শনিবার, ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৩:২৯
Home / অনুসন্ধান / আমাদের স্বাধীনতার লড়াই, শায়খুল হিন্দ ও জমিয়ত (২য় পর্ব)

আমাদের স্বাধীনতার লড়াই, শায়খুল হিন্দ ও জমিয়ত (২য় পর্ব)

12212297_1642716139350019_976124232_nসৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ ::

গতকাল আমার লেখায় ১৮৬৭ সালের বিপর্যায়ে পর দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা ও দেওবন্দের আলেমদের তিনটি স্বাধীনতাকামী সংঘবদ্ধ আন্দোলনে সন্ধান ইতিহাসে পাই। শায়খুল হিন্দের নেতৃত্বে সর্বভারতীয় ‘জমিয়তুল আনসার’  শায়খুল হিন্দ ও শায়খুল ইসলাম মাদনী রাহ. কারাগারে থাকাবস্থায় দুটি আন্দোলন গড়ে উঠে। একটি মাওলানা আলী ভ্রাতৃদ্বয় ও মাওলানা আযাদের খেলাফত আন্দোলন, অপরটি মাওলানা আব্দুল বারী ফিরিঙ্গী মহল্লীর প্রতিষ্ঠিত জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ।

(১) শায়খুল হিন্দ ১৯০৯ সালে দারুল উলূম দেওবন্দের প্রাক্তন ছাত্রদের ডেকে একটি দস্তারবন্দী সম্মেলনের আয়োজন করেন। সিন্ধুর এক বিপ্লবী বুর্জুগ হযরত শায়েখ আবুস সেরাত গোলাম মোহাম্মদ দীনপুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে দেওবন্দের প্রায় ৩০ হাজার প্রাক্তন ছাত্র, কর্মী হিসেবে এই সম্মেলনে যোগদান করেন। (ইসলাম ও আধুনিক চিন্তাধারা, কেনথ ডব্লিউ মরগান, পৃষ্টা ৩৩০)

(২) শায়খুল হিন্দের বৈপ্লবিক দর্শনের বাহিরে তিনি কারাগারে থাকাবস্থায় ১৯১৯ সালে আলেমদের প্রকাশ্যে আরো দুটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম তৈরি হয়ে যায়। প্রথমটি মাওলানা মোহাম্মদ আলী, মাওলানা শওকত আলী ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদ। আধুনিক ধারার ইসলামী নেতাদের নেতৃত্বে বৃটিশ সরকারের ন্যাক্কারজনক বিভিন্ন কমর্কাণ্ডের নিন্দা প্রকাশ করে শক্তিশালী একটি আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৭ অক্টোবর খেলাফত আন্দোলন নামে একটি বৃহৎ মোর্চা যাত্রা শুরু করে। (ইতিহাস পরিক্রমা, একেএম রইস উদ্দিন খান, পৃষ্ঠা-৬১৫)।

(৩) ১৯১৯ সালের ডিসেম্বরের প্রথমদিকে “জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ” নামে নতুন আরেকটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর ভারতের অর্মিত শহরে মাওলানা আবদুল বারী ফিরিঙ্গী মহল্লীর সভাপতিত্বে জমিয়তে হিন্দের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। (উলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাঝি, পৃষ্টা ৭৭, মোহাম্মদ মিয়া)

