মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুর রহমান ::
নামাযে তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে রাফয়ে ইয়াদাইন না-করা বিষয়ে সবচেয়ে প্রসিদ্ধ আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর হাদীস। এটি হাদীসের অনেক কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। ইমাম তিরমিযী রাহ. (২৭৯হি.) ও তাঁর ‘সুনান’ গ্রন্থে তা বর্ণনা করেছেন। তাঁর সনদে হাদীসটির আরবী পাঠ নিম্নরূপ:
حدثنا هناد قال: حدثنا وكيع، عن سفيان، عن عاصم بن كليب، عن عبد الرحمن بن الأسود، عن علقمة قال: قال ابن مسعود: ألا أصلي لكم صلاة رسول الله صلى الله عليه و سلم؟ قال: فصلى فلم يرفع يديه إلا في أول مرة.
অর্থাৎ ইমাম তিরমিযী হান্নাদ থেকে, তিনি ওকী থেকে, তিনি সুফিয়ান ছাওরী থেকে, তিনি আসিম ইবনে কুলাইব থেকে, তিনি আবদুর রহমান ইবনুল আসওয়াদ থেকে, তিনি আলকামা থেকে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, আমি কি তোমাদের (শেখার) জন্য রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামাযের মত নামায পড়ব না? এরপর তিনি নামায পড়েছেন এবং শুধু প্রথমবারে রাফয়ে ইয়াদাইন করেছেন। -সুনানে তিরমিযী, হাদীস ২৫৭
ওকী রাহ.-এর আরেকজন শাগরিদ যুহাইর ইবনে হারব একই হাদীস তাঁর থেকে নিম্নোক্ত শব্দে বর্ণনা করেছেন:
ثنا زُهَيْرُ بْنُ حَرْبٍ أَبُو خَيْثَمَةَ ثنا وَكِيعٌ عَنْ سُفْيَانَ الثَّوْرِيِّ عَنْ عَاصِمِ بْنِ كُلَيْبٍ عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ الْأَسْوَدِ عَنْ عَلْقَمَةَ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ مَسْعُودٍ قَالَ: أَلَا أُرِيكُمْ صَلَاةَ رَسُولِ اللَّهِ – صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ – فَرَفَعَ يَدَيْهِ فِي أَوَّلِ تَكْبِيرَةٍ ثُمَّ لَمْ يَعُدْ.
অর্থাৎ যুহাইর ইবনে হারব ওকী থেকে, তিনি সুফিয়ান ছাওরী থেকে, তিনি আসিম ইবনে কুলাইব থেকে, তিনি আবদুর রহমান ইবনুল আসওয়াদ থেকে, তিনি আলকামা থেকে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, আমি কি তোমাদেরকে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায দেখাব না? এরপর (তিনি নামায পড়ে দেখিয়েছেন) এবং তাতে শুধু প্রথম তাকবীরের সময় দুই হাত উঠিয়েছেন। এরপর আর তা করেননি। -আলমুহাল্লা, ইবনে হাযম ৪/৮৭ (অর্থাৎ অন্য কোনো তাকবীরে হাত ওঠাননি)
ওকী রাহ.-এর ন্যায় ইমাম সুফিয়ান ছাওরী রাহ.-এর আরেকজন শাগরিদ ইমাম আবদুল্লাহ ইবনে মুবারক রাহ.ও সুফিয়ান ছাওরী থেকে একই সনদ ও একই মতনে এই হাদীস বর্ণনা করেছেন, যা‘সুনানে নাসায়ী’তে বর্ণিত হয়েছে-
أَخْبَرَنَا سُوَيْدُ بْنُ نَصْرٍ، قَالَ: أَنْبَأَنَا عَبْدُ اللَّهِ بْنُ الْمُبَارَكِ، عَنْ سُفْيَانَ، عَنْ عَاصِمِ بْنِ كُلَيْبٍ، عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ الْأَسْوَدِ، عَنْ عَلْقَمَةَ، عَنْ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ: أَلَا أُخْبِرُكُمْ بِصَلَاةِ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: فَقَامَ فَرَفَعَ يَدَيْهِ أَوَّلَ مَرَّةٍ ثُمَّ لَمْ يُعِدْ
অর্থাৎ ইবনুল মুবারক সুফিয়ান ছাওরী থেকে, তিনি আসিম ইবনে কুলাইব থেকে, তিনি আবদুর রহমান ইবনুল আসওয়াদ থেকে, তিনি আলকামা থেকে, তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, আমি কি তোমাদেরকে রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায সম্পর্কে খবর দিব না? এরপর তিনি দাঁড়িয়ে (নামায পড়ে দেখিয়েছেন) এবং তাতে শুধু প্রথমবার দুই হাত উঠিয়েছেন। এরপর আর তা করেননি। -সুনানে নাসায়ী, হাদীস ১০২৬
এ হাদীসে আমরা দেখলাম, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. তাঁর শাগরিদদেরকে রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায নিজে পড়ে দেখিয়েছেন এবং তাতে তিনি তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া আর কোথাও হাত ওঠাননি। এটি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. কর্তৃক এ কথার কর্মগত বিবরণ যে,রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া আর কোথাও হাত ওঠাতেন না।[1]
সনদের সংক্ষিপ্ত আলোচনা
এই হাদীসের সনদ সহীহ, এর রাবীগণ সকলেই ছিকা। আর হাদীস সহীহ হওয়ার যে পাঁচ শর্ত, এতে বিদ্যমান আছে। ইমাম বদরুদ্দীন আইনী রাহ. (৮৫৫হি.)-এর বর্ণনা অনুযায়ী ইমাম .তিরমিযী রাহ. এ হাদীসকে ‘হাসানুন সহীহ’ বলেছেন।[2] এ বাক্যটি তিনি সাধারণত এমন হাদীস সম্পর্কেই বলেন, যা বিশুদ্ধতার উচ্চস্তরে উন্নীত। আলোচিত হাদীসটি মূলত এ পর্যায়েরই। ইমাম ইবনে হাযম রাহ. (৪৫৬হি.) ‘আলমুহাল্লা’ গ্রন্থে একে ‘সহীহ’ই বলেছেন। পাঠকগণ সামনে গিয়ে দেখবেন, এটিই আরো অনেক মুহাদ্দিসের মত।
যদিও আমাদের কাছে বিদ্যমান ‘জামে তিরমিযী’র মুদ্রিত কপিগুলোতে এখানে শুধু ‘হাসান’ শব্দ আছে। কিন্তু তাতে কোনো অসুবিধা নেই। কারণ এ কথা তো স্বীকৃত যে, ‘হাসান’ হাদীস দলীলযোগ্য হাদীসেরই একটি প্রকার।
মুদ্রিত কপি অনুযায়ী এ হাদীস বর্ণনার পর ইমাম তিরমিযী বলেছেন:
حديث ابن مسعود حديث حسن، وبه يقول غير واحد من أهل العلم من أصحاب النبي صلى الله عليه وسلم، والتابعين، وهو قول سفيان الثوري، وأهل الكوفة.
অর্থাৎ এ হাদীসটি হাসান। একাধিক আহলে ইলম সাহাবী ও তাবেয়ীনের বক্তব্য এ হাদীস অনুযায়ীই ছিল। এবং এটিই সুফিয়ান ছাওরী ও কূফাবাসীদের (কূফায় অবস্থানকারী সাহাবী, তাবেয়ী এবং তাদের ফকীহ-মুহাদ্দিস শাগরিদদের) বক্তব্য।’ -জামে তিরমিযী, হাদীস ২৫৭ এর আলোচনায়
এখানে একটি বিষয় বিশেষভাবে লক্ষণীয়। আর তা এই যে, ইবনে মাসউদ রা. এই হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায-পদ্ধতির উদ্ধৃতিতে যে বিষয়টি কর্মের মাধ্যমে বর্ণনা করেছেন, অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে শুধু তাকবীরে তাহরীমার সময় দুই হাত ওঠাতেন, অন্য কোনো তাকবীর বা ওঠানামায় হাত ওঠাতেন না- এ তাঁর একার বর্ণনা নয়, আরো অনেক সাহাবী তা বর্ণনা করেছেন। আর কর্মরূপে তো শত শত সাহাবী বর্ণনা করেছেন।
সবচেয়ে বড় কথা এই যে, এটি (রাসূলল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামাযে শুধু তাকবীরে তাহরীমার সময় হাত ওঠানো, অন্য কোথাও না-ওঠানো) সাহাবা, তাবেয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীন-যুগের‘আমলে মুতাওয়াতির’ (যুগ পরম্পরায় চলে আসা ব্যাপক ও অনুসৃত কর্মধারা)-এর মাধ্যমে প্রমাণিত। এর বিশুদ্ধতা তাঁদের কাছে ছিল এক স্বতঃসিদ্ধ বিষয় । দ্বিতীয় খলীফায়ে রাশেদ উমর ইবনুল খাত্তাব ও চতুর্থ খলীফায়ে রাশেদ আলী ইবনে আবী তালিব রা.-এর আমলও এ অনুযায়ীই ছিল।
আলোচিত হাদীসটিকে শুধু শাস্ত্রীয় সহীহ নয়, অকাট্য ও সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত ঘোষণাকারীদের মধ্যে রয়েছেন প্রসিদ্ধ তাবেয়ী ইমাম ইবরাহীম আন্ নাখায়ী রাহ. (৯৫হি.)। একবার আমর ইবনে র্মুরা তাঁর সামনে বললেন, আমাকে ওয়াইল ইবনে হুজর রা.-এর পুত্র আলকামা তাঁর পিতা থেকে বর্ণনা করেছেন যে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে নামায পড়েছেন এবং তাঁকে তাকবীরে তাহরীমার সময়, রুকুতে যাওয়ার সময় ও তা থেকে ওঠার সময় দুই হাত ওঠাতে দেখেছেন। ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বললেন:
مَا ادري، لَعَلَّه لم ير النَّبِي صلى الله عَلَيْهِ واله وَسلم يفعل إلا ذَلِك الْيَوْم، فحفظ هَذَا مِنْهُ وَلم يحفظه ابْن مَسْعُود وَأَصْحَابه، مَا حفظته وَمَا سمعته من احد مِنْهُم، إنما كَانُوا يرفعون أيديهم فِي بَدْء الصَّلَاة حِين يكبرُونَ.
অর্থাৎ ‘আমার তো মনে হয়, তিনি (ওয়াইল ইবনে হুজর রা.) নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে ঐ একদিনই নামায পড়তে দেখেছেন। তো তিনি তাঁর রাফয়ে ইয়াদাইনের বিষয়টি ইয়াদ করে ফেললেন আর আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. ও তাঁর সাথীগণ সেটা ভুলে গেলেন? আমি তাদের কাউকে তা বলতে শুনিনি। তারা তো শুধু নামাযের শুরুতে তাকবীর দেওয়ার সময় হাত ওঠাতেন।’-কিতাবুল হুজ্জাহ আলা আহলিল মাদীনা, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান ১/৭৫-৭৬; শরহু মাআনিল আছার, ইমাম তহাবী ১/১৬২-১৬৩
ইবরাহীম নাখায়ী রাহ.-এর এ কথার উদ্দেশ্য, ওয়াইল ইবনে হুজর রা. মদীনার অধিবাসী ছিলেন না,বরং প্রতিনিধিদের সাথে এক-দুবার অল্প সময়ের জন্য ইয়ামান থেকে মদীনায় এসেছিলেন। সুতরাং তিনি যদি রাফয়ে ইয়াদাইন করতে দেখে থাকেন, তাহলে স্পষ্ট যে, এ মাঝেমধ্যের আমল হবে, যা তিনি দেখেছেন এবং ইয়াদ করেছেন। নতুবা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সাধারণ আমল এটাই ছিল যে, তিনি শুধু তাকবীরে তাহরীমার সময় রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন, আর কোথাও নয়। যদি রাফয়ে ইয়াদাইন করা স্বতন্ত্র কিংবা অধিকাংশ সময়ের আমল হত, তবে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.সহ বড় বড় সাহাবী, যাঁরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের পেছনে প্রথম কাতারে নামায পড়তেন, তাঁদের তা জানা থাকত এবং তাঁরা সে অনুযায়ীই আমল করতেন আর মানুষকে শেখাতেন। অথচ তাঁদের আমল ছিল রাফয়ে ইয়াদাইন না-করা। এবং নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায-পদ্ধতির উদ্ধৃতিতে তাঁরা মানুষকে এরই মৌখিক বা কর্মগত তালীম দিতেন। ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. বলেন, আমরা তাঁদের শাগরিদদের কাছ থেকে রাফয়ে ইয়াদাইন না-করাই পেয়েছি, করা নয়।
এ বাস্তবতাকেই ইমাম মুহম্মাদ ইবনুল হাসান রাহ. (১৩২-১৮৯হি.) এভাবে ব্যক্ত করেছেন:
جَاءَ الثبت عَن عَليّ بن ابي طَالب وَعبد الله بن مَسْعُود، أنهما لَا يرفعان فِي شَيْء من ذَلِك إلا فِي تَكْبِيرَة الِافْتِتَاح، فعلي ابْن ابي طَالب وَعبد الله بن مَسْعُود كَانَا أعْلَم برَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ واله وَسلم من عبد الله عمر، لِأَنَّهُ قد بلغنَا أَن رَسُول الله وَسلم صلى الله عَلَيْهِ وَسلم قَالَ: إذا أقيمت الصَّلَاة فليلني مِنْكُم أولو الاحلام والنهى ثمَّ الَّذين يَلُونَهُمْ ثمَّ الَّذين يَلُونَهُمْ، فَلَا نرى أن أحدا كَانَ يتَقَدَّم على أهل بدر مَعَ رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ وآله وَسلم إذا صلى، فنرى أن أصحاب الصَّفّ الأول وَالثَّانِي أهل بدر وَمن أشبههم فِي مَسْجِد الْمُسلمين، وأن عبد الله بن عمر رَضِي الله عَنْهُمَا ودونه من فتيانهم خلف ذَلِك فنرى عليا وَابْن مَسْعُود رَضِي الله عَنْهُمَا وَمن اشبههما من أهل بدر أعْلَم بِصَلَاة رَسُول الله صلى الله عَلَيْهِ واله وَسلم، لأنهم كَانُوا أقْرب إليه من غَيرهم وأنهما أعرف بِمَا ياتي من ذَلِك وَمَا يدع.
অর্থাৎ ‘আলী ইবনে আবী তালিব ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে নির্ভরযোগ্য খবর এসেছে যে, এঁরা নামাযে তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া আর কোথাও দুই হাত ওঠাতেন না। আর এঁরা দুজনই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পর্কে আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা.-এর চেয়ে বেশি অবগত ছিলেন। আমাদের কাছে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এ ইরশাদ পৌঁছেছে যে,তোমাদের মধ্যে যারা অধিক জ্ঞানী ও বুদ্ধিমান তারা আমার কাছে দাঁড়াবে। এরপর যারা তাদের পরের স্তরের, এরপর যারা তাদের পরের স্তরের।
এজন্য আমরা মনে করি না, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে নামাযে অন্য কেউ বদরী সাহাবীদের চেয়ে অগ্রবর্তী হত। আমরা বরং মনে করি, মুসলমানদের মসজিদে প্রথম ও দ্বিতীয় কাতারস্থ ছিলেন আহলে বদর ও তাঁদের সমপর্যায়ের সাহাবীগণ। আর আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. ও যুবক সাহাবীগণ দাঁড়াতেন এর পিছনে।
সুতরাং আমরা মনে করি, আলী ইবনে আবী তালিব রা., আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. ও তাঁদের অনুরূপ অন্যান্য বদরী সাহাবীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায সম্পর্কে অধিক অবগত ছিলেন। কারণ এঁরা অন্যদের চেয়ে তাঁর অধিক নিকটবর্তী ছিলেন এবং তিনি কী করতেন কী করতেন না সেটা বেশি বুঝতেন।’-কিতাবুল হুজ্জা আলা আহলিল মাদীনা, ইমাম মুহাম্মাদ ইবনুল হাসান ১/৯৪-৯৫
কথা দীর্ঘ হয়ে গেল। আমি মূলত আরয করছিলাম, ইবরাহীম নাখায়ী রাহ.-এর উপরিউক্ত বক্তব্য থেকে বড় বড় সাহাবীর বাসস্থান কূফায় সাহাবা-যুগ থেকে রাফয়ে ইয়াদাইন না-করার আমলগত তাওয়াতুর (কর্মধারা) যেমন প্রমাণিত হচ্ছে, তেমনি এ-ও প্রমাণিত হচ্ছে যে, ইবরাহীম নাখায়ী রাহ.-এর দৃষ্টিতে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. ও অন্যান্য সাহাবী কর্তৃক রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায-পদ্ধতির বরাতে রাফয়ে ইয়াদাইন না-করার তালীম দেওয়া ছিল একটি মীমাংসিত বাস্তবতা ।
তো বিষয়বস্তুর দিক থেকে আলোচিত হাদীসটির বিশুদ্ধতা ও প্রামাণিকতা তাবেয়ী-যুগে একটি স্বতঃসিদ্ধ বাস্তবতা ছিল, যার প্রতিধ্বনি আমরা ইবরাহীম নাখায়ী রাহ.-এর এ বক্তব্যে শুনতে পাই।
সনদগত দিক থেকেও অনেক মুহাদ্দিস একে ‘সহীহ’ বলেছেন। আর বিষয়বস্তুর দিক থেকে এ কর্মগত মুতাওয়াতির এবং খাইরুল কুরূনে একে কর্মগত ও মৌখিক উভয়ভাবে সহীহ বলা হয়েছে। তা সত্তে¡ও কিছু সংখ্যক হাদীস বিচারক কর্তৃক এর উপর কিছু সনদগত আপত্তি উত্থাপিত হয়েছে, যার স্পষ্ট ও দলীলভিত্তিক উত্তর বিদ্যমান ছিল। এবং বড় বড় মুহাদ্দিসগণ সেসব উত্তর উপস্থাপনও করেছেন। আর কেউ কেউ তো এমন কিছু আপত্তি-ও করেছে, যা একেবারে ‘লাহনে জালী’র অন্তর্ভুক্ত। এগুলোর হাকীকতও স্পষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।
নিয়ম হল কোনো শাস্ত্রীয় আপত্তির যুক্তিসঙ্গত ও সন্তোষজনক জবাব এসে গেলে আর তার পুনরাবৃত্তি করা যায় না। আর ‘লাহনে জালী’র পুনরাবৃত্তির তো প্রশ্নই আসে না। কিন্তু বর্তমানে ফিকহে ইসলামী ও মুজতাহিদ ইমামদের প্রতি একধরনের শত্রæতা পোষণকারী একটি দল আছে, যারা হাদীস অনুসরণের অনুসৃত ও মাসনূন তরীকা ছেড়ে দিয়ে এক নবআবিষ্কৃত পন্থায় তা অনুসরণ করছে। এদের মধ্যে যাদের জরহ-তাদীল ও ইলালুল হাদীস শাস্ত্রের নিয়মনীতি ও পরিভাষাগুলো শাস্ত্রজ্ঞদের সাহচর্যে থেকে শেখার সুযোগ হয়নি, তারা কখনো শুধু তরজমার উপর ভিত্তি করে, কখনো নিজের বা অন্যের অপরিপক্ব সমঝের উপর নির্ভর করে ‘লাহনে জালী’সহ ঐ সব আপত্তি এভাবে পেশ করছে,যেন তারা কোনো কীর্তি আঞ্জাম দিচ্ছে! অথচ এ কীর্তি নয়, নিছক না-ইনসাফি ও যুলুম।
মুনাসিব মনে হচ্ছে, যুক্তিসঙ্গত ও সন্তোষজনক জবাব থাকা সত্ত্বেও যে আপত্তিগুলোর কিংবা ‘লাহনে জালী’র যে বিষয়গুলোর খামোখা পুনরাবৃত্তি করা হচ্ছে, তার আংশিক সম্পর্কে নমুনাস্বরূপ কিছু পর্যালোচনা করা যায়।
এক. ইমাম আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক রাহ.-এর নামে চালানো আপত্তি
‘জামে তিরমিযী’তে উদ্ধৃত আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক রাহ.-এর একটি বক্তব্য ভুল বুঝে কেউ কেউ এ আপত্তি করেছে যে, তিনি এই হাদীসকে অপ্রমাণিত বলেছেন। অথচ পাঠকগণ দেখেছেন, আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক রাহ. নিজেই এ হাদীসের একজন রাবী। তিনি সুফিয়ান ছাওরী রাহ. থেকে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন। সুনানে নাসায়ী’র বরাতে আমরা তা উল্লেখ করেছি।
‘জামে তিরমিযী’তে আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক রাহ.-এর বক্তব্যটি সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে। তবু তাতে যা কিছু আছে আগে তা দেখুন:
وقال عبد الله بن المبارك: قد ثبت حديث من يرفع، وذكر حديث الزهري، عن سالم، عن أبيه، ولم يثبت حديث ابن مسعود أن النبي صلى الله عليه وسلم لم يرفع إلا في أول مرة.
অর্থাৎ ইবনুল মুবারক রাহ. বলেন, যারা রাফয়ে ইয়াদাইন করেন, তাদের (দলীল-উপস্থাপনের) হাদীস প্রমাণিত। এ কথা বলে তিনি ইবনে উমর রা. এর হাদীসের আলোচনা করেছেন। (এবং বলেছেন) ইবনে মাসউদ রা.-এর মাধ্যমে বর্ণিত এ হাদীস প্রমাণিত নয় যে, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রথমবার ছাড়া আর কোথাও রাফয়ে ইয়াদাইন করেননি ।-জামে তিরমিযী, ইবনে উমর রা.-এর হাদীস (২৫৫)-এর আলোচনা
লক্ষণীয়! এখানে ইবনুল মুবারক রাহ. এ কথা বলেননি, রাফয়ে ইয়াদাইন না-করা বিষয়ক সমস্ত হাদীস অপ্রমাণিত। আর না এ কথা বলেছেন, রাফয়ে ইয়াদাইন না-করা বিষয়ে ইবনে মাসউদ রা.-এর মাধ্যমে বর্ণিত কোনো হাদীস প্রমাণিত নয়। এখানে তিনি একটি বিশেষ রেওয়ায়েত সম্পর্কে আপত্তি করেছেন। তা হল, কোনো কোনো রাবী ইবনে মাসউদ রা.-এর বরাতে তাঁর এই মৌখিক হাদীস বর্ণনা করেছে, ‘নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাযে তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া আর কোথাও হাত ওঠাননি।’ ইবনে মাসউদ রা.-এর মাধ্যমে বর্ণিত এই মৌখিক হাদীস সম্পর্কেই ইবনুল মুবারক রাহ. বলেছেন, এটি প্রমাণিত নয়। যদিও বিভিন্ন মুহাদ্দিসের মতে একেও অপ্রমাণিত বলা সঠিক না।
কিন্তু আলোচিত হাদীসটি, যাতে ইবনে মাসউদ রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায দেখানোর লক্ষ্যে নামায পড়েছেন এবং তাতে তিনি (ইবনে মাসউদ রা.) শুধু প্রথম তাকবীরের সময় দুই হাত উঠিয়েছেন, অন্য কোথাও ওঠাননি- এর ব্যাপারে ইবনুল মুবারক রাহ. অপ্রমাণিতের হুকুম আরোপই করেননি। বরং তিনি নিজে সুফিয়ান ছাওরী রাহ. থেকে তা বর্ণনা করেছেন।
মুহাদ্দিসগণের সাধারণ নীতি হল, কোনো বিষয়ে যদি একাধিক হাদীস থাকে, যার মধ্যে কিছু সহীহ,কিছু সহীহ নয়, তাহলে তারা যেটা সহীহ নয় সেটাকে সহীহ নয়ই বলেন। এর অর্থ এই না যে, এ বিষয়ক সকল হাদীসকে তারা সহীহ নয় বলছেন।
ইবনুল মুবারক রাহ.-এর বক্তব্যটি আরো বিশদভাবে ‘সুনানে কুবরা’ বায়হাকীতে (২/৭৮) বর্ণিত হয়েছে। সেখানে তিনি রাফয়ে ইয়াদাইনের প্রাধান্য উল্লেখ করা সত্তে¡ও এ কথা বলেছেন, وَأَرَاهُ وَاسِعًا অর্থাৎ আমি হাত ওঠানো, না-ওঠানো দুটোকেই প্রশস্ত মনে করি।
তো ইবনুল মুবারক রাহ.-এর মতে যখন হাত না-ওঠানোরও সুযোগ আছে, তাহলে বোঝা গেল তাঁর কাছে এ পদ্ধতিও কোনো না কোনো হাদীস বা আছার দ্বারা প্রমাণিত।
এর পরও যদি কেউ খামোখা এ পীড়াপীড়ি করে যে, ইবনুল মুবারক রাহ. আলোচিত হাদীস সম্পর্কেই বলেছেন, এটি প্রমাণিত নয়, তাহলে আদবের সাথে আমরা এ কথাই আরয করব যে, এটি ইবনুল মুবারক রাহ.-এর দৃষ্টিতে প্রমাণিত না হলেও তাঁর উস্তায সুফিয়ান ছাওরীর দৃষ্টিতে প্রমাণিত। এমনভিাবে তাঁর উস্তাযদের উস্তাযুল আসাতিযা তাবেয়ী ইমাম ইবরাহীম নাখায়ীর দৃষ্টিতেও প্রমাণিত।[3] ইমাম ইবনে দাকীকুল ঈদ রাহ. (৭০২হি.)-এর ভাষায়, যদি ধরেও নেওয়া হয়, এটি ইবনুল মুবারক রাহ.-এর মতে প্রমাণিত নয়, তবে এই সনদের তাহকীক করতে কী সমস্যা? এরপর তিনি সনদের তাহকীক পেশ করেছেন এবং দেখিয়েছেন, তাতে অপ্রমাণিত হওয়ার কিছুই নেই।-দেখুন: নাসবুর রায়াহ ১/৩৯৫
এ হাদীসে কি ثم لم يعد বাক্য নেই?
