হাকীম সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ ::
১৮৫৭-এর সিপাহী বিদ্রোহ
ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে বালাকোটের পর ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত সিপাহী-জনতার বিদ্রোহ একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী অধ্যায়। এই অধ্যায়ের প্রকৃতপক্ষে মূল নেতা মাওলানা কাসেম নানতুভী ও মাওলানা রশীদ আহমদ গাংগুহী দু’জনই ছিলেন হাজী এমদাদ উল্লাহ মুহাজিরে মক্কির আধ্যাত্মিক ও রাজনৈতিক শিষ্য। হাজী এমদাদ উল্লাহ মুহাজিরে মক্কি ছিলেন সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) এর সিলসিলার এবং আদর্শের অনুসারী; এতে কারো দ্বিমত নাই। ১৮৫৭ বিদ্রোহকে ইংরেজরা সিপাহী বিদ্রোহ বলে চালিয়ে দেবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু আসলে এটা কেবল সিপাহী বিদ্রোহ ছিল না; বরং সিপাহীদের সাথে সাথে জনগণেরও বিদ্রোহ ছিল। ভারতে ইংরেজের শাসনের বিরুদ্ধে ধূমায়িত আক্রোশের এটাই ছিল প্রথম বিস্ফোরণ। এ বিদ্রোহে মুসলমানের সাথে বৃহত্তর হিন্দু সমাজের বিরাট অংশও যোগ দেয়। তবে বাংলার হিন্দুরা ছিল ব্যতিক্রম। তারা ইংরেজের পক্ষ নেয়। ইংরেজের শাসনকে পরাধীনতার শৃংখলের পরিবর্তে তারা ভগবানের বিশেষ আশীর্বাদ ও কৃপা আখ্যায়িত করতে থাকে।
ইংরেজের একশো বছরের শাসন জনগণের মধ্যে বিক্ষোভ ও সিপাহী বিদ্রোহের বিভিন্ন কারণ সৃষ্টি করে দিয়েছিল। সিপাহীদের বিদ্রোহের সবচেয়ে বড় কারণটি ছিল কারতুজে শুয়োরের চর্বি ব্যবহার সম্পর্কিত গুজবটি। আর এ কারতুজ দাঁত দিয়ে ছিঁড়তে হতো। ফলে মুসলমান-হিন্দু নির্বিশেষে সকল সিপাহীর এতে ক্ষিপ্ত হওয়াই স্বাভাবিক ছিল। তাদের মধ্যে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়ে গিয়েছিল। ১৮৫৭ সালের ২ জানুয়ারী দমদম থেকে এ অস্থিরতার প্রকাশ শুরু হয়। ফেব্রুয়ারিতে কলকাতা থেকে ১৬ মাইল দূরে বারাকপুর সেনানিবাসে মংগল পাণ্ডে নামক একজন হিন্দু সৈনিক একজন ইংরেজ সার্জেন্ট মেজরের ওপর গুলি চালিয়ে এই বিদ্রোহের উদ্বোধন করে। তারপর মীরাটে সবচেয়ে বড় সেনানিবাসে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে। বিদ্রোহী বিপ্লবী সৈন্যরা দিল্লীর দিকে মার্চ করতে শুরু করে। সেখানে ছিলেন ক্ষমতাহীন শেষ মোগল বাদশাহ বাহাদুর শাহ জাফর। তখন সারা দেশ থেকে একই আওয়াজ ওঠে, ‘দিল্লী চলো ’।
ইনকিলাবী সেনাদলের দিল্লীতে প্রবেশ
১৮৫৭ সালের ১১ মে থেকে বিভিন্ন দিক থেকে ছোট বড় বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে স্বেচ্ছাসেবক, মুজাহিদ ও ইনকিলাবী সেনাদল দিল্লীতে প্রবেশ করতে লাগলো। তারা বাদশাহকে স্মারকলিপি পেশ করলো। তার শুরুতেই বলা হলো, ‘সৃষ্টি আল্লাহর, রাজ্য বাদশাহর, হুকুম কোম্পানির।’ ইংরেজের বিরুদ্ধে দেশবাসী বাদশাহের কাছে এসেছে ইনসাফের জন্য। কিন্তু বাদশাহ প্রথমে ইংরেজের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে অপারগতা প্রকাশ করলেন। পরবর্তী পর্যায়ে রাজী হয়ে গেলেন। ইনকিলাবী সেনাদল ও মুজাহিদগণ সারা দেশে ইংরেজের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলো। যেখানে সেনাছাউনি আছে সেখানে লড়াই চলতে লাগলো। মজলুম সৈনিকরা কেবল ইংরেজ জাতিসত্তার প্রতি ঘৃণা পোষণ করতো না, তারা ইংরেজদের প্রতিটি জিনিস ও প্রতিটি নিদর্শনকে ঘৃণা করতো। ঘৃণা ও আক্রোশের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে তারা ইংরেজের প্রতিটি নিশানী খতম করে দিতে চাচ্ছিল। সেনাবাহিনীর ইংরেজ অফিসারদের খতম করে দিতে লাগলো। ইংরেজদের বসতি আক্রমণ করে ইংরেজ বাসিন্দাদের মেরে কেটে ছারখার করে দিল। ইংরেজের প্রতিষ্ঠিত ব্যাংক আক্রমণ করে টাকা-পয়সা লুটপাট করে নিয়ে ব্যাংক জ্বালিয়ে দিল। ইংরেজের প্রতিষ্ঠিত প্রেস দিল্লীর কাশ্মিরী গেটের কাছে দিল্লী গেজেটের বিল্ডিংয়ে আক্রমণ করে প্রেস জ্বালিয়ে দিল। প্রেসে কর্মরত ঈসায়ী কম্পোজিটারকেও রেহাই দিল না। তারপর ইংরেজের গীর্জার দিকে অগ্রসর হলো। ওপরে টাঙানো ক্রুশকে গুলীবিদ্ধ করলো। ঘণ্টার রশি কেটে দিল। দেয়ালের গায়ে যেসব ক্রুশ সেঁটে দেয়া হয়েছিল সেগুলো টেনে নামিয়ে খণ্ড-বিখণ্ড করে দূরে নিক্ষেপ করলো। ইনকিলাবী ফৌজের সংখ্যা দিল্লীতে পঞ্চাশ হাজারে পৌঁছে গিয়েছিল। চার মাস ধরে তারা বীর বিক্রমে ইংরেজের মোকাবিলা করলো। তাদের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সেনাপতি বখত খান। কিন্তু রসদ ফুরিয়ে আসছিল। সৈন্যদের বেতন দেবার সামর্থ ছিল না কর্তৃপক্ষের। সেপ্টেম্বর মাস আসতে আসতেই চারদিকে পরাজয়ের আলামত ফুটে উঠছিল। দিল্লীর ও আশাপাশের উলামায়ে কেরাম একজোট হয়ে ইংরেজের বিরুদ্ধে জিহাদের ফতোয়া দিয়েছিলেন; যার ফলে বাদশাহের কোষাগারে অর্থ ও খাদ্য না থাকলেও শহরের মুসলিম জনসাধারণ ইসলামী চেতনা ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুজাহিদদের আহার জুগিয়ে আসছিল। কিন্তু তাদেরও সামর্থ ফুরিয়ে আসছিল। তাছাড়া ইংরেজের ‘ওজীফাখোর’ একদল অসৎ উলামার কর্মকাণ্ডও ভেতরে ভেতরে ঘুণ ধরিয়ে দিচ্ছিল। ফলে ইংরেজ সেনাদল বিদ্রোহের প্রাথমিক ধাক্কা সামলে নিয়ে নিজেদের শক্তি সুসংবদ্ধ করে যখন দিল্লীর ওপর চড়াও হলো তখন পরিস্থিতি পালটে যেতে থাকলো।
মীরাট থেকে শুরু