এখন আমাদের পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন যে, এই তিন সংগঠন কেন হল? শায়খুল হিন্দকে মুক্ত না করে কী উদ্দেশ্যে জমিয়তুল আনসার ভেঙ্গে আরো দুটি স্বাধীনতাকামী সংগঠন তৈরি হল? শায়খুল হিন্দের প্রতিষ্ঠিত জমিয়তুল আনসার, জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ও খেলাফতের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য কি অভিন্ন ছিল? অভিন্ন হলে কেন শায়খুল হিন্দের বিপ্লবে প্রধান বীরসেনানীখ্যাত মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধি তাদের সাথে না এসে জমিয়তুল আনসারে থেকে গেলেন? এই দুটি সংগঠন প্রতিষ্ঠার পরে ও জমিয়তুল আনসার জিইয়ে থাকায় এটা প্রমাণিত হয়েছে শায়খুল হিন্দের রাজনৈতিক দর্শন ও জমিয়তে উলামার স্বাধীনতা নীতিতে অনেক পার্থক্য আছে। বঙ্গবন্ধু আওমীলীগের প্রতিষ্ঠাতা; এটা যেমন ঐতিহাসিক ভুল ধারনা তেমনি ইসলামিস্টদের ঐতিহাসিক ভুল অপপ্রচার শায়খুল হিন্দ ও শায়খুল ইসলাম মাদনী রাহ. জমিয়তে উলামায়ে হিন্দের প্রতিষ্ঠাতা। জমিয়ত উলামায়ে হিন্দ যখন ভারতের নির্জশন শহর অর্মিতে প্রতিষ্ঠা হয়, তখন অন্ধকার কারাগারে তাদের উপর চলছিল নির্যাতনের স্টিমরোলার।

আসুন ইতিহাসের পেছনে তাকাইKOMASISA02। শায়খুল হিন্দের জমিয়তুল আনসারের সশ্রস্ত্র জিহাদের একটি পটভূমি দেখে নেই, যা পরবর্তিতে রেশমী রুমাল আন্দোলন হিসেবে পরিচিতি পায়।বালাকোটের যুদ্ধ থেকে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ পর্যন্ত আন্দোলনগুলো ব্যর্থ হওয়ার পর আলেম সমাজ চাপে পড়েন। কারণ, ইংরেজ সরকার বিদ্রোহ ও গণঅভ্যুত্থানের জন্য প্রধাণত আলেম সমাজকে দায়ী করে। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে নেতৃত্বের জন্য আলেম সমাজকে দায়ী করে রিপোর্ট প্রদান করেন উইলিয়াম লিওর। এরপর শুরু হয় ওলামা নির্যাতনের নির্মম ও দুর্বিষহ অধ্যায়। অর্ধ লক্ষাধিক আলেম-ওলামাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়। কালাপানি, সাইপ্রাস, আন্দামান ও মাল্টায় দ্বীপান্তরে সাজা পান হাজার হাজার আলেম। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত, ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া ছিলো একেবারে সাধারণ ঘটনা। প্রায় সবকটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। সেই সময়ে শুধু দিল্লীর আনাচে-কানাচে চার সহস্রাধিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান চালু ছিল।

ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে স্বাধীনতাকামী আলেম সমাজ আবার সংঘবদ্ধ হবার চেষ্টা করলেন। সে সময় বিভিন্ন সংগঠন-সংস্থারও আত্মপ্রকাশ ঘটল। কেউ কেউ আপোষকামী ধারায় গিয়ে ইংরেজের কাছে দণ্ডমণ্ডু শপে দিলো। কিন্তু আলেম সমাজ ও মুসলমানেরা স্বাধীনতার ব্যাপারে কোন ছাড় দিতে চাইলেন না; বরং তাদের নির্যাতন ক্রমান্বয়ে ব্রিটিশ বিরোধী চাপা ক্ষোভকে আরো বাড়িয়ে দিলো। ইতিমধ্যে ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল শুরু হয়ে যায়। ব্রিটিশ সৈন্যরা অন্যায়ভাবে দুটি তুর্কী জাহাজ আটক করে বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষীত রচনা করতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করে। এর প্রতিক্রিয়া হলো দুনিয়াজুড়ে। বিশ্ব বিভক্ত হয়ে পড়লো দুটি শিবিরে। ভারত শাসক ব্রিটিশ তাদের মিত্রপক্ষ, আর প্রতিপক্ষে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরী, তুরস্ক। জার্মানিতে অধ্যয়নরত কিছু ভারতীয় ছাত্র এবং স্বাধীনতাপ্রিয় কিছু বুদ্ধিজীবি এই সুযোগে মিত্রপক্ষের প্রতিপক্ষে ব্রিটিশ বিরোধী ভূমিকা পালন করতে সুযোগ খুঁজলো। কিছু ভারতীয়, তুর্কী ও জার্মানি মিলে ভারতের ব্রিটিশ শক্তিকে আঘাত হানার পরিকল্পনা গ্রহণ করলো। এ পরিকল্পনা সফল করার জন্য আফগানিস্তানের সহায়তা জরুরী ছিল। অপরদিকে আফগান তথা কাবুলে বৃটিশপন্থী দুর্বল সরকার প্রতিষ্ঠা ছিলো। তুরস্ক থেকে সৈন্যবাহী জাহাজ ভারতে এসে ব্রিটিশ আক্রমণের জন্য আফগানের করিডোর ব্যাবহার করার কোন বিকল্প ছিল না, তাই ক’জন স্বাধীনতাকামী ভারতীয়, তুর্কী ও জার্মান উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কাবুল সফর করে তুর্কী বাহিনীর আক্রমণ ও বৃটিশ বিরোধী ভূমিকায় কাবুল সরকারকে উদ্বুদ্ধ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। এই সময় শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান রাহ. এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত বিপ্লবী সংগঠন ‘জমিয়তে আনসারের’ বৈঠকে পূর্ব নির্ধারিত দিনে একটি অভ্যুত্থান ঘটানো, তুর্কী ও আফগান সরকারের সাথে প্রত্যক্ষ আলাপ-আলোচনার জন্য শায়খুল হিন্দের উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। প্রবাসে তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। ব্রিটিশ সরকারও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। নেতৃবৃন্দের উপর নজরদারী বাড়িয়ে দেয়। মাওলানা জওহর, আজাদ ও শওকত আলী প্রমুখ ততদিনে গ্রেফতার হয়ে যান। গ্রেফতারের তালিকায় ছিলেন শায়খুল হিন্দ ও উবায়দুল্লাহ সিন্ধী রাহ. প্রমুখ। শায়খুল হিন্দ হযরত সিন্ধিকে কাবুলের পথে পাঠালেন। নিজে গ্রেফতার এড়িয়ে হিজাজের পথে রওয়ানা হবার সিদ্ধান্ত নিলেন। (শাহ ওয়ালী উল্লাহর রাজনৈতিক চিন্তাধারা, উবায়দুল্লাহ সিন্ধী)

হযরত উবাইদুল্লাহ সিন্ধীকে কাবুল পাঠানোর অনেক কারণ ছিলো । প্রধান কারণ ছিল তিনিটি। প্রথমতঃ গ্রেফতারী এড়ানো।

দ্বিতীয়তঃ কাবুল সরকারের সহযোগিতা নিশ্চিত করা।

তৃতীয়তঃ আফগান সীমান্ত জুড়ে দুর্ধর্ষ স্বাধীনতা কামী মুক্তিপ্রিয় জাতিগুলোকে সংগঠিত করে ভারতের আযাদীর সংগ্রামের কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করা।

শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদ হাসান রাহ. হিজাজের পথে তুরস্ক পৌঁছা জরুরী ভাবলেন দু’টি কারণে;

তুরস্ক কর্তৃক ভারত অভিযানের চুক্তি চূড়ান্ত করা এবং পুরো পরিকল্পনাটি সমন্বয় করে ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ভারতে ইংরেজ বিরোধী স্বাধীনতা উদ্ধারের অভ্যুত্থান সফল করা।