অনেক জোরেশোরে এ আপত্তি করা হয় যে, এ হাদীসে ثم لم يعد বাক্যটি সহীহ নয়। এটি কোনো রাবীর ভুল কিংবা তার নিজের পক্ষ থেকে বাড়ানো।
আপত্তির উদ্দেশ্য সম্ভবত এই যে, আলোচিত হাদীসটি দ্বারা রাফয়ে ইয়াদাইন না-করা প্রমাণিত হওয়া এ বাক্যটির উপর নির্ভরশীল। সুতরাং এটি যখন সহীহ নয় তখন এর দ্বারা দলীল পেশ করাও ঠিক হবে না। অথচ এ কথা সঠিক নয় যে, এ হাদীসে ثم لم يعد বাক্যটি সহীহ না, বরং তা নিঃসন্দেহে সহীহ। এ সত্তে¡ও যদি ধরে নেওয়া হয়, এটি সহীহ নয় তবু হাদীসটির বাকি অংশ থেকে সে কথাই প্রমাণিত হয়, যা প্রমাণিত হয় ثم لم يعد বাক্যটি থেকে।
ثم لم يعد বাক্যটি কেন সহীহ নয়? কে তা বাড়িয়েছে? এ সম্পর্কে দারাকুতনী রাহ.-এর বক্তব্যের সারসংক্ষেপ এই যে, (তাঁর ধারণামতে) ওকী রাহ.-এর শাগরিদ হিম্মানী (যিনি যয়ীফ) এ বাক্যটি বর্ণনা করেন। তাঁর ছিকা শাগরিদ আহমদ ইবনে হাম্বল, আবু বকর ইবনে আবী শাইবা ও ইবনে নুমাইরের বর্ণনায় তা নেই। এমনিভাবে (তাঁর ধারণামতে) সুফিয়ান ছাওরী রাহ.-এর শাগরিদদের মধ্যে আবু হুযায়ফা (দারাকুতরী রাহ.-এর মতে যার বর্ণনায় অনেক ভুল হয়েছে)[4] এ বাক্যটি বর্ণনা করেন। তাঁর ছিকা শাগরিদ মুআবিয়া ইবনে হিশামের বর্ণনায় তা নেই।[5]
দারাকুতনী রাহ. পরিষ্কার বলেছেন, এ হাদীসের সনদ সহীহ। তাঁর আপত্তি শুধু এই যে, ثم لم يعد বাক্যটি মাহফূয নয়…।
وَإِسْنَادُهُ صَحِيحٌ، وَفِيهِ لَفْظَةٌ لَيْسَتْ بِمَحْفُوظَةٍ… ৬[6]
এখানে লক্ষণীয় বিষয় এই যে, ইমাম দারাকুতনীর মতে এ হাদীসের সনদ সহীহ। কিন্তু যেহেতু তাঁর ধারণা অনুযায়ী ثم لم يعد বাক্যটি ওকী থেকে হিম্মানী আর সুফিয়ান ছাওরী থেকে আবু হুযায়ফা বর্ণনা করেন, তাই একে তিনি সহীহ বলতে প্রস্তুত নন, নতুবা মূল হাদীসটি তাঁর মতে সহীহ। ইমাম আবুল হাসান ইবনুল কাত্তান রাহ. (৬২৮হি.) ‘বায়ানুল ওয়াহামি ওয়ালঈহাম’ কিতাবে (৩/৩৬৫-৩৬৭) দারাকুতনী রাহ.-এর বক্তব্যের এ মর্মই বুঝেছেন। তিনি নিজেও এবং ‘অন্যান্যদের’ উদ্ধৃতিতে বলেছেন, এ হাদীস সহীহ। আপত্তি শুধু ثم لم يعد বাক্যটি নিয়ে।
অথচ ওকীর ছিকা শাগরিদদের মধ্যে যুহাইর ইবনে হারব, যিনি বড় হাফিযুল হাদীস ছিলেন, তাঁর থেকে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং তাতে ثم لم يعد বাক্য আছে।[7] একারণে এ ধারণা সঠিক নয় যে, ثم لم يعد বাক্যটি হিম্মানীর একার বর্ণনা। এমনিভাবে সুফিয়ান ছাওরীর ছিকা শাগরিদদের মধ্যে আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক রাহ.-এর মত ইমাম ও হাফিযুল হাদীস তাঁর থেকে এ হাদীস বর্ণনা করেছেন এবং তাতে ثم لم يعد বাক্য আছে।[8] তাই এ ধারণাও সঠিক নয় যে, এটি আবু হুযায়ফার একার বর্ণনা। সুতরাং দারাকুতনী রাহ.-এর আপত্তির ভিত্তি শেষ হয়ে যাওয়ায় তাঁর বক্তব্য অনুযায়ী এ হাদীস ثم لم يعد বাক্যসহই সহীহ।
এখানে আরেকটি বিষয় লক্ষণীয়, দারাকুতনী রাহ. যে বলেছেন, ওকীর শাগরিদ আহমদ ইবনে হাম্বল,আবু বকর ইবনে আবী শাইবা ও ইবনে নুমাইরের বর্ণনায় ثم لم يعد বাক্য নেই, তাঁদের বর্ণনায় তাহলে কী আছে? ইমাম আহমদের বর্ণনা তাঁর ‘মুসনাদ’ গ্রন্থে আর আবু বকর ইবনে আবী শাইবার বর্ণনা তাঁর ‘মুসান্নাফ’ গ্রন্থে বিদ্যমান আছে। উভয়ের বর্ণনায় স্পষ্টভাবে এ কথা আছে, فلم يرفع يديه إلامرةঅর্থাৎ ‘আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায দেখানোর সময় শুধু একবার দুই হাত উঠিয়েছেন।’[9]
শুধু একবার ওঠানোর অর্থ এটাই যে, দ্বিতীয়বার আর ওঠাননি। আর ثم لم يعد বাক্যের অর্থও তাই। এতে অতিরিক্ত কিছু নেই।
ওকী রাহ.-এর শাগরিদ ইমাম হান্নাদের বর্ণনা প্রবন্ধের শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। তাতে স্পষ্টভাবে আছে, فلم يرفع يديه إلا في أول مرة অর্থাৎ ‘শুধু প্রথমবার দুই হাত উঠিয়েছেন।’ এর অর্থও এটাই যে,আর কোথাও ওঠাননি। ওকীর শাগরিদ মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাইল আলআহমাসী, মাহমূদ ইবনে গায়লান ও উসমান ইবনে আবী শাইবাও তাঁর থেকে একই কথা বর্ণনা করেছেন-
فلم يرفع يديه إلا في أول مرة
অর্থাৎ ‘তিনি শুধু একবার দুই হাত উঠিয়েছেন।’ এর অর্থ এ ছাড়া আর কী যে, তিনি আর কোথাও হাত ওঠাননি।[10]
এ থেকে বোঝা গেল, দারাকুতনী রাহ.-এর ধারণা, ثم لم يعد বাক্যটি ওকীর ছিকা শাগরিদের বর্ণনায় নেই, হলেও এ প্রসঙ্গ আসত না যে, তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে রাফয়ে ইয়াদাইন না-করা বিষয়ে এ হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করা ঠিক না। বরং দলীল-উপস্থাপনের বিষয়টি ঠিক আগের মতই থাকছে। আর এখন যখন তা সঠিকই হল না, বরং ছিকা শাগরিদের বর্ণনায় ثم لم يعد বাক্য আছে তখন তো তাঁর আপত্তির ভিত্তিই শেষ হয়ে গেল।
দারাকুতনী রাহ.-এর আপত্তি সম্পর্কিত আলোচনা থেকে এ বিষয়টিও পরিষ্কার হয়ে গেল, ইবনে হিব্বান রাহ. সহ কেউ কেউ যে বলেছেন, ثم لم يعد বাক্যটি ওকী নিজের পক্ষ থেকে বলেছেন, এটি হাদীসের অংশ নয়- এ দাবি একেবারে ভিত্তিহীন। এ যদি ওকী কর্তৃক বর্ধিত হত তাহলে সুফিয়ান ছাওরীর শাগরিদ আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারকের বর্ণনায় তা কোত্থেকে এল?[11]
আরেকটি আপত্তি
ইমাম বুখারী রাহ. ‘জুযউ রাফউল ইয়াদাইন’-এ লিখেছেন-
وَيُرْوَى عَنْ سُفْيَان، عَنْ عَاصِمِ بْنِ كُلَيْبٍ. عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ الْأَسْوَدِ، عَنْ عَلْقَمَةَ قَالَ: قَالَ ابْنُ مَسْعُودٍ: ” أَلَا أُصَلِّي بِكُمْ صَلَاةَ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ: فَصَلَّى وَلَمْ يَرْفَعْ يَدَيْهِ إِلَّا مَرَّةً
অর্থাৎ সুফিয়ান ছাওরী আসিম ইবনে কুলাইব থেকে, তিনি আবদুর রহমান ইবনুল আসওয়াদ থেকে,তিনি আলকামা থেকে, তিনি ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেছেন, আমি কি তোমাদের নিয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামাযের মত নামায পড়ব না? এরপর তিনি নামায পড়েছেন এবং শুধু একবার রাফয়ে ইয়াদাইন করেছেন।
ইমাম বুখারী এখানে আলোচিত হাদীসটি وَلَمْ يَرْفَعْ يَدَيْهِ إِلَّا مَرَّةً (শুধু একবার রাফয়ে ইয়াদাইন করেছেন) বাক্যে উদ্ধৃত করেছেন, ثم لم يعد বাক্যে নয়। তা সত্তে¡ও লিখেছেন-
وَقَالَ أَحْمَدُ بْنُ حَنْبَلٍ: عَنْ يَحْيَى بْنِ آدَمَ[12] قَالَ: نَظَرْتُ فِي كِتَابِ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ إِدْرِيسَ عَنْ عَاصِمِ بْنِ كُلَيْبٍ لَيْسَ فِيهِ: ثُمَّ لَمْ يَعُدْ. فَهَذَا أَصَحُّ لِأَنَّ الْكِتَابَ أَحْفَظُ عِنْدَ أَهْلِ الْعِلْمِ لِأَنَّ الرَّجُلَ رُبَّمَا حَدَّثَ بِشَيْءٍ ثُمَّ يَرْجِعُ إِلَى الْكِتَابِ فَيَكُونُ كَمَا فِي الْكِتَابِ.
