কিছু বিষয় আছে ছাইচাপা আগুনের মতো। বুক ফাটে কিন্তু মুখ ফুটে না। যৌন বিষয়টাও তেমনি।
মুসলমানদের মাঝে একান্নবর্তী পরিবার। সাত ভাই, ছয় বোনের সংসারে পিতা-মাতা মারা যাবার পূর্ব পর্যন্ত চান না সন্তানরা কেউ আলাদা থাকুক, উনুন আলাদা হোক।
একজনের রুজিতে সতের জনের বসে বসে খাওয়া। ছেলে-মেয়েদের বিয়ে-শাদীর পর যখন ধাক্কা-ধাক্কি শুরু হয়, তখন আলাদা করার চিন্তা আসে। একটা মেয়েকে উপযুক্ত বয়সে বিয়ে দেয়া যেভাবে অভিভাবকের দায়িত্ব, ঠিক তদ্রুপ ছেলেকে লালন পালন করে বড় করিয়ে লেখাপড়া শিখিয়ে বিয়ে করিয়ে দেয়াও কি অভিভাবকের কাজ?
ছেলেদেরকে নিজের পায়ে দাঁড়ানোর শিক্ষা দেয়া একান্ত প্রয়োজন ছিলো। কিন্তু ঘটে বিপরীত। একের পর এক ছেলেকে বিয়ে করালেন আর ঘর ভরলেন ছেলের বউদের দিয়ে।
পাশাপাশি রুমে অবস্থান। পর্দা-পুশিদার বালাই নেই। এমনকি ছেলে-মেয়ের ঘরের সন্তানরা নিজেদের কাজিনকে আপন ভাই-বোনের মতো সামনে আসা যাওয়া, একত্রে উঠা-বসা, খাওয়া-পরা ইত্যাদি শুরু করে।
এই রিহার্সেলগুলোর পরিণতি শেষ পর্যন্ত যৌন হয়রানিতে গিয়ে পৌছে। চোখের ফাঁকিতে, আড়ালে-আবডালে কত মেয়ের জীবন নিকটাত্মীদের দ্বারা নষ্ট হচ্ছে তার হিসাব কে রাখে? শরয়ী পর্দা পালন না করার কারণে ইসলামের মৌলিক বিধানের প্রতি সৃষ্টি হয় উদাসীনতা। স্কুল-কলেজের পরিবেশ দেখছি; কিন্তু সর্বনাশা আমাদের জাহেলি সমাজব্যবস্থার খবর আমরা কতটুকু রাখি?
এক হাজি সাহেব একদিন অভিযোগ করে বললেন, ইমাম সাহেব! আমার জেঠালির মেয়েদের লেখাপড়া, সাহায্য-সহযোগিতা সবই করলাম। মেয়েরা এখন বড় হয়েছে ঠিকই; কিন্তু সামনে এসে আর সালাম করে না। এটা কি ইসলাম? বললাম, তারা পর্দার ভেতর থেকে আপনাকে সালাম দিতে পারে; কিন্তু সামনে খোলামেলাভাবে তো আসার বিধান ইসলামে নেই! লক্ষ্য করলাম, হাজি সাহেব জবাবে খুব একটা খুশি হলেন না!
যৌনতা কি শুধু হাতের স্পর্শ?
চোখের চাহনি, মুখের কথা, কণ্ঠস্বর হাতের স্পর্শের মতোই কাজ করে। তাই আমাদের ছেলে-মেয়েদের সে বিষয়ে জানানো, বুঝানো উচিত। খালার বাড়ি, নানার বাড়ি, চাচার বাড়ি, তালইর বাড়ি, দুলাভাইর বাড়ি বেড়াতে যাওয়ার আনন্দ কে অস্বীকার করে। কিন্তু এসব আনন্দের মাঝে যে বিষাদ আছে, ভয়ানক বিষ বিদ্যমান আছে, এ ব্যাপারে অভিভাবকমহলের সচেতন ও জানা থাকা একান্ত জরুরী।
আপনার ছেলে-মেয়ে সাত বছর বয়স থেকে কার সাথে চলবে, কার পাশে ঘুমাবে তা অবশ্যই আপনাকে আগ থেকে জানতে হবে এবং সাথে সাথে ছেলে-মেয়েদের জানাতে হবে।
এতো গেল পারিবারিক যৌন সচেতনতার কথা। কারণ, যৌন নিপীড়ন থেকে শিশুদের বাঁচানোও একপ্রকার যৌনশিক্ষা বা যৌন সচেতনতা।
অনেকে ছেলে মেয়েদের শিক্ষার জন্য বোর্ডিং স্কুল বা মাদরাসায় দেন। হোক তা ছেলে এবং মেয়েদের জন্য আলাদা আলাদা শিক্ষালয়। অবশ্যই আপনার জানা থাকা দরকার, আপনার সন্তান কতটুকু নিরাপদ সেখানে। শিক্ষক-শিক্ষিকা কেউ-ই ