সৈয়দ মবনু::
১ : সহজ ভাষায় দর্শন কি? উত্তর : এই প্রশ্নের উত্তর আমি দিতে চেষ্টা করেছি ‘দয়াদর্শ’ গ্রন্থের পৃষ্টা নম্বার সাত, আট এবং নয়-এর মধ্যে। সেই বক্তব্যকে আরও সহজ করলে দর্শন বলা যায়, যে জ্ঞান দিয়ে কোন কিছুর সঠিক অবস্থান যুক্তি বা লজিকের মাধ্যমে বুঝা যায় তা হলো দর্শন। ঐতিহাসিক ইবনে খালদুন মনে করতেন, দর্শনের প্রাথমিক ও প্রধান শাখা হলো যুক্তি বা লজিক বিদ্যা। যা দিয়ে সত্য-মিথ্যা, শুদ্ধ-অশুদ্ধ, ভালো-মন্ধ যাচাই করা যায়। তিনি পদার্থবিদ্যা, অধিবিদ্যা বা তত্ত্ববিদ্যা এবং জ্যামিতি, গণিত, সঙ্গীত ইত্যাদিকেও দর্শন মনে করতেন। পরবর্তীতে বিভিন্ন দার্শনিক ইবনে খালদুনের মতকে একটু এদিক-সেদিক করে গ্রহণ করে নিয়েছেন। ‘দর্শন’ শব্দের অর্থ ‘দেখা’ হলেও এখানে সাধারণ চোখে দেখাকে দর্শন বলা হচ্ছে না। দর্শনে কোনকিছু দেখতে হলে তার সবদিক বিচার-বিবেচনার মধ্যে এনে যুক্তি-তর্কের মাধ্যমে দেখতে হবে।
২ : দর্শনের প্রয়োজনীয়তা কি এ সময়ে আছে? উত্তর : চলমান মানব সমাজে দর্শনের প্রয়োজনীয়তা কোনদিন হ্রাস পাবে না। অনেকের ধারণা বিজ্ঞানের চূড়ান্ত সফলতা এসেগেছে, তাই দর্শনের প্রয়োজনীয়তা আর নেই। এ ধারণা বস্তুবাদি মূর্খদের। মানুষ যতদিন চলমান থাকবে, মানুষের সমাজে সকল পরাবাস্তব বিষয়গুলো যতদিন বাস্তবতায় আসবে না ততদিন বিজ্ঞানকে চূড়ান্ত সফল বলা যাবে না। পরাবাস্তব অনেক বিষয় এখনও বাস্তবতায় আসেনি, তাই স্বীকার করতে হবে বিজ্ঞান চূড়ান্ত হয়নি। যদি কোনদিন পরাবাস্তব সবকিছু বাস্তবে এসে যায় তবে বলা যাবে বিজ্ঞান চূড়ান্ত সফল। বিজ্ঞানের চূড়ান্ত সফলতার পরও দর্শনের প্রয়োজনীয়তা শেষ বলা যাবে না। কারণ বিজ্ঞান একমুখি আর দর্শন বহুমুখি। বিজ্ঞানের কাজ শুধু বাস্তবে। দর্শনের কাজ বাস্তবে যেমন, তেমনি পরাবাস্তবে। বিজ্ঞান এবং দর্শনকে তার নিজের স্থান থেকে বুঝতে হবে। আমাদের নোট ভিত্তিক পরীক্ষা নির্ভর শিক্ষা পদ্ধতি আমাদের ছাত্রদের হাতে বইয়ের গাট্টি তুলে দিলেও জ্ঞানী করার দিকে নিয়ে যেতে পারছে না। যেকোন বিষয়ে বুঝতে হবে সেই বিষয়ের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে বিচরণ করে। যখন আমরা বুঝতে পারবো দর্শন কি, তখনই বুঝতে পারবো দর্শনের প্রয়োজনীয়তা। দর্শন ছাড়া সমাজ অচল।
