হাকীম সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ ::
উপমহাদেশের প্রথম ইসলামিক রাজনৈতিক দল ও ভারতবর্ষের প্রথম স্বাধীনতার ঘোষণাকারী সংগঠন “জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের” প্রতিষ্ঠার পেক্ষাপট ও উলামাদের সরাসরি আলাদা রাজনীতিতে আসার কারণ জানার আগে উপমহাদেশের রাজনীতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাসে আপনাকে চোঁখ ভুলিয়ে নিতে হবে। গত পর্বে আমরা শায়খুল হিন্দের মুক্তি আন্দোলন ও তার রাজনৈতিক তৎপরতা নিয়ে যৎসামান্য আলোচনা করেছিলাম। শায়খুল হিন্দ সশস্ত্র বিপ্লবের দর্শন থেকে জমিয়তের আলেমরা কেন রাজনীতিতে বাঁক ঘুরালেন তা জানতে হলে উপমহাদেশের সর্বসাধারণকে সাথে নিয়ে আলেমদের পূর্বেকার আন্দোলন সংগ্রামের ইতিহাস ও ফলাফল পর্যালোচনা করা অতি প্রয়োজন।
১৮০৫ খৃস্টাব্দে ইংরেজরা দিল্লী শাসক সম্রাট শাহ আলমকে লালকেল্লা, এলাহাবাদ ও গাজীপুরের জায়গীর ছেড়ে দিলেও এগুলোর উপর থেকে তাঁর কর্তৃত্ব ছিনিয়ে নিয়ে উপমহাদেশে মুসলিম শাসন ক্ষমতার শেষ বিন্দুটি পর্যন্ত মুছে দেবার পূর্বেই ইংরেজরা সমগ্র ভারতে নিরঙ্কুশ অধিকার প্রতিষ্ঠা করে নিয়েছিল। ব্রিটিশরা প্রায় দু’শ বছর ভারতবর্ষে শাসন, শোষণ, নির্যাতন ও নিপীড়ন করেছে। বিভিন্ন কৌশলে মুসলমানদের মধ্যে ভাঙ্গন সৃষ্টি করে, মুনাফিকদের সাথে অাঁতাত করে, অর্থলোভী দানবদের যোগসাজশে এ উপমহাদেশে তারা প্রভূত্ব কায়েম করেছিল। পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজ উদ-দৌলাকে হারিয়ে ব্রিটিশরা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মাধ্যমে সামরিক কর্তৃত্ব কায়েম করেছিল। তারপর বক্সারের যুদ্ধে মীর কাশেমকে পরাজিত করে বাংলায় তাদের রাজনৈতিক কর্তৃত্বও কায়েম করে সাধারণ মানুষের উপর নির্যাতন আর নিপীড়নের মাত্রা বাড়াতে থাকে। এতে দিন দিন স্বাধীনতাকামী মানুষের আর্তনাদ বাড়তে থাকে। তখন ইংরেজ শক্তির মোকাবেলায় ভারতবর্ষ ও তার প্রতিবেশী মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর হেফাজত, খেলাফতের রাশেদার আদর্শে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.)। তাঁর সংস্কার আন্দোলনে রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, রাষ্ট্রনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, মৌলিক অধিকার, ধর্ম, জিহাদ ইত্যাদি সবই ছিল। তার এই আন্দোলনের ফলে মানুষ যখন সচেতন হচ্ছিল এবং বিপ্লবের সম্ভাবনা দেখা দিল তখন তৎকালীন দিল্লীর বাদশাহর পদস্থ কর্মকর্তা জ্ঞানান্ধ ‘নজফ ইয়াযদানী’ ক্ষুব্ধ হয়ে তাঁর উপর অমানবিক অত্যাচার শুরু করল এবং তাঁর হাতের কব্জি কেটে ফেলল।
যুগে যুগে নবী রাসূল (সা.) বা আউলিয়ায়ে কেরামগণ যখনই ইক্বামতে দ্বীনের প্রচেষ্টা করেছেন তখনই কোন না কোন আবু জাহেলের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছেন। ভারতবর্ষেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। ১৭৬৩ খ্রিস্টাব্দে শাহ্ ওয়ালী উল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) ইন্তেকাল করলে তাঁর সুযোগ্য ছেলে শাহ আব্দুল আজীজ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) ব্রিটিশ আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেন। তিনি একদিকে ভারতবর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন অপরদিকে সমাজ ও রাষ্ট্রে যে সব শিরক, বিদআত ও কুসংস্কার বাসা বেঁধেছিল তাঁর মুলোৎপাটনের আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। তিনি ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের সর্বস্তরে কুরআন ও সুন্নাহর আদর্শ প্রতিষ্ঠার জন্য এবং ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য ইংরেজদের বিরুদ্ধে জিহাদকে ‘‘ফরজে আইন’’ ফতোয়া দিয়েছিলেন। তাঁর ব্যক্তিত্ব স্বভাব-চরিত্র, দাওয়াত ও তাবলীগের প্রভাব অত্যন্ত সূদূরপ্রসারী ছিল। যে কারণে তার উপর জালেম সরকারের কুদৃষ্টি পড়ে।
শাহ আব্দুল আজীজ মুহাদ্দিসে দেহলভী (রহ.) এর শরীরে তৎকালীন জালেম সরকার বিষাক্ত টিকটিকির প্রলেপ লাগিয়ে দেয় এবং তিনি কুষ্টরোগে আক্রান্ত হন। ১৮২৪ খ্রিস্টাব্দে তাঁর ইন্তেকালের পর তাঁরই প্রধান খলিফা ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অগ্রপথিক শহীদে বালাকোট, আমিরুল মুজাহিদীন হযরত মাওলানা শাহ সায়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) আন্দোলনের নেতৃত্বে আসেন। সারা উপমহাদেশে আলিম ও গায়ের আলিম, সুধীসমাজের মধ্যে এমন কারও প্রকাশ্যে এ ঘোষণা করার সাহস ছিল না যে, বিদেশীর শাসনাধীন ভারত হচ্ছে ‘দারুল হরব’ যেখানে জিহাদ করা প্রতিটি খাঁটি মুসলমানের কর্তব্য। সর্বত্র নৈরাশ্যের ছায়া ঘনীভূত হয়ে এসেছিল। সকল শ্রেণির মুসলমান কিংকর্তব্যবিমঢ় হয়ে পড়েছিলেন। ইংরেজগণ উপমহাদেশে নিজেদের রাজনৈতিক ক্ষমতাকে দৃঢ়তর করার জন্য এবং পাশ্চাত্য শিক্ষা, সভ্যতা, ধ্যান- ধারণা, কৃষ্টি- সংস্কৃতির প্রসার ও এদেশের ঐতিহ্যবাহী শাসক জাতি মুসলমানদেরকে পাশ্চাত্যমুখী করে গড়ে তোলার জন্য গভীর পরিকল্পনায় নিয়োজিত ছিল। মুসলমানদের ঐ সময়টি এক কঠিন পরীক্ষা।
ইংরেজ বিরোধী বিপ্লবী ফতওয়া
ঠিক ঐ সময় শাহ ওয়ালিউল্লাহ আন্দোলনের প্রধান এবং ওয়ালিউল্লাহর তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র শাহ আবদুল আযীয দেহলভী এক বিপ্লবী ফতওয়া প্রচার করে এই হতোদ্যম জাতিকে পথের সন্ধান দেন এবং তাদেরকে ইসলামের জিহাদী প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হবার আহবান জানান। শাহ আবদুল আযীয তাঁর পিতা মহামনীষী ও ইসলামী বিপ্লবের স্বপ্নদ্রষ্টা হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভীর তিরোধানের পর (১৭৬৭ খৃস্টাব্দ) দিল্লীর রহিমিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে ওয়ালিউল্লাহর চিন্তাধারার প্রচার, জনসংগঠন প্রভৃতির মাধ্যমে ‘তারগীবে মুহাম্মদী’ নামে ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলনে নিয়োজিত ছিলেন। এই নির্ভীক মুজাহিদ দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা করলেনঃ
“এখানে অবাধে খৃস্টান অফিসারদের শাসন চলছে আর তাদের শাসন চলার অর্থই হলো তারা দেশরক্ষা, জননিয়ন্ত্রণবিধি, রাজস্ব, খেরাজ, ট্যাক্স-উশর, ব্যবসায়পণ্য, দণ্ডবিধি, মোকদ্দামার বিচার, অপরাধমূলক সাজা প্রভৃতিতে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী। এ সকল ব্যপারে ভারতীয়দের কোনোই অধিকার নেই।
অবশ্য জুমার নামায, ঈদের নামায, গরু জবাই এসব ক্ষেত্রে ইসলামের কতিপয় বিধানে তারা প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করছেন না। কিন্তু এগুলোতো হচ্ছে শাখা-প্রশাখা। যেসব বিষয়ে উল্লেখিত বিয়ষসমূহের এবং স্বাধীনতার মূল(যেমন মানবীয় মৌলিক অধিকার, বাক স্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার) তার প্রত্যেকটিই ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে এবং পদদলিত করা হয়েছে। মসজিদসমুহ ধ্বংস করা হচ্ছে, কি হিন্দু কি মুসলমান পাসপোর্ট পারিমিট ব্যতীত কারও শহরে আগমন-নির্গমনের সুযোগ নেই। সাধারণ প্রবাসী ও ব্যবসায়ীদেরকে শহরে আসা-যাওয়ার অনুমতি দান ও দেশের স্বার্থে কিংবা নাগরিক অধিকারের ভিত্তিতে না দিয়ে নিজেদের স্বার্থে দেওয়া হচ্ছে।
অবশ্য হায়দ্রাবাদ, লাক্ষ্ণৌ ও রামপুরের শাসনকর্তাগণ ইংরেজদের আনুগত্য স্বীকার করে নেওয়ায় সরাসরি খৃস্টান সরকারের আইন সেখানে চালু হয় নি; কিন্তু এতেও গোটা দেশের উপরে দারূল হরবেরই হুকুম বর্তাবে।“ [ফতওয়া- এ আযীযী (ফারসী, পৃষ্ঠা ১৭ মুজতবায়ী প্রেস।) এমনিভাবে তিনি অন্য একটি ফতওয়ার মধ্যেও অবিভক্ত ভারতকে ‘দারুল হরব’ বলে ঘোষণা করেছেন। এই ফতওয়া যে সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়কেন্দ্রিক তাতে কোনোই সন্দেহ নেই। যার সারর্মম দাঁড়ায় এই যে, আইন রচনার যাবতীয় ক্ষমতা খৃস্টানদের হাতে তারা ধর্মীয় মুল্যবোধকে হরণ করেছে। কাজেই প্রতিটি দেশপ্রমিকের কর্তব্য হলো বিদেশি ইংরেজ শক্তির বিরুদ্ধে নানাভাবে সংগ্রাম করা এবং লক্ষ্য অর্জনের আগ পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত রাখা।
ইংরেজ বিরোধী ফতওয়ার প্রভাব
সাধারণ মুসলমানগণ এ যাবত যেখানে ইংরেজদের প্রতাপের সামনে নিজেদেরকে অসহায় মনে করতেন এবং দ্বিধাদ্বন্দে লিপ্ত ছিলেন; এ ফাতওয়া প্রকাশের পর মুসলমানরা কর্মনীতি নির্ধারণের পথ খুঁজে পেলেন। শাহ আবদুল আযীয দেহলভীর আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত কর্মী ও তাঁর বিশিষ্ট ছাত্রবৃন্দর দ্বারা উপমহাদেশের সকল শ্রেণির মুসলমানের নিকট এই বিপ্লবী ফাতওয়ার বাণী প্রচারিত হয়। আর এমনিভাবে মুসলমানদের মনে ক্রমে ক্রমে ইংরেজেদের বিরুদ্ধে জিহাদীভাব জাগ্রত হতে থাকে। পরবর্তীকালে দেখা যায়, তাঁরই শিষ্য সাইয়েদ আহমদ বেরেলভীর নেতৃত্বে এবং তাঁর জামাতা মওলানা আবদুল হাই ও ভ্রাতুষ্পুত্র মওলানা ইসমাইল (শহীদ)_ এর সেনাপতিত্বে (আনু ১৮১৭ খৃষ্টাব্দ) বিরাট মুজাহিদ বাহিনী গঠিত হয়। এই মুজাহিদ বাহিনীর একমাত্র লক্ষ্য ছিল খাঁটি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা এবং তার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী (শিখ ও পরে ইংরেজ) দের বিরুদ্ধে জিহাদ করা। তাঁরা এ উদ্দেশ্য পূর্ব ভারত কিংবা দক্ষিণ অথবা উত্তর পশ্চিম সীমান্তবর্তী অঞ্চলে পেশোয়ার কাশ্মীর এলাকায় নিজেদের কেন্দ্র স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেন। তাঁদের এ আন্দোলনে পূর্বে ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকাসমুহ (কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, মোমেনশাহী, সিলেট প্রভৃতি জেলা) থেকেও মুলমানরা যোগদান করেছিলেন। বাংলাদেশেও বিলুপ সাড়া জাগিয়াছিলো। যার ফলে ১৮২৮ খৃস্টাব্দে ফরিদপুরের হাজী শরীয়ত উল্লাহর নেতৃত্বে ফরায়েজী আন্দোলন নামে এক শাক্তিশালী ইসলামী আন্দোল গড়ে উঠেছিল। প্রায় ঐ সময়ই মুজাহিদ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত বাংলার মাওলানা হাজী তিতুমীর (নেছার আলী) ও তাঁর সঙ্গীরা এখানে বহু স্থানে ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হন। মওলানা হাজী তিতুমীর ছিলেন ‘শহীদে বালাকোট’ সাইয়েদ আহমদ শহীদের একনিষ্ঠ শিষ্য। তিনি ১৮৩১ খৃস্টাব্দে (সাইয়েদ আহমদ বেরেলভী যে সালে বালাকোটে শাহাদাত বরণ করেন ঐ সালেই বাংলাদেশে) ইংরেজদের সঙ্গে সংঘর্ষে শহীদ হন। সাইয়েদ আহমদ শহীদের শিষ্য মওলানা কেরামত আলী জৈনপুরী (রহ) বাংলাদেশে ইসলামী শিক্ষা-সংস্কৃতি ও আদর্শ প্রচারে বিরাট কাজ করেন। তখন ইংরেজরা একদল মোনাফিক আলেমদরদ্বারা ভারতকে দারুল ইসলাম ঘোষণা করায়।
বিশিষ্ট গবেষক সৈয়দ মবনু লিখেছেন- ‘ব্রিটিশরাও থেমে ছিলো না। তারা আলেম সমাজের ছোট- ছোট মতানৈক্যকে সামনে রেখে বড়-বড় যড়যন্ত্র শুরু করে। বিভিন্ন মাস’আলাগত ব্যবধানকে সুকৌশলে সিলসিলাবাজী, ফেরকাবাজীতে রূপান্তরিত করে। এই সব সংঘাতকে দীর্ঘস্থায়ী করার পরিকল্পনায় তারা নিজস্ব খরচে আলেম তৈরি করতে থাকে। এই সময় গোটা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ সরকারের সহযোগিতায় একদল ভন্ড পীরের তৎপরতা শুরু হয়।
সাইয়্যিদ আহমদ (রহ.) এর সময় ভারতের রাজনৈতিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। একদিকে ইংরেজরা সমস্ত ভারত গ্রাস করছে অন্যদিকে মোগলের ধ্বংসাবশেষের উপর গজিয়ে উঠা রাজ্যগুলির পরিচালকগণ নিজেদের আরাম আয়েশ নিয়ে ব্যস্ত। শিখরা পাঞ্জাবে মুসলমানদের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালাচ্ছে। টিপু সুলতান ও হায়দার আলীর প্রতিরোধ ব্যর্থ হল। তখন তিনি তাঁর মুরিদান ও ভক্তবৃন্দকে যুদ্ধ বিদ্যা শিক্ষা দিতে লাগলেন। উদ্দেশ্য জিহাদ করে ভারতে ইসলামী হুকমত কায়েম করবেন। তিনি যেমন আত্মিক জেহাদ করেছেন তেমনি বাহ্যিকভাবে মুসলমানদের নির্যাতনকারী পাঞ্জাবের রাজা রণজিৎ সিংহের বিরুদ্ধে জেহাদ করে ২৪মে জিলক্বদ ১২৪৬ হিজরী ভারতের বালাকোট শহরের নিকটবর্তী যুদ্ধক্ষেত্রে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। ব্রিটিশ বেনিয়ারা এ উপমহাদেশের মানুষের মধ্যে কিভাবে বিভেদ সৃষ্টি করা যায় সব সময় সেই চিন্তায় মগ্ন থাকত। বিশেষ করে মুসলমানদের মধ্যে ফাটল ধরিয়ে তাদেরকে দুর্বল করার জন্য বেশ কিছু গবেষণাকারী এবং ইতিহাস রচনাকারী নিয়োগ করে। WW Hunter (ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার) এর মধ্যে অন্যতম। হান্টার সাইয়্যিদ আহমদ (রহ.)