১৮৫৭ সালের ১০মে মীরাটের সশস্ত্র সৈন্যরা দেশ ও মিল্লাতের প্রতি নিজেদের গুরু দায়িত্ব অনুভব করে স্বাধীনতা যুদ্ধের সূচনা করেছিল। মীরাট ও তার আশপাশের সমগ্র এলাকার জনগণের সার্বিক সহায়তা তাদের উৎসাহ ও উদ্দীপনা আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। কিছুদিনের মধ্যে সমগ্র মীরাট জেলা স্বাধীনতা সংগ্রামের কেন্দ্রস্থলে পরিণত হয়েছিল। সেখান থেকেই তা ছড়িয়ে পড়েছিল রাজধানী দিল্লীর আশপাশের মুজফফরনগর, সাহারানপুর, বুলন্দশহর, আলীগড় ও রোহিলাখণ্ড ইত্যাদি জেলায় ও শহরে। মীরাট থেকেই স্বাধীনতা সৈনিকদের বিশাল বাহিনী দিল্লীতে প্রবেশ করে দিল্লীকে ইংরেজের শাসনমুক্ত করেছিল। জেনারেল বখ্ত খানের নেতৃত্বাধীনে দিল্লীর জামে মসজিদে শহরের শ্রেষ্ঠ উলামা ও মুফতীগণ ইংরেজের বিরুদ্ধে জিহাদের ফতোয়ায় স্বাক্ষর করেছিলেন। দিল্লীর আশেপাশের এই এলাকাগুলোয় মুসলমানরা সংখ্যার দিক দিয়ে বিপুল না হলেও শিক্ষা-দীক্ষা, ইসলামী তাহযীব-তমদ্দুন, রাজ্য শাসন, আইন ও বিচার বিভাগ পরিচালনা এবং অন্যান্য গুণগত মানের দিক দিয়ে সিপাহী বিদ্রোহ-পূর্ব বিগত আড়াইশো বছর সময় কালে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছিল। তাই ইসলামী চেতনায় তারা ছিল অগ্রবর্তী। থানাভূন, কিরানা, কান্ধলা, শামেলী, পাহল্ত, খাতুলী, জাঁস্ট, ঝানঝানা, বুঢানা, দেওবন্দ, নানুতা, গাংগোহ, মংগলোর, রুড়কী, আম্বীঠ, রায়পুর, রামপুর মিনহারান, নুক্কড় এই এলাকার বিখ্যাত থানা শহর।
থানভূনে উলামায়ে কেরামের জিহাদী মোর্চা
চতুর্দিকে সেনা বিদ্রোহের কারণে যখন আইন-শৃংখলার চরম অবনতি দেখা দিয়েছিল এবং ইংরেজ শাসকরাও ভীতি ও আতংকের মধ্যে অবস্থান করছিল তখন সাহারানপুরের ইংরেজ কালেকটর মি. স্প্যাংকির একটি চক্রান্তমূলক পদক্ষেপের কারণে স্থানীয় উলামা ও জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়লো। কালেকটর সাহেব বিনা দোষে থানাভূনের প্রভাবশালী ও সম্ভ্রান্ত রইসের ছোট ভাই কাজী আবদুর রহীম ও তাঁর দলবলকে সাজানো মামলায় ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী ঘোষণা করে তড়িঘড়ি ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলালো। এ ঘটনায় থানাভূন, নান্নুতা ও চারদিকের থানাগুলোর জনতা ক্ষিপ্ত হয়ে উঠলো। তাছাড়া এসব এলাকার সকল প্রতিষ্ঠিত ও মশহুর আলেমের মুরব্বী ও মুরশিদ হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজির মক্কীর বাসস্থানও ছিল থানাভূন। শহীদ কাজী আবদুর রহীমের বড় ভাই কাজী ইনায়েত আলী খান এসময় জনগণের বিক্ষোভের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। এলাকার লোকদের কাছে দিল্লীর ইনকিলাব এবং স্থানীয় আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি যথেষ্ট জটিলতার সৃষ্টি করেছিল। তাই পরিস্থিতি সামাল দেবার এবং করণীয় সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য উলামায়ে কেরামের জরুরী মজলিস শূরা আহবান করা হলো। কাজেই মওলানা মুহাম্মদ কাসেমকে আহবান করা হলো নান্নুতা থেকে।
১. মওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব এসময় সাহারানপুরে ছিলেন। তাঁকে সেখান থেকে ডেকে আনা হলো।
২. রহমতুল্লাহ কিরানভীকে দিল্লীর সঠিক অবস্থা জানার জন্য সেখানে পাঠানো হয়েছিল। তিনি ফিরে এসে বৃদ্ধ বাদশাহ ও তাঁর শাহজাদাদের অনভিজ্ঞতার রিপোর্ট পেশ করেছিলেন। তাঁর রিপোর্ট থেকে জানা গিয়েছিল, ইনকিলাবী ফৌজ বাদশাহর হাতে নেতৃত্ব ছেড়ে দিয়েছেন ঠিকই কিন্তু কোনো চিন্তাশীল ব্যক্তি ও নিয়মতান্ত্রিক দলের পক্ষে তাঁদের ওপর নির্ভর করা কঠিন। কাজেই প্রথম বৈঠকে সায়্যিদ আহমদ শহীদ প্রবর্তিত এ যাবত যে সংস্কারমূলক ও রাজনৈতিক দলীয় ব্যবস্থাপনা চলে আসছিল তাকে একটি রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার রূপ দেবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হলো। হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ সাহেবকে এই রাষ্ট্র ব্যবস্থার ‘আমীর’ নির্বাচন করা হলো। মওলানা মুহাম্মদ কাসেম, মওলানা রশীদ আহমদ, হাফেজ যামেন, মওলানা মুহাম্মদ মুনীরের ন্যায় নেতৃবৃন্দকে সেনাবাহিনী, প্রতিরক্ষা, আইন-শৃংখলা ও বিচার বিভাগ ইত্যাদি পরিচালনার দায়িত্বে নিযুক্ত করা হলো।
৩. এই সংগে বাদশাহর একান্ত সহচর নওয়াব শের আলী মুরাদাবাদীকে বাদশাহর কাছে পাঠানো হলো যথাযথভাবে আইন-শৃংখলা প্রতিষ্ঠিত রাখার এবং তাঁদের সাথে সহযোগিতা করার বার্তা দিয়ে। মওলানা মানাযির আহসান গীলানী তাঁর মওলানা মুহাম্দ কাসেমের জীবন কথার ২য় খণ্ডের ১৩৭ পৃষ্ঠায় ক্বারী মুহাম্মদ তৈয়ব সাহেবের সূত্রে একথাও লিখেছেন, ‘বাদশাহকে শামেলীর ওপর আক্রমণ পরিচালনা করতে উদ্বুদ্ধ করার জন্য শের আলী সাহেবকে বাদশাহর কাছে পাঠানো হয়েছিল।’ কারণ ইতিপূর্বে বাদশাহর ইনকিলাবী ফৌজকে নেতৃত্ব দান করে শাহী জুলুস সহকারে ১২ মে দিল্লী শহর পরিভ্রমণ করেছিলেন। বড় বড় বাজার খোলার ব্যবস্থা করেছিল এবং জনগনকে শান্তি ও নিরাপত্তা দানের ওয়াদা করেছিলেন। কাজেই শামেলীতে উলামা গ্রুপ যেভাবে মোর্চা গঠন করে হাজী ইমদাদুল্লাহর নেতৃত্বে স্বাধীনতার ঝাণ্ডা উঁচু করেছিলেন তার ফলে দিল্লী থেকে বাদশাহর নেতৃত্বে ইনকিলাবী ফৌজ এদিকে আক্রমণ পরিচালনা করলে দিল্লী থেকে নিয়ে এই পুরো এলাকাটাই ইংরেজ দখল ও শাসনমুক্ত হয়ে যেতে পারে।