অপরদিকে শাখুলহিন্দ জমিয়তুল আনসারকে একটি সশ্রস্ত্র আন্তর্জাতিক সংগঠনের রূপ দিয়েছিলেন। সে লক্ষ্যে তিনি ভারতের অস্থায়ী সরকার ও সেনাবাহিনীর আদলে বেসামরিক বাহিনীও তৈরি করেন। ‘‘অস্থায়ী ভারত সরকাররের” পক্ষ থেকে রাশিয়ায় একটি প্রতিনিধি দল পাঠানো হয়েছিল। একজন হিন্দু ও একজন মুহাজির মুসলিম ছাত্র এই দলের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন। তারা রাশিয়া থেকে আফগানিস্তানের জন্য ভাল খবর নিয়ে এসেছে। এখন রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত আফগানিস্তানে আসবে। রাশিয়া ইংরেজদের প্রতি রুষ্ট। ইরান, কনস্টট্যান্টিনোপল ও বার্লিনেও একটি প্রতিনিধিদল পাঠানো হয়েছে। তাতেও আমাদের দু’জন মুহাজির ছাত্র অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। এখন একটি প্রতিনিধিদল চীন ও জাপানে যাওয়ার জন্য তৈরি হচ্ছে। হিন্দুস্তানে প্রথম প্রতিনিধিদল পৌঁছে গেছে। তারা সফলকাম হয় নি। এবার দ্বিতীয় প্রতিনিধিদল যাচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যে বার্লিনে আরো একটি প্রতিনিধিদল যাবে। জাপান দূতাবাসের সাথে আমার উচ্চ পর্যায়ের সম্পর্ক রয়েছে। এর ফলে ইসলামী স্বার্থ উদ্ধারের প্রচেষ্টা পুরোপুরি চালানো সম্ভব হবে। এই ‘অস্থায়ী ভারত সরকার’ এর প্রধান হচ্ছেন রাজা মহেন্দর প্রতাপ, মওলবী বরকতুল্লাহ ভূপালী প্রধানমন্ত্রী এবং আমি হিন্দুস্তান সংক্রান্ত বিষয়ের মন্ত্রীর পদে নিযুক্ত রয়েছি। ওয়াসসালাম ….. উবাইদুল্লাহ।’’

হিন্দুস্তানে ইংরেজের সাথে যুদ্ধ করার সেনাদল তৈরি করে তার নাম দেয় ‘জুনুদে রব্বানিয়াহ।’ নিম্নোক্ত নেতৃবর্গ ছিলেন এ সেনাদলের প্রথম সারিতে-
প্রধান পৃষ্ঠপোষক : তুরস্কের সুলতান, ইরানের সুলতান আহমদ শাহ কাচার, আফগানিস্তানের বাদশাহ আমীর হাবিবুল্লাহ খান।
সহকারী পৃষ্ঠপোষক : আনোয়ার পাশা, তুরস্কের যুবরাজ, তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী, শরীফে মক্কা, আফগানিস্তানের সহকারী রাষ্ট্রপ্রধান সরদার নসরুল্লাহ খান, হায়দরাবাদের নিজাম, ভূপালের নওয়াব, রামপুরের নওয়াব, বাওয়ালপুরের নিজাম, ইয়াগিস্তানের মুজাহিদ দলের প্রধান।1857-2
প্রধান সেনাপতি : শায়খুল হিন্দু মওলানা মাহমুদ হাসান এবং সহকারী সেনাপতি : মওলানা উবাইদুল্লাহ সিন্ধী।
বিভাগীয় সেনাপতিবৃন্দ : মওলানা আবদুর রহীম, মওলানা গোলাম মুহাম্মাদ দীনপুরী, মওলানা তাজ মাহমুদ আনরুজ, মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী, মওলবী হামদুল্লাহ, হাজী তরঙ্গ যই, ডা. মুখতার আহমদ আনসারী, মুল্লা সাহেব বাবড়া, জান সাহেব বাজোড়, মওলবী মুহাম্মাদ মিয়া, হাকিম আবদুর রাজ্জাক, মওলবী উবাইদুল্লাহ গাজীপুর, মওলবী আবদুল বারী ফিরিঙ্গী মহল্লী, মাওলানা আবুল কালাম আযাদ, মওলানা মুহাম্মদ আলী জওহর, মওলানা শওকত আলী, মওলানা জাফর আলী খান, মওলানা হাসরাত মোহানী, মওলবী আবদুল কাদের কাসুরী ও পীর আসাদুল্লাহ শাহ সিন্ধী।

