বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ৯:২৩
Home / প্রতিদিন / ইসলামী ফিকহের নবসম্পাদন : প্রেক্ষিত একুশশতক (শেষ পর্ব)

ইসলামী ফিকহের নবসম্পাদন : প্রেক্ষিত একুশশতক (শেষ পর্ব)

মুসা আল হাফিজমুসা আল হাফিজ ::

জীবন যখন ইসলামের আওতায়: এ কারণে দেখা যায়, ইসলামী শরীয়তের আওতায় যখন জীবন প্রবেশ করলো, জীবন সার্বিক বিকাশের পথ পেলো। সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা যখন জীবনের প্রাণশক্তিকে ত্বরান্বিত করে তখন মানবতার বাগানে বসন্তের বাতাস বয়ে যায়, আর আইন-কানুন যখন স্বভাবগত স্বাভাবিকতার সাথে একাত্মবোধে মনুষত্যের বিকাশ কামনা করে, তখন মানবীয় সম্ভাবনা ও প্রতিভার প্রতিটি পাতা পল্লব ফুলে ফলে সুশোভিত হয়ে উঠে। ইসলামী শরীয়তের শাসনে মানুষের মানবিক উৎকর্ষ উন্নততর পর্যায়ে উপনীত হলো। মানব প্রকৃতি যেন সুপ্ত সকল সুন্দরের বাতায়ন খুলে দিলো। আর মানুষের মহিমা যেন আত্মবিকাশের অনুভবের সিক্ততায় প্রশান্তি উদযাপন করছিলো। যে পৃথিবী ছিল জমাট এক গ্রহ, নানা পুরান অপবিশ্বাস ও কুসংস্কারের আবিলতায় আকীর্ণ, মানুষের মেধা ছিল অবিকশিত, আর সকল সম্ভাবনা নিয়ে সময় যেন ঘুমিয়ে পড়েছিল আদিম নর্দমায়- তখনই অবতীর্ণ ওহীর আলোকমালা ইসলামী শরীয়তের উদ্ভাসনে একটি অভিঘাত তৈরী করলো। সেটা ছিল প্রবল এক প্রকম্পন, যা সব নিস্তরঙ্গতাকে কাঁপিয়ে দিলো। ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো সবকিছুকে করে রাখা বহুত্ববাদের শিকল। যে মানুষ সৃষ্টির চতুর্দিকে স্বীয় প্রভূদের প্রত্যক্ষ করতো, ইসলামী শরীয়ত তাকে বললো, গোটা সৃষ্টি তোমার দাসানুদাস, সবকিছু জয় করো। হৃদয়ের দরজা খুলো এবং চিন্তার দিগন্ত উন্মোচন করো। আল্লাহর আয়াত ছড়িয়ে আছে আকাশ পৃথিবীর প্রতিটি কণায়, প্রাণী, পদার্থে, হাওয়ায়, সমুদ্রে, মাটির তলায়। এই হলো এক তীব্রবোধ, প্রখর মনন, চিন্তারমুক্তি ও বিজ্ঞানচেতনার নবজন্মের কাহিনী। ইসলামী ফিকহের ছায়ার নিচে জেগে উঠে ঘুমন্ত চেতনা ও অনুসন্ধিৎসা, যার জাদুময় ছোয়ায় জীবন্ত হয়ে উঠে আজকের বহু উচ্চারিত, মহিমান্বিত নাম- আধুনিক বিজ্ঞান।

ইসলামী ফিকহ যখন সমুদ্র অতিক্রম করে স্পেনের বাতাসে ছড়িয়ে পড়লো, তার ঢেউ ক্রমশ- ‘অজ্ঞতা ও আদিমতার মহাঅরণ্য’ (রবার্ট ব্রিফল্ট) ইউরোপে আলোর আগমনী জানিয়ে দিলো। ইউরোপ পেলো জ্ঞান বিজ্ঞানের ছোয়া এবং জেগে উঠলো সহস্র বছরের ঘুম থেকে। সেই জাগরণই মানুষকে পথ দেখালো চন্দ্র জয়ের, নবনব আবিস্কারের, আকাশ-পৃথিবীর রহস্য মন্থনের। বহুত্ববাদ ও পৌরাণিক বিশ্বাস প্রকৃতিকে মানুষের শ্রদ্ধার ‘বেদিতে’ বসিয়ে রেখেছিলো, যার ফলে মুক্ত বিশ্লেষণ ও অধিকার প্রয়াসের প্রক্রিয়া থেকে মানুষ দূরে রইল। ইসলামী ফিকাহ এলো মুক্ত বিশ্লেষণের কাড়ানাকাড়া বাজিয়ে। ইসলামী ফিকাহের জগতে প্রবেশের পূর্ব প্রস্তুতি হলো মনের দরজা জানালা খুলে দেয়া। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি তথা প্রকৃতির মুক্ত বিশ্লেষণ ও তার উপর অধিকার প্রতিষ্ঠার প্রক্রিয়ায় নবনব উদ্ভাসন- তা মূলত ইসলামী ফিকহের মেজাজের সাথে অধিকতর সঙ্গতিশীল।

ইসলামী ফিকহ মানেই ভারসাম্যপূর্ণ চিন্তা, ভিত্তিহীন মনগড়া মূলনীতির ইৎসাদন এবং ঔজ্জল্য উৎকর্ষ ও প্রমাণসিদ্ধ প্রক্রিয়ায় সত্যে উপনীত হওয়া। প্রগতির সমার্থক সেই প্রক্রিয়া, তা এমনই যে, যার স্রোতধারায় চিন্তানীতি এবং কর্মনীতি সমান্তরালভাবে প্রবাহিত। এর পাশাপাশি ইসলামের মূলপ্রয়োগস্থল যেহেতু মানুষ এবং মনুষত্বের মর্যাদাকে সর্বোত্তম উপায়ে উচ্চকিত করেছে। মানুষের দেহের বিকাশ ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছে। আত্মার পবিত্রতা ও সৌকর্য বিধানে বিধিব্যবস্থা নিশ্চিত করেছে। প্রাণ ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান করেছে। এ জন্য প্রয়োজনে কঠোর আইনের ধারস্থ করেছে। হত্যার বদলে হত্যা, চুরিতে হাতকাটা, নিষিদ্ধ যৌনাচারে রজম ও হদ (তবে সবগুলোই কঠিন শর্ত ও ব্যাপক পথ- পরিক্রমার সূত্রে আবদ্ধ)। আবার অন্যদিকে শরয়ী জ্ঞান অর্জন বাধ্যতামূলক। চরিত্রি গঠনে সর্বাত্মক তৎপরতা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও সাম্য, সম্পদের ইনসাফভিত্তিক বণ্টন, মানবাধিকারের প্রতিষ্ঠা, বৈষম্যের অপনোদন, ‘আমরবিল মা’রুফ’ ও ‘নাহি আনিল মুনকারের’ মাধ্যমে অপরাধের উৎসকে বন্ধ করেছে। তাকওয়াভিত্তিক মন ও সালাতভিত্তিক জীবন গঠনের কর্মসূচির মাধ্যমে ব্যক্তির হৃদয়ে বলিষ্টতা দিয়েছে সেই শক্তিকে, অপরাধ প্রবণতার বিরুদ্ধে যা মনোজগতে দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলে।

জীবনের চালক: ইসলামী ফিকাহ বরাবরই মধ্যপন্থার ধারক। যেহেতু কুরআন-হাদীসই তার সারাসার, অতএব ইসলামী সত্যের তাবৎ সৌন্দর্য নিয়ে সে জীবনের সমুদ্রে ফিতরাত নামক জাহাজের নাবিক। এখানে প্রান্তিকতা নেই, নেই বাড়াবাড়ি। ঘূর্ণিমত্ব তুফানের ভেতর নেই অযথা আত্মধ্বংশ, আবার নেই গতিহীনতা। ইফরাত নেই, তাফরীতও নেই। কষ্ট সাধ্য দুটি বিষয়ের মধ্যখানে এই ফিকাহ সম্ভবের দুয়ার ধরে দাঁড়িয়ে। যে দূরত্ব অনতিক্রম্য, ইসলামী ফিকাহ সেটা মানুষের সন্নিকটে এনে দেয়। সমকালীন ও জ্বলন্ত উদাহরণ হিসেবে দ্রব্যের মূল্যনির্ধারণ ব্যবস্থাকে পেশ করা যায়। ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা বাজারের লাগামকে তুলে দিয়েছে পুঁজিপতির হাতে। ফলে বেনিয়াদের আকাঙ্খার পারদ উঠা-নামার সাথে দ্রব্যমূল্যের জোয়ার ভাটা হয়।

