জাগৃতি প্রকাশনীর কর্ণধার ফয়সাল আরেফিন দীপনকে নির্মমভাবে হত্যার পর এক আবেগময়ী স্ট্যাটাসে বিশিষ্ট লেখক, বুদ্ধিজীবী ও সমাজ চিন্তক ফরহাদ মজহার লিখেছেন, আমরা দেশকে বিভক্ত করে দিয়েছি। আমরা দুই পক্ষেই আমাদের সন্তানদের হারাতে থাকব। আমরা কাঁদতে ভুলে যাব। নিজ নিজ সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়ে গোরস্থানের দিকে যাব, আর সন্তানের রক্তে আমাদের শরীর ভিজে যাবে।
তার সেই স্ট্যাটাসটি তুলে ধরা হলো:
দীপন আমাকে এক হিসাবে জোর করেই ‘ডিজিটাল ফ্যাসিবাদ’ বইটি তৈরি করিয়ে নিয়েছিল। বলেছিল, আপনার কিছু বই আমাকে দিতেই হবে। ও ছিল আহমদ ছফা ও আমার প্রিয় বন্ধুদের একজন আবুল কাশেম ফজলুল হকের ছেলে।
দীপনের চেহারা আমাদের মতো বাম রাজনীতি করে আসা পুরানা আর রুক্ষ বাবা-কাকাদের মতো ছিল না। স্নেহ জাগানিয়া মুখ, লজ্জিত ভাবে হাসত। দুই একবার যতোটুকু কথা বলেছি মনে হয় নি মগজ কোন খোপে বন্ধক দিয়ে দীপন মুক্তবুদ্ধিওয়ালা হয়ে গিয়েছে। চিন্তা করতে চাইত সব দিক থেকেই। ওকে প্রথম দিন থেকেই আমার ভাল লেগেছিল।
বইটি ২০১১ সালের শেষের দিকে তৈরি করে দিয়েছিলাম। ও পরের বছর ফেব্রুয়ারিতে বের করেছিল।
জাক দেরিদার ওপর আমার লেখাগুলো জোগাড় করে বললো এটা গুছিয়ে দিন, আমি প্রচ্ছদ বানিয়ে প্রচার করে দিয়েছি। আমার মাথায় তখন ‘ভাবান্দোলন’ চেপে বসা। দেরিদার সঙ্গে হুসালের তর্ক পাশ্চাত্য চিন্তার জায়গা থেকে যতোটা বুদ্ধিদীপ্ত তার চেয়েও বাংলার ভাবচর্চার জায়গা থেকে আরও দুর্দান্ত। ভাবলাম, নতুন করে পুরাটা বাংলাভাষার ভাবচর্চার ক্ষেত্র থেকে লিখব। এমনভাবে লিখব যাতে ফকির লালন শাহের ভাষা ও শরীরের সম্পর্ক বিচার কিম্বা নদিয়ার সাধকদের ‘গুরু’ ধারণা ভাষার বহু অর্থ বোধকতাকে কিভাবে মোকাবিলা করে তা নিয়ে লিখি।
এতে দেরিদা প্রাসঙ্গিক হবে। বিদেশি দার্শনিকদের নিয়ে আঁতেলি ভাল লাগে না। কিন্তু লেখা সহজে এগুলো না। কারণ যা লিখতে চাই তা সহজ বিষয় নয়। লিখছিলাম আস্তে আস্তে দীপনকে আর দেওয়া হোল না। ও বইয়ের জন্য তাড়া দিতে আবার যখন গত বছর এলো, আমি বুঝিয়ে বলায় খুব খুশি। এ বছর তাকে যেভাবেই হোক শেষ করব বলে কথা দিয়েছিলাম। গুছিয়ে এনেছি।
কিন্তু ফয়সাল আরেফিন দীপন আর নাই।
গতকাল সন্ধ্যায় জাগৃতি প্রকাশনার দীপন সহ শুদ্ধস্বরের আহমেদুর রশীদ টুটুল ও অন্য দুই লেখক সুদীপ কুমার বর্মন ও তারেক রহিমের খবর পেয়ে পাথর হয়ে আছি।
দীপনের বাবা আবুল কাশেম ফজলুল হক বলেছেন, ‘আমি কোনো বিচার চাই না। আমি চাই শুভবুদ্ধির উদয় হোক। যাঁরা ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ নিয়ে রাজনীতি করছেন, যাঁরা রাষ্ট্রধর্ম নিয়ে রাজনীতি করছেন উভয় পক্ষ দেশের সর্বনাশ করছেন। উভয় পক্ষের শুভ বুদ্ধির উদয় হোক। এটুকুই আমার কামনা। জেল-ফাঁসি দিয়ে কী হবে।’
অবিশ্বাস্য শোক মাথায় নিয়ে আবুল কাশেম ফজলুল হক এই কথাটা স্পষ্ট ভাবে বলতে পেরেছেন।
আমরা দেশকে বিভক্ত করে দিয়েছি। আমরা দুই পক্ষেই আমাদের সন্তানদের হারাতে থাকব। আমরা কাঁদতে ভুলে যাব। নিজ নিজ সন্তানের লাশ কাঁধে নিয়ে গোরস্থানের দিকে যাব, আর সন্তানের রক্তে আমাদের শরীর ভিজে যাবে।
কে বুদ্ধি প্রতিবন্ধী সেকুলার মুক্তবুদ্ধিওয়ালা আর কে ধর্মান্ধ বা ইসলামি জঙ্গী গোরস্থান তার বিচার করে না। শুধু কবরের ওপর ঘাস গজায়, আর একদা ঐতিহাসিকরা গবেষণা করতে বসে কিভাবে একটি জাতি তাদের বেয়াকুবির জন্য ধ্বংস হয়ে গেলো।
যেহেতু আমরা মৃত্যু নিয়ে ভাবতে অভ্যস্ত নই, তাই জীবনের কোন মূল্য আমরা দিতে জানি না। আমি দেখছি, বিভক্ত ও দ্বিখণ্ডিত বাংলাদেশে দুই দিক থেকে দুটো মিছিল গোরস্থানের দিকে যাচ্ছে। দীপন, আমি প্রাণপণ এই বিভক্তি ঠেকাতে চেষ্টা করেছি। এই ভয়াবহ বিভাজনের পরিণতি সম্পর্কে আমি জানপরান সবাইকে হুঁশিয়ার করার চেষ্টা করেছি। চেষ্টা করে যাব।। কিন্তু তাতে কি যারা চলে গিয়েছে ফিরে আসবে?
কেউই প্রত্যাবর্তন করে না।
এই লাশের ভার অনেক ভারি, বাংলাদেশ বহন করতে পারবে কি? সেই দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতার চর্চা আমরা করি না যা আমাদের গোরস্থানের দিকে নয়, সপ্রতিভ জীবনের দিকে নিয়ে যায়।