রেশমী রুমাল আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী নেতৃবর্গের সংখ্যা দুশো’ বাইশের মতো। সাধারণ লোকেরাও এর মধ্যে ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ থেকে শুরু করে সিন্ধু, পাঞ্জাব, দিল্লী, অযোধ্যা পর্যন্ত এর প্রভাব বিস্তার লাভ করতে শুরু করেছিল। শায়খুল হিন্দের রাজনৈতিক দর্শন ছিল একমাত্র সশস্ত্র জিহাদের মাধ্যমে ভারতের স্বাধীনতা লাভ। (মাসিক পৃথিবী, এপ্রিল ১৯৮৬। কাবুল মে সাত সাল, মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধী। রাওলাট কমিটি রিপোর্ট, লাহোর, কাশমীর প্রেস, ১৯২৮, পৃষ্টা ২২৬) 

১৯১৫ সালের ১৫ আগস্ট সিন্ধী সাথীদের নিয়ে কাবুলে পৌঁছেন এবং বাদশার সাথে সাক্ষাৎ করেন। এসব সফরের খবর সংশ্লিষ্টরা ছাড়া অন্য কেউ জানতো না। বাদশা সিন্ধীর কথায় সন্তুষ্ট হন এবং কাবুলে ভারতের স্বাধীনতার স্বপক্ষে কাজ করার অনুমতি দেন। তুর্কি-জার্মান মিশনের সাথেও পরিচয় করিয়ে দিয়ে সমন্বিত কাজ করার পরামর্শ দেন।

হযরত সিন্ধী কাবুল পৌঁছে অসংখ্য স্বাধীনতাকামী ভারতীয়কে দেখতে পান। তিনি একটি ‘অস্থায়ী ভারত সরকার’ প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা খুঁজে পান। তুর্কি-জার্মান মিশনের সমন্বয়কারী প্রতিনিধি রাজা মহেন্দ্র প্রতাপকে এই সরকারের প্রেসিডেন্ট, বরকতুল্লাহকে প্রধানমন্ত্রী, হযরত সিন্ধী প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন। এই সরকারে তুর্কী-জার্মানরাও ছিলো। ভারতীয়দের প্রাধান্য, হিন্দু প্রাধান্য, জার্মান পরিকল্পনা প্রভৃতি নানা বিষয়ে অস্থায়ী সরকারের ভেতর জটিলতা সৃষ্টি হয়। অসাধারণ যোগ্যতা বলে হযরত সিন্ধী অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এসব জটিলতা দূর করতে সক্ষম হন। কার্যত, এক সময় মাওলানা সিন্ধীই হয়ে ওঠেন অস্থায়ী সরকারের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা।

১৮ সেপ্টেম্বর নাগাদ শায়খুল হিন্দ বোম্বাই-জিদ্দা হয়ে অক্টোবরে মক্কা পৌঁছান। হিজাজ তথা মক্কা-মদিনা ছিলো তুর্কি খিলাফতের অংশ। মক্কায় শায়খুল হিন্দ হিজাজের গভর্নরের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি যুদ্ধমন্ত্রী আনোয়ার পাশার সাথে সাক্ষাতের প্রয়োজন অনুভব করেন। হিজাজের গভর্নর গালিব পাশা মদিনার গভর্নর বসরী পাশার নামে একটি চিঠি লিখে শায়খুল হিন্দকে আনোয়ার পাশার সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানান।এসময় হিজাজের গভর্নর গালিব পাশার প্রচুর ধর্মীয় প্রভাব ছিলো। গালিব পাশা শায়খুল হিন্দের মহৎ উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত হয়ে আরো দুটি চিঠি লেখেন। একটি ছিলো ভারতবর্ষ ও তার অঞ্চল ঘেঁষে আফগান গোত্রপতি মুসলমানদের প্রতি। এতে সমাজবাদী ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের আহ্বান ছিলো। ইতিহাসে এই চিঠিকে ‘গালিবনামা’ নামে আখ্যায়িত করা হয়। অপর চিঠির বিষয় ছিলো আফগান সরকারের প্রতি শায়খুল হিন্দের প্রস্তাব ও পরিকল্পনা মত আফগান ভূখণ্ড দিয়ে তুর্কী সৈন্য চলাচলের অনুরোধ অস্থায়ী ভারত সরকারের প্রতি। তুর্কী সরকারের স্বীকৃতি ও অনুমোদনের কথা চিঠিতে এই নিশ্চয়তাও ছিলো যে, তুর্কী বাহিনী কোনভাবেই আফগানিস্তানের কোন অংশে হস্তক্ষেপ করবে না। এটাকে ‘গালিব চুক্তিনামা’ বলা হয়। শায়খুল হিন্দ মদিনায় পৌঁছে জানতে পারেন যে, আনোয়ার পাশা রওজা মোবারক জিয়ারতে আসছেন, তাই তাকে তুরস্কে যেতে হবে না। মদিনায় বসেই সাক্ষাৎ করা সম্ভব হবে। কার্যত হলোও তাই। আনোয়ার পাশার পক্ষ থেকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রকার সহায়তার আশ্বাস দিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।