কে ওহাবী, শহীদ তিতুমীরকে গুন্ডা বলে অখ্যায়িত করেছেন। তার প্রণীত ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ পুস্তকে তিনি সাইয়্যিদ আহমদ শহীদ বেরলভী (রহ.) সম্পর্কে লিখেন- পাঞ্জাব সীমান্তে বিদ্রোহী শিবিরের গোড়াপত্তন করে সাইয়্যিদ আহমদ। অর্ধ শতাব্দি আগে আমরা পিন্ডারী শক্তিকে নির্মূল করার ফলে যে কয়েকজন তেজস্বী পুরুষ ভারতের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়েছিল সাইয়্যিদ আহমদ তাদের মধ্যে অন্যতম।
দস্যু বৃত্তি ত্যাগ করে (নাউজুবিল্লাহ) ১৮১৬ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ সে দিল্লিতে চলে যায় মুসলমানী আইনের একজন সুবিখ্যাত পন্ডিত ব্যক্তির নিকট পবিত্র শাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য। তিন বৎসর সেখানে শিক্ষানবিশীর পর সে নিজেই একজন প্রচারক হিসেবে কাজ শুরু করে। ১৮২০ খ্রিস্টাব্দে ধর্মীয় নেতা ধীরে ধীরে দক্ষিণ অভিমূখে অগ্রসর হতে থাকে। আধ্যাত্মিক মর্যাদার স্বীকৃতি স্বরূপ শিষ্যরা এই ভ্রমণকালে তার সেবা-যত্ন করতে থাকে। (দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস, পৃষ্টা-৫) মুসলমানদেরকে বিভ্রান্ত করা এবং খন্ড খন্ড করে দুর্বল করা এটা ইহুদি খ্রিস্টানদের মিশন। এটা তারা পূর্বেও করেছে, বর্তমানে করছে, ভবিষ্যতেও করবে।
তৎকালীন পেশোয়ারের সুলতান মুহাম্মাদ খাতেনের ষড়যন্ত্রে ইসলামী হুকুমতের ক্বাযী, তহসিলদারসহ বহু কর্মচারীর গণহত্যার ঘটনায় সাইয়েদ আহমাদ অত্যন্ত মর্মাহত হন এবং তিনি দ্বিতীয় দফা হিজরত করার মানসে কাশ্মীর অভিমুখে যাত্রা করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ) যে পাঞ্জতার থেকে হাযারা জেলার উচ্চভূমির দিকে গমন করেন, তার উদ্দেশ্য ছিল কাশ্মীরের দিকে অগ্রসর হয়ে সেখানে কেন্দ্র স্থাপন করে উপমহাদেশকে বিধর্মী ও বিদেশীদের জবর দখল হতে মুক্ত করার পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। কাশ্মীরের দিকে অগ্রসর হবার প্রস্তুতি গ্রহণে সবচেয়ে উপযুক্ত স্থান ছিল এই বালাকোট, সেকারণ এখানেই সামরিক ঘাঁটি স্থাপন করা হয়। অবশ্য প্রথম দিকে প্রধান সামরিক ঘাঁটি রাওয়ালপিণ্ডিতে স্থানান্তরিত করা হয়েছিল। সাইয়েদ আহমাদ শহীদ (রহঃ) তাঁর দীর্ঘ চার বছরের পাঞ্জতার ঘাঁটি ছেড়ে কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে যাত্রার সময়টি ছিল ডিসেম্বরের বরফঢাকা শীতকাল। সাইয়্যিদ আহমাদ কাশ্মীরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে যে এলাকাটি ত্যাগ করেছিলেন শিখরা শীঘ্রই সে এলাকাটি দখল করে তথাকার জনগণের ওপর অবর্ণনীয় নির্যাতন করল। এ সময় কাশ্মীর গমনের পথে বিভিন্ন এলাকার খান ও সামন্তগণ যেমন- মুজাফ্ফরাবাদের শাসনকর্তা যবরদস্ত খান, খুড়া অঞ্চলের সামন্ত নাজা খান, দেরাবা অঞ্চলের সামন্ত মানসুর খান ও গাঢ়ী অঞ্চলের সামন্ত হাবীবুল¬াহ খান প্রমুখ সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর নিকট সাহায্য প্রার্থনা করলেন। সাইয়েদ আহমাদ এই আবেদনে সাড়া দিয়ে যবরদস্ত খানের সাহায্যার্থে মৌলবী খায়রুদ্দীন শেরকুটীর নেতৃত্বে একদল মুহাজিদ মুযাফ্ফরবাদে প্রেরণ করলেন। এদিকে শিখ সেনাপতি রনজিৎ সিংহ-এর পুত্র শেরসিংহ বিরাট বাহিনী নিয়ে নখলী নামক স্থানে পৌঁছে যায়। ফলে সাইয়েদ আহমাদ উক্ত বাহিনী কোন দিকে অগ্রসর হয় তার গতিপথ নির্ণয় করে পরবর্তী করণীয় স্থির করাকে সমীচীন মনে করলেন। এ সময় তিনি মূল গন্তব্য কাশ্মীরের দিকে অগ্রসর হওয়ার নিমিত্তে শের সিং-এর বাহিনীর বিরুদ্ধে সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়ে এগিয়ে যেতে পারতেন, কিন্তু তা তিনি করেননি। কারণ হাযারাবেলাতে অবস্থানকারী সাইয়েদ আহমাদ-এর সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে সম্পৃক্ত খানদের শিখ সেনারা অত্যাচারের শিকার বানাত। তাই তিনি তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থা নিশ্চিত না করা পর্যন্ত হাযারাতেই থেকে গেলেন। পরে যখন তিনি শুনতে পেলেন যে, শের সিংহ ভূগাড়মুঙ্গ গিরিপথ আক্রমণ করার পরিকল্পনা করছে, তখন তিনি নিজে রাজদারওয়ান নামক স্থান হতে সারচুল নামক স্থানে পৌঁছান এবং শাহ ইসমাঈল শহীদকে বালাকোট পাঠিয়ে দিলেন। তারপর যখন তিনি জানলেন যে, শের সিং বালাকোট আক্রমন করতে পারে তখন তিনি ভুগাড়মুঙ্গের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে নিজেই বালাকোটে চলে গেলেন। আর সেই সময় শের সিং-এর বাহিনী কুনহার নদীর পূর্ব তীরে অবস্থিত সোহাল নাজাফ খান গ্রামের সম্মুখে ময়দান নামক স্থানে শিবির স্থাপন করে।
ঘটনাপ্রবাহ :
মেটিকোট পাহাড়ের পাদদেশে শিখ বাহিনীর অবস্থানস্থল।একটি বিষয় স্পষ্ট করে দেওয়া আবশ্যক যে,শিখ বাহিনীর অবস্থান থেকে বালাকোটে মুসলিম বাহিনীর উপর আক্রমণ করার দু’টি পথ ছিল। প্রথমত : কুনহার নদীর পূর্ব তীর বরাবর উত্তর দিকে অগ্রসর হওয়ার পর নদী পার হয়ে বালাকোটে পৌঁছনো। দ্বিতীয়ত : ভুগাড়মুঙ্গের গিরিপথের মধ্য দিয়ে বালাকোটে পৌঁছনো। মূলত বালাকোটে পৌঁছনোর জন্য তাদের সোজা কোন পথ ছিল না। কেননা বালাকোটের পূর্ব দিকে কালুখানের উচ্চচূড়া পশ্চিম দিকে মেটিকোট পর্বত শিখর ও উত্তর-দক্ষিণে প্রবাহিত কুনহার নদী। বালাকোট মূলত দক্ষিণমুখী একটি উপত্যকার নাম। কুনহার নদীর উৎসমুখ ছাড়া এখানে প্রবেশের কোন পথ নেই। সঙ্গত কারণেই অনেক কষ্টে মুজাহিদ বাহিনীসহ সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী ১৮৩১ সালে ১৭ এপ্রিল বালাকোটে প্রবেশ করেন। উপমহাদেশের জিহাদ আন্দোলনের পথিকৃৎ, সমরকুশলী, আল্লাহ্র পথের নিবেদিতপ্রাণ বীর সিপাহসালার সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী তাঁর সূক্ষ্ম পরিকল্পনা মাফিক বালাকোটে প্রবেশ করা যায় এমন ধরনের কয়েকটি স্থানে প্রতিরক্ষামূলক সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছিলেন। বলা যায়, রাসূল (ছাঃ) উহুদ যুদ্ধের সময় গিরিপথ বন্ধ করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে যে স্বশস্ত্র সৈন্য মোতায়েন করেন সে পদ্ধতিকেই তিনি অনুসরণ করেছিলেন। কয়েকদিন অতিবাহিত হওয়ায় পর শিখ শিবিরে অগ্রযাত্রার লক্ষণ আঁচ করা গেল। শিখ সৈন্যরা পারাপারের সুবিধার জন্য আগেই নদীর উপর একটি কাঠের সাঁকো নির্মাণ করে রেখেছিল। সেই সাঁকোর উপর দিয়ে নদী পার হয়ে শিখ সৈন্যরা সোহাল নাজাফ খান গ্রামের দক্ষিণ দিক দিয়ে এবং সোহাল গ্রামের পার্বত্যাঞ্চলের পাদদেশে দিয়ে সাইয়েদ আহমাদের মুজাহিদ বাহিনী ঢাকা গ্রামের পশ্চাতে পৌঁছান। আর সেই দিকেই বালাকোটের দক্ষিণাংশে খাড়েয়্যানের কাছে এবং পূর্ব দিকে সাঁকোর কাছে তিনি সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছিলেন। এইভাবে মেটিকোটে ও উহার পাহাড়ী রাস্তায় একেকটি করে সামরিক চৌঁকি বসিয়ে রেখেছিলেন। আর সর্বাগ্রের চৌঁকির নেতা ছিলেন মীর্যা আহমাদ বেগ খান। অকস্মাৎ তার চৌঁকির দিক হতে গুলির শব্দ শোনা গেল। পরক্ষণেই জানা গেল যে, শিখ সৈন্যগণ এদিক দিয়েই বালাকোটের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। মীর্যা আহমাদ বেগ ও তাঁর নেতৃত্বাধীন মুজাহিদ বাহিনী বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে শিখ বাহিনীকে প্রতিরোধ ও গতিরোধ করার চেষ্টা চালালে তাদের একাংশ শাহাদত বরণ করেন এবং বাকী অংশ পশ্চাদপসারণ করতে বাধ্য হন। তারপর মেটিকোটে স্থাপিত চৌকিরত মুজাহিদদেরকে তাদের পথ দিয়ে শিখ বাহিনীর প্রবেশ করার বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হল। এমনকি বালাকোটেও পৌঁছিয়ে দেওয়া হল। তবে শিখ সেনাদের গতিরোধ করা কোনমতেই সম্ভব হল না। বিপুল সংখ্যক সৈন্য মেটিকোটে পৌঁছে গেল। আর মেটিকোট মূলত একটি পাহাড়, যার পাদদেশের সমতল ভূমিই হচ্ছে বালাকোট। বালাকোট অঞ্চলের একটি প্রবাদ আছে যে, মেটিকোট যার অধিকারে আসবে, বালাকোট তাহারই অধিকার আসিবে’। সুতরাং যুদ্ধের জয়-পরাজয়ের বিষয়টি আগেই নির্ধারণ হয়ে গেল। ফলে মুজাহিদদের সংখ্যাল্পতা ও রসদ- সমরাস্ত্রে অপ্রতুলতা