ধনতন্ত্রী সাধারণত আত্মকেন্দ্রিক, ফলে তার স্বার্থের চুল্লিতে সবসময় আগুন জ্বলে। অতএব ব্যবসায়িক স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে দ্রব্যের যে মূল্য নির্ধারণ করবে, সে মূল্যের উত্তাপে দরিদ্র মানুষের ক্ষুধার্ত উদর পুড়ে যেতে বাধ্য। কিন্তু কার উদর পুড়লো, আর কার উদর তিমির মতো ফুলে উঠলো, তাতে পুঁজিবাদ দৃষ্টিপাত করবে না । সে সবাইকে বলেছে পেটটা তিমির মতো বানিয়ে নাও। কিন্তু সুযোগ দিয়েছে কেবল পুঁজিপতিকে। তাই বলে যারা পারলোনা, পুঁজিবাদের কাছে তাদের নালিশ করার কিছু নেই। এটা হলো পুঁজিবাদের জুচ্চুরি। কিন্তু সমাজতন্ত্র এ রকম নয়। সে সরাসরি লুটেরা। সে বলবে বাজার ব্যবস্থা সরকারের এখতিয়ারের একটি অংশ। সরকার যখন যে দাম বলবে, সেটাই দ্রব্যের উপযুক্ত দাম। এতে উৎপাদনকারীর স্বার্থ যদি মারা যায়, তার জীবনযাত্রা যদি পথকলির মতো পথের পাশে নিঃশব্দদশায় উপনীত হয়- তাতে কিছুই যায় আসে না।

আবার যদি নির্ধারিত মূল্য জনগণের ছোট ছোট হাত নাগাল না পায়- তাতেও কিছুই করার নেই। সরকার যা করেছেন, অলংঘনীয়। কিন্তু ইসলাম মূল্যনির্ধারণ ব্যবস্থাকে বাজার পরিস্থিতির উপর ছেড়ে দিয়েছে, উৎপাদক যাতে না ঠকে, ক্রেতাও যাতে শোষিত না হয়। বাজার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রিত হবে ক্রেতা-বিক্রেতার যৌথ সঙ্গতির ভিত্তিতে। অযাচিত দালালি, মজুদদারী, প্রতারণা ইত্যাদিকে ইসলাম কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। উপার্জনের অবৈধ সবপন্থার লাগাম টেনে ধরেছে। অসৎ ব্যবসায়ীর মূল্যবৃদ্ধির কোন সুযোগ নেই। সিন্ডিকেট বলতে কোন কিছু নেই। দ্রব্যমূল্যের ক্ষেত্রে স্বার্থচরিতার্থকারীদের জন্য কঠোর আইনের প্রয়োগ সুনিশ্চিত। ফলে ইসলামে বাজার নিয়ন্ত্রণহীন হয়না। সাধারণ মানুষের জীবনকে দূর্বিষহ করে তুলে না। পৃথিবীতে এক বিপ্লব হলো, ইসলামী আইনকে গৃহবন্দী করা হলো: ইউরোপ জাগলো ইসলামের স্পর্শে। কর্ডোভা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিখানো কুরআনের শানেনুযূল সূত্র ও আয়াতের ক্রমানুক্রমিক প্রক্রিায়াকে আত্মস্থ করে বেকননামায় দার্শনিকদ্বয় ইউরোপে প্রচার করলেন প্রয়োগবাদ। প্রয়োগবাদই হলো পাশ্চাত্য সভ্যতার প্রকৃত দার্শনিক ভিত্তি। জাগৃতির টনিক। প্রয়োগবাদের পথ ধরে বিভিন্ন সভ্যতা থেকে জীবনোপকরণ তারা নিয়েছে। ইসলাম থেকে নিয়েছে বিপুলভাবে, সবচেয়ে বেশি। কিন্তু তাদের আইনাদর্শের বুনিয়াদ ছিল রোমান ল এম্পায়ার।