এ বক্তব্যের একটি মর্ম এই হতে পারে যে, আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীসের কাছে আসিম ইবনে কুলাইবের কিতাব ছিল। তাতে ইয়াহইয়া ইবনে আদম সুফিয়ান ছাওরীর বর্ণনাকৃত হাদীসটি প্রত্যক্ষ করেছেন। কিন্তু ثُمَّ لَمْ يَعُدْ বাক্য তিনি পাননি।
দ্বিতীয় মর্ম এই হতে পারে যে, ইয়াহইয়া ইবনে আদম আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীসের কিতাব পাঠ করেছেন। তাতে তিনি আসিম ইবনে কুলাইবের এই হাদীস, যা সুফিয়ান ছাওরী বর্ণনা করেন,পেয়েছেন। কিন্তু তাতে ثُمَّ لَمْ يَعُدْ বাক্য ছিল না।
যেন বলতে চাচ্ছেন, এ থেকে বোঝা গেল, সুফিয়ান ছাওরীর এখানে ভুল হয়ে গেছে! আর এজন্যই তিনি ثُمَّ لَمْ يَعُد বাক্যটি বাড়িয়ে দিয়েছেন!? নতুবা আসিম ইবনে কুলাইবের হাদীসে এ বাক্য ছিল না,যেমনটি আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীসের কিতাবের উদ্ধৃতিতে ইয়াহইয়া ইবনে আদম বলেছেন।
এ দাবি প্রমাণের জন্যই বলা হয়েছে, الْكِتَاب أَحْفَظُ অর্থাৎ ‘কিতাবের ইয়াদ সবচেয়ে শক্তিশালী।’ স্মৃতি থেকে বর্ণনার ক্ষেত্রে রাবীর কখনো ভুল হয়ে যায়। পরে কিতাবের শরণাপন্ন হয়ে তা সংশোধন করে নেয়। সুতরাং ইয়াহইয়া ইবনে আদমের মাধ্যমে আমরা যেহেতু কিতাবের বর্ণনা পেয়ে গেছি তাই একেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। অর্থাৎ বলা উচিত, এই হাদীসে ثُمَّ لَمْ يَعُدْ বাক্য নেই।[13]
শাস্ত্রীয় প্রশ্ন
‘জুযউ রাফউল ইয়াদাইন’-এর এ আলোচনার উপর শাস্ত্রীয় দিক থেকে বিভিন্ন প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। একাধিক মুহাদ্দিস সংক্ষেপে সেগুলোর দিকে ইঙ্গিত করেছেন। আলোচনার পূর্ণতার স্বার্থে এখানে তা উল্লেখ করা মুনাসিব মনে হচ্ছে।
এক. ইমাম আহমদ রাহ.-এর বক্তব্যটি সংক্ষেপে উল্লেখ করা হয়েছে। এজন্য তাতে কারো এ ধারণার সৃষ্টি হতে পারে যে, ইয়াহইয়া ইবনে আদম যেন সরাসরি আসিম ইবনে কুলাইবের কিতাবেই আলোচিত হাদীসটি প্রত্যক্ষ করেছেন। অথচ বিষয়টি এ রকম নয়। ইমাম আহমদের ছেলে মুহাদ্দিস আবদুল্লাহ ‘আলইলাল ওয়া মারিফাতুর রিজাল’ (১/৩৭০-৩৭১)-এ তার পিতার পুরো বক্তব্য উল্লেখ করেছেন। তা থেকে স্পষ্ট যে, ঐ কিতাবটি আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীসের ছিল। তিনি নিজ কিতাব থেকে ইয়াহইয়া ইবনে আদমকে আসিম ইবনে কুলাইবের হাদীস লিখিয়েছেন। সুতরাং ব্যাপারটি এ রকম নয় যে, ইয়াহইয়া ইবনে আদমের মাধ্যমে আমরা হাদীসটি আসিম ইবনে কুলাইবের কিতাবে কীভাবে লিখিত ছিল সেটা পেয়ে গেছি। বরং ব্যাপারটি শুধু এটুকু যে, সুফিয়ান ছাওরী ছাড়া আসিম ইবনে কুলাইবের আরেকজন শাগরিদ আব্দুল্লাহ ইবনে ইদ্রীসের বর্ণনা আমরা পেয়েছি, যা তিনি ইয়াহইয়া ইবনে আদমকে মৌখিক নয়, কিতাব থেকে লিখিয়েছেন।
দুই. সুফিয়ান ছাওরী আসিম ইবনে কুলাইব থেকে যে হাদীস বর্ণনা করেছেন, একই হাদীস আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীসও আসিম ইবনে কুলাইব থেকে বর্ণনা করেছেন, যদি বিষয়টি এ রকমই হয় তাহলে ইনসাফের দাবি হল উভয় বর্ণনার মাঝে তুলনা করা। এবং তাতে কোনো বিরোধ থাকলে কোনটি অগ্রগণ্য কোনটি অনগ্রগণ্য সেটা নির্ণয় করা।
‘জুযউ রাফউল ইয়াদাইনে’র বক্তব্যটি সংক্ষিপ্ত হওয়ায় তাতে এ ধারণার সৃষ্টি হয় যে, ইয়াহইয়া ইবনে আদম আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীসের কাছে আসিম ইবনে কুলাইবের ঠিক ঐ হাদীসটিই দেখেছেন,যা সুফিয়ান ছাওরী আসিম ইবনে কুলাইব থেকে বর্ণনা করেছেন। অথচ আবদুল্লাহ ইবনে আহমদের পুরো আলোচনা থেকে এ কথা পরিষ্কার, আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীসের বর্ণনাকৃত হাদীস সনদের দিক থেকে সুফিয়ান ছাওরীর বর্ণনাকৃত হাদীসের সদৃশ হলেও আসলে তা ভিন্ন একটি হাদীস।
আবদুল্লাহ ইবেন আহমদ বলেন-
حَدَّثَنِي أَبِي قَالَ حَدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ آدَمَ قَالَ أَمْلَاهُ عَلَيَّ عَبْدُ اللَّهِ بْنُ إِدْرِيسَ مِنْ كِتَابِهِ عَنْ عَاصِمِ بْنِ كُلَيْبٍ عَنْ عَبْدِ الرَّحْمَنِ بْنِ الْأَسْوَدِ قَالَ حَدَّثَنَا عَلْقَمَةُ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ قَالَ عَلَّمَنَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الصَّلَاةَ فَكَبَّرَ وَرَفَعَ يَدَيْهِ ثُمَّ رَكَعَ وَطَبَّقَ يَدَيْهِ وَجَعَلَهُمَا بَيْنَ رُكْبَتَيْهِ فَبَلَغَ سَعْدًا فَقَالَ صَدَقَ أَخِي قَدْ كُنَّا نَفْعَلُ ذَلِكَ ثُمَّ أَمَرَنَا بِهَذَا وَأَخَذَ بِرُكْبَتَيْهِ حَدثنِي عَاصِم بن كُلَيْب هَكَذَا [14]
আমাকে আমার পিতা (ইমাম আহমাদ) বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আমাকে ইয়াহইয়া ইবনে আদম বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, আমাকে আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীস নিজ কিতাব থেকে আসিম ইবনে কুলাইবের উদ্ধৃতিতে বর্ণনা করেছেন। তিনি আবদুর রহমান ইবনে আসওয়াদ থেকে, তিনি বলেন,আমাকে আলকামা আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। তিনি (ইবনে মাসউদ রা.) বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নামায শিখিয়েছেন। তিনি তাকবীর দিয়ে দুই হাত উঠিয়েছেন।[15] তারপর রুকু করেছেন এবং তাতে দুই হাত জড়ো করে দুই হাঁটুর মাঝে রেখেছেন। সাদ রা.-এর কাছে এ খবর পৌঁছলে তিনি বলেন, আমার ভাই (আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ) সত্য বলেছেন। আমরা (আগে) তাই করতাম। পরে আমাদের এই হুকুম দেওয়া হয়। এ কথা বলে তিনি দুই হাঁটু ধরেছেন।
(আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীস বলেন) আসিম ইবনে কুলাইব এ হাদীস আমাকে (সরাসরি) বর্ণনা করেছেন।-আলইলাল ওয়মারিফাতুর রিজাল ১/৩৭০-৩৭১[16]
এ উদ্ধৃতি থেকে বোঝা গেল:
১. ঐ কিতাবটি আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীসের ছিল, আসিম ইবনে কুলাইবের নয়।
২. আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীস তাঁর বর্ণনাকৃত হাদীসটি সরাসরি আসিম ইবনে কুলাইব থেকে বর্ণনা করেছেন। কিন্তু তাঁর কাছ থেকে শুনে তিনি সেসময়ই নিজ কিতাবে লিখে নিয়েছিলেন কি না, লেখার পর তাঁকে দেখিয়েছিলেন কি না, এমনিভাবে আসিম ইবনে কুলাইব তাঁকে মৌখিকভাবে বর্ণনা করেছিলেন, না নিজ কিতাব থেকে দেখে- আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীসের বর্ণনায় এগুলোর কোনো বিবরণ নেই। অথচ এসব তথ্য ছাড়া الْكِتَابَ أَحْفَظُ -এর নীতিতে আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীসের বর্ণনাকে প্রাধান্য দেওয়া প্রশ্নবিদ্ধ।
৩. সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কথা এই যে, আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীস আসিম ইবনে কুলাইবের উদ্ধৃতিতে যে হাদীসটি ইয়াহইয়া ইবনে আদমকে বর্ণনা করেছেন, সেটা আর সুফিয়ান ছাওরীর বর্ণনাকৃত হাদীস এক নয়, দুটো ভিন্ন ভিন্ন হাদীস।
সুফিয়ান ছাওরীর বর্ণনাকৃত হাদীসের সারসংক্ষেপ হল, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. তাঁর শাগরিদদের রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামায দেখানোর উদ্দেশ্যে নামায পড়েছেন। তাতে তিনি (আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.) শুধু তাকবীরে তাহরীমার সময় হাত উঠিয়েছেন, আর কোথাও নয়।
আর আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীসের বর্ণনাকৃত হাদীসের সারসংক্ষেপ হল, ইবনে মাসউদ রা. তাঁর শাগরিদদের বলেছেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদের নামায শিখিয়েছেন। এরপর তিনি তাঁর (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের) নামাযের মৌখিক বর্ণনা দিয়েছেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকবীর দিয়ে নামায শুরু করেছেন। এরপর যখন রুকুর সময় হল রুকু করেছেন এবং তাতে দুই হাত জড়ো করে দুই হাঁটুর মাঝে রেখেছেন।’ সুতরাং প্রেক্ষাপট ও বিষয়বস্তু উভয় দিক থেকে এ ভিন্ন ভিন্ন দুই হাদীস।[17]
তিন. যখন সুফিয়ান ছাওরী ও আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীসের বর্ণনা ভিন্ন ভিন্ন দুই হাদীস, একই হাদীসের দুই বর্ণনা নয়, তখন একটিকে অন্যটির সাথে তুলনা করা এবং তাতে কোনো ফারাক দৃষ্টিগোচর হলে অন্যটিকে মাহফূয নয় বলা সঠিক না।
চার. আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীসের কিতাবে সুফিয়ান ছাওরীর বর্ণনাকৃত হাদীস একেবারেই নেই। এমন না যে, তাতে মূল হাদীসটি আছে বটে ثُمَّ لَمْ يَعُد বাক্যটি নেই। তাহলে কি সুফিয়ান ছাওরীর পুরো বর্ণনাই ভুল? যখন পুরো বর্ণনা আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীসের কিতাবে না থাকা সত্তে¡ও একে সহীহ বলা হচ্ছে তো ثُمَّ لَمْ يَعُد বা এর সমার্থক বাক্যের কী দোষ যে, শুধু এটিই যয়ীফ বা অসংরক্ষিত হয়ে যায়!
পাঁচ. الْكِتَاب أَحْفَظُ অর্থাৎ ‘কিতাবের ইয়াদ সবচেয়ে শক্তিশালী’ আইম্মায়ে হাদীসের ভাষ্য অনুযায়ী এটি সর্বত্র-প্রযোজ্য কোনো নীতি নয়। এমন অনেক মুহাদ্দিস আছেন, যাদের ইয়াদ কিতাবের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। কোনো কোনো মুহাদ্দিসকে তাদের শক্তিশালী হিফয ও নিখুঁত বর্ণনার কারণে জরহ-তাদীলের ইমামগণ ‘মুছহাফ’ বলেছেন।[18]
উসূলুল হাদীস শাস্ত্রের নির্ভরযোগ্য ও প্রসিদ্ধ কিতাব ‘আলকিফায়া’তে খতীব বাগদাদী রাহ. (৪৬৩হি.) লিখেছেন, নিখুঁত বর্ণনাকারী হাফিযুল হাদীসের হিফয আর তার কিংবা অন্যের কিতাবের মধ্যে বিরোধ দেখা দিলে ফায়সালা তার হিফযের পক্ষেই হবে।
الْحُكْمُ لِحِفْظِ الْحَافِظِ الْمُتْقِنِ عَلَى كِتَابِهِ وَكِتَابِ غَيْرِهِ.