দিল্লী নিকটবর্তী মুজফফরনগর জেলার উলামায়ে কেরামের মধ্যে ইংরেজের বিরুদ্ধে এই জিহাদী চেতনা আচানক সৃষ্টি হয় নি; বরং তাঁরা দিল্লীতে জেনারেল বখ্ত খানের নেতৃত্বে ইসলামের চিরাচরিত শিক্ষা অনুযায়ী ইনকিলাবী সেনাদলের সুসংগঠিত বাহিনীর কথা শুনলেন এবং দিল্লীর জামে মসজিদের উলামায়ে কেরামের ইজতিমায় জিহাদের ফতোয়া দানের সময় তাঁদের একজন প্রতিনিধি অর্থাৎ মওলানা রহমতুল্লাহ কিরানভী সশরীরে উপস্থিত ছিলেন। এক্ষেত্রে তাঁদের মধ্যে জিহাদের চেতনা ও জিহদের জোশ সৃষ্টি হওয়াই স্বাভাবিক। কাজেই তাঁদের মতানুযায়ী দিল্লীতে এসময় একটি সৎ ও সত্যনিষ্ঠ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়ে গিয়েছিল। সেখানে উলামায়ে কেরাম ও মিল্লাতের নেতৃবৃন্দ গভীর চিন্তা-ভাবনা করে জিহাদের ফতোয়া জারী করেছিলেন। কাজেই এখন শামেলী ও থানাভূনের জামায়াতের জন্য পথ পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। এ এলাকার আমীর হাজী ইমদাদুল্লাহর ওপর দায়িত্ব এসে পড়েছিল আগামীর জন্য নতুন কর্মসূচি গ্রহণ করার। কাজেই আল্লাহর বিধানঃ ওয়া শাবিরহুম ফিল আমর তথা নিজেদের বিষয়গুলো পরামর্শের ভিত্তিতে ফায়সালা করার জন্য উলামায়ে কেরামের সমাবেশ করা হলো। মূল এজেন্ডা ছিল : জিহাদের ঘোষণা। অর্থাৎ দিল্লীর মতই এখানেও আলোচনার একই বিষয়বস্তু ছিল- বর্তমান অবস্থায় আমরা ইংরেজের সুসংগঠিত ফৌজের বিরুদ্ধে জিহাদ ঘোষণা করতে পারি কিনা? এ ব্যাপারে শরীয়তের ফায়সালা কি? শূরার আলোচনা সভায় উপস্থিত সবাই সামনে এগিয়ে যাবার পদক্ষেপ নেবার তাগাদা করেন অর্থাৎ তাঁরা দিল্লীর জিহাদের ফতোয়ার সমর্থন করেন। একমাত্র মওলানা শায়খ মুহাম্মদ থানবী দ্বিমত পোষণ করেন। মওলানা মুহাম্মদ কাসেম নান্নুতবী তাঁকে অত্যন্ত আদব সহকারে জিজ্ঞেস করেন: হযরত, আমরা বুঝতে পারলাম না আপনি কি কারণে দেশ ও দীনের দুশমন ইংরেজের বিরুদ্ধে জিহাদকে ফরয তো দূরের কথা, জায়েযও মনে করেন না? হযরত মুহাদ্দিস মওলানা শায়খ মুহাম্মদ বলেন, এজন্য জায়েয মনে করি না যে, আমাদের কাছে যুদ্ধ করার মতো অস্ত্রশস্ত্র নেই। আমরা বলতে গেলে একেবারে খালি হাত।
মাওলানা কাসেম: আমাদের কাছে কি সেই পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্রও নেই যা বদরের যুদ্ধে মুসলমানদের কাছে ছিল ?
শায়খ মুহাম্মদ : আপনার সমস্ত কথা মেনে নিলেও তবুও জিহাদের সবচেয়ে বড় শর্ত জিহাদের ইমাম নেই যাঁর নেতৃত্বে জিহাদ অনুষ্ঠিত হবে।
মওলানা মুহাম্মদ কাসেম: ইমাম নির্বাচন কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। মুরশিদে বরহক হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ সাহেব এখানে উপস্থিত আছেন। আসুন, আমরা সবাই তাঁর হাতে জিহাদের জন্য বাইআত করি।
হাফেয যামেন সাহেব: মওলানা, ব্যস ! আপনার কথা বুঝতে পেরেছি।
এরপর সবাই হযরত হাজী সাহেবের হাতে জিহাদের বাইআত করলেন অর্থাৎ প্রথমে হাজী সাহেবকে আমীর করা হয়েছিল এলাকার শাসন পরিচালনা করার জন্য। এবার তাঁর হাতে বাইআত করলেন জানমাল কুরবানী করার জন্য।
এখন প্রশ্ন ছিল : এ জিহাদী বাহিনী কোনদিকে যাবে? দিল্লীর দিকে মার্চ করাই ছিল স্বাভাবিক। কাজেই দীন ও স্বদেশভূমির এই প্রাণ উৎসর্গকারী দল জীবন বাজি রেখে একটি সুসংগঠিত শক্তির সাথে মোকাবিলা করার জন্য নিজেদের বাড়িঘর ছেড়ে বের হয়ে পড়লো। তাদের গন্তব্য ছিল দিল্লী। এ উদ্দেশে তারা শামেলী হয়ে দিল্লী যাবার জন্য এগিয়ে চললো। ধ্বনি উঠলো, দিল্লী চলো। ৪ শামেলী হয়ে যাবার আর একটি কারণও ছিল। সেটি ছিল, শামেলীর হিন্দু জমিদার মাহার সিং ইংরেজের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার ঝাণ্ডা বুলন্দ করেছিল। তাকে সাহায্য করার প্রয়োজন ছিল। মাহার সিং পত্রের মাধ্যমে দিল্লীর দরবারের সাথে সম্পর্ক স্থাপন করেছিল। শামেলী সে সময় সাহারানপুর জেলা হেডকোয়ার্টারের সাথে সম্পর্কিত ছিল। জেলা ইংরেজ প্রশাসক স্প্যাংকি (Spankee) সাহেব শামেলীর অবস্থান দৃঢ় করার জন্য সেখানে গুর্খা ফৌজের একটি ব্যাটালিয়ান প্রেরণ করলো। ফৌজি কমান্ডার এডওয়ার্ড গুর্খা সৈন্যের সহায়তায় শামেলী পুরোপুরি অধিকার করে নিল। একজন বিশ্বস্ত সেনা অধিনায়ক ইবরাহীমের অধীনে সামান্য সংখ্যক সৈন্য রেখে ১৮৫৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর নিজে সামনের দিকে এগিয়ে গেলো। কাজী ইনায়েত আলী সাহেব ও তাঁর সহযোগীরা এই সুযোগে শামেলী আক্রমণ করে বসলো। প্রায় একশত তের জন সৈন্য নিহত হবার পর ইবরাহীম অস্ত্র সমর্পণ করলো। এডওয়ার্ড ফিরে এলো কিন্তু ১১৩ জন্য সৈন্য ক্ষয়ের কারণে ক্রোধে ফেটে পড়লো। অন্যদিকে এ সময় মুজফ্ফর নগরের অবস্থাও শোচনীয় হয়ে পড়েছিল। ফলে এডওয়ার্ড সেখানে চলে গেলো। সেখান থেকে ক্যাপ্টেন স্মিথ ও লেফটেন্যান্ট কিউল রুসের নেতৃত্বে শিখ ও গুর্খা বাহিনী থানাভূনে প্রেরণ করলো। মুজাহিদরা তাদেরকে চরমভাবে পরাস্ত করে ভাগিয়ে দিল। ফলে এবার পূর্ণ ইংরেজ সেনাবাহিনী পাঠনো হলো কর্ণেল ডানলপের নেতৃত্বে। তারা প্রথমে থানাভূন দখল করলো। তারপর শামেলী দখল করে তাকে বিধ্বস্ত ও ধ্বংস করলো।
১৮৫৭ সাল। সারা হিন্দুস্তান তখন বিদ্রোহের আগুনে উত্তাল। বিদ্রোহ দমাতে গিয়ে বৃটিশ সরকার হয়ে পড়ে টাল-মাটাল। বিদ্রোহের ঢেউ থানাভুনেও আছড়ে পড়েছিল। আর এখানেই ছিল হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ (রহ) এর প্রতিষ্ঠিত আন্দোলনের কর্ণধাররা। বালাকোটের যুদ্ধের পর এ আন্দোলন অনেকটা থেমে গিয়েছিল, তবে বিভিন্ন যায়গায় বিচ্ছিন্নভাবে এ আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট মুজাহিদরা যুদ্ধ করে যাচ্ছিলেন। শাহ ওয়ালীউল্লাহ (রহ) এর বংশধররা, যারা এই আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন তারা মক্কায় হিজরত করেন। ১৮৪৪ সালে যখন হাজী ইমদাদুল্লাহ সাহেব (রহ) বায়তুল্লায় প্রথমবারের মত হজ্জ করতে যান,তখন মাওলানা ইসহাক (রহ) হাজী ইমদাদুল্লাহ(র) কে হিন্দুস্তানের জন্য আমীর নিযুক্ত করেন। তিনি ১৮৬৬ সালে হিন্দুস্তান প্রত্যাবর্তন করার পর এই আন্দোলনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা হাজী ইমদাদুল্লাহ সাহেবের চতুষ্পার্শ্বে সমবেত হন। আর হাজী সাহেব অবস্থান করছিলেন থানাভুনে, ফলে থানাভুন হয়ে হয়ে ওঠে এই আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র।