রোমান আইন প্রণীত হয় মানুষের প্রবৃত্তি ও অভ্যাসের উপর ভিত্তি করে, যার ফলে উন্নত চরিত্র বিধান করার কোন আকাঙ্খা এই আইনে গুরুত্ব পায়নি এবং এই লক্ষ্যের সাথে তার কোন যুগসূত্রও ছিলনা। রোমান আইনের দৃষ্টিভঙ্গির উপর নতুন রূপরেখায় গড়ে তুলা হলো ইউরোপীয় আইন। এই আইনের অবস্থাও তথৈবচ। ফরাসী বিপ্লবের পর ইউরোপে পরিবর্তনের স্রোত বইতে থাকে। সেই স্রোত যখন ইউরোপীয় আইনের উপর দিয়ে বয়ে গেল, দেখা গেলো শান্তি ও নিরাপত্তাবিষয়ক মূলনীতিগুলো ছাড়া ইউরোপীয় আইনে ধর্মীয়, মানবিক গুণাবলী, চারিত্রিক বিধিবিধানের যতটুকুই বা ছিটে ফোটা অবশিষ্ট ছিল – স্রোতের তীব্রটানে সব নিরুদ্দেশ হয়ে গেছে। সে আইন ইশ্বরের প্রাপ্যকে পরজগতে নির্বাসিত করলো, ইশ্বরের বিধি- নিষেধকে একান্ত ব্যক্তিগত ইচ্ছার হাতে তুলে দিলো। আর জীবনের মাঠে ইশ্বর বানিয়ে দিলো স্বার্থপ্রবণতা, প্রবৃত্তি ও আত্মকেন্দ্রিকতাকে। ভোগবাদের বুনোমোষের লাগাম খুলে দিলো । ফলে পাশববৃত্তি আর বেহায়াপনার দৌরাত্মে জীবনের মানচিত্র থরথর করে কাঁপতে লাগলো। প্রবৃত্তির চাহিদা যেহেতু আইনের অন্যতম মানদণ্ড, অতএব ব্যভিচারের বৈধতার সনদ পেলো, এখন পেতে যাচ্ছে পশুর সাথে মানুষের সহবাস। এই চরম অধ:পতনের পাশাপাশি ইউরোপীয় সভ্যতা পৃথিবীকে দিলো বস্তুগত উন্নয়ন ও বিস্ময়কর গতিশীলতা। নতুন নতুন জীবনোপকরণ আবিস্কৃত হতে লাগলো। জীবনোপকরণের মান চাঁদের দেশের উচ্চতা স্পর্শ করলো। সাবেকী জীবনযাত্রা পৃথিবীতে অচল হয়ে গেলো।

যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে পৃথিবী উঠে এলো মানুষের হাতের মুঠোয়। রাজনীতি, অর্থনীতি, আইন আদালত, শিল্প-প্রযুক্তি, সমাজ-সভ্যতা, নকুন নতুন উদ্ভাবন, বিকাশ, অভূতপূর্ব প্রাণবন্যা ও বহুবিস্তারী রূপরেখায় বিস্ময়কর নতুনত্ব লাভ করলো। প্রতিদিন নতুন নতুন বিষয়াবলী মানুষের সামনে আসতে লাগলো এবং বিদ্যমান ব্যবস্থার অবসান ঘোষণা করে নবতর ব্যবস্থা এসে পুরাতনের স্থান অধিকার করতে লাগলো। এর ধারাবহিকতা শিল্পবিপ্লবের পর থেকে সেই যে শুরু হলো, তা আর পিছনের দিকে তাকায়নি। কেবলই অভিনব গতি মাত্রা লাভ করেছে। কিন্তু নতুনের এই প্লাবন যেহেতু এমন এক প্রেক্ষাপটে শুরু হয়, যখন ইসলামের সত্যিকার অনুসরণ ত্যাগ করে অকর্মন্য জীবনযাপন, ভোগ-বিলাসে নিমজ্জন ও জ্ঞান গবেষণার দিগন্ত থেকে নিজেদের গুটিয়ে নেয়ার ফলে বিশ্ব সভ্যতার কর্তৃত্ব মুসলমানদের হাত থেকে সরে গিয়ে ইউরোপের মাটিতে ডেরা গেড়েছে।

জীবনের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য যে কর্মকুশলতা ও সৃজনশীলতা চাই, তার অনুপস্থিতিতে মুসলমানরা শুধু নেতৃত্ব হারালো না, বরং ইউরোপীয় সভ্যতার রাজনৈতিক গোলামীর নাগপাশে আবদ্ধ হতে থাকলো এবং ক্রমান্বয়ে সাংস্কৃতিক গোলামীও অবধারিত হয়ে উঠলো। এ সময়ে ইউরোপ নিজস্ব শিক্ষাব্যবস্থা পৃথিবীতে চালু করলো, এটা ছিল এমন এক শিক্ষা, যা জীবনের মৌলিক বহুচেতনা থেকে রিক্ত হলেও ইসলাম থেকে মানুষকে পথভ্রষ্ট করার জন্য ছিল যথেষ্ট। এই শিক্ষা দ্বারা আপাদমস্তক সিক্ত এক শ্রেণীর বিভ্রান্ত লোকের হাতে পরবর্তীতে ইসলামী দুনিয়ার নেতৃত্ব চলে গেলো। এদের হাতে ইসলাম মোটেও নিরাপদ ছিলনা এবং ইসলামী শিক্ষা ও ফিকাহের প্রতি বরাবরই এরা ছিলো বীতশ্রদ্ধ। কিন্তু যাদের থেকে ইসলামী শিক্ষা ও ফিকাহের যথার্থ বিকাশ এবং জীবনের পরিবর্তনশীল প্রেক্ষাপটে এর ভূমিকাকে নিশ্চিত করণের কথা ছিলো, তাদের থেকে জীবনের গতিময়তার সমান্তরাল কোন তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়নি। ফলে জীবন এগিয়েছে ঠিকই, কিন্তু ইসলামী ফিকাহ গুপ্তধনের এক পুঞ্জিভূত সঞ্চয়ের মতো গ্রস্থ ও গ্রন্থের চারপাশে ঘূর্ণমান এক পরিমণ্ডলে নিরাপদ আশ্রয় লাভ করলো। বৃহত্তর জীবনযাত্রার পরিচালনায় তার ভূমিকা কায়েম করা ও তাকে সেভাবে সম্পাদন করার চেষ্টা থাকলেও সুপ্তির সুবিশাল পরিমণ্ডলে তা কাঁপন ধরাতে পারেনি। অথচ সমস্যাসমূূহ জীবনের রাজপথে প্রতিনিয়ত গর্জন করছিলো। নবনব জিজ্ঞাসার কালো মেঘ আকাশ আচ্ছন্ন করছিলো। জীবনের অভিযাত্রীরা সমাধান খুঁজছিলো।

ইসলামী ফিকাহ চায় পরিবর্তন: ইসলামী ফিকাহ যেহেতু প্রয়োগশীল, অতএব তার চাহিদা পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নিজের নবসম্পাদন। ইসলামী ফিকাহ যেহেতু জীবনের জন্যে, অতএব জীবন এগিয়ে যেখানে আছে, ইসলামী ফিকাহ তার লাগাম ধরতে চায়। জীবন যদি ডুব দিয়ে সমুদ্রের তলে যায, ফিকাহ সেখানেও যাবে, জীবন যদি গ্রহ-উপগ্রহে ঘরবাড়ি বানায় সেখানেও ফিকাহর পরিসর পরিব্যাপ্ত। সে প্রতিটি প্রেক্ষাপটেই অনিবার্য এবং জীবনের প্রতিটি সম্ভাবনায় স্বীয় গতির তরঙ্গ কামনা করে। বাঁচা মরার সংগ্রামে সে কর্মকে, দৃষ্টিভঙ্গিকে এবং চৈতন্যকে নির্দেশনা দিতে চায়। প্রতিটি পরিবর্তনে আলো ফেলতে চায়, হতে চায় পরিবর্তনের সহচর। এটি সেই জ্ঞান-বিজ্ঞান, যা বিকাশ ও উন্নতির পূর্ণ যোগ্যতা রাখে। অত্যন্ত প্রশস্ত ও প্রগতিশীল এই আইন; প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমনসব চিরস্থায়ী রীতিনীতির উপর যেগুলোর ক্ষয় নেই, লয় নেই। চিরন্তন ও চিরণবীন। জীবন বাঁক ঘুরে যেখানেই দাঁড়ায় সেখানেই তাকে দেখতে পাবে, উন্নতি যে পর্যায়ে হোক, সে তার সহযাত্রী হতে পারে এবং তার উপস্থিতিতে মানুষের উদ্ভাবিত কোন আইনের আশ্রয় নেয়ার কোনো প্রয়োজনই পড়েনা। কিন্তু সেই আইন নিজেই যখন পরিস্থিতির পরিবর্তনে মাসআলার পরিবর্তনকে বিধিবদ্ধ করে দিয়েছে, সেখানে পরিবর্তিত এলাকার উপর দিয়ে এই স্রোতাবহ নদীটির গতিযাত্রা ব্যাহত করা হলো এবং বিস্ময়করভাবে এক খরস্রোতা নদীকে অলসতা ও স্থবিরতার কঙ্কর দিয়ে এমনভাবে আবদ্ধ করে দেয়া হলো যে, দূরে অবস্থানকারী লোকেরা ভাবলো এটি একটি নদীর ধ্বংসাবশেষ, যা স্থবিরতা, আবদ্ধতা ও মৃত্যুময়তার ভেতর দিয়েও অতীতের জীবন্ত স্রোত ও গতিশীলতার একটি স্মৃতিকে বাঁচিয়ে রাখছে মাত্র। যে কারণে তারা প্রচণ্ড ক্ষুৎ পিপাসায় তড়পালেও তৃষ্ণা নিবারণের জন্য এদিকে আসলো না। ভাবতেই পারলোনা এখানে শীতল পানির সঞ্চয় বিদ্যমান।

