আমাদের স্বাধীনতার প্রথম যুদ্ধ ১৮৫৭ সালে সিপাহী জনতা বিপ্লব (সিপাহী বিপ্লব বা মহাবিপ্লব) নানান ষড়যন্তে বিপর্যস্ত হওয়ার পর ভারতের মানুষের দুর্দিনে আটারশত সাতান্নর স্বাধীনতা সংগ্রমী কয়েকজন মনীষী মাওলানা কাসিম নানুতবী, মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গোহী, মাওলানা ইয়াকুব নানুতবী, মাওলানা জুলফিকার আলী, (শায়খুল হিন্দের আব্বা), হাজী আবিদ হুসাইন, মাওলানা শাহ রফি উদ্দীন, এই ছয় মহানায়ক ১৮৬৬ সালের ৩০শে সেপ্টম্বর বৃহস্পতিপার ভারতের উত্তর প্রদেশের দেওবন্দে দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠা করেন। দেওবন্দের প্রথম শিক্ষক মোল্লা মাহমুদ ও প্রথম ছাত্র মাহমুদ হাসান।
ইংরেজ ইতিহাসবিদ কেনেথ ডবলিউ মরগান সম্পাদিত ইসলাম ও আধুনিক চিন্তাধারা গ্রন্থের ৩২৫ পৃষ্টার পাকিস্তান ও ভারত অধ্যায়ে লিখেছেন, “শাহ ওলিউল্লাহর ঐতিহ্য পুনরুজ্জীবিত করার ও ইসলামী আযাদীর নয়া আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য দেওবন্দের বিখ্যাত ধর্মীয় শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে দেওবন্দ ছিল নয়া আযাদী আন্দোলনের জন্য সৈন্য সংগ্রহের কেন্দ্র। শিক্ষাদান ছিল সেখানকার গৌণ কর্মসূচি।
এতে বুঝা যায় দেওবন্দ থেকে একটি স্বাধীনতার লড়াইয়ের ভিতরগত প্রস্তুতি চলছিল। ফলে দেওবন্দের একেক ছাত্র স্বাধীনতা আন্দোলনের অতন্দ্রপ্রহরী হয়ে উপমহাদেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়েছিলেন।
শিক্ষা সমাপ্ত করে মাত্র ২২ বছর বয়েসে ১৮৭৩ সালে মাওলানা মাহমুদ হাসান (শায়খুল হিন্দ) দারুল উলুম দেওবন্দের সহকারী অধ্যাপকরূপে শিক্ষকতা শুরু করেন। ২৯ বছর বয়সে দেওবন্দের অধ্যক্ষের দায়িত্বে সমাসীন হন দারুল উলূম দেওবন্দে শিক্ষকতার ৫ বছরের মাথায়। শায়খুল হিন্দ হজরত মাওলানা মাহমুদ হাসান দেওবন্দি তাঁর প্রজ্ঞা ও নিরলস কর্মতৎপরতার ছোঁয়ায় উলামায়ে হকের মৃতপ্রায় বিপ্লব ও রাজনৈতিক জিহাদী অঙ্গন পুনরায় সরগরম হয়ে ওঠে ৷জাতীয় চেতনাকে শাণিত করে স্বাধীনতা আন্দোলনকে বেগবানের জন্য তিনি কর্মজীবনের শুরু থেকেই নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
হুজ্জাতুল ইসলাম হজরত মাওলানা কাসেম নানুতুবী (রহঃ) এর অভিষ্ট লক্ষ্য ও মহৎ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে হজরত শায়খুল হিন্দ ১৮৭৮ সালে দারুল উলূমের সাবেক ছাত্রদেরকে নিয়ে ‘সামারাতুত তারবিয়্যাহ’ নামে সাংগঠনিক প্রক্রিয়া শুরু করেছিলেন। তার ছাত্র-শিষ্যদের অন্যতম শায়খুল ইসলাম মাওলানা হুসাইন আহমদ মাদানী, হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানভী, মাওলানা শাব্বির আহমদ উসমানী, হযরতজী মাওলানা ইলিয়াস কান্ধালবী, মাওলানা ইবায়দুল্লাহ সিন্ধি, মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মুফতি কেফায়তুল্লাহ’ র মতো বিশ্ববিখ্যাত মনীষীরা ছিলেন শায়খুল হিন্দের হাতেগড়া ছাত্র।
আটারশত সাতান্ন সালের মহাবিপ্লবের শামেলী রানাঙ্গনে দুই সিপাহশালার মাওলানা রশিদ আহমদ গাঙ্গোহী ও মাওলানা কাশেম নানুতবীর বিপ্লবী ও আধ্যাত্মিক চিন্তাধারার উত্তারাধিকার লাভ করেছিলেন হয়রত শায়খুল হিন্দ মাহমুদ হাসান। এরই প্রেক্ষাপটে বৃট্টিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে যখন কথা বলার মতো যখন কোনো সংগঠন ছিল না, তখন শায়খুল হিন্দ ১৯০৯ সালে দারুল উলুম দেওবন্দের প্রাক্তন ছাত্রদের ডেকে একটি দস্তারবন্দী সম্মেলেনর আযোজন করেন। সিন্ধির এক বিপ্লবী বুজুর্গ হযরত শায়েখ আবুস সিরাত গোলাম মোহাম্মদ দীনপুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সম্মেলনে দেওবন্দের প্রায় ৩০ হাজর প্রাক্তন