এই শিরোনামের অধীনে তাঁর উল্লেখ-করা কয়েকটি ঘটনার মধ্যে দু’টি ঘটনা এই:
১.ইমাম আহমদ বলেন, একবার আমি ও আলী ইবনুল মাদীনী সুলায়মান ইবনে হারবের কাছে গিয়ে বললাম, আমাদের আপনার উস্তায হাম্মাদ ইবনে যাইদের হাদীস কিতাব থেকে শুনান। তিনি বললেন,তা হবে না। এ কিতাব তো আমি আমার ইয়াদ থেকেই লিখেছি। আর আমার ইয়াদ আমার কিতাবের চেয়ে বেশি সহীহ।
…وَحِفْظِي أَصَحُّ مِنْ كِتَابِي
২.যুহাইর ইবনে মুআবিয়া সুফিয়ান ইবনে উয়াইনার কাছে গিয়ে বললেন, আমাদের আপনার কিতাব দেখান। তিনি বললেন, আমার ইয়াদ আমার কিতাবের চেয়ে বেশি মজবুত। এ কিতাব তো আমি আমার ইয়াদ থেকেই লিখেছি।
أَنَا أَحْفَظُ مِنْ كِتَابِي…
-আলকিফায়া ফী ইলমির রিওয়ায়াহ পৃ. ১১৩-১১৪
যদি সুলায়মান ইবনে হারব ও সুফিয়ান ইবনে উয়াইনার ইয়াদই এ পর্যায়ের হয় তাহলে ইমাম সুফিয়ান ছাওরী রাহ.-এর ইয়াদ কী পর্যায়ের হবে তা সহজেই অনুমেয়। তাঁর ইয়াদ নিঃসন্দেহে কিতাবের চেয়ে বেশি সহীহ হবে। [19]
কিতাব-নির্ভরশীলতার কারণে রাবীদের থেকে কখনো কখনো যে ভুল হয়ে যায়, ইলালুল হাদীস ও শরহুল হাদীসের কিতাবে সেগুলো চিহ্নিত করা হয়। কিছু উদাহরণের জন্য দেখুন : আততামহীদ ২২/২৫৮, ২৩/২৮৫; আলইসতিযকার, ইবনে আবদুল বার ৮/২৯৮
এজন্য শুধু الْكِتَاب أَحْفَظُ ‘কিতাবের ইয়াদ সবচেয়ে শক্তিশালী’ এ একতরফা নীতির ভিত্তিতে সুফিয়ান ছাওরী রাহ.-এর মত ইমামুল হুফ্ফাযের বর্ণনার উপর ভুলের হুকুম আরোপ করা আপত্তিকর। [20]
ছয়. সুফিয়ান ছাওরী ও ইবনে ইদ্রীস দুজনই বড় হাফিযুল হাদীস ও ইমাম ছিলেন। কিন্তু আসমাউর রিজালের কিতাব থেকে উভয়ের জীবনী মুতালাআ করলে স্পষ্ট দেখতে পাবেন, ইলম ও আমল,হিফয ও ইতকান এবং যুহদ ও তাকওয়ায় সুফিয়ান ছাওরী রাহ. আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীসের চেয়ে অগ্রগামী ছিলেন। স্বয়ং আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীস তাঁর প্রশংসা করতেন। শুবা রাহ.সহ অনেক মুহাদ্দিস তাঁকে ‘আমীরুল মুমিনীন ফিল হাদীস’ বলেছেন।
আলোচিত বিষয়ে উভয়ের বর্ণনার মাঝে এমন কোনো বিরোধ নেই, যাতে একটির কারণে অন্যটিকে পরিহার করতে হবে। কিন্তু প্রাধান্য দেওয়ার প্রয়োজন হলে সুফিয়ান ছাওরী রাহ.-এর বর্ণনাই অগ্রগণ্য হওয়া উচিত।[21]
সাত. এখানে এ কথাটিও স্মরণ রাখতে হবে যে, আসিম ইবনে কুলাইবের কাছে তাকবীরে তাহরীমা ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে রাফয়ে ইয়াদাইন করা, না-করা প্রসঙ্গে একাধিক হাদীস ছিল। নিজ নিজ ক্ষেত্রে তা সবই সঠিক। একটি হাদীসের কারণে অন্য সব হাদীস কিংবা কোনো একটিকে প্রত্যাখ্যান করা মুহাদ্দিসগণের নীতি-বিরুদ্ধ।
এ শুধু সুফিয়ান ছাওরী ও আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীসের এ বর্ণনাদু’টিতে সীমাবদ্ধ নয়, আসিম ইবনে কুলাইবের কাছে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নিম্নোক্ত সবক’টি হাদীসই ছিল:
১. সুফিয়ান ছাওরী রাহ.-এর হাদীস, যা এ প্রবন্ধের আলোচ্য বিষয়।
২. আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীসের হাদীস, যার আলোচনা এখন চলছে। এতে তাকবীরে তাহরীমার সময় দুই হাত ওঠানোর কথা আছে। অন্য ক্ষেত্রে ওঠানো না ওঠানো কোনোটিরই উল্লেখ নেই।-সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৭৪৭, সুনানে কুবরা, বায়হাকী ২/৭৮-৭৯
৩. আসিম ইবনে কুলাইব তাঁর পিতা থেকে, তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের একজন সাহাবী থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রথমবারে রাফয়ে ইয়াদাইন করতে দেখেছেন।
وَرَوَى عَنْ أَبِيهِ، عَنْ رَجُل مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ أَنَّهُ رَآهُ يَرْفَعُ فِي أَوَّلِ مَرَّة.ٍ
মুসনাদে বায্যার ৫/৪৮
৪. আবু বকর নাহশালী আসিম ইবনে কুলাইব থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে, তিনি আলী রা. থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি (আলী রা.) শুধু প্রথম তাকবীরে দুই হাত উঠিয়েছেন। এরপর আর তা করেননি।
رَوَى أَبُو بَكْرٍ النَّهْشَلِيُّ عَنْ عَاصِمِ بْنِ كُلَيْبٍ، عَنْ أَبِيهِ أَنَّ عَلِيًّا رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ رَفَعَ يَدَيْهِ فِي أَوَّلِ التَّكْبِيرِ ثُمَّ لَمْ يَعُدْ بَعْدُ.
-মুআত্তা মুহাম্মাদ পৃ. ৯০; শরহু মাআনিল আছার ১/২২৫; রাফউল ইয়াদাইন, বুখারী পৃ. ৪৬
৫. বিশর ইবনে মুফায্যাল ও শুবা প্রমুখ আসিম ইবনে কুলাইব থেকে, তিনি তাঁর পিতা থেকে, তিনি ওয়াইল ইবনে হুজর রা. থেকে, তিনি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নামাযের বিবরণ দিয়েছেন। তাতে রুকুতে যাওয়া ও তা থেকে ওঠার সময় রাফয়ে ইয়াদাইনের কথা আছে। -সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৭২৬-৭২৮; রাফউল ইয়াদাইন, বুখারী পৃ. ৬৯
৬. আসিম ইবনে কুলাইব মুহারিব ইবনে দিছার থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে উমর রা. রুকুতে যাওয়া ও তা থেকে ওঠার সময় রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন। এ বর্ণনার শেষে এ কথাও আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দুই রাকাত থেকে দাঁড়াতেন তখন দুই হাত ওঠাতেন।-মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ২৪৫৪; মুসনাদে আহমদ, হাদীস ৬৩২৮;রাফউল ইয়াদাইন, বুখারী পৃ.৬৯
এ সবকটি রেওয়ায়েতের সনদ সহীহ বা হাসান অর্থাৎ দলীলযোগ্য। এজন্য এখানে সে নীতিটিই উল্লেখ করা উচিত, যা ইমাম বুখারী রাহ. রাফয়ে ইয়াদাইন বিষয়ে রেওয়ায়েতের ইখতিলাফ প্রসঙ্গে বলেছেন।
রাফয়ে ইয়াদাইন মোট কত জায়গায় হবে তাতে রেওয়ায়েতের মধ্যে ইখতিলাফ আছে। কোনো রেওয়ায়েতে অল্প জায়গার কথা এসেছে, কোনো রেওয়ায়েতে বেশি জায়গার কথা। কোনো রেওয়ায়েতে কোথাও করার কথা আছে, অন্য রেওয়ায়েতে সেটা অস্বীকার করা হয়েছে। এসব রেওয়ায়েতের সনদ সহীহ হওয়ায় ইমাম বুখারী রাহ. এর মধ্যে থেকে কোনো একটিকে মাহফূয, অন্যটিকে মাহফূয নয় না বলে এ কথা বলেছেন-
كُلُّهُ صَحِيحٌ لِأَنَّهُمْ لَمْ يَحْكُوا صَلَاةً وَاحِدَةً فَيَخْتَلِفُوا فِي تِلْكَ الصَّلَاةِ بِعَيْنِهَا، مَعَ أَنَّهُ لَا اخْتِلَافَ فِي ذَلِكَ، إِنَّمَا زَادَ بَعْضُهُمْ عَلَى بَعْضٍ، وَالزِّيَادَةُ مَقْبُولَةٌ مِنْ أَهْلِ الْعِلْمِ.
‘এ সব রেওয়ায়েতই সহীহ। কারণ এর রাবীগণ একই নামাযের পদ্ধতি বর্ণনা করেননি যে, একে ইখতিলাফ বলা যায় (বরং স্পষ্ট যে, কোনো বর্ণনায় কোনো দিন বা সময়ের নামাযের পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে, অন্য বর্ণনায় অন্য দিন বা সময়ের পদ্ধতি বর্ণিত হয়েছে)। তাছাড়া একে এমনিতেও ইখতিলাফ বলা যায় না। কারণ এগুলো ‘যিআদাহ’র অন্তর্ভুক্ত- এক রাবী অন্য রাবীর চেয়ে একটি অতিরিক্ত বিষয় বর্ণনা করেছেন। আর আহলে ইলমের যিআদাহ গ্রহণযোগ্য।’ -রাফউল ইয়াদাইন,বুখারী পৃ. ১৫০
অথবা সেই নীতিটি যা তিনি নামাযের বিভিন্ন ক্ষেত্র এবং নামায ছাড়া অন্যত্র রাফয়ে ইয়াদাইন করা বিষয়ক একাধিক সহীহ হাদীস উল্লেখ করে বলেছেন-
هَذِهِ الْأَحَادِيثُ كُلُّهَا صَحِيحَةٌ عَنْ رَسُولِ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، لَا يُخَالِفُ بَعْضُهَا بَعْضًا، وَلَيْسَ فِيهَا تَضَادٌ، لِأَنَّهَا فِي مَوَاطِنَ مُخْتَلِفَةٍ.
অর্থাৎ এ সব হাদীসই সহীহ, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে প্রমাণিত। এতে কোনো ইখতিলাফ ও বৈপরীত্য নেই। কারণ এগুলো বিভিন্ন ক্ষেত্রের।’ -রাফউল ইয়াদাইন, বুখারী পৃ. ১৪৮
এ দুই নীতি ছেড়ে এ কথা বলা, আসিম ইবনে কুলাইবের ঐ ৬ টি হাদীসের মধ্যে শুধু অমুক হাদীসটি সহীহ, বাকি একটিও মাহফূয না, কিংবা শুধু অমুক হাদীসটি মাহফূয না, বাকি সব সহীহ অথবা ইযতিরাবের কারণে সবই যয়ীফ [22] উসূলুল হাদীস শাস্ত্রের নীতিসম্মত নয়।[23]
মুহাদ্দিস আহমদ শাকির (১৩৭৭হি.) ও শায়খ নাছিরুদ্দীন আলবানী (১৪২০হি.) তাকলীদ ও মাযহাবের কঠোর বিরোধী। রাফয়ে ইয়াদাইন মতের জোরালো সমর্থক এবং সনদ ও ফিকহ উভয় দিক থেকে একেই অগ্রগণ্য মনে করেন। তা সত্তে¡ও উভয়ই আলোচিত হাদীসটি সম্পর্কে-করা সমস্ত আপত্তি প্রত্যাখ্যান করে স্পষ্টভাষায় বলে দিয়েছেন, এটি সহীহ।
আহমদ শাকির ‘সুনানে তিরমিযী’র টিকায় (২/৪১) লিখেছেন,
هذا حديث صححه ابن حزم وغيره من الحفاظ , وهو حديث صحيح , وما قالوه في تعليله ليس بعلة
এ হাদীসটি সহীহ। ইবনে হাযম ও অন্যান্য হাফিযুল হাদীস একে সহীহ বলেছেন। আর আপত্তিকারীরা এর যে ইল্লত উল্লেখ করেছেন আসলে তা কোনো ইল্লত নয়।’
শায়খ আলবানী ‘আসলু সিফাতি সালাতিন নাবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম’ (২/৬১১)-এ বলেন,
والحق أنه صحيح ثابت لا مطعن في إسناده.