দোষ কি শুধু বিশ্বের মানুষের? যে পদ্ধতিগত ধারাবাহিকতার কারণে তর্কের তুফান তুলা, মাযহাবী মতভেদ, কতিপয় মাসআলার প্রাচীন অবশেষ ও একান্ত ব্যক্তিগত পর্যায়ের কিছু উপাদানের সমাহার হিসেবে পৃথিবীর নিকট ইসলামী ফিকাহ পরিচিত হলো, এর দায়ভার সেই অব্যাহত ধারাবাহিকতার কাঁধে পতিত হবে। যার কারণে আধুনিক পৃথিবী সঙ্কটের আগুনে দাউ দাউ করে পুড়লেও বিপন্ন মানুষ অগ্নি নিবারণের ক্ষেত্রে ইসলামী ফিকাহের কোনো উপযোগিতা বিস্মৃত হয়েছে এবং ইসলামী ফিকাহের অপরিহার্যতাকে সে অবজ্ঞা করেছে ও জীবনের কাছে ইসলামের আবেদনকে সময়ের যুক্তিতে অস্বীকার করেছে। সে একে জেনেছে যাদুঘরের বস্তু অথবা একান্তই ঘরোয়া আসবাব। ফলে সে মুরতাদ হয়েছে এবং কেবল ‘সে’ বা ‘তারা’ নয় বরং ইরতেদাদ মুসলিম বিশ্বের ঘরে ঘরে বানের পানির মতো ছড়িয়ে পড়েছে। অথচ এই ফিকাহ যদি নতুন পোষাকে সজ্জিত হতো, যাতে যামানা তাকে বুঝতে পারে এবং তাপদগ্ধ মানুষ তার শীতলতা উপলব্ধি করতে পারে, তাহলে এর মাধ্যমে বিশ্বব্যাপী শক্তিশালী এক বিপ্লব ছিলো অনিবার্য। যার ফলে পণ্য ও যন্ত্রকে যারা মাবুদ হিসেবে জানে ও পুঁজা করে, তারা সত্যিকার ‘মানুষের’ সন্ধান পেতো। ভুগবাদ যেখানে ‘আনা রাব্বুকুমুল আ’লা’ বলে শত শত বছর ধরে একচ্ছত্র ফেরাউনী শাসন পরিচালনা করছে, সেখানে মুসার জালালিয়াত নিয়ে ‘আসমানী পয়গামের ঢেউ’ তাগুতী বালাখানার বুনিয়াদকে ধ্বসিয়ে দিতো।