১৮৫৭ সালের আন্দোলনের সূচনা ইংরেজদের কাছে যেমন ছিল আকস্মিক ঠিক তেমনি বিপ্লবী দলগুলোর জন্যও তা ছিল তাৎক্ষণিক। তাই যারা এই কোন দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিল না, তাদের পক্ষে প্রথম সুযোগেই একটি দলের সাথে যোগ দেওয়া বা তা থেকে দূরে থাকার সুযোগ ছিল। কিন্তু যারা ইতি পূর্বেই নিজেদের জীবনকে কোন একটি ব্যবস্থার সাথে জড়িয়ে নিয়েছিলেন, তাদের পক্ষে কেন্দ্রীয় নির্দেশনা কিংবা দলের ফয়সালা ব্যতিরেকে ব্যক্তিগতভাবে কোন সিদ্ধান্ত নিয়ে তাড়াহুড়া করে কোন কাজ শুরু করার সুযোগ ছিল না বা তা সঠিকও নয়। যে দলটি পূর্ব থেকেই বৃটিশদের বিরুদ্ধে জিহাদে লিপ্ত ছিল, যখন সে দলটির কাছে দিল্লীর বিপ্লবের খবর পৌঁছে তখন সে সম্পর্কে চিন্তা-ভাবনা করার প্রয়োজন দেখা দেয়। যখন পুরো দেশ বিপ্লবের আগুনে উত্তপ্ত, এই সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চাচ্ছিলেন না। তাই জরুরী অধিবেশন ডাকা হয়। তাই মাওলানা কাসেম(রহ) কে নানুতাহ থেকে, মাওলানা রশীদ আহমদ সাহেবকে গংগুহী থেকে এবং হযরত মাওলানা ইয়াকুব সাহেবকে সাহারানপুর থেকে ডেকে আনা হয়। প্রথমে দিল্লীর আন্দোলনের সঠিক চিত্র ও প্রকৃতি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য মাওলানা রহমাতুল্লাহ কীরানভীকে দিল্লী প্রেরণ করা হয়।মে মাসের শেষের দিকে বা জুন মাসের প্রথম দিকে মাওলানা কিরানভী দিল্লী পৌঁছান। তখন পর্যন্ত আন্দোলন ছিল বৃদ্ধ বাদশাহ ও আলালের ঘরের দুলাল শাহাযাদাদের অনভিজ্ঞতার হাতে বন্দী। তবুও বিপ্লবী সিপাহীরা নেতৃত্বের চাবি কাঠি তাদের হাতেই তুলে দিয়েছিলেন। কিন্তু একটা নীতিবাদী দলের পক্ষে তাদের উপর আস্থা রাখা ছিল বড়ই মুশকিল। কিন্তু এইসব স্বাধীনচেতা বীর পুরুষদের পক্ষে এই অনুকূল পরিবেশ ও উপযুক্ত পরিস্থিতিতে নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকা সম্ভব ছিল না। আবহাওয়ার এই শুভ পরিবর্তন দ্বারা তারা মোটেই উপকৃত হবেন না, তা কি করে সম্ভব হতে পারে। কিন্তু যে উজ্জ্বল শরীয়ত ও পবিত্র শিক্ষার আলোকে তারা সম্মুখে পা বাড়াতেন, তার প্রথম শর্ত ছিল, যে পাই সম্মুখে বাড়ানো হবে, তা হবে নিয়ম-শৃঙ্খলা, সুস্থ-চিন্তা এবং পরিপূর্ণ আইনের অনুগত।
যাইহোক, এ প্রথম অধিবেশনে এতটুকু কাজ হয়, যে দলীয় শৃঙ্খলা তখন পর্যন্ত একটা সংস্কারমূলক ও রাজনৈতিক দল হিসেবে ছিল, এখন থেকে তা শাসন ব্যবস্থায় রূপ দেওয়া হয়। হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ সাহেবকে ‘আমির’ এবং মাওলানা কাসেম সাহেব, মাওলানা রশীদ আহমদ সাহেব,হাফিজ যামিন সাহেব এবং মাওলানা মুহাম্মাদ মুনীর সাহেবের মতো বড় বড় আলেম এবং নেতাদের সেরা বিভাগ, প্রতিরক্ষা বিভাগ, বিচার বিভাগ, আইন বিভাগ ইত্যাদির দায়িত্বে নিযুক্ত করা হয়। সে উপলক্ষে এ সিদ্ধান্তও নেওয়া হয় যে, আইন শৃঙ্খলা বিধানের জন্য স্বয়ং বাদশাহকেও এ ব্যবস্থায় শামিল হওয়ার পরামর্শ দেওয়া হবে। এ উদ্দেশ্যে বাদশার ঘনিষ্ঠ সভাসদ ও অকৃত্রিম সুহৃদ নওয়াব শিব্বির আলী মুরাদ আবাদীকে দিল্লী প্রেরণ করা হয়। নওয়াব শিব্বীর আলীকে প্রেরণ করার আরেকটি উদ্দেশ্য ছিল, বাদশাহ যাতে দিল্লী থেকে শামেলীতে অভিজান চালান। আর তারা অভিজান চালাবেন এদিক থেকে। এমনিভাবে দু’দিক থেকে অভিজান চালালে এলাকাটি ইংরেজদের এবং তাদের দোসরদের উপদ্রব থেকে মুক্ত হবে।
যাইহোক, রমজান মাসের পরপরই মে মাসের শেষের দিকে অথবা জুন মাসের প্রথম দিকে হাজী ইমদাদুল্লাহ সাহেবের নেতৃত্বে আঞ্চলিক বা স্থানীয় আইন ও নিয়ম-শৃঙ্খলা অনুযায়ী থানাভুনে একটি সরকার ব্যবস্থা কায়েম করা হয়। মে মাস শেষ, জুন মাসও শেষ হওয়ার পথে, তবু এই নিষ্ঠাপূর্ণ প্রচেষ্টা সুসংবদ্ধ রূপ নেওয়ার কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছিল না। এসময় থানাভুনের রইস কাযী ইনায়াত আলী সাহেবের ভাইয়ের বিয়োগান্তক ঘটনা সংঘটিত হয়। তিনি হাতী ক্রয় করার জন্য সাহরানপুর যান। তার সম্পর্কে ইংরেজদের দোসররা ইংরেজদের অবহিত করে। তখন সাহারানপুর জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মিঃ স্পেংকী (Spankie) উনাকে গ্রেফতার করে এবং ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে দেয়। এ ঘটনাতে থানাভুন সরকারের কেউ কেউ উত্তেজিত হলেও যারা এরকম শত শত ঘটনার মুখোমুখি হয়েছেন এবং যাদের জিহাদের উদ্দেশ্য ছিল ‘ইলায়ে কালিমাতুল্লাহ’ তথা আল্লাহর বাণীকে বুলন্দ করা এবং ন্যায় ও হককে ঊর্ধ্বে তুলে ধরা তারা আবেগতাড়িত হয়েই সাথে সাথে কোন সিদ্ধান্ত নেননি বরং তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করছিলেন ঠাণ্ডা মাথায়।