‘সঠিক কথা হল, এ হাদীস সহীহ ও প্রমাণিত, এর সনদে কোনো ত্রুটি নেই।’
এঁদের কেউই হানাফী মাযহাবের অনুসারী নন এবং দুজনই রাফয়ে ইয়াদাইনের অগ্রগণ্যতার প্রবক্তা। এজন্য আহলে হাদীস বন্ধুদের এঁদের এ তাহকীকের কদর করা উচিত।
আর উলূমুল হাদীসের তলাবায়ে কেরামের তো জানা আছে, ইবনে দাকীকুল ঈদ শাফেয়ী (৭০২হি.), ইবনুত তুরকুমানী (৭৪৫হি.), জামালুদ্দীন যায়লায়ী (৭৬১হি.), বদরুদ্দীন আইনী (৮৫৫হি.), ইবনুল হুমাম (৮৬১হি.), কাসিম ইবনে কুতলূবুগা (৮৭৯হি.) এর মত বড় বড় হাফিযুল হাদীস এবং ইবনু আমীরিল হাজ্ব (৮৭৯হি.), মুরতাযা যাবীদী (১২০৫হি.), মুল্লা আবিদ সিন্দী (১২৫৭হি.), আবদুল হাই লৌখনবী (১৩০৪হি.), যহীর আহসান নিমাবী (১৩২২হি.), আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী (১৩৫২হি.),যফর আহমদ থানবী (১৩৯৪হি.) ও ইউসুফ বানুরী রাহ. (১৩৯৭হি.) সহ পূর্ববর্তী ও পরবর্তী অনেক ইলমে হাদীস বিশেষজ্ঞ একে সহীহ ও দলীলযোগ্য বলেছেন।
আর ফতোয়া ও আমলগতভাবে একে গ্রহণ-করা মুহাদ্দিসদের সংখ্যা তো অগণিত। আর খাইরুল কুরূনের তালাক্কী, তাওয়ারুস ও তাআমুলের কথা তো শুরুতেই উল্লেখ করা হয়েছে। আল্লাহ তাআলা আমাদের কলম ও যবানকে স্বেচ্ছাচারিতা ও আসাবিয়াত থেকে হেফাযত করুন। আমীন।
আলোচিত হাদীস-সংশ্লিষ্ট অধিকাংশ শাস্ত্রীয় সূক্ষ্ম বিষয়গুলোর সারসংক্ষেপ এখানে সহজ ভাষায় উপস্থাপনের চেষ্টা করা হয়েছে। উলূমুল হাদীসের সাথে মুনাসাবাত-রাখা বন্ধুগণ এ সব আলোচনা মূল উৎস থেকে মুতালাআ করতে পারেন। বিশেষ করে নিম্নোক্ত কিতাবগুলোর শরণাপন্ন হতে পারেন:
১.আলজাওহারুন নাকী (সুনানে কুবরা বায়হাকীর সাথে মুদ্রিত) ইবনুত তুরকুমানী ২/৭৭-৮২
২. নাসবুর রায়াহ, জামালুদ্দীন যায়লায়ী ১/৩৯৪-৩৯৬
৩. নুখাবুল আফকার ফী তানকীহি মাবানিল আখবার শরহু মাআনিল আছার, বদরুদ্দীন আইনী ২/৬০১-৬০৬
৪. নাইলুল ফারকাদাইন ফী মাসআলাতি রাফইল ইয়াদাইন, আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী ৭১/১০৮
৫. মাআরিফুস সুনান শরহে সুনানে তিরমিযী, ইউসুফ বানুরী ২/৪৭৭-৪৮৬
৬. ইলাউস সুনান, যফর আহমদ থানবী ৩/৫৭-৬১
এই হাদীসে কি সাহাবীয়ে রাসূলেরই ভুল হয়ে গেছে?!
কিছু সংখ্যক মানুষের ভঙ্গি-প্রবণতা থেকে মনে হয়, এরা আগে থেকেই অঙ্গীকার করে রেখেছে যে, এ হাদীস প্রত্যাখ্যান করতেই হবে। একারণে একে প্রত্যাখ্যান করতে এরা একের পর এক বাহানা উদ্ভাবন করছে। এর পরও যখন এদের মন ভরেনি তখন একেবারে হাদীসের কেন্দ্রীয় বর্ণনাকারী সাহাবিয়ে রাসূল আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এরই উপর আক্রমণ করে বসে। এবং চরম নির্লজ্জার সাথে বলতে শুরু করে, তাঁর হাদীস কীভাবে গ্রহণযোগ্য হবে, তিনি তো (নাউযুবিল্লাহ) মুআব্বিযাতাইন (সূরা ফালাক ও নাস)-এর অস্বীকারকারী ছিলেন! কেউ আবার বলে, এ দুটোর কুরআন মাজীদের সূরা হওয়া তো তাঁর জানাই ছিল না!!
এই বেচারাদের কে বুঝাবে, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর বর্ণনাকৃত হাদীসের বিশুদ্ধতা ও প্রামাণিকতা সাহাবায়ে কেরাম বিশেষ করে মুহাজির ও বদরী সাহাবীগণের মাকাম-মর্যাদা-সংশ্লিষ্ট আয়াত ও হাদীস, তাঁর (ইবনে মাসউদ রা.-এর) মর্যাদা-ফযীলত সম্পর্কিত হাদীস, খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাত এবং সাহাবায়ে কেরাম, তায়েয়ীন ও তাবে-তাবেয়ীনের ইজমা দ্বারা প্রমাণিত। এবং পরবর্তীতেও তাতে পুরো উম্মাহর ইজমা রয়েছে। ফুকাহায়ে কেরাম ও আইম্মায়ে হাদীস যেকোনো মাযহাবের হোক তাঁর হাদীস দ্বারা দলীল পেশ করেছেন। সহীহ বুখারী ও সহীহ মুসলিমে তাঁর ১২০ টি হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
এর পরও যদি কেউ এই নির্বুদ্ধিতার শিকার হয়- তাঁর কোনো হাদীস সম্পর্কে দ্বিধাদ্ব›দ্ব শুরু করে,তাহলে তো তার দিল-দেমাগের চিকিৎসা করা উচিত। আমরা তার শুধু হেদায়াতের জন্য দুআ করতে পারি।
বাকি রইল সূরা ফালাক ও নাস প্রসঙ্গ। এ ধারণা সম্পূর্ণ অবাস্তব যে, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. এর অস্বীকারকারী ছিলেন। এবং এ ধারণাও ভুল যে, তিনি তা কুরআন মাজীদের সূরা হওয়া স্বীকার করতেন না। কিছু অস্পষ্ট বর্ণনা ও বক্তব্যের ভিত্তিতে কিছু সংখ্যক লেখক তা লিখে দিয়েছেন। আর এই বিচ্ছিন্ন কথাটিই আরো রঙ মিশিয়ে শুধু মাযহাবী আসাবিয়াতের ভিত্তিতে প্রচার করা হচ্ছে! অন্যথায় এ ক্ষেত্রে সঠিক কথা সেটাই, যা ইমাম ইবনে হাযম, কাযী ইয়ায (৫৪৪হি.) ও নববী রাহ. (৬৭৬হি.) বলেছেন।
ইবনে হাযম রাহ. বলেন, ‘ইবনে মাসউদ রা.-এর মুছহাফে মুআব্বিযাতাইন ও উম্মুল কুরআন ছিল না- বলে এ সম্পর্কে তাঁর থেকে যা কিছু বর্ণনা করা হয় তা সবই বানোয়াট, জাল ও অপ্রমাণিত। তাঁর থেকে প্রমাণিত শুধু আসিমের কিরাত, যা তিনি যির ইবনে হুবাইশ থেকে, তিনি ইবনে মাসউদ রা. থেকে বর্ণনা করেছেন। আর তাতে উম্মুল কুরআন ও মুআব্বিযাতাইন আছে।’আলমুহাল্লা ১/১৫
কাযী ইয়ায রাহ. ‘ইকমালুল মু‘লিম বিফাওয়াইদি মুসলিম’ (৩/১৮)-এ উকবা ইবনে আমির রা. কর্তৃক বর্ণিত রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ইরশাদ, ‘তুমি কি দেখনি আজ রাতে কী আয়াত নাযিল হয়েছে, এর মত আয়াত আর কখনো দেখা যায়নি- কুল আউযু বিরাব্বিল ফালাক ও কুল আউযু বিরাব্বিন নাস’-এর ব্যাখ্যায় লিখেছেন, ‘এটি এ দুটোর (সূরা ফালাক ও নাসের) কুরআন মাজীদের অংশ হওয়ার স্পষ্ট প্রমাণ এবং তাদের বক্তব্য খণ্ডন করে, যারা ইবনে মাসউদ রা. সঙ্গে ভিন্ন কিছু যুক্ত করেছে…।’
ইমাম নববী রাহ. বলেছেন, ‘উম্মুল কুরআন ও মুআব্বিযাতাইন কুরআন মাজীদের অংশ না- এ বলে ইবনে মাসউদ রা. থেকে যা বর্ণনা করা হয় তা বাতিল, এ তাঁর থেকে প্রমাণিত না।’ আলমাজমূ শরহুল মুহায্যাব ৪ /৪৪২
এটা খুবই দুঃখজনক যে, হাদীস অনুসরণের নামে অকারণে একটি সহীহ হাদীস প্রত্যাখ্যান করে দেওয়া হয়। এবং এজন্য মর্যাদাবান সাহাবীর উপর আক্রমণ করাকেও মেনে নেওয়া হয়! শুধু তাই না,তাঁকে কুরআন মাজীদ সম্পর্কেও জাহেল বানানোর চেষ্টা-তদবির করা হয়!! অথচ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম উম্মতকে এই নির্দেশ দিয়েছিলেন যে, তোমরা চারজনের কাছ থেকে কুরআন শেখ। তার মধ্যে সর্বপ্রথম ইবনে উম্মে আবদ (আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.)-এর নাম নিয়েছেন।-সহীহ বুখারী, হাদীস ৩৮০৮
সারকথা এই যে, আলোচিত হাদীসটি সনদের বিচারে সহীহ। অনেক মুহাদ্দিস একে সহীহ বলেছেন। এবং খাইরুল কুরূনের ইমামগণ কর্তৃক মুতালাক্কা বিল কবুল। আর আমলের দিক থেকে মুতাওয়াতির। আর একে যয়ীফ প্রমাণ করার জন্য যা কিছু বলা হয়েছে, তা না ফনের নিয়মনীতির বিচারে গ্রহণযোগ্য হয় আর না বাস্তবতার নিরিখে তার কোনো মান-মূল্য আছে।
যদিও এ হাদীসের সমর্থনে অতিরিক্ত দলীল-প্রমাণ উল্লেখের প্রয়োজন ছিল না তবু আরো ফায়েদা-উপকারের জন্য কিছু আছার উল্লেখ করা মুনাসিব মনে হচ্ছে।
১.ইবরাহীম নাখায়ী থেকে বর্ণিত, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. নামাযের শুরুতে রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন। এরপর আর তা করতেন না। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ২৪৫৮; শরহু মাআনিল আছার ১/১৬
সনদসহ আছারটির আরবী পাঠ এই-
قال ابن أبي شيبة: حدَّثَنَا وَكِيعٌ ، عَنْ مِسْعَرٍ ، عَنْ أَبِي مَعْشَرٍ ، عَنْ إِبْرَاهِيمَ ، عَن عَبْدِ اللهِ ؛ أَنَّهُ كَانَ يَرْفَعُ يَدَيْهِ فِي أَوَّلِ مَا يَفْتَتِحُ ، ثُمَّ لاَ يَرْفَعُهُمَا.