যেখানে বস্তুবাদী সভ্যতার হাজার হাজার যাদু সাপের আকারে চারদিক বিস্তার করে ফেলছে, সেখানে পয়গাম্বরী ‘আসা’ মুহূর্তেই রুদ্ররূপ ধারণ করে সব যাদুর ভেলকি নিশ্চিহ্ন করে দিতো। সেই বিপ্লব সৃষ্টির জন্য প্রয়োজন ছিলো ইসলামী শরীয়তের শক্তিশালী মর্মস্পর্শী হৃদয়গ্রাহী ও চিত্তাকর্ষক ব্যাখ্যা বর্ণনা এবং আধুনিক যুগে যে ভাষা, সাহিত্য, বর্ণনাপদ্ধতি ও রচনাশৈলীর প্রয়োজন তার উপর দক্ষতাসম্পন্ন মুহসিন আলেম ও দায়ী ইলাল্লাহর জামাত। যারা পরিপূর্ণ বিজ্ঞতার সাথে আধুনিক সভ্যতার খোলসকে উন্মোচন করবেন, তার কদাকার চিত্রের জ্ঞানদক্ষ সমালোচনা করবেন এবং এর পাশাপাশি ইসলামের সত্যিকার উচ্চতা ও শ্রেষ্ঠত্বের চিত্র অঙ্কন করবেন যামানার অন্দরে ও মানবমনের কন্দরে। এ জন্য ইসলামী ফিকহ সর্বশ্রেষ্ট হাতিয়ার, ব্যবহৃত হওয়ার জন্যে সবরকমভাবে সে তৈরী ছিলো। যামানার পরিবর্তনকে নিজের সাথে সামঞ্জস্যশীল করার জন্যে তার আগ্রহ ছিলো পুরোপুরি। এটি ছিল ইসলামের চাহিদা ও দাবি। ইসলামের সেই কর্মনীতি চিরন্তন । যখনই যে সংস্কৃতির গায়ে সে হাত রাখে তার রোগগুলো দূর করে, সুস্থ, বলবীর্য ও বিকাশের ব্যবস্থা করে, তাকে সৌন্দর্যমন্ডিত করে। নতুন সমস্যাসমূহের ভারসাম্যপূর্ণ ও উপযুক্ত সমাধানের উপর নির্ভর করছে আজকের এই বস্তুবাদী গ্যাংগ্রিন দূষিত, এইডস আক্রান্ত সভ্যতাকে ইসলামী ফিকাহের মুখোমুখি করা।

মানবতার জন্য যে কাজটি না করলেই নয়: যন্ত্র ও যোগাযোগের এ সভ্যতা পৃথিবীকে দুহাত ভরে দিলেও নৈতিকগুণাবলীর দিক দিয়ে করেছে রিক্তহস্থ। জীবনযাত্রাকে সহজ করে তুললেও মানবিক জীবন ও পাশবিক জীবনের মধ্যকার পার্থক্য ঘুচিয়ে দিয়েছে। হিসেব করলে এই সভ্যতার অবদানের চেয়ে অপদানই বেশি। কেননা মানুষ যখন পশুত্বকে গ্রহণ করলো, তখন সে মুহূর্তেই পৃথিবীর এ প্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে যোগাযোগ করতে পারলেও সেই যোগাযোগ পশুত্বেরই বিস্তার ঘটালো। অতএব মানুষকে মানুষ রেখে যোগাযোগ উপকরণ তার আয়ত্বে এনে দিলে পৃথিবীর জন্য সুফলদায়ক হয়। এ জন্যে আধুনিক সভ্যতার অপদানগুলোকে দূরিভূত করে অবদানগুলোকে মানবতার কাজে লাগনোটাই সময়ের চ্যালেঞ্জ। এ চ্যালেঞ্জ মুকাবেলা করার জন্যে প্রয়োজন প্রতিটি বিষয়কে ওজন করার দাড়িপাল্লা। প্রয়োজন এমন এক বিচারের আদর্শ, যা মানবতার মাটিতে দাঁড়িয়ে আধুনিক মূল্যবোধ ও জীবনযাত্রার প্রতিটি অনু-পরমাণু পরীক্ষা নিরীক্ষাপূর্বক তার সম্পর্কে রায় দেবে। মানবিক বিবেক সেই আদর্শের সন্ধানে পথচারি এবং এর অনুপস্থিতিতে হতাশ। অতএব আমাদের প্রস্তাব সেই বিচারের আদর্শ হওয়ার যোগ্যতা একমাত্র ইসলামী ফিকাহের মধ্যে নিহিত আছে। যে মন্দ জীবনের অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে, ইসলামী ফিকাহ এর বিকল্প উপাস্থাপন করতে চায়। যে ভালোয় মন্দত্ব মিশে আছে অর্থাৎ যা একদিক দিয়ে ভালো অন্যদিক দিয়ে মানুষের জন্য ক্ষতির, ইসলামী ফিকাহ ক্ষতিকে দূর করে নিঁখাদ ভালো হিসেবে তার কল্যাণকামিতা নিশ্চিত করতে চায়। বিরাজমান জাহিলিয়্যাতকে সে বিধ্বস্ত করে, কিন্তু এটি করে নবসৃষ্টির স্বার্থে, পরিপূর্ণ এক ব্যবস্থাপনার জন্য স্থান করে দিতে। যার মাধ্যমে মানবতাকে দেয়া যাবে প্রতিটি বস্তুর উত্তম বিনিময়। ইসলাম কখনো জীবনের চাকাকে স্থবির করে দিতে চায়না এবং মানুষের স্বভাব ও প্রকৃতির জন্য জটিল বিষয়কে পরিত্যাগ করে সরলপথ অবলম্বনই ইসলামের নিয়ম।

