খতিব তাজুল ইসলাম ::
বিভাগীয় রিপোর্টিং পদ্ধতি চালু করুন। নোটের প্রতি অনুৎসাহী করতঃ শিক্ষকদারস্থের পথ সুগম করুন। প্রতিষ্ঠানের প্রতিটি আইন-কানুন, নিয়ম-পদ্ধতি লিপিবদ্ধ করুন এবং নিয়মিত আপডেট করে রাখুন।
হাতেগুনা দু’একটা প্রতিষ্ঠান ছাড়া আমরা যা বলছি, তা অনুধাবনের শক্তি কতটুকু আছে এই সমস্ত কর্তৃপক্ষের, তা আল্লাহ তায়ালাই ভালো জানেন। তবুও আমাদের বলে যেতে হবে। শোনতে শোনতে হয়তো একদিন জানা হয়ে যাবে। আর জানা থেকে মানা, মানা থেকে কার্যকর হওয়া। হয়ত একদিন হয়ে যাবে। হয়ত।
বিভাগীয় রিপোর্টিং পদ্ধতি হলো- একটি প্রতিষ্ঠানে যখন একাধিক ডিপার্টমেন্ট থাকে, তখন সবগুলোকে একটি চেইঞ্জ অব কমান্ডে নিয়ে আসা। বিভাগীয় দায়িত্বশীলগণ সদা সর্বদা মূল কেন্দ্রে নিয়মিত রিপোর্ট পেশ করবেন। যাকে বলে সেন্ট্রান কমান্ড। যার আন্ডারে সকল বিভাগ পরিচালিত হবে। বিভাগীয় দায়ীত্বশীল গণ সেন্ট্রাল কমান্ডে নিয়মিত রিপোর্ট জমা দিবেন। প্রথমে থাকতে হবে ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ। কাজের স্বাধীনতা আর জবাবদিহীতা। ঊর্ধতন কর্তৃপক্ষ যেন অধঃস্থন বিভাগে অহেতুক হস্তক্ষেপ না করে, কিন্তু প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা, নিয়মতান্ত্রিক পরামর্শ আলাদা কথা।
আরেকটু খোলাসা করে বলি, যেমন কোন একটি প্রতিষ্ঠানে মক্তব বিভাগ, হিফজ বিভাগ, মুতাওয়াসিসতা বিভাগ আছে, এই তিন বিভাগে তিনজন বিভাগীয় দায়িত্বশীল থাকবেন। সবার উপরে থাকবেন শিক্ষাসচিব বা নাজিমে তা’লিমাত। বিভাগীয প্রধানগণ নিজ নিজ বিভাগের যাবতীয় কার্যক্রম পর্যায়ক্রমে রিপোর্টিং খাতায় লিপিবদ্ধ করে রাখবেন। সংশ্লিষ্ট শিক্ষকদের সাথে বৈঠক, ছাত্র-শিক্ষকের প্রগ্রেস রিপোর্ট, পরামর্শ, সিদ্ধান্ত, সার্বিক আলোচনা, ছাত্রদের উন্নতি, অবনতি, সমস্যা ও সমাধানের পথসহ সকল বিষয় প্রস্তাব আকারে নোট করে রাখবেন। সিলেবাস টার্গেটে পৌঁছলো কিনা, পরীক্ষার আগাম প্রস্তুতি, মাসিক প্লানসহ সংশ্লিষ্ট সব বিষয় আলোচনা-পর্যালোচনায় নিয়ে আসতে হবে। প্রতি ১৫দিন পর পর বিভাগীয় বৈঠক হবে। প্রয়োজনে এক ঘণ্টার জন্য হলেও প্রতি সপ্তাহে একবার বৈঠকে বসা যায়। কেন্দ্রীয়ভাবে বিভাগীয় দায়িত্বশীলগণ প্রতি মাসে একবার বসা জরুরি। শিক্ষা সংক্রান্ত বা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্ট এই আলোচনায় মুহতামিম বা প্রিন্সিপ্যাল মহুদয় অবশ্যই উপস্থিত থাকবেন, তবে প্রতি তিনমাস অন্তর প্রতিষ্ঠান প্রধান সকল বিভাগের সাথে মিটিং-এ মিলিত হওয়া একান্ত প্রয়োজন।
অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, দ্বীনি মাদরাসা সমূহে বন্ধ-খোলা ও কুরবানি ঈদ এবং বাৎসরিক ওয়াজ মাহফিল নিয়ে যত বৈঠক হয়, তার সিকিভাগ বৈঠক শিক্ষা বিভাগ নিয়ে হয় না। নাজিম সাহেব কিতাব আর রুটিনের ছক আঁকেন, মুহতামিম সাহেব দালান আর বেতনের ফিকিরে দিন গুজরান করেন, অথচ এতোসব আয়োজন যে জিনিসের জন্য, সে বিষয়ে খুব কমই কথা হয়। আলোচনা-পর্যালোচনা এবং গবেষণা নেই বললেই চলে।
নিয়মিত বৈঠকের আরো একটি ফায়দা হলো, হয়তো কোনো কিছু খেয়ালের অভাবে ছাড়া হয়ে গেছে বা আড়ালে চলে গেছে, অথচ তা খুব জরুরি বিষয় ছিলো। তখন আলোচনায় এই ভুলে যাওয়াটাও হয়ত স্মরণ হয়ে যাবে এবং সংশোধনের সুযোগ আসবে। ছোট্ ছোট ভুল ক্রমে হাঙ্গামায় পরিণত হয়, তাই নিয়মিত বৈঠকে ছোট ছোট ক্রুটি কিংবা কোনো প্রকার ভুল বুঝাবুঝি হলে তাও সুরাহার সুযোগ আসবে। কারো মনের দুরত্ব হলে বৈঠকের বরকতে তাও চলে যাবে। খুব ক্ষতিকর মনোমালিন্য থাকলে নিয়মিত বৈঠক হলে কর্তৃপক্ষ অনায়াসে বুঝতে পারবে কোথাও কোন গণ্ডগুল আছে কিনা। তাই নিয়মিত বৈঠকের কোনো বিকল্প নেই।
নোট, শরাহ কিংবা সারসংক্ষেপ আমরা দেখছি স্কুল কলেজ গুলোকে ধংস করে দিয়েছে। কোচিং সেন্টার মানে একেকটি কসাইখানা। ছাত্রদের মেধার অপচয় ঘটানো। ক্লাসের পড়া ক্লাসে শিখা ছিলো চিরাচরিত নিয়ম, কিন্তু অসাধু শিক্ষকরা চালু করলো নোট আর কোচিং ব্যবসা্। ক্লাস হলো ছায়া আর কায়া। প্রাইভেট টিউশনির আধুনিক ফর্মে কোচিং সেন্টারে চলে শিক্ষা চর্চার নাটক। এই অসুস্থতা এখন মাদরাসাতেও ঢুকে পড়েছে। আগে আগে কষ্ট করে কলেও আরবি কিতাব পড়ে অর্থ উদ্ধার করতে হতো, ক্লাসে চলতে তাকরার। এখন সকল কিতাবের বাংলা তরজমা আর নোটের বাহারি সাজ। ছাত্ররা জ্ঞান আহরণ না করে প্রশ্নোত্তর মুখস্থ করে। দশ পনের বছরের প্রশ্ন একত্রে জমা করে উত্তরপত্র ও নোট বইয়ে বাজার সয়লাব। বের হোক তাতে অসুবিধা না, কর্তৃপক্ষের চোখ, কান খোলা থাকা দরাকার যে, এসববেই দ্বারা ছাত্ররা কিছু একটা শিখছে কিনা। ক্লাসের পড়া কেন ক্লাসে শিখা হলো না, এসব দেখা দরকার। যে ভাষায় যে কিতাব, সেই ভাষায় সে কিতাব পড়ানো উচিত। পরীক্ষাও হবে সেভাবে। নিত্যনতুন শিক্ষা পদ্ধতি ও বই বিশ্বে লিখা হচ্ছে, আবিষ্কৃত হচ্ছে, তা এনে সংযোজন করা।
প্রতিটি মজলিসে যা আলোচনা পর্যালোচনা হবে, তা সিদ্ধান্তাকারে লিখে রাখা। আইন সম্পর্কে সংস্লিষ্ট সকলকে অবহিত করা। দেখা গেছে কোন প্রতিষ্ঠানের প্রধান যা বলেন, তাই অঘোষিত আইন। কথনো দেখা যায় তিনি নিজেই তা লংগন করছেন, তখন তোর এসবের বিরোদ্ধে কারো কিছু বলার থাকে না। অনেকে জানেই না যে, কি কি আইন আছে অত্র প্রতিষ্ঠানে। নিত্যনতুন বিষয়ে সময়ের প্রয়োজনে অনেক উদ্যোগ নিতে হয়, তা সকলের জানা উচিত এবং মানাও উচিত। এগুলোকে আইনের বইয়ে লিপিবদ্ধ করে রাখতে হবে। মনে রাখা দরকার, ছোট থেকে বড় কেউই আইনের উর্ধে নয়। সর্বক্ষেত্র আল্লাহ তায়ালাকে ভয় করা উচিত।
লেখক : খতিব ও গবেষক।