এদিকে ১৮৫৭ সালে ২রা জুলাই জেনারেল বখত খান তার সুশৃঙ্খল ও নিয়মিত বাহিনী নিয়ে দিল্লী পৌঁছেন। দলপতি হিসেবে তাদের সাথে ছিল মাওলানা সরফরাজ আলী সাহেব। বাদশাহ ও তার শাহাযাদাদের সময় যে অরাজকতা ও বিশৃঙ্খলা সেনাবাহিনীতে ছিল, জেনারেল বখত এসে সেনাবাহিনীকে শুধু সুশৃঙ্খল করেন নি, বরং নিয়ম-শৃঙ্খলাকে সে মানদণ্ডে নিয়ে আসার চেষ্টা করেন, ইসলামী শিক্ষা অনুযায়ী যা ছিল জরুরী। বখত খান দিল্লীর জামে মসজিদে ওলামাকিরামকে একত্রিত করেন এবং জিহাদের ফতোয়া ঘোষণা করেন। এই ফতোয়াতে রহমাতুল্লাহ সাহেবের সাক্ষর ছিল যাকে ইতিপূর্বে থানাভূন থেকে দিল্লীর অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছিল। দিল্লীতে জিহাদের ফতোয়া জারী হওয়ার পর, থানাভুনের পথ অনেকটা পরিষ্কার হয়ে যায়। ফলে এতদঞ্চলের আমির হাজী ইমদাদুল্লাহ সাহেবের পক্ষেও পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণ সহজ হয়ে যায়। তা সত্ত্বেও পূর্ণ সতর্কতা অবলম্বনের জন্য মজলিসে শুরার অধিবেশন ডাকেন। আর আল্লাহর বাণী- “এবং কাজের ক্ষেত্রে তাদের সাথে পরামর্শ কর”- এর দাবীও ছিল তাই। অধিবেশনের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল পদক্ষেপ গ্রহণ-অন্য কথায় জিহাদ ঘোষণা।
শূরার অধিবেশনে সকল সদস্য দিল্লীতে গৃহীত জিহাদের ফতোয়ার প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। তারপর হাজী ইমদাদুল্লাহ সাহেবকে ইমাম নিযুক্ত করে সকলে তার হাতে জিহাদের বায়াত করেন। অর্থাৎ ইতিপূর্বে সরকার গঠনের সময় বায়য়াত করা হয়েছিল আর এখন করা হচ্ছে জান-মাল কোরবানীর জন্য। তখন দীন ও স্বদেশভূমির জন্য উৎসর্গিত প্রাণ মুজাহিদরা জীবনের মায়া ত্যাগ করে একটা সুসংগঠিত শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য ঘর ত্যাগ করে থানাভুন থেকে শামেলী অভিমুখে যাত্রা করে, তাদের মূল লক্ষ্য ছিল দিল্লী। শামেলী অভিমুখে যাত্রা করার আর একটা কারণ ছিল, শামেলীর রইস জিহার সিং আযাদীর যে পতাকা উত্তোলন করেছিলেন, তার সাহায্যের ভীষণ প্রয়োজন ছিল। অতঃপর জিহাদের প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায় এবং তার ঘোষণা দেওয়া হয়। হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ সাহেবকে ইমাম নিযুক্ত করা হয়। মাওলানা কাসিম সাহেবকে নানুতভীকে সশস্ত্র বাহিনীর সিপাহসালার ও মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহীকে কাযী বা বিচারপতি নিযুক্ত করা হয়। এবং মাওলানা মুনীর সাহেব নানূতভী ও হাফেয যামেন থানভীকে সেনাবাহিনীর ডান ও বাম ব্রিগেডের অধিকর্তা হিসেবে নিয়োগ করা হয়। যেহেতু উল্লেখিত ব্যক্তিদের তাকওয়া ও ইলম (শরীয়ত ও তাসাউফ জ্ঞান)- এর বিপুল খ্যাতি ছিল, তাদের ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যাত সম্পর্কে লোকেরা অবগত ও প্রভাবিত ছিলেন এবং তাদের দীনদারী ও খোদাভীতি সকলে প্রত্যক্ষ করে আসছিল, তাই তাদের প্রতি লোকদের আস্থা ছিল। মুরীদ ও ছাত্র ছাড়াও সাধারণ মুসলমান তাদের অত্যন্ত ভক্ত ছিল। এ কারণে অতি অল্প সময়ে মধ্যেই দলে দলে লোক তাদের পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে। তখন পর্যন্ত অস্ত্রের উপর কোন নিষেধাজ্ঞা ছিল না। সাধারণতঃ সকলের কাছেই অস্ত্র থাকত। আর অস্ত্র রাখা এবং অস্ত্র পরিচালনা শিক্ষা করা মুসমানদের মাঝে জরুরী মনে করা হতো। কিন্তু সেসব অস্ত্র ছিল অনেকটা পুরনো ধরনের। শুধু গাঁদা বন্দুক ছিল। কার্তুজের কোন রাইফেল ছিল না। কেবল ইংরেজদের কাছে এই রাইফেল ছিল। হাজার হাজার মুজাহিদ সমবেত হয় এবং থানাভুন ও তার আশপাশে সরকার প্রতিষ্ঠা করা হয় এবং ইংরেজদের অধীন শাসকদের সেখান থেকে বের করে দেওয়া হয়। এ সময় খবর আসে, তোপখানা, সাহারানপুর থেকে শামেলীতে প্রেরণ করা হচ্ছে এবং এক প্লাটুন সৈন্য রাতে এ পথ অতিক্রম করবে। এ খবর শুনে লোকেরা ব্যাকুল হয়ে পড়ে। কারণ, এ সকল মুজাহিদদের কাছে যে সব অস্ত্র ছিল, তা হচ্ছে তরবারি, হাতওয়ালা বন্দুক, বর্শা ইত্যাদি। কারো কাছেই তোপ ছিল না। সুতরাং কি করে ইংরেজদের এই তোপখানার মোকাবেলা করা হবে? হযরত গাঙ্গুহী (রহ) বললেন- তোমরা ঘাবড়ে যেও না। সড়কটি ছিল একটি বাগানের গা ঘেঁষে। হযরত ইমদাদুল্লাহ সাহেব মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহীকে ৩০-৪০ জন মুজাহিদের কমান্ডার নিযুক্ত করেন। সকলকে আগে থেকেই প্রস্তুত থাকার হুকুম দিয়ে তিনি বললেন, আমি নির্দেশ দেওয়ার সাথে সাথে তোমরা একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়বে। ইংরেজ প্লাটুন তোপখানা সহ বাগানের কাছে পৌঁছতেই সকলে এক সঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ইংরেজ সৈন্যরা ঘাবড়ে যায় এই ভেবে যে, না জানি আরো কত লোক আত্মগোপন করে আছে- তারা সকলেই তোপখানা সেখানে রেখে পলায়ন করে। হযরত গাঙ্গুহী (র) নিজেই তোপখানা টেনে নিয়ে হাজী সাহেবের মসজিদের সম্মুখে চলে আসেন। এতে মানুষের অন্তরে তাদের প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, যুদ্ধ বিদ্যার পারদর্শিতার দিক ফুটে ওঠে।
বর্তমানে শামেলী মুজাফফর নগর জেলার একটি সাবডিভিশনের সদরদপ্তর। তৎকালে সেটা সাহরানপুর জেলার সাথে সংযুক্ত ছিল। সাহরানপুরের শাসক মিঃ স্পেংকী এই এলাকায় নিজের অবস্থান সুদৃঢ় করার জন্য একটা গোর্খা বাহিনী সেখানে প্রেরণ করেছিলেন। সেখানকার সামরিক কমান্ডার এডোয়ার্ডস গোর্খাদের সাহায্যে সেটা পুরো অধিকার করে ছিল। তাদের একজন বিশ্বস্ত লোক ইবরাহীম খাঁর অধীনে একটা বাহিনী রেখে তারা শামেলী ত্যাগ করে এবং ১৮৫৭ সালের ১৪ই সেপ্টেম্বর আরও সম্মুখে অগ্রসর হয়। মুজাহিদরা বিশেষ করে কাযী ইনায়াত আলী ও তার সঙ্গীরা পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে শামেলীর উপর আক্রমণ করতে চাচ্ছিলেন। তাই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় শামেলীতে হামলা চালানো হবে। শামেলীতে আক্রমণ করা হয়। শামেলীতে যে ইংরেজ সৈন্যরা ছিল,তারা মুজাহিদদের ভিড় দেখে তহসীলের চৌহদ্দিতে আটকা পড়ে এবং ভেতর থেকে গুলি করা শুরু করে।