শায়খুল ইসলাম হাফিজ ইবনে তাইমিয়া রাহ. ‘ইকতেযাউস সিরাতিল মুস্তাকিম’ গ্রন্থে লিখেন-‘মানবীয় স্বভাব ও প্রকৃতি সর্বদাই কোনো জিনিষ থেকে কেবল তখন হাত গুটিয়ে নেয় এবং তার উপর দাবি পরিত্যাগ করে যখন সে এর বিকল্প পায়। মানুষ স্বভাবতই কিছু করার জন্য জন্ম নিয়েছে এবং তার স্বভাবের দাবি ও চাহিদা হলো সক্রিয়তার ভেতর দিয়ে আবর্তিত থাকা। নিস্ক্রিয়তা ও স্থবিরতা মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি বিরুদ্ধ। ’ “কিতাবুন নবুওত” গ্রন্থে তিনি লিখেন- ‘আম্বিয়ায়ে কেরাম মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি বদলে দেবেন বলে আসেননি, বরং তাকে পূর্ণতা দেয়ার জন্য এসেছিলেন।’ শাহ ওয়ালীইল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ. “হুজ্জাতুল্লাহিল বালেগা” গ্রন্থের ষষ্টতম আলোচ্য বিষয়ের একবিংশতম অধ্যায়ে ‘জাহিলি যুগ ও রাসূল সা. এর সংস্কার’ শিরোনামে এ বিষয়ের উপর আলোকপাত করেছেন যে, নবীকরীম সা. আরবকে পরিপূর্ণ নতুন শরীয়ত বা অভিনব কোনো ব্যবস্থার মুখোমুখি করেন নি। নতুন কোনো সংস্কৃতিও তাদের উপর চাপিয়ে দেননি। বরং তাদের মধ্যে যে ব্যবস্থাপনা, যে সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রা প্রচলিত ছিল, এর মন্দজিনিষগুলো দূর করেছেন, বক্রতা সোজা করেছেন। বিচ্যুতি সংশোধন করেছেন এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে উত্তম বিকল্প উপস্থাপন করেছেন। আজকের এই সভ্যতাকে ইসলামী ফিকাহের বিচারের সম্মুখীন করা এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসা জরুরী হয়ে পড়েছে। সেই কাজ মানবতার জন্য, মানবতার পৃথিবীর জন্য এবং অনাগত আগামীর জন্য অপরিহার্য। কিন্তু এ জন্য ইসলামী ফিকাহের সরঞ্জামগুলোর প্রায়োগিক প্রতিষ্ঠা নিশ্চিত করা চাই, নব সম্পাদন করা চাই।

লেখক : কবি ও গবেষক

আরও পড়ুন

ইসলামী ফিকহের নবসম্পাদন : প্রেক্ষিত একুশশতক (১ম পর্ব)

ইসলামী ফিকহের নবসম্পাদন : প্রেক্ষিত একুশশতক (২য় পর্ব)

ইসলামী ফিকহের নবসম্পাদন : প্রেক্ষিত একুশশতক (৩য় পর্ব

About Abul Kalam Azad

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...