৩ : কোরআন-হাদিসের মতো দুটি বিষয় থাকার পর নতুন দর্শনের কি প্রয়োজন আছে? উত্তর : আমি যদি প্রশ্ন করি, ইসলাম থাকার পর আবার খন্ড খন্ড ইসলামী দল কেন তৈরি করা হয়? কোরআন-হাদিস থাকার পর আবার ফেকাহ কেন? এক নবী এবং এক আল্লাহর অনুসরণ করার পর আবার বিভিন্ন মতবাদে বিভক্ত কেন মুসলমানেরা? প্রকৃত অর্থে কোরআন, হাদিস, ইসলাম ইত্যাদি বিষয় খুবই ব্যাপক। এগুলোকে খনির সাথে উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। একটা তেলের খনিতে অনেক প্রকারের তেল হয়। ইঞ্জিনিয়ার এগুলোকে উঠিয়ে রিফাইন করে পৃথক করে বিভিন্ন কাজের উপযোগি করেন। তেমনি কোরআন-হাদিসের কথাগুলোর সাথে সমাজকে মিলিয়ে তার উপযোগি করতে দর্শনের প্রয়োজন হয়। স্বর্ণকে যেভাবে জুয়েলার্সে নিয়ে অলঙ্কার বানিয়ে ব্যবহারের উপযোগি করতে হয় তেমনি কোরআন-হাদিসকে দর্শনের আলোকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে প্রত্যেক সমাজের উপযোগি করতে হয়। আল্লাহ আছেন, আল্লাহ নেই-দুটাই দর্শনের বিষয়। ইসলামী আইন দিয়ে সামাজ চলতে পারে-চলতে পারে না, তাও দর্শন দিয়ে প্রমাণ করতে হয়। একটা দর্শনের বিভিন্ন দিক থাকে। কোরআন-হাদিস থাকার পরও নতুন দর্শনের প্রয়োজন আছে যেমনি মানুষের মধ্যে মুসলিম একটি গ্রুপ হওয়ার পরও আরও ইসলামী গ্রুপের প্রয়োজন হয়।
৪ : চলমান দর্শনের সাথে দয়া দর্শনের পার্থক্য কি? উত্তর : চলমান দিয়ে কোন দর্শনকে বুঝানো হয়েছে আমি বুঝতে পারি নি। যদি এই চলমান দিয়ে পৃথিবীর সকল দর্শনকে বুঝানো হয় তবে আমি বলবো, দয়াদর্শন বাকীগুলোর সাথে অভিন্নতার মধ্যে ভিন্ন। দয়াদর্শনের মূল হলো জ্ঞান, বুদ্ধি, কর্ম ও প্রেমের সমন্বয়। যাদের কাছে তা পাওয়া যাবে দয়াদর্শনের তাদের সাথে কোন ভিন্নতা নেই। এই চারে সাথে যার যতটুকু সম্পর্ক দয়াদর্শন তার সাথে ততটুকু সম্পর্ক রাখে। দয়াদর্শন হলো প্রত্যেক অঞ্চলের মানুষদের নিজস্ব সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সাথে সমন্বয় রেখে যেকোন বিষয়কে জ্ঞান, বুদ্ধি, কর্ম ও প্রেমের সাথে সমন্বয় করা। দয়াদর্শনের জন্য মুসলমানকে কোরআন হাদিস ছাড়তে হবে না, হিন্দুকে হিন্দু ধর্ম ছাড়তে হবে না, বাঙালিকে অবাঙালী হতে হবে না, অবাঙালীকে বাঙালী হতে হবে না, কোন দলের মানুষকে তার দল ছাড়তে হবে না। দয়াদর্শন একে অন্যের সাথে সমন্বয়ের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে। যেকোন ভাল জিনিষকে পূর্ণাঙ্গতান দিকে যেতে সহযোগিতা করে। যেকারো ভুলকে ভুল এবং শুদ্ধকে শুদ্ধ বলাই দয়াদর্শনের মূল কাজ।
লেখক: কবি সাহিত্যিক গবেষক।