তহসীলের ইমারত ছিল দুর্ভেদ্য, মুহূর্তে তা দুর্গের কাজ করে। মুজাহিদদের ভিড় ছিল বাইরের ময়দানে যেখানে কোন আড়াল ছিল না, তাছাড়া তাদের নিকট বন্দুকের সংখ্যা ছিল কম। তাই দুই দিনের যুদ্ধে তাদের অনেকে অঘোরে প্রাণ দিতে থাকে। তহসীলের কাছে ছিল একটা ছাপড়া। মাওলানা কাসেম (র) নজর পড়ে ঐ ছাপড়ার দিকে। তিনি সেটা তুলে এনে তহসীলের সদর দরজার সামনে স্থাপন করে তাতে আগুন লাগিয়ে দেন। এতে ফটক পুড়ে যায় এবং ভেতরে প্রবেশের পথ উন্মুক্ত হয়। তৃতীয় দিন হাফিয যামিন সাহেব তহসীলের দরজা ভেঙ্গে ফেলেন। তখন ইংরেজ সৈন্যদের মাঝে মুকাবিলা করার সুযোগ ছিল না। তাদের কেউ কেউ পালাতে সক্ষম হয়, কিছুসংখ্যক নিহত হয় এবং বাকিরা গ্রেফতার হয়। শেষ পর্যন্ত মুজাহিদদের অধিকারে শামেলী চলে আসে।এতে প্রায় ১১৩ জন ইংরেজ সৈন্য মারা যায়।তবে মুজাহিদের মধ্যে হযরত যামিন সাহেব এই যুদ্ধে শহীদ আর উনার মৃত্যুর সাথে সাথে মুজাহিদদের অগ্রযাত্রা ব্যহত হয়। তার শাহাদাতের পূর্বে প্রতিদিন খবর আসত, আজ অমুক স্থান ইংরেজদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে, আজ হিন্দুস্তানিরা অমুক স্থান অধিকার করেছে। কিন্তু হাফিজ যামিন সাহেবের শাহাদাতের পর প্রথমেই খবর আসে যে, ইংরেজরা দিল্লী দখল করে ফেলেছে।
হাফিজ যামিন সাহেবের শাহাদাত আর দিল্লীর পতনের খবরে অনেক লোক সাহস হারিয়ে ফেলে নিজ নিজ ঘরে ফেরা। এদিকে এডওয়ার্ডস ফিরে এসে শামেলীর অবস্থা দেখে ভীষণ ক্ষিপ্ত হয়, কারণ তাদের ১১৩ জন সৈন্যের প্রাণহানি হয়েছে। কিন্তু তখন মুজাফফর নগরের অবস্থা খুব খারাপ। তাই সে সেখানে চলে যায়। তারপর ক্যাপ্টেন স্মীথ ও ল্যাফট্যানেন্ট কিউলরস এর নেতৃত্বে শিখ এবং গোর্খা বাহিনী থানাভুন প্রেরণ করে।শহরের লোকদের কাছে কোন বড় তোপ ছিল না, মামুলি ধরনের ২ টি ছোট তোপ ছিল। এ দুটি দিয়েই নগর দ্বার রক্ষার কাজ চালানো হচ্ছিল। ইংরেজদের ২-৩ টি গোলা জনবসতিতে পড়ে, এ সময় মুজাহিদদের একজন ছোট তোপ দিয়ে একটি গোলা নিক্ষেপ করেন। গোলা ইংরেজদের তোপের মুখে গিয়ে পড়ে এবং তা অকেজো হয়ে যায়। দ্বিতীয় গোলা দ্বারা আরেকটি তোপ বিকল হয়। মুজাহিদদের কাছে যুদ্ধাস্ত্র ছিল সামান্য, মাত্র কয়েকশ জনের কাছে ছিল মামুলী বন্দুক, তলোয়ার ও তীর- ধনুক ছিল বেশী। ইংরেজ সৈন্যদের কাছে যেন কোন সাহায্য না পৌঁছে সেজন্য মুজাহিদরা পরের দিন শহরের বাইরে গিয়ে ইংরেজদের উপর হামলা চালায়। সাত ঘণ্টার হাতাহাতি যুদ্ধের পর ইংরেজ সৈন্যরা পরাজিত হয়। মুজাহিদরা তাদের মেরে তাড়িয়ে দেযা।
১৮৫৭ সালের সেপ্টেম্বরে যখন বাহাদুর শাহ গ্রেফতার হন তখন দিল্লীর উপর ইংরেজদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে ইংরেজ সৈন্যরা আশেপাশের এলাকা অধিকার করা শুরু করে। কয়েকদিন পরেই আসে থানাভুনের পালা। কর্নেল ডনলপ এর নেতৃত্বে সেখানে সামরিক বাহিনী প্রেরণ করা হয়।রাতের অন্ধকারে ইংরেজদের আগমনের সংবাদে সর্বত্র চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়। এবার তো পরাজয় নিশ্চিত। কিন্তু বাহাদুরি হুলো, নিশ্চিত পরাজয়ের অবস্থা সৃষ্টি হলেও, মোকাবেলা করার সাহস করা। থানাভুনের চারপাশে ছিল পাঁচিল। তাই যে তোপটি মুজাহিদরা পূর্বে ছিনিয়ে এনেছিল, তা একটি উচুস্থানে স্থাপন করা হয়। এ তোপের প্রথম ফায়ার এতটা সফল হয় যে, এর গোলা ঠিক ইংরেজদের তোপের মুখে গিয়ে পড়ে। ফলে ইংরেজদের তোপটি টুকরো টুকরো হয়ে যায়। কিন্তু এ ধারা খুব বেশীক্ষণ বহাল থাকেনি। কেননা এখানে ছিল একটি মাত্র তোপ আর শত্রুদের ছিল অনেক। এখানে গাঁদা বন্দুক ছিল, তাও সংখ্যায় অনেক কম। অপর দিকে শত্রুর ওখানে নতুন ধরনের রাইফেলের প্রাচুর্য। শেষ পর্যন্ত দু’ঘণ্টার চেয়ে বেশী মোকাবেলা অব্যাহত থাকতে পারেনি। সুবহে সাদিকের সময় পূর্ব দিক থেকে থানাভুনে অবিরাম গোলাবর্ষণ শুরু করে ইংরেজ। তারপর শহরের পাঁচিল ভেঙে দেওয়া হয়, দরজা উড়িয়ে দেয়া হয় এবং তেল ঢেলে গৃহে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হয়। যাকেই পাওয়া যায় তাকেই হত্যা করা হয়। মূল্যবান সবকিছু ইংরেজ সৈন্যরা পকেট ভর্তি করে নিয়ে যায়, অবশিষ্ট যা বাকি ছিল তা আশ পাশের গ্রামের লোকেরা লুটে নেয়। ফলে থানাভুন এক শূন্য বিরানভূমিতে পরিণত হয়। থানাভুনের পর ইংরেজরা শামেলী দখল করে তার ধ্বংস সাধন করে। কাযী ইনায়াত আলী সাহেবের ব্যক্তিগত সহকারী মওলভী আব্দুর রহীম ছিলেন শহীদদের মধ্যে অন্যতম। তার সাথে তার সৎ মাকেও স্ব গৃহে শহীদ করা হয়। মোট ১৩২ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এদের সকলকেই মহাজন ওয়ালাবাগান আলেমদের প্রতি ইংরেজদের বিরূপ মনোভাবের কারণে এরপর আর কোন সংগঠন গড়ে উঠতে পারেনি। সরকার তাদেরকে গ্রেফতার করার জন্য সর্বশক্তি নিয়োগ করে। জনসাধারণকে বড় বড় লোভ দেখিয়ে তাদের ধরার জন্য চেষ্টা করা হয়, এমনকি কখনো কখনো শাসকরা তাদের নিকটও পৌঁছে যায়। কিন্তু প্রতিবারই তারা বিস্ময়করভাবে গ্রেফতারের হাত থেকে রক্ষা পান।