সত্ত্বেও সাইয়েদ আহমাদের জন্য বালাকোটের পশ্চিমাংশের অবস্থিত প্রান্তরে শিখদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হওয়া ছাড়া আর কোন গত্যন্তর রইল না। এখানে একটি কথা বলে নেওয়া ভাল যে, এমত পরিস্থিতিতে যদি সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী আপাতত যুদ্ধ এড়াবার জন্য পিছন দিকে চলে যেতেন তাহলে শিখ সৈন্যগণ তাঁর পশ্চাদ্ধাবন করতে পারত না। অথবা তিনি নদী পার হয়ে পূর্ব তীরে পৌঁছেও আক্রমণ করতে পারতেন। আর এ ব্যাপারে যেসব মুসলিম গ্রামবাসী অনিচ্ছা সত্ত্বেও চাপে পড়ে শিখদের পক্ষাবলম্বন করেছিলেন তারাও গোপনে অনুরোধ করেছিল। কিন্তু ইতিহাস যে সাক্ষ্যটি এ যাবৎ বহন করে চলছে তা যে আরশে আযীমের অধিপতির পক্ষ হতে বহুকাল পূর্বেই নির্ণিত হয়ে রয়েছে। সুতরাং সর্বদিক ভেবে তিনি শিখদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে লিপ্ত হবার সিদ্ধান্ত নিলেন। কোনরূপ রণকৌশল নয়; বরং বীরত্ব, সাহসিকতা ও ঈমানী শক্তির যে মূল্যবান সম্পদ মুজাহিদগণের মধ্যে বিদ্যমান ছিল, তাকে সম্বল করেই শিখদের বিপুল সমরশক্তির মুকাবিলা করে যাওয়াকে এবং তার পরিণতিকে আল্ল¬াহ তা‘আলার ইচ্ছার উপর ছেড়ে দেওয়াকেই স্বীয় কর্তব্য বলে গ্রহণ করলেন।
৫ই মে শিখ সৈন্যগণ মেটিকোট পাহাড়ের শিখরে আরোহন করতে সক্ষম হয়েছিল। বিধায় ৬ই মে ১৮৩১ মোতাবেক ২৪ যুলকা’দা ১২৪৬ হিঃ সনে পবিত্র জুম‘আর দিনে সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর মুজাহিদ বাহিনী চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নেন। উল্লে¬খ্য যে, মুজাহিদ বাহিনীতে সর্বমোট যোদ্ধা ছিল ৭০০ জন এবং শিখ সৈন্যদের সংখ্যা ছিল ১০ হাজার। শিখ সৈন্যগণ মেটিকোট টিলা হতে বালাকোট ময়দানে অবতরণ করতে আরম্ভ করল। আর সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী এবং অধিকাংশ মুজাহিদ মসজিদে-ই বালা ও তার আশপাশে অবস্থান করছিলেন। উল্লেখ্য যে, ৭০০ জনের মুজাহিদ বাহিনীকে সাতবানে ঝরনা বরাবর বহুদুর পর্যন্ত শিবির স্থাপন করানো হয়েছিল। সায়্যিদ আহমদ ব্রেলভী হঠাৎ শিখদের আক্রমণ করার জন্য মসজিদ-ই বালা হতে বের হয়ে মসজিদে যেরিনে পৌঁছলেন। অতঃপর তিনি মুজাহিদ বাহিনী নিয়ে মেটিকোটের পাদদেশের দিকে অগ্রসর হলেন। মেটিকোটের পাদদেশে অবতরণরত শিখসেনাদের অধিকাংশ নিহত হল। কিন্তু ইতিমধ্যে মেটিকোটে টিলার প্রতিটি ইঞ্চি পর্যন্ত সৈন্য দ্বারা পূর্ণ হয়েছিল। তারা প্রত্যেক স্থান দিয়ে নেমে এসে মুজাহিদদের উপর প্রচণ্ড হামলা শুরু করে। সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী মুজাহিদ বাহিনীর অগ্রভাগে ছিলেন। তার সাথে ছিলেন একান্ত সহযোগী শাহ ইসমাঈল। হঠাৎ করে সাইয়েদ আহমদ ব্রেলভী মেটিকোটের ঝরনার মধ্যে শাহাদত বরণ করেন এবং শাহ ইসমাঈলও শাহাদত বরণ করলেন। মুজাহিদগণের একটি বড় দল সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর শাহাদত বরণের বিষয়টি উপলব্ধি করতে না পারায় তাঁর সন্ধানে ঘুরে ঘুরে শাহাদত বরণ করলেন। এছাড়া মুজাহিদদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দল বিভিন্ন স্থানে যুদ্ধ করতে করতে শাহাদত বরণ করেন। এই যুদ্ধ স্থায়ী হয়েছিল কমপক্ষে দুই ঘণ্টা। অতঃপর গোজার গোষ্ঠির লোকজন বিভিন্ন দলে উচ্চৈঃস্বরে প্রচার করতে থাকল যে, সাইয়েদ আহমাদকে পাহাড়ের উপরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। সুতরাং তোমরা সকলে পাহাড়ের উপরের দিকে আস। ফলে মুজাহিদগণ উত্তর দিকে অবস্থিত পাহাড়ের দিকে গমন করেন। আর এইভাবে যুদ্ধের সমাপ্তি ঘটল। গোজার গোষ্ঠির লোকদের এরূপ করার কারণ হিসেবে উল্লে¬খ করা যেতে পারে যে, হয় তারা শিখদের প্ররোচনায় তা করেছিল। কেননা মুজাহিদগণ মেটিকোটে যুদ্ধরত থাকলে আরও বহু শিখ যোদ্ধার প্রাণনাশ হত। অথবা অবশিষ্ট মুজাহিদগণকে হিজরতের উদ্দেশ্যে উক্ত কৌশল অবলম্বন করতে হয়েছিল বলে ধারণা করা যায়। মুজাহিদ বাহিনীর আমীর ও প্রধান সেনাপতি সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর শহীদ হওয়া সম্পর্কে অন্য একটি কথা ছড়িয়ে আছে তা হল তিনি মুজাহিদগণের