ছাত্র, কর্মী হিসেবে এই সম্মেলনে যোগদান করেন। এই সম্মেলনেই তিনি এদেরকে নিয়ে ‘জমিয়তুল আনসার’ প্রতিষ্ঠা করেন। এবং সেখানে সবাই শায়খুল হিন্দের হাতে প্রথম বায়াতে জিহাদ ও স্বাধীনতার শপত নেন। ইতিহাসখ্যাত রেশমী রুমাল আন্দোলন, খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন, বিপ্লবী সেনাবাহিনী গঠন ও গোপনে স্বাধীন সরকার গঠন ছিল সেই প্রচেষ্টারই একেকটি বহিঃপ্রকাশ মাত্র। (বিস্তারিত পরবর্তী পর্বে) তৎকালীন সময়ে নেতৃস্থানীয় চিন্তাবিদ মাওলানা আবুল কালাম আযাদ, মাওলানা মোহাম্মদ আলী জওহর, ডা মুখতার আনসারী, নবাব ফখরুল মুল্লুক প্রমুখ বিপ্লবী মনীষীরা জমিয়তুল আনসারে যোগদান করেন। শায়খুল হিন্দের বৈপ্লবিক আর্দশেরর প্রধান সেনানী মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধিকে এর সেক্রেটারি করা হয়।
এসব গোপন বৈপ্লবিক কার্যক্রম ও আন্তর্জাতিক কুটনৈতিক তৎপরতার এক পর্যায়ে শায়খুল হিন্দ ও মাওলানা মাদানী রাহ বৃটিশ সরকারের হাতে গ্রেপ্তার হন। মাল্টার কারাগারে থাকাবস্থায় তারা যখন নির্মম, নিষ্টুর নির্যাতনে শিকার হন (তাদের গ্রেপ্তার ও জেলকাহিনী পরবর্তী পর্বে) তখন তাদের জেলে রেখেই শায়খুল হিন্দের বৈপ্লবিক দর্শনের বাইরে ১৯১৯ সালে আলেমদের প্রকাশ্যে আরো দুটি রাজনৈতিক প্লাটফর্ম তৈরি হয়ে যায়। প্রথমটি মওলানা মোহাম্মদ আলী, মওলানা শওকত আলী ও মাওলানা আবুল কালাম আজাদ ও আধুনিক ধারার ইসলামী নেতাদের নেতৃত্বে বৃটিশ সরকারের ন্যাক্কারজনক নানান কমর্কাণ্ডের নিন্দা করে শক্তিশালী একটি আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ১৭ অক্টোবর খেলাফত আন্দোলন নামে একটি বৃহৎ মোর্চা যাত্রা শুরু করে। একে ফজলুল হক এবং মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলমাবাদীর নেতৃত্বে বাংলায় খেলাফত আন্দোলন গড়ে ওঠে। ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দের ১৪ নভেম্বর খেলাফত বৈঠকের প্রথম অধিবেশন দিল্লীতে অনুষ্ঠিত হয়। (ইতিহাস পরিক্রমা, একেএম রইস উদ্দিন খান, পৃষ্ঠা-৬১৫)।
খেলাফত আন্দোলনের পাশাপাশি শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। কলকাতায় কংগ্রেসের বিশেষ অধিবেশনে ৪ সেপ্টেম্বর ১৯২০ মহাত্মা গান্ধী ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের প্রস্তাব করেন।সভায় সর্বস্মতিক্রমে প্রস্তাব গৃহীত হয়। খেলাফত ও অসহযোগের যুগপৎ আন্দোলন দুর্বার গতিলাভ করে এবং ইংরেজ শাসকের ভীত কাঁপিয়ে তোলে।
খেলাফত আন্দোলন প্রতিষ্ঠার মাত্র ১৫/১৬ দিন পরেই আরো কিছু তরুণ আলেমদের নেতৃত্বে ১৯১৯ সালের ডিসেম্বরের প্রথমদিকে “জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ” নামে নতুন আরেকটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা হয়। ১৯১৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর ভারতের অর্মিত শহরে মাওলানা আবদুল বারী ফিরিঙ্গী মহল্লীর সভাপতিত্বে জমিয়তে হিন্দের প্রথম অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। আর শায়খুল হিন্দের দর্শন ও চেতনার মহানায়ক মাওলানা উবায়দুল্লাহ সিন্ধিসহ বড় একটি বৈপ্লবিক আলেমদের কাফেলা ঐ দুই প্লাটর্ফমের বাইরে শায়খুল হিন্দের মুক্তি ও বিপ্লবী আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন।
ব্যক্ত করা আব্যশক যে, তৎকালীন ভারতবর্ষের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্য জমিয়তে উলামায়ে হিন্দই প্রথম ভারতবর্ষের পূর্ণ স্বাধীনতার প্রস্তাব পেশ করে। (চলবে…)
তথ্যসুত্র :
মুসলিম মনীষা, সৈয়দ আব্দুল্লাহ।
উলামা হিন্দ কা শানদার মাঝি, মোহাম্মদ মিয়া।
ইসলাম ও আধুনিক চিন্তাধারা, কেনেথ ডব্লিউ মরগান।