হযরত হাজী ইমদাদুল্লাহ সাহেব (রহ) দু’বছর হিন্দুস্তানের বিভিন্ন প্রান্তে আত্মগোপন করে থাকার পর মক্কায় হিজরত করেন। কেবল মাওলানা রশীদ আহমদ গাঙ্গুহি গ্রেফতার হন তিনি ছয় মাস কারা নির্যাতন ভোগ করেন। তারপর সাধারণ ক্ষমার অধীনে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। অন্যান্যদেরকে সরকার আর উত্যক্ত করেনি। কাযী ইনায়েত আলী খান সাহেব তারপরেও অনেকদিন ইংরেজদের সাথে কয়েক দফা সংঘর্ষে লিপ্ত হন। এসব সংঘর্ষের কয়েকটিতে তিনি জয়ীও হন। তাই তার বিরুদ্ধে বিপুল সংখ্যক সেনা নিয়োজিত করা হয় তাকে গ্রেফতার করার জন্য।এক সংঘর্ষে তার বিরুদ্ধে ইংরেজরা প্রায় তিন গুণ বেশী সৈন্য নিয়ে নিয়ে তাঁকে ঘেরাও করে এবং কামানধারী বিশাল ইংরেজ সৈন্যের বহর তাদের সাথে ছিল। ১০ ঘণ্টার যুদ্ধের পর উনার একটা ভুলের কারণে তিনি পরাজিত হন। এরপর হিন্দুস্তানের বিভিন্ন জায়গায় পালিয়ে বেড়ানোর পর তিনি আলোর রাজ্যের তাজারা গ্রামে এক বন্ধুর কাছে চলে যান এবং সেখানে নির্জনে নীরবে জীবন যাপন করেন, এবং সেখানেই মৃত্যুবরণ করেন, উনার মৃত্যুর পর মানুষ জানতে পারে তিনিই ছিলেন থানাভুনের মাশহুর মুজাহিদ কাযী ইনায়াত আলী খান।
ইংরেজদের হামলার পর থানাভুন সম্পূর্ণ বিরান হয়ে পড়েছিলো। এখানকার বাসিন্দারা অন্য এলাকায় বসবাস শুরু করে। মুজাহিদদের থেকে যাদেরকে ক্ষমা করে দেওয়া হয় তাদের নানাভাবে কোণঠাসা করে রাখা হয়। তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়, কাযী সাহেবের ২২ টি গ্রাম বাজেয়াপ্ত করা হয় যা বংশানুক্রমে তাদের জায়গীর ছিলো। গোটা এলাকা দু’বৎসর যাবত অনাবাদী ছিল। রানী ভিক্টোরিয়ার সাধারণ ক্ষমার ঘোষণার পর পুনরায় যখন তা আবাদ হয়, তখনও সেখানে ১৩২ জন শহীদের লাশ গাছে ঝুলন্ত অবস্থায় ছিল। তাদেরকে ইংরেজরা মহাজনওয়ারা বাগানে ফাঁসি দিয়েছিল। তাদের লাশ কোন চিল-শকুন খায়নি, অন্য কোন জন্তু জানোয়ারও স্পর্শ করেনি- এ দৃশ্য দেখে অনেকেই বিস্মিত হয়।থানাভুনে আযাদী যুদ্ধে মোট কতজন শহীদ হয়েছেন, তার সঠিক তথ্যের কোন রেকর্ড পাওয়া যায়নি।তবে অনেকে অনুমান করেছেন , অন্তত এক হাজার মানুষ বাসাবাড়ি স্থানান্তর-কালে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে জীবন দিয়েছেন। থানাভুনের মুক্তিকামী মানুষের ভীতি দীর্ঘকাল ইংরেজদের মনে জাগরূক ছিল। তাই দীর্ঘকাল যাবত তাদেরকে সরকারী চাকুরীতে নেয়া হয়নি। সিপাহী বিপ্লবের কয়েক দশক পরেও তাদের পুলিশ বিভাগে নেওয়া হয় নি। এমনকি বিশ্বযুদ্ধের সময়ও এখানকার কোন লোককে সেনাবাহিনীতে নেওয়া হয় নি।
১৯১৭ সালে মুজাফফর নগরেরে কালেক্টর সি. ম্যুর থানাভুন দেখে বলেছিলেনঃ থানাভুন থেকে এখনো বিদ্রোহের গন্ধ আসে। সরকারের এমন বিদ্বেষমূলক আচরণের কারণে এখানকার জনবসতি আস্তে আস্তে কমে গিয়েছিল। এত বড় জনবসতি হওয়া সত্ত্বেও এখানে সরকার মিডল ক্লাস স্কুল পর্যন্ত স্থাপন করে নি- স্থাপন করেনি, কোন হাসপাতাল কিংবা অন্য কোন প্রতিষ্ঠান, অথচ এরচেয়ে অনেক ছোট জনবসতিতেও এসব প্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হয়ে যাই হোক এরপর শাহ ওয়ালীউল্লাহ ধারার সেই আন্দোলন দীন ও শিক্ষা রক্ষা আন্দোলনে পরিণত হয় এবং আন্দোলনের কর্ণধাররাও রাজনীতি থেকে দূরে থাকবেন বলে ঘোষণা দেন। ফলে প্রতিষ্ঠা করা হয় মাযাহেরুল উলুম ও দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসা। তারপরেও এই আন্দোলন প্রকাশ্যে-অপ্রকাশ্যে চলতে থাকে। ১৯০৭ সাল থেকে ১৯১৪ সাল পর্যন্ত “রেশমী রুমাল আন্দোলন” গোপনে চলতে থাকে। কিন্তু এই আন্দোলন শেষ পর্যায়ে গিয়ে কয়েকজনের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য সফল হতে পারেনি। তখন এ আন্দোলন দ্বারা হিন্দুস্তান আযাদ হয়নি, হতে পারেনি।
থানাভূনের ধ্বংসের কাহিনী
১৮৫৭ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর বাদশাহ বাহাদুর শাহ যাফর গ্রেফতার হয়ে গেলেন। দিল্লী পুরোপুরি ইংরেজের দখলে চলে এলো। বিজয়ী ইংরেজ সেনারা দিল্লীর আশপাশের এলাকাগুলো পুনর্দখল করতে শুরু করলো। কয়েক দিন পরেই সেনাদল এগিয়ে চললো থানাভূনের দিকে। একদিন রাতের অন্ধকারে ইংরেজ সেনাদলের আগমনের খবর শহরের লোকদের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করলো। এখন তো পরাজয় নিশ্চিত ! এরপরও ইংরেজের মোকাবিলার জন্য সবাই প্রস্তুত হয়ে গেলো। থানা শহরের চারদিকে উঁচু দেওয়াল ছিল। তার গেটগুলো বন্ধ করে দেয়া হলো। ইতিপূর্বে যুদ্ধের শুরুতে ইংরেজদের কাছ থেকে একটি তোপ ছিনিয়ে নেয়া হয়েছিল। সেটি বসানো হলো একটি উঁচু স্থানে। ঘটনাক্রমে তোপের প্রথম গোলা যখন নিক্ষেপ করা হলো তা গিয়ে পড়লো শত্রুপক্ষের তোপের ঠিক মুখের ওপর। ইংরেজের একটি তোপ ধ্বংস হলো। জবাবে তাদের দিক থেকে তোপের গোলা নিক্ষিপ্ত হতে থাকলো একের পর এক। তাদের তোপ ছিল সাতটি। আর প্রচুর রাইফেল ও উন্নত পর্যায়ের যুদ্ধাস্ত্র। আর মুসলমানদের ছিল দোনলা বন্দুক আর কয়েকটা গাদা বন্দুক। আর ছিল গ্রামীণ হাতিয়ার অর্থাৎ তীর , ধনুক, সড়কি, বল্লম। কাজেই মোকাবিলা দু’ ঘণ্টার বেশি টিকলো না। সুবহে সাদিকের সময় পূর্ব দিক থেকে থানাভূনের ওপর প্রচণ্ড গোলা বর্ষণ শুরু হলো। নগর প্রাকার ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়া হলো। কেরোসিন ঢেলে দিয়ে বাড়িঘর সব পুড়িয়ে ফেলা হলো। যাকে সামনে পেলো তাকে হত্যা করা হলো। মূল্যবান মালসামান ইংরেজ সৈন্যরা নিজেদের ব্যাগে ভরে নিল। আর বাকি যা ছিল আশপাশের গ্রামের লোকেরা লুটপাট করে নিয়ে গেলো। থানাভূন একটি বিধ্বস্ত নগরীতে পরিণত হলো। কাজী ইনায়েত আলীসহ পূর্বোল্লিখিত চার নেতা কোনক্রমে ধ্বংসস্তুপ থেকে বের হয়ে জীবন রক্ষা করতে পারলেন। ইংরেজের ভাষায় থানাভূনের এই আলেম নেতৃবর্গ ইংরেজের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ক্ষেত্রে এমন কোনো অপরাধ নেই যা করেনি। তাঁরা থানাভূনে শের আলীর বাগানে হামলা করে ইংরেজ সেনাদলকে পরাজিত করে। তাদের কমান্ডারকে হত্যা করে। তোপখানা