে বাকি সৈন্যদের জন্য দরজা খুলে দেয় এবং সকালের মধ্যেই শহরটি তাদের দখলে চলে যায়। এরপর পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের উপর হত্যাযজ্ঞ চলে এবং শহরে আগুন লাগিয়ে দেয়া হয়। এতকিছু ঘটেছিল শুধুমাত্র একজন অস্ত্র প্রস্তুতকারী একটি জরিমানার ব্যাপারে অসন্তুষ্ট ছিল বলে।
সবচেয়ে সুরক্ষতি শহর তাদের পথ থেকে সরে যাওয়ার পর ক্রুসেডাররা জেরুজালেমের দিকে তাদের যাত্রা অব্যহত রাখে। পথিমধ্যে বহু শহরেই অ্যান্টিয়কের মতো একই ধরনের বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনা ঘটে। নিজেদের রক্ষা করার বিনিময়ে বিভিন্ন শহরের আমির তাদের প্রতিবেশীদের প্রতি ক্রুসেডারদের লেলিয়ে দেয়। অ্যান্টিয়কের মতো পরিণাম এড়াতে ভূমধ্যসাগর (Mediterranean Sea) উপকূলবর্তী প্রায় সব শহরই নিজেদের ভূমি দিয়ে ক্রুসেডারদের যাবার পথ করে দেয়।
অবশেষে ১০৯৯ খ্রিস্টাব্দের ৭ই জুন ক্রুসেডাররা তাদের লক্ষ্যস্থল জেরুজালেমে পৌঁছায়। শহরটি নিজেকে রক্ষা করার মতো অবস্থায় ছিলনা। মাত্র একবছর আগেই মিশরের শিয়া ফাতিমিদ সাম্রাজ্য শহরটিকে তুর্কিদের থেকে দখল করে সিরিয়ান অঞ্চলে তাদের দখলদারিত্ব বাড়িয়েছিল। দেয়ালগুলো তখন ভগ্নাবস্থায় ছিল, শহর প্রতিরক্ষাকারী সৈন্যের সংখ্যা কয়েকশর বেশী ছিলনা এবং কারো কাছ থেকে সাহায্যপ্রাপ্তিরও কোন আশাও ছিলনা।
একমাস অবরোধের পর পবিত্র শহর জেরুজালেমের দেয়াল ভেদ করা সম্ভব হয়। সেই পবিত্র শহর ক্রুসেডারদের হস্তগত হয় যে শহর থেকে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) ইস্রা ও মি’রাজের সময় উর্ধাকাশে আরোহণ করেছিলেন। এরপর শহরে গণহত্যা চলে এবং বিভিন্ন রাস্তা, অলি-গলিতে ৭০,০০০ এরও বেশী মুসলিম এবং ইহুদীদের হত্যা করা হয়। মুসলমানরা মসজিদ আল-আক্সায় গিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলে তাদেরকে সেই পবিত্র মসজিদের ভেতরেও হত্যা করা হয়। যুদ্ধের কাহিনী বর্ণনাকারী এক ক্রুসেডার পরবর্তীতে অহংকার ও দম্ভ দেখিয়ে বলে, শহরে মুসলিমদের রক্ত “গোড়ালি সমান উচ্চতায়” পৌঁছে গিয়েছিল। মসজিদ আল-আক্সায় লুটতরাজ চালানো হয় এবং নোংরা করে অপবিত্র করে ফেলা হয়। পাশে অবস্থিত ডোম অব দি রককে খ্রিস্টানদের চার্চ বানানো হয়। উমর ইবন আল-খাত্তাবের সময়ের পরে সেই প্রথম কুদ্সের রাস্তায় সেদিন কোন আযান শোনা যায়নি এবং মসজিদে মসজিদে কোন নামাজ পড়া হয়নি।
ইসলামের তৃতীয় পবিত্র ভূমি এতো জঘন্য এবং ঘৃণ্যভাবে দখল হয়ে যাওয়া সত্ত্বেও মুসলিম বিশ্বের প্রতিক্রিয়া ছিল অত্যন্ত হতাশাব্যঞ্জক। জেরুজালেমকে স্বাধীন করার প্রকৃত কোন প্রচেষ্টা আসতে আরো অনেক বছর লেগে যায়।
অনুবাদ করা হয়েছেঃ The Crusades Part 1: Invasion আর্টিকেল থেকে।
অনুবাদ: জাহ্রা বিনতে মুহাম্মাদ
Sources:
Maalouf, A. (1984). The Crusades Through Arab Eyes. New York: Schocken.
Ochsenwald, W., & Fisher, S. (2003). The Middle East: A History. (6th ed.). New York: McGraw-Hill.