ইসলাম ও মুসলমানদের সেবায় কওমী মাদরাসার অবদান অপরিসীম। যুগ যুগ ধরে এই দেশে মানুষের মাঝে দ্বীনের বাতি জ্বালিয়ে রেখেছে যে মানুষগুলো, তাঁরা প্রায় সবাই কওমির সন্তান। আমি কওমী মাদরাসার এক নগণ্য সদস্য হিসেবে গর্বিত। কওমির সন্তান হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানের ভালো মন্দ নিয়ে বলার অধিকার আমার আছে বলেই আমার ধারণা। এই ধারণা থেকেই মনের ভেতরে লুকনো কিছু কথা বলতে চাই।
কওমী মাদ্রাসায় বছরে তিনটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। স্কুলেও তিনটি পরীক্ষা হয়। তবে মাদ্রাসার সাথে স্কুলের পরীক্ষার অনেক পার্থক্য আছে। প্রথমত মাদ্রাসার কথা বলি। মাদ্রাসার পরীক্ষার স্বাভাবিক চিত্র এমন যে, আরম্ভ হওয়ার সপ্তাহ থেকে দশদিন আগে দারস-তাদরীস বন্ধ করে দেয়া হয়। ছাত্ররা প্রস্তুতির জন্য ৭ থেকে১০ দিন সময় পায়। ওই সময়ের মধ্যে ক্লাসভেদে কারো হয়তো স্বীয় বইয়ের ২০ পৃষ্ঠা পরীক্ষার পাঠ্যসূচিতে থাকে, আবার কারো ৪০০ থেকে ৬০০ পৃষ্ঠার বই প্রায় প্রতিদিন পরীক্ষা দিতে হয়। পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত সিলেবাস না থাকায় পুরো বই পড়তে হয়। ফলে পরীক্ষার সময় মাথায় যেন পাহাড় ভেঙ্গে পড়ে। আবার পরীক্ষার পূর্বের বন্ধ, পরীক্ষা চলাকালীন সময় এবং পরীক্ষার পর আবারও বন্ধ দেয়া মিলিয়ে প্রায় মাসখানেক সময় একেকটি পরীক্ষায় চলে যায়।
অপরদিকে স্কুলের পরীক্ষার চিত্র হলো- ক্লাস টেন, এইট, ফাইভ-এর পরীক্ষার সময় লম্বা সময় নিয়ে পরীক্ষা হয়। প্রতি বিষয়ের পর ২দিন হলেও বিশ্রামের সুযোগ দেয়া হয়। অন্যান্য শ্রেণির পরীক্ষাতেও বিশ্রামের সামান্য একটা সুযোগ থাকে। পুরো বইয়ের মধ্যে পরীক্ষার জন্য নির্ধারিত সিলেবাস থাকে। ফলে ছাত্র-ছাত্রীরা বছরের শুরুতেই জেনে যায় যে, কোন পরীক্ষায় কতটুকু এবং কোন কোন চ্যাপ্টার থেকে আসবে। এই কারণে তাদের জন্য পরীক্ষা দেয়াটা মাদ্রাসার ছাত্রদের তুলনায় অনেক সহজ হয়ে যায়।
আমি মনে করি কিছু বিষয়ে বাস্তবতা চিন্তা করে উলামাদের ব্যবস্থা নেয়া উচিত। যদি এমন হয় যে, মাদরাসায় প্রতিবছর দুটো পরীক্ষা নেয়া হয়, তবে পড়ানোর জন্য একমাস সময় বাড়তি পাওয়া যাবে। দারস-তাদরীস হচ্ছে আসল, পরীক্ষা তো তার ফলাফল জানার মাধ্যম। তার উপর প্রতি বছরের শুরুতে যদি পুরো বছরের সিলেবাস প্রণয়ন করে দেয়া হয়, তবে সেটা খুব বেশী ভালো কিছু না করলেও কিছু ভালো ফলাফল আসবে বলে আমার বিশ্বাস।
আমার লেখার মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে যে, আলিয়া ১ম বর্ষ থেকে দাওরায়ে হাদীস পর্যন্ত যেসব কিতাবাদী পড়ানো হয়, সেগুলো এক বছরে ভালভাবে আয়ত্ব করা বর্তমানের ছাত্রদের জন্য অনেক জটিল ও কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমাদের আঁকাবিরদের জীবনের দিকে লক্ষ্য করলে দেখা যায় যে, তাঁরা আমাদের মত গতবাঁধা নিয়মে পড়-লেখা করে আঁকাবির হন নি। তার উপর বর্তমান সময় বিবেচনায় ছাত্ররা দুনিয়ার প্রতি এতো আসক্ত হয়ে গেছে যে, মুখতাসারুল মাআনী, বায়যাবী শরীফের মতো জটিল কিতাবাদি তার জন্য বোঝা মনে করতে শুরু করেছে। মিশকাত-দাওরায়ে হাদিসের কিতাবগুলো ভালোভাবে বুঝে একবছরের মধ্যে আয়ত্ব করা বর্তমানের ছাত্রদের জন্য অসম্ভব হয়ে দাঁড়িয়েছে।
কাজেই এতোসব বিষয় বিবেচনা করে যদি সেমিস্টার পদ্ধতি চালু কারা যেত, তবে ছাত্ররা সম্ভবত একটু সহজেই কিতাবাদি বুঝতে পারতো। আমি আরেকটু পরিষ্কার করে বলি, মনে করুন প্রতি বছর পরীক্ষা দুইবার অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম পরীক্ষার পূর্বে যা পড়া হবে, সেগুলো পরবর্তী পরীক্ষায় আসবে না। কারণ বেশিরভাগ ছাত্রই পরীক্ষার সময় পড়ালেখায় মনযোগী হয় এবং পরীক্ষার মৌসুমেই সে তার পূর্ণ পড়াগুলো ভালভাবে আয়ত্ব করে থাকে।
বাস্তবতা হলো যে, ছাত্ররা যখন তাদের ৭০০ থেকে ৮০০ পৃষ্ঠার একেকটি কিতাব নিজেদের সামনে মেলে ধরে, তার মাথা এমনিতেই গুলিয়ে যায়। তখন সে বাছাই করে পড়তে আরম্ভ করে। ফলে কিতাবের উপর তার দক্ষতা অর্জিত হয় না। তবে একথা অস্বীকার করছি না যে, কিছু ছাত্র এমন আছে, যারা সবসময় নিজেদেরকে পড়ালেখার সাথে সম্পর্কিত রাখে। ওইসব ছাত্রদের কথা আলাদা। বেশিরভাগ ছাত্রই পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়। এখন যদি সে সামান্য করে শিখতে থাকে তবে তার জন্য অনেক সহজ হয়ে যায়।
মনে করুন প্রতিটি শ্রেণির বইগুলো দুই অংশে ভাগ করে দেয়া হবে। প্রথম অংশ শেষ হওয়ার সাথে তার প্রথম অংশের সাথে সম্পর্ক থাকবে না, ফলে সে পরের অংশে পূর্ণ মনোযোগ দেবে। তখন তার পক্ষে বই আগের তুলনায় কিছুটা হলেও বেশী আয়ত্ব করা সম্ভব হবে। অনেকটা প্রাইভেট কলেজ-ভার্সিটির মত।
দয়া করে কেউ এ কারণে মাদ্রাসার সম্মান কমে যাবে, এমনটি মনে করবেন না। সেই সাথে যদি মাসে একদিন মাসিক পরীক্ষার ব্যবস্থা নেয়া যায়, তবে তো সোনায় সোহাগা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, অনলাইন এক্টিভিস্ট
Komashisha