ছিনিয়ে নেয়। তারপর শামেলীর তহশীলের ওপর আক্রমণ করে সেখানে সেনাবাহিনীকে পরাজিত করে। সরকারি ইমারত ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। সরকারি জিনিসপত্র মালসামান জব্দ করে। সিপাহীদের মারপিট করে। নিজেদের স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠিত করে। বিদ্রোহী বাদশাহর প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে ইত্যাদি ইত্যাদি। মোটকথা এমন কোনো অপরাধ নেই যা এই স্বাধীনতাকামীরা করেনি। তাদেরকে হাতির পদতলে পিষে মারার বা সাগর পাড়ে দেশান্তরের শাস্তি দেবার চাইতে কম এমন কোনো শাস্তি ছিল না যার অধিকারী তারা হয়নি। কিন্তু এই সমস্ত বিদ্রোহাত্মক কর্মকাণ্ড সত্ত্বেও তাদের প্রাণে বেঁচে যাওয়াটা অনেকটা অলৌকিক ব্যাপার মনে হতে পারে। অবশ্য পরে তাঁদের কেউ কেউ গ্রেফতার হয়েছেন। তাঁদের বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। কেউ কারারুদ্ধ হয়েছেন। কেউ দেশান্তরী হয়েছেন। ইতিমধ্যে ১৮৫৮ সালের ১ নভেম্বর মহারাণী ভিক্টোরিয়ার সাধারণ ক্ষমা ঘোষিত হয়। তাঁদের মধ্যে যাঁরা দেশান্তরী হয়েছিলেন তাঁরা দেশে ফিরে আসেন।
ফাঁসিকাষ্ঠে তেরো হাজার আলেম
পলাশী যুদ্ধের একশো বছর পর ১৮৫৭ সালে উপমহাদেশের মুসলমানরা ইংরেজের গোলামী থেকে মুক্ত হবার জন্য তাদের প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করে। সিপাহী বিদ্রোহ ছিল একটি উপলক্ষ মাত্র। আসলে শাহ অলিউল্লাহর নতুন ও বিপ্লবী ব্যবস্থাপত্র অনুযায়ী সমগ্র উপমহাদেশে ইসলামী পুনরুজ্জীবনের যে কার্যক্রম শুরু হয় এবং যাতে নেতৃত্ব দেন তাঁর সুযোগ্য পুত্র শাহ আবদুল আযীয মুহাদ্দিস দেহলবী। তারই সূত্র ধরে সারা ভারতে আলেম সমাজের মধ্যে ইসলামী জ্ঞান চর্চা বৃদ্ধি পায়। ইসলামকে তারা উনিশ শতকের ভারতবর্ষের জাতি-বর্ণ নির্বিশেষ সকল মানুষের জন্য রাজতন্ত্রের পরিবর্তে একটি পরামর্শভিত্তিক যথার্থ সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইনসাফপূর্ণ নিয়ম হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছিলেন। এ উদ্দেশে সাইয়েদ আহমদ শহীদের নেতৃত্বে জিহাদ আন্দোলনও শুরু হয়। কিন্তু ১৮৩৭ সালে বালাকোটের যুদ্ধে সাইয়েদ আহমদ ও তাঁর বিশ্বস্ত অনুচরদের শাহাদত বরণের ফলে এ আন্দোলন একটা বড় রকমের ধাক্কা খাওয়ার পর খতম হয়ে যায় নি; বরং অলিউল্লাহী চিন্তাকেন্দ্র ও আযীযী শিক্ষা কেন্দ্রগুলো থেকে অজস্র আলেম দেশের চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে।
১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ এই আলেমগণের জিহাদী প্রেরণাকে উজ্জীবিত করে। জিহাদ ও সংঘর্ষে ইংরেজের বিরুদ্ধে সর্বত্র তাঁরা জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু সময় তাদের অনুকূল ছিল না। সাত সমুদ্র তের নদী পার হয়ে আসা ইংরেজের কার্যক্রম, শক্তি, জ্ঞানবত্তা ও তাদের পরিচালিত ব্যবস্থা সম্পর্কে উলামায়ে কেরামের আরো গভীর জ্ঞান ও পর্যালোচনার প্রয়োজন ছিল। বলা যায়, শত্রুর ক্ষমতা সম্পর্কে অনেকটা অন্ধকারেই ছিলেন তাঁরা। যার ভয়াবহ পরিণতি ভোগ করতে হয়েছে। অন্যদিকে ইংরেজ তার আসল শত্রুকে ঠিকমতো চিনতে ভুল করেনি। ফলে সারা দেশে প্রায় তেরো হাজার আলেমকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো হয়। এডওয়ার্ড টমাস দিল্লী শহরের হৃদয়বিদারক ঘটনাবলীর বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে লিখেছেন : একমাত্র দিল্লী শহরে পাঁচশো শ্রেষ্ঠ আলেমকে শুলবিদ্ধ করা হয়েছিল। জল্লাদদের বাধ্য করা হতো যাতে তারাবেশি সময় পর্যন্ত লাশ শূলের ওপর টাঙিয়ে রাখে। ময়দানে প্রতিষ্ঠিত শূলদণ্ডগুলো থেকে বারবার লাশ নামানো হচ্ছিল। আর তা দেখে সাম্রাজ্যবাদী শাসক ইংরেজদের কলিজা ঠাণ্ডা হচ্ছিল।
(ঐতিহাসিক এই প্রবন্ধের কোন অংশ কারো লেখার সাথে মিলে যাওয়া স্বাভাবিক।)
তথ্যসূত্র:
১। সাওয়ানেহে কাসেমী ২ য় খণ্ড
২। সাওয়ানেহে উমরী মওলানা মুহাম্মদ কাসেম, লেখক মওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব।
৩। উলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী, ৪য় খণ্ড
৪। সাওয়ানেহে কাসেমী, ২য় খণ্ড
৫। ১৮৫৭-এর মুজাহিদ
৬। মহাবিদ্রোহ।
৭। আবুল হাসান নাদভী, সীরাতে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ।
ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ (পিএইচ.ডি. থিথিস)।
৮। ইসলামী বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ। আই, এইচ কুরেশী।
৯। উপমহাদেশের রাজনীতিতে আলেম সমাজ; (ঢাকা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ : ২০০৫)।
১০। মুহাম্মাদ মিঞা, ওলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী। ড. মুহিব্বুল্ল্যাহ সিদ্দীকী, প্রবন্ধ :
১১। বালাকোটের মর্মান্তিক শিক্ষা : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, এপ্রিল-জুন ২০০৭
১২। চেতনার বালাকোট, শেখ জেবুল আমীন দুলাল
লেখক : আলেম, গবেষক, কবি ও সমাজবিশ্লেষক
আরও পড়ুন
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, শায়খুল হিন্দ ও জমিয়ত (১ম পর্ব)
আমাদের স্বাধীনতার লড়াই, শায়খুল হিন্দ ও জমিয়ত (২য় পর্ব)
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, শায়খুল হিন্দ ও জমিয়ত। (৩য় পর্ব)
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, শায়খুল হিন্দ ও জমিয়ত (৪র্থ পর্ব)
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, শায়খুল হিন্দ ও জমিয়ত (৫ম পর্ব)