وقال الطحاوي: حدثنا بن أبي داود قال: ثنا أحمد بن يونس قال: ثنا أبو الأحوص ، عن حصين ، عن إبراهيم قال: كان عبد الله لا يرفع يديه في شيء من الصلاة إلا في الافتتاح.
ইবরাহীম নাখায়ী রাহ. পর্যন্ত এর সনদ সহীহ। আর তিনি আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-কে না পেলেও সরাসরি তাঁর উদ্ধৃতি তখনই দেন যখন বিষয়টি ইবনে মাসউদ রা.-এর একাধিক শাগরিদের মাধ্যমে তাঁর কাছে প্রমাণিত হয়। ইমাম সুলায়মান ইবনে মেহরান আলআ’মাশ রাহ. (১৪৮হি.) বলেন, আমি ইবরাহীম নাখায়ীর কাছে আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা. পর্যন্ত তাঁর সনদ বর্ণনার জন্য অনুরোধ করলে তিনি বলেন, আমি যখন তাঁর থেকে একজনের সূত্রে বর্ণনা করি তা সেই নাম নেওয়া একজনের কাছ থেকেই শুনেছি। আর যখন বলি আবদুল্লাহ বলেছেন তো এ তাঁর একাধিক শাগরিদের মাধ্যমে আমার কাছে পৌঁছেছে। -আলইলালুস সগীর, ইমাম তিরমিযী পৃ. ৬২
২. আসওয়াদ থেকে বর্ণিত, আমি উমর রা.-এর সঙ্গে নামায পড়েছি, তিনি শুধু নামায শুরু করার সময় রাফয়ে ইয়াদাইন করেছেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ২৪৬৯
সনদসহ আছারটির আরবী পাঠ এই-
حدَّثَنَا يَحْيَى بْنُ آدَمَ ، عَنْ حَسَنِ بْنِ عَيَّاشٍ، عَنْ عَبْدِ الْمَلِكِ بْنِ أَبْجَرَ، عَنِ الزُّبَيْرِ بْنِ عَدِيٍّ، عَنْ إبْرَاهِيمَ، عَنِ الأَسْوَدِ قَالَ: صَلَّيْت مَعَ عُمَرَ فَلَمْ يَرْفَعْ يَدَيْهِ فِي شَيْءٍ مِنْ صَلاَتِهِ إِلاَّ حِينَ افْتَتَحَ الصَّلاَةَ.
ইমাম তহাবী (৩২১হি.) বলেন,
هو حديث صحيح
‘এটি সহীহ আছার।’ ইবনুত তুরকুমানী বলেন,
هذا السند علي شرط مسلم
‘এই সনদ সহীহ মুসলিমের সনদের সমমানের।’ হাফেয ইবনে হাজার (৮৫২হি.) বলেন, رجاله ثقات ‘এর রাবীগণ ছিকা।’ -শরহু মাআনিল আছার ১/১৬৪; আলজাওহারুন নাকী ২/৭৫; আদদিরায়া,হেদায়ার সাথে মুদ্রিত ১/১১৩
৩. কুলাইব ইবনে শিহাব থেকে বর্ণিত, আলী রা. প্রথম তাকবীরের সময় রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন। এরপর আর কোথাও করতেন না।
সনদসহ আছারটির আরবী পাঠ এই-
عَن عَنْ أَبِي بَكْرِ بْنِ عَبْدِ اللهِ بْنِ قِطَافٍ النَّهْشَلِيِّ، عَنْ عَاصِمِ بْنِ كُلَيْبٍ الجرمي، عَنْ أَبِيه، وكان من أصحاب علي، أَنَّ عَلِيًّ بن ابي طالب كرم الله وجهه كَانَ يَرْفَعُ يَدَيْهِ في التكبيرة الأولي التي يفتتح بها الصلاة، ثم لايرفعهما في شيء من صلاته.
-আলমুআত্তা, ইমাম মুহাম্মদ পৃ. ৯৪; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ২৪৫৭; শরহু মাআনিল আছার ১/১৬১; আসসুনানুল কুবরা, বায়হাকী ২/৮০
হাফেয যায়লায়ী বলেন, وهو أثر صحيح ‘এটি সহীহ আছার।’ বদরুদ্দীন আইনী বলেন,
إسناد حديث عاصم بن كليب صحيح على شرط مسلم.
‘এই সনদ সহীহ মুসলিমের সনদের সমমানের।’ হাফেয ইবনে হাজার বলেন, رجاله ثقات ‘এর রাবীগণ ছিকা।’ -দেখুন : নাসবুর রায়াহ ১/৪০৬; উমদাতুল কারী ৫/২৭৪; আদদিরায়া ১/১১৩
আলী রা. ও আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর রাফয়ে ইয়াদাইন না-করা শুধু এই এক-দু’টি মৌখিক বর্ণনার উপর নির্ভরশীল নয়, বরং এটি তাআমুল ও তাওয়ারুস তথা ব্যাপক ও সম্মিলিত কর্মধারার মাধ্যমে প্রমাণিত, যা মৌখিক সাধারণ বর্ণনা-সূত্রের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী। এঁদের শাগরিদবৃন্দসহ কূফাবাসী প্রায় সকল তাবেয়ী ও তাবে-তাবেয়ী ফকীহের আমল তাই ছিল।
বিশিষ্ট তাবেয়ী আবু ইসহাক সাবিয়ী রাহ. (১২৯হি.) বলেন, আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ ও আলী রা.-এর শাগরিদগণ শুধু নামাযের শুরুতে রাফয়ে ইয়াদাইন করতেন। -মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস ২৪৬১
সনদসহ বর্ণনাটির আরবী পাঠ এই-
حدَّثَنَا وَكِيعٌ وَأَبُو أُسَامَةَ ، عَنْ شُعْبَةَ ، عَنْ أَبِي إِسْحَاقَ قَالَ: كَانَ أَصْحَابُ عَبْدِ اللهِ ، وَأَصْحَابُ عَلِيٍّ ، لاَ يَرْفَعُونَ أَيْدِيَهُمْ إِلاَّ فِي افْتِتَاحِ الصَّلاَةِ ، قَالَ وَكِيعٌ: ثُمَّ لاَ يَعُودُونَ.
ইবনুত তুরকুমানী রাহ. বলেন,
هذا أيضا سند صحيح جليل
‘এটি উঁচুপর্যায়ের সহীহ সনদ।’ বদরুদ্দীন আইনী রাহ. এই সনদের দিকে ইঙ্গিত করে বলেন, ‘এটি সহীহ সনদ।’ -আলজাওহারুন নাকী ২/৭৯; নুখাবুল আফকার ফী তানকীহি মাবানিল আখবার শরহু মাআনিল আছার, বদরুদ্দীন আইনী ২/৬০৬
[1] ‘মিশকাতুল মাসাবীহ’ কিতাবে (১/৩৪৪)
فلم يرفع يديه إلا مرة -এর পর مع تكبيرة الافتتاح (তাকবীরে তাহরীমার সময়) বাক্য উল্লেখিত আছে। এটি হাদীসের অংশ নয়, মিশকাত-গ্রন্থকার নিজের পক্ষ থেকে বলেছেন। তাঁর উদ্দেশ্য হল আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ রা.-এর হাদীসে যে রাফয়ে ইয়াদাইনের কথা আছে তা ছিল তাকবীরে তাহরীমার সময়। এর অর্থ কখনোই এই না যে, তাকবীরে তাহরীমার সময় তিনি শুধু একবার রাফয়ে ইয়াদাইন করেছেন, যেমনটি কেউ কেউ মনে করেছেন (কী হাস্যকর বুঝ ও সমঝ)। কারণ তাকবীরে তাহরীমার সময় একাধিকবার রাফয়ে ইয়াদাইনের কোনো নিয়ম নেই।
[2] নুখাবুল আফকার ফী তানকীহি মাবানিল আখবার শরহু মাআনিল আছার, বদরুদ্দীন আইনী ২/৬০২, ৬০৫
[3]সুফিয়ান ছাওরী রাহ.-এর মাযহাব তো প্রসিদ্ধ। তথাপি তাঁর সাথে ইবনুল মুবারক রাহ.-এরও একটি বিশেষ ঘটনা আছে। আততামহীদ, ইবনে আবদুল বার ৯/২২৮-২২৯-এ তা দেখা যেতে পারে।
[4] তাহযীবুত তাহযীব ১০/১৭২-১৭৩
[5] মুআবিয়া ইবনে হিশাম ও উবায়দুল্লাহ আলআশজায়ী উভয়ই ছাওরী রাহ.-এর ছিকা শাগরিদ এবং তাঁর থেকে এই হাদীস বর্ণনা করেছেন। এঁদের বর্ণনায় ثم لم يعد বাক্য না থাকলেও এর সমার্থক বাক্য অবশ্যই আছে। যেমন فرفع يديه مرة واحدة ‘শুধু একবার দুই হাত উঠিয়েছেন।’ (দেখুন: সুনানে আবুদ দাউদ, হাদীস ৭৪৯; আলইলাল ওয়ামারিফাতুর রিজাল, আহমদ ইবনে হাম্বল ১/৩৭০) এজন্য এঁদের বর্ণনায় ثم لم يعد বাক্য না থাকার কারণে হাদীসের মূল উদ্দেশ্য প্রভাবিত হয় না।
[6] আলইালাল, দারাকুতনী ৫/১৭২-১৭৩
[7] পাঠকগণ ‘আলমুহাল্লা’ গ্রন্থের বরাতে সেটা দেখে এসেছেন।
[8] আবদুল্লাহ ইবনুল মুবারক রাহ.-এর বর্ণনা পাঠকগণ ‘সুনানে নাসায়ী’র উদ্ধৃতিতে দেখে এসেছেন।
[9] মুসনাদে আহমদ ১/৩৮৮, হাদীস ৩৬৮১; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা ২/৪১৫, হাদীস ২৪৫৬
[10]এসব রেওয়ায়েতের জন্য যথাক্রমে দেখনু: আস্সুনানুল কুবরা, বায়হাকী ২/৮৭; সুনানে নাসায়ী ২/১৯৫, হাদীস ১০৫৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৭৪৮
[11] ইবনে হিব্বানের বক্তব্যটি শাওকানী (১২৫০হি.) রচিত ‘নাইলুল আওতার’ (২/১৮২)-এ যে শব্দ-বাক্যে উদ্ধৃত হয়েছে, তা খুবই আপত্তিকর এবং এ শুধু দাবি আর দাবি, এতে দলীল-প্রমাণের নামগন্ধও নেই। ইবনে হিব্বানের বক্তব্য ইবনুল কাইয়্যিম রাহ. (৭৫১হি.)ও তাঁর ‘রাফউল ইয়াদাইনি ফিস্সালত’-এ উল্লেখ করেছেন, যা ‘নাইলুল আওতার’-এর উদ্ধৃতি থেকে অনেক ভিন্ন। তাতে ইবনে হিব্বান রাহ. যে সুনির্দিষ্ট আপত্তি করেছেন, তা হল, ثُمَّ لَمْ يَعُدْ বাক্যটি ওকী নিজের পক্ষ থেকে বলেছেন। এ আপত্তির হাকীকতও পাঠকগণ এইমাত্র দেখে এসেছেন।
[12] قال الراقم :يبدو أن هذا تعليق علقه البخاري رحمه الله تعالى عن أحمد، والبخاري رحمه الله تعالى قد يعلق عن شيوخه أيضا كما في “هدي الساري إلى فتح الباري” للحافظ ابن حجر ص ১৯، وهذا ليس من تعليقات “صحيح البخاري” فيحكم له بالصحة، مع أن في النقل اختصارا مخلا، ويراجع تمام الكلام في “العلل” رواية عبد الله عن أبيه أحمد، وإن كان الأمر مقصورا على هذا النقل فما هو إلا وجادة، وكيف يجوز إعلال رواية حافظ إمام معتمدا على الوجادة، فتأمل.