অগ্রভাগে ছিলেন এবং শিখদের একদল সৈন্যের মধ্যে ঢুকে পড়েন। শিখরা তাঁকে ঘেরাও করে ফেলে যা তাঁর অনুসারীরা লক্ষ্য করেননি। এভাবে তিনি শহীদ হন এবং তাঁর লাশও মুজাহিদগণ শনাক্ত করতে পারেননি। এ কারণে অনেককাল পরেও অবশিষ্ট মুজাহিদগণ সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর শাহাদতের বিষয়টি সত্য বলে বিশ্বাস করতে পারেননি। সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর কবর শাহ ইসমাঈল শহীদের কবর একটি বর্ণনা মতে, একজন বন্দী প্রত্যক্ষ করেন যে, তাঁর খণ্ডিত দেহ পাওয়া গিয়েছিল এবং এক নদীর ধারে তাকে কবরস্থ করা হয়েছিল। অনেকেই সেটাকে তাঁর কবর বলে বিশ্বাস করেন। কিন্তু অপর একটি বর্ণনা মতে, তাঁর মস্তক নদীতে নিক্ষেপ করা হয়েছিল এবং তা কয়েক মাইল ভাটিতে পাওয়া গিয়েছিল। অতঃপর সেটি সেখানে কবরস্থ করা হয়। ওদিকে মুজাহিদগণের মধ্য থেকে প্রায় ৩০০ জন শাহাদাত বরণ করেন। আর ৭০০ জন শিখ সৈন্য নিহত হয়। ১০০০ জন শিখ সেনা নিহত হবার কথাও কোন কোন জায়গায় উল্লে¬খ করা হয়েছে। আর অন্য বর্ণনা মতে, ৬০০ মুজাহিদ শহীদ হন। তবে নির্ভরযোগ্য তথ্য হল, সেখানে ৩০০ মুজাহিদ শাহাদাত বরণ করেন আর শিখ সৈন্য নিহত হয় ৭০০ জন। এরপর শিখদের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বালাকোটের ঘর-বাড়ীতে আগুন দিয়ে তাদের নিহত সৈন্যদের লাশ তার মধ্যে নিক্ষেপ পূর্বক পুড়িয়ে ভস্ম করে দেয়। শিখদের উক্ত আগুন লাগানোর ফলে মুসলমানদের অপরিমেয় ক্ষতি সাধিত হয়েছিল। ভস্মীভূত সম্পদের মধ্য হতে উল্লে¬খযোগ্য যা ছিল তা হল সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভী ও শাহ ইসমাইল শহীদের অনেক রচনা, পত্রাবলীর পাণ্ডুলিপি, পুস্তিকা ও বক্তৃতাবলীর অনুলিপি। সমসাময়িক যুগের অনেক আলিম, সুলতান ও বিশিষ্ট প্রভাবশালী ব্যক্তির পত্রাবলীও সেখানে ছিল। এছাড়া সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর সম্পূর্ণ দফতরই বালাকোটে অবস্থিত ছিল। যেখানে রোজনামচাসহ তাঁর জীবন বৃত্তান্ত বর্ণনায় রচিত ‘নূর-ই আহমদী’ গ্রন্থটিও সংরক্ষিত ছিল। ঘটনা প্রবাহের শেষ লগ্নে অবশিষ্ট মুজাহিদগণ পালিয়ে উপত্যকার বিপরীতে রাত্রি যাপন করেন। ধীরে ধীরে তারা সেখানে একত্রিত হন এবং আংগ্রাইতে রাত্রিযাপন করেন। দু’জন গুপ্তচর এসে জানালেন যে, সাইয়েদ জীবিত এবং নিরাপদে আছেন। কিছু দূরে তিনি আছেন। মুজাহিদরা পরবর্তী প্রভাত পর্যন্ত সেখানে অপেক্ষা করলেন। সূর্যদয়ের পর যখন তাঁরা গোজারদের নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছলেন তখন সাইয়েদের কোন অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন না। মুজাহিদরা যখন তাঁদের নেতাকে নিজেদের মধ্যে অবর্তমান দেখলেন তখন তারা শোকাহত হলেও ভেঙ্গে পড়লেন না। আন্দোলনের লক্ষ্য পরিত্যাগের ধারণা তাঁরা তাদের হৃদয়ে স্থান দেননি। এজন্যে তারা সাইয়েদ আহমাদ ব্রেলভীর প্রত্যাবর্তন না করা পর্যন্ত অথবা তারা মৃত্যুর বিষয়ে নিশ্চয়তা লাভ না করা পর্যন্ত দায়িত্বভার আরোপের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন নেতা হিসাবে কুলাতের শাইখ ওয়াদী মুহাম্মাদকে নেতা নির্বাচিত করলেন। এভাবে আন্দোলন অব্যাহত থাকলেও যোগ্য নেতৃত্বের অভাবে উপমহাদেশের প্রথম স্বাধীনতা আন্দোলনটি অচিরেই স্তিমিত হয়ে পড়ে।
পরাজয়ের কারণঃ
মুজাহিদদের সংখ্যাস্বল্পতা ও রসদপত্রের অপ্রতুলতা যুদ্ধে পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসাবে ঐতিহাসিকরা উল্লেখ করলেও পরাজয়ের মুল কারণ ছিল মুসলিম নামধারী মুনাফিকদের বিশ্বাসঘাতকতা। তা ছিল- প্রথমত: যেসব সামন্ত ও খানরা শিখবাহিনীর হাত থেকে তাদেরকে রক্ষার জন্য সাইয়েদ আহমাদকে আহ্বান করেছিল তারা পরবর্তীতে মুসলমানদের সাহায্য না করে গোপনে শিখদের সাথে হাত মিলায়। দ্বিতীয়ত: শিখবাহিনী যখন মেটিকোটে আরোহনের চেষ্টা করছিল তখন সেখানে পাহারায় থাকা মুজাহিদ বাহিনীতে অনুপ্রবেশকারী কিছু মুনাফিক তাদেরকে গোপন পথ বাতলে দেয়। এই চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা না করলে শিখবাহিনী মেটিকোটে প্রবেশ করতে পারত না। তৃতীয়ত: সাইয়েদ আহমাদের সাথে চূড়ান্ত বিশ্বাসঘাতকতা করে হাযারার এক উপজাতীয় প্রধান শিখদেরকে বালাকোটের সাথে সংযুক্ত পাহাড়ের উপরিভাগে উঠার গোপন পথের সন্ধান দেয়।