আনোয়ার পাশা 06শায়খুল হিন্দকে তিনিটি চিঠি লিখে দিলেন। এর একটি অস্থায়ী ভারত সরকার ও তুর্কী সরকারের মধ্যকার চুক্তিনামা। দ্বিতীয়টি মুসলিম নেতৃবৃন্দের কাছে শায়খুল হিন্দকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আহ্বান। তৃতীয় পত্রটি ছিলো আফগান সরকারে প্রতি। এর বিষয়বস্তু ছিলো আফগান সরকারের সম্মতিতে তুর্কী বাহিনীর ভারত অভিযানের কথা। সিদ্ধান্ত ছিলো আফগান সরকার সম্মত থাকলে তুর্কী বাহিনী আফগান সীমান্তে অবস্থান নেবে। ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯১৭ সালে তারা ভারত প্রবেশ করবে এবং ভারতের ভেতর গণঅভ্যুত্থান ঘটাবে। আফগান সরকার কর্তৃক অনুমোদিত চিঠিটি মদিনায় অবস্থানরত শায়খুল হিন্দের মাধ্যমে তুর্কি সরকারের হাতে পৌঁছবে, সেই মোতাবেক তুর্কি সরকার কর্তৃক প্রদত্ত যুদ্ধের নির্দেশনামাটি ১৯১৭ সালের ১লা জানুয়ারির মধ্যে কাবুল সদর দপ্তরে পৌঁছানো হবে। সবকিছু ঠিকঠাক হলে তুর্কি বাহিনী আফগানিস্তান হয়ে ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯১৭ সালে ভারতে অভিযান শুরু করবে। এই সময়ে শায়খুল হিন্দ আফগানিস্তানে অবস্থান করে সামগ্রিক নির্দেশনা দেবেন। যথারীতি সিদ্ধান্ত মোতাবেক হিজাজ থেকে প্রদত্ত পত্রটি কাবুলে অবস্থিত অস্থায়ী ভারত সরকারকে পৌঁছানো হলো। উবায়দুল্লাহ সিন্ধীর নেতৃত্বে এই চিঠি নিয়ে আফগান বাদশাহ হাবিবুল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি পররাষ্ট্র বিষয়ে চাপের কথা তুলে সম্মতি দানে দ্বিধাগ্রস্ত রইলেন। অবশ্য বাদশাহর অন্যান্য মিত্র এবং জনগণ ভারতের অস্থায়ী সরকারের প্রতি আন্তরিক ছিলেন। শেষ পর্যন্ত চুক্তি হলো, আফগান সরকার নিরপেক্ষ থাকবে, তবে তুর্কী বাহিনী আফগান সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করবে। কোন আফগানী ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধ যেতে চাইলে আফগান সরকার আপত্তি তুলবে না। তবে ইংরেজদের কৈফিয়ত দেবে এই বলে যে, সীমান্তে উপজাতিদের বিদ্রোহে বেসামাল হয়ে তারা তুর্কী বাহিনী ঠেকাতে পারেনি। পরিস্থিতি আফগান সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিলো। (উবায়দুল্লাহ সিন্ধীর  জীবন ও কর্ম, ড. মোহাম্মদ আব্দুল্লাহ, ইসলামিক ফাউন্ডেশন,। তাযকিরায়ে শায়খুল হিন্দ, মুফতি আজিজুর রহমান বিজনৌরী, দারুত তালীফ, ভারত।)