[13] পাঠকগণের স্মরণ থাকবে, ثُمَّ لَمْ يَعُد বাক্য ছাড়াও এই হাদীসের দাবি তাই থাকে, যা এ বাক্যসহ এর মর্ম। স্বয়ং ‘জুযউ রাফউল ইয়াদাইন’-এ হাদীসের যে পাঠ (মতন) উল্লেখ করা হয়েছে, এর তরজমায় ফিকির করুন, প্রয়োজন হলে আবার দেখুন, এতে কি সে কথাই প্রমাণিত হয় না, যা এ বাক্যের মর্ম?
[14] قال الراقم: قال عبد الله بن أحمد بعد إيراد هذه الرواية: ” قَالَ أبي هَذَا لفظ غير لفظ وَكِيع، وَكِيع يثبج الحَدِيث، لِأَنَّهُ كَانَ يحمل نَفسه فِي حفظ الحَدِيث”. والجواب بمتابعة عبد الله بن المبارك، و الأشجعي، وأبي حذيفة لوكيع، وبمنزلة وكيع بن الجراح الفائقة في الحفظ والإتقان، وبشهادة أكابر الائمة، وبشهادة الإمام أحمد نفسه، راجع ترجمة وكيع في كتب الرجال، وفي كتاب العلل نفسه. فالله المستعان وعليه التكلان.
[15]অন্য রেওয়ায়েতে স্পষ্টভাবে আছে যে, এটি নামাযের শুরুর তাকবীর ছিল।
[16] আবদুল্লাহ ইবনে ইদ্রীস থেকে এই হাদীস হাসান ইবনে রবীও বর্ণনা করেছেন। অবশ্য তাতে এ কথা নেই যে, এটি তিনি নিজ কিতাব থেকে বর্ণনা করেছিলেন। দেখুন: ‘জুযউ রাফউল ইয়াদাইন’ ইমাম বুখারী পৃ. ৮৩
[17] ১৭ قال الراقم: فإن من المعلوم أن المحدثين ونقاد علل الحديث يعدون اختلاف سياق المتن والتباعد بين ألفاظ السياقين من أهم القرائن الدالة على تعدد الحديث، وإذا رجع الاختلاف إلى التعدد فليس هناك اضطراب أوتعارض حتى يجوزإعلال إحدى الروايتين بالأخرى وكم من حديث أعل بالاضطراب من أحاديث “الصحيحين” وغيرهما فأجاب الحافظ ابن حجر وغيره من النقاد بدفع الاضطراب حاملا الاختلاف على تعدد الحديث, ومن كلام الحافظ ابن حجر في “الإصابة” ৭/৪১ (أبو بشر السلمي) :”..، وقرينة اختلاف السياقين أيضا ترشد إلى التعدد”.
وليس اتحاد السند قرينة قاطعة يجوز أن يحكم لأجلها بوحدة الحديث، وفي “الصحيحين” وغيرهما جملة أحاديث مما اختلف فيها الرواة على مدار الحديث، فروى عنه كل منهم بسند واحد، وإنما اختلفوا في المتن، ومن كلام الحافظ ابن حجر في أمثال هذه الروايات:
“والذي يتبين لي أنهما حديثان، أحدهما في المغرب, والآخر في العشاء، كانا جميعا عند عبد الوارث بسند واحد”. قاله في “الفتح” ৩/ ৫৩،كتاب مواقيت الصلاة، الباب ১৯.
ومن كلامه أيضا :
“فالذي يترجح أنهما حديثان عند ابن شهاب بسند واحد، عند بعض الرواة عنه ما ليس عند بعض…” .قاله في الفتح” ৮/৬৮০، كتاب فضائل القرآن, باب المعوذات.
وكذلك الأمر في الاختلاف المبحوث عنه، فهما حديثان عند عاصم بن كليب بسند واحد، عند سفيان عنه ما ليس عند ابن إدريس، وليس هذا من الاضطراب والتضاد في شيء.
ومما ينبغي ذكره هنا:
১থإن أصر أحد على دعوى أن أصل حديث عاصم هو حديث التطبيق لأجل رواية عبد الله ابن إدريس، وأنه علة لرواية سفيانথوحاشا أن يكون كذلكথ فينبغي أن يعلم أن سياق ابن أدريس لحديث التطبيق مخالف لرواية عامة الثقات المخرجة في كتب الصحاح، فماذا يكون حكم رواية ابن إدريس إذا؟ أشار إلى ذلك العلامة الكشميري في “نيل الفرقدين”.
إذا عرفت هذا عرفت النظر فيما جاء في “علل ابن أبي حاتم” ص ৩৫৫ (المسألة ২৫৮) من قوله: ” قال أبي : هذا خطأ، يقال: وهم فيه الثوري، وروى هذا الحديث عن عاصم جماعة، فقالوا كلهم:…”.
والكلام هنا مختل جدا، فنسب إلى الثوري مالم يروه، وادعي عليه مالم يقع منه وادعي أيضا أن جماعة روى حديث التطبيق عن عاصم بن كليب، وهل يجوز تعليل روايات الثقات المبرزين بقول لا سند له سوى”يقال”؟! وما ادعاه هذا القائل المجهول أن سفيان خالف جماعة الرواة عن عاصم لم نجد له أثرا، فأين من روى حديث التطبيق عن عاصم سوى عبد الله ابن إدريس؟
২থ قول الإمام أبي داود في سياق سفيان إنه مختصر من حديث طويل ويريد بالحديث الطويل سياق ابن أدريس، فيه تأمل، فإن سياق ابن أدريس كذلك مختصر لايوجد فيه من صفة الصلاة إلا الافتتاح والتطبيق، مع قول الصحابي في فاتحة الرواية : علمنا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ الصلاة، ولئن ساق ابن أدريس في روايته صفة الصلاة بتمامها لكان هناك مجال للمقارنة بين سياقه وسياق سفيان، وإذ ليس فليس، والله أعلم.
[18] শু‘বা রাহ. বলেন, আমরা মিসআর (ইবনে কিদাম ১৫৫হি.) রাহ.-কে মুছহাফ বলতাম। আবদুল্লাহ ইবনে দাউদ আলখুরাইবী বলেন, আমি শুবা রাহ.-কে আমাশ রাহ. (ইমাম সুলায়মান ইবনে মেহরান ১৪৮হি.)-এর নাম শুনলে এ কথা বলতে শুনেছি, তিনি মুছহাফ। এ কথা তিনি দুবার বলতেন। -আলজারহু ওয়াততাদীল, ইবনে আবী হাতেম ১/১৫৪; তারিখে বাগদাদ ৯/১১
[19] والمحدثون جمعوا كتب العلل والتصحيفات في أغلاط الرواة والكتب، فانظر هناك كم للكتب من تصحيفات وتحريفات، وكم لأكثر الكتب تداولا بين المحدثين من أغلاط النساخ وإحالاتهم، انظر على سبيل المثال كتاب الامام أبي علي الغساني (৪২৭-৪৯৮هـ) “تقييد المهمل وتمييز المشكل”, ثم احكم بما شئت، قاله الراقم.
[20] ২০ وربما يكون سفيان حدث بهذا الحديث من كتابه أيضا، فإنه كان صاحب حديث وصاحب كتاب كما يظهر من ترجمته، وهو مصنف كتاب “الجامع” الذي اشتهر في الآفاق، والذي تلقاه الإمام البخاري عن أبي حفص الكبير، تلميذ الإمام محمد بن الحسن وصديق والد الإمام البخاري رحمهم الله جميعا.
[21] এই সেই সুফিয়ান, আমীন বিলজাহর প্রসঙ্গে যার বর্ণনাকে শুবা রাহ.-এর মত পর্বত-প্রমাণ হিফযের অধিকারীর মোকাবেলায় প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে! তো যখন রেওয়ায়েতের ইখতিলাফের ক্ষেত্রে রাজিহ-মারজূহ নির্ণয় করা নাযুকও, ইজতেহাদীও, তাহলে ইমাম ইবরাহীম নাখায়ী, মুহাম্মদ ইবনুল হাসান, তহাবী ও তিরমিযী রাহ. -এর মত পূর্ববর্তী ও পরবর্তী হাদীস ও ফিকহের অনেক ইমামের তাসহীহ (সহীহ বলা) ও ইহতিজাজ (দলীলস্বরূপ পেশ করা)-কে বাতিল সাব্যস্ত করার কী প্রয়োজন? একে কমপক্ষে একটি ইজতিহাদী মতের মর্যাদা দিতে এবং স্বেচ্ছাচারিতার পথ পরিহার করতে কী অসুবিধা?
[22] قال البزار في مسنده : وعاصم في حديثه اضطراب ولا سيما في حديث الرفع…
[23] সন্দেহ নেই, ইলমে ইলালুল হাদীস খুবই নাযুক একটি শাস্ত্র। রেওয়ায়েতের মধ্যে ইখতিলাফ দেখা দিলে কোন ইখতিলাফটি তাআদ্দুদে হাদীসের কারণে, কোনটি ইযতিরাবের কারণে, কোন ইখতিলাফের ক্ষেত্রে রাজিহ গ্রহণ করা হয়, মারজূহ পরিত্যাগ করা হয়, আর কোন ইখতিলাফের কারণে মূল হাদীসই যয়ীফ প্রমাণিত হয় অথবা কোন ইখতিলাফের ক্ষেত্রে সমন্বয়ের পন্থা অবলম্বন করা হয়- এ সবই অতি সূক্ষ্ম ও স্পর্শকাতর বিষয়। এগুলোর ফায়সালা কেবল আহলে ফনই করতে পারেন। এজন্য এ বিষয়গুলোতে আহলে ফন কর্তৃক সর্বসম্মত ফায়সালা পাওয়া গেলে পরবর্তীদের জন্য তাঁদের তাকলীদের বিকল্প নেই। ফনের নিয়মনীতির উদ্ধৃতিতেও তাঁদের সর্বসম্মত ফায়সালা উপেক্ষা করার অধিকার নেই। কেননা আহলে ফন ফনের নিয়মনীতির ‘মানাত’, হাকীকত ও প্রয়োগ-পদ্ধতি সম্পর্কে অন্যদের চেয়ে বেশি অবগত। তাঁদের প্রতিটি সদস্য এককভাবে মাছুম না হলেও তাঁদের সর্বসম্মত ফায়সালা অবশ্যই মাছুম। এমনকি তা ‘ইজমায়ে সুকূতী’র পর্যায়ের হলেও।
কিন্তু যেখানে স্বয়ং আহলে ফনের মাঝে ইখতিলাফ হয়, কিংবা তাঁদের কিছু সংখ্যক এমন কোনো রেওয়ায়েত সম্পর্কে আপত্তি করেন, যা দ্বারা এমন কোনো ফকীহ দলীল পেশ করেছেন, যিনি ইলমে হাদীস সম্পর্কেও বা-খবর ছিলেন (যেমন মুজতাহিদ ইমামগণ এবং তাঁদের বড় বড় শাগরিদগণ, যারা ইলমে ফিকহে ইমাম হওয়ার পাশাপাশি ইলমে হাদীসেও উচ্চস্তরের ছিলেন, বরং তাঁদের কেউ কেউ তাতেও ইমামের মর্যাদায় উপনীত ছিলেন) অথবা যেখানে আহলে ফন এমন কোনো রেওয়ায়েত সম্পর্কে আপত্তি তোলেন, যা খাইরুল কুরূন থেকে মুতালাক্কা বিল কবুল হয়ে চলে আসছে- এধরনের ক্ষেত্রে যদি ইলমে ফিকহ ও ইলমে হাদীসের সাথে বিশেষ মুনাসাবাত-রাখা আহলে ইলমগণ স্বয়ং আহলে ফনেরই ব্যবহারকৃত নিয়মনীতির উদ্ধৃতিতে দ্বিতীয় প্রামাণিক মতটি পেশ করেন তবে তা গলদ নয়, বরং ইলমী আমানতের দাবি। তবে হ্যাঁ, স্বেচ্ছাচারিতা ও আসাবিয়্যাত (অন্যায় পক্ষপাত) থেকে বেঁচে থাকা সর্বাবস্থায় ফরয। এমনিভাবে আহলে ইলমের সোহবতে থেকে নিয়মতান্ত্রিকভাবে ফন না শিখে ফন্নী বিষয়ে প্রবেশ করা অনুচিত অনুপ্রবেশের শামিল, যা থেকে বেঁচে থাকা আরো বেশি ফরয। আল্লাহ তাআলা আমাদের সর্বপ্রকার অনুচিত অনুপ্রবেশ থেকে হেফাযত করেন। আমীন। -আবদুল মালেক
সূত্র : আল কাউসার-এর সৌজন্যে