পরোক্ষ আরো কিছু কারণ ছিল যেমন : ১. উপমহাদেশের মূল ভূখণ্ড বাংলা, বিহার, মধ্যপ্রদেশ প্রভৃতি অঞ্চল থেকে এক থেকে দুই হাজার অনুসারী সৈয়দ সাহেবের সাথে পশ্চিম সীমান্তে যায়। তারা ইসলামি চেতনাসম্পন্ন ছিল। স্থানীয় পাঠানরা তিন লাখ লোক দিয়ে সহায়তা করলেও এরা সরদার বা গোত্রীয় শাসকের দ্বারা প্রভাবিত ছিল। এই সরদার ও শাসকদের অনেককেই শিখ ও ইংরেজ কর্তৃপক্ষ ‘কিনে ফেলে’। ফলে দরিদ্র ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন পাঠান সিপাহিরাও বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে শত্রুর মনস্তাত্ত্বিক লড়াইয়ে।
২. আধুনিক রণকৌশলের প্রশিক্ষণ তেমন ছিল না মুজাহিদ বাহিনীর।
৩. সৈয়দ সাহেব পাঠান নেতা সুলতান মুহাম্মদ খাঁ ও তার ভাইদের বিশ্বাস করে সুলতানকে পেশোয়ারের প্রশাসক বানান। সে বিশ্বাসঘাতকতা করে কয়েক শ’ উঁচুস্তরের মুজাহিদকে এক রাতে শহীদ করেছিল। ফলে পেশোয়ার হাতছাড়া হয়ে যায় সৈয়দ সাহেবের।
৪. কিছু পাঠান জিহাদ করার চেয়ে লুটপাটে বেশি আগ্রহী ছিল।
৫. পাঠানেরা অনেক ক্ষেত্রে শরিয়তি আইনের চেয়ে স্থানীয় কবিলার প্রচলিত আইন পালন করত বেশি। যেমন- গরিব পাঠানেরা মেয়েকে বিয়ে দিত যা অনেকটা মেয়ে বেচার মতো, বলপূর্বক বিয়েও সেখানে ছিল, কেউ কেউ চারের অধিক বিবি রাখত, মৃতের ওয়ারিশানের মধ্যে বিধবাদের বাটোয়ারা করত ইত্যাদি।সৈয়দ আহমদ এগুলো সম্পর্কে শরিয়তের আলোকে ফয়সালা দিলেন, যা পাঠানদের মনঃপূত হলো না। এ দিকে ওশর (ফসলের দশমাংশ) ও জাকাত (শতকরা আড়াই ভাগ) বায়তুলমালে দিতে বলা হলে পাঠানেরা রাজি হলো না। পাঠানেরা কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কমই মানত। সৈয়দ আহমদ সংস্কারমূলক আইনগুলো একসাথে সব বাস্তবায়ন না করে ধীরে ধীরে করলে হয়তো প্রতিক্রিয়া এত উগ্র হতো না।
৬. সৈয়দ সাহেবকে আসলেই মোকাবেলা করতে হয়েছে (যদিও পরোক্ষভাবে) ইউরোপীয়দের, যাদের সূর্য সেই সময় মধ্যগগনে। প্রায় সমগ্র বিশ্বকে তারা কবজা করে ফেলেছিল। সেখানে ছিল স্বার্থপর, কুসংস্কারাচ্ছন্ন ও বিশ্বাসঘাতক সরদার ও তাদের অনুসারীরা।
৭. ফলে এভাবেই ক্ষুদ্র অথচ পর্বতসম ঈমানী শক্তিতে বলীয়ান মুজাহিদ বাহিনীর চূড়ান্ত বিপর্যয় ঘটে।
(ঐতিহাসিক এই প্রবন্ধের কোন অংশ কারো লেখার সাথে মিলে যাওয়া স্বাভাবিক।)
তথ্যসূত্র:
১। সাওয়ানেহে কাসেমী ২ য় খণ্ড
২। সাওয়ানেহে উমরী মওলানা মুহাম্মদ কাসেম, লেখক মওলানা মুহাম্মদ ইয়াকুব।
৩। উলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী, ৪য় খণ্ড
৪। সাওয়ানেহে কাসেমী, ২য় খণ্ড
৫। ১৮৫৭-এর মুজাহিদ
৬। মহাবিদ্রোহ।
৭। আবুল হাসান নাদভী, সীরাতে সাইয়েদ আহমাদ শহীদ।
ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব, আহলেহাদীছ আন্দোলন : উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ দক্ষিণ এশিয়ার প্রেক্ষিতসহ (পিএইচ.ডি. থিথিস)।
৮। ইসলামী বিশ্বকোষ, ইসলামিক ফাউণ্ডেশন বাংলাদেশ। আই, এইচ কুরেশী।
৯। উপমহাদেশের রাজনীতিতে আলেম সমাজ; (ঢাকা, ইসলামিক ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ : ২০০৫)।
১০। মুহাম্মাদ মিঞা, ওলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাযী। ড. মুহিব্বুল্ল্যাহ সিদ্দীকী, প্রবন্ধ :
১১। বালাকোটের মর্মান্তিক শিক্ষা : একটি তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন পত্রিকা, এপ্রিল-জুন ২০০৭
১২। চেতনার বালাকোট, শেখ জেবুল আমীন দুলাল।
আরও পড়ুন
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, শায়খুল হিন্দ ও জমিয়ত (১ম পর্ব)
আমাদের স্বাধীনতার লড়াই, শায়খুল হিন্দ ও জমিয়ত (২য় পর্ব)
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, শায়খুল হিন্দ ও জমিয়ত। (৩য় পর্ব)
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, শায়খুল হিন্দ ও জমিয়ত (৪র্থ পর্ব)