ইংরেজ গোয়েন্দা ও শত্রু বাহিনীর কড়া পাহারায়ও তথ্য ফাঁস হবার ভীতি থেকে মাওলানা সিন্ধী ও আমীর নসরুল্লাহ খান চুক্তির বিষয় ও তারিখ দক্ষ কারিগর দিয়ে একটি রেশমি রুমালে সুতার সাহায্যে আরবী ভাষায় লিখে নিলেন। শত্রুর চোখ ও তল্লাশি নির্বিঘ্ন করার জন্য এই অভিনব ব্যবস্থা গ্রহণ করে একজন নিষ্ঠাবান ভক্তকে দিয়ে মক্কায় শায়খুল হিন্দ বরাবর পাঠাবার ব্যবস্থা করা হলো। অনেকগুলো হাত বদল হয়ে রুমালটি শেখ আব্দুর রহিম এর হাতে পৌঁছে। তিনি হজ্জে গিয়ে রুমালটি শায়খুল হিন্দের হাতে দেয়ার কথা। এদিকে আমীর হাবিবুল্লাহ খান বিরাট আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে তথ্যটি ইংরেজ সরকারের কাছে ফাঁস করে দেয়। ব্রিটিশ গোয়েন্দা পুলিশ আব্দুর রহিমের বাড়ী তল্লাশি করে রুমালটি উদ্ধার করে ফেলে। আব্দুর রহিম আত্মগোপন করে পালিয়ে যান। কথিত আছে, এই আত্মগোপন থেকে আমৃত্যু তিনি কখনো লোক সমাজে ফিরে আসেন নি। এমনিতেই ইংরেজ সরকার ও গোয়েন্দারা বেখবর ছিলো না। তার উপর আলেম-উলামাসহ মুসলিম নেতারা ছিলেন সন্দেহের তালিকার শীর্ষে। রেশমী রুমাল ইংরেজ সরকারের হাতে পড়ার পর নির্যাতন-গ্রেফতারী পরোয়ানার মাত্রা হাজার গুণ বেড়ে যায়।

আন্দোলনের প্রধান নেতা শায়খুল হিন্দ তার প্রিয় ছাত্র হোসাইন আহমদ মাদানীসহ হিজাজে গ্রেফতার হন এবং তাদেরকে মাল্টায় নির্বাসন দেওয়া হয়। আর উবাইদুল্লাহ সিন্ধীকে অনেকগুলো বছর নানা দেশে দেশে ঘুরে বেড়াতে হয় মুসাফিরের মত। আরেকটি বিশ্বাসঘাতকতার ফলে স্বাধীনতার পথটি আরো পিচ্ছিল হয়ে পড়ে। আরো তিনটি দশক নির্যাতন-নিপীড়নের খুনরাঙ্গা পথ পাড়ি দিয়ে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে।

(সুত্র : সফর নামায়ে আসসীরে মাল্টা, শায়খুল ইসলাম সৈয়দ হুসাইন আহমদ মাদানী।
সররগুজশতে মুজাহিদ, গোলাম রসুল, কিতাব মঞ্জিল, লাহোর।
তাহরিকে রেশমী রুমাল, মাওলানা আব্দুর রহমান, ক্লাসিক, লোহার। ঐ)

 লেখক : বহু গ্রন্থ প্রণেতা ও কবি-গবেষক

আরও পড়ুন

প্রথম পর্ব :: আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম, শায়খুল হিন্দ ও জমিয়ত

কৈফিয়ত : কেন জমিয়তিদের নেতা নির্বাচিত হওয়ার পর হাসিমুখে ফুলের মালা গলায় দেওয়ার নিন্দা করলাম? সৈয়দ মবনু।

About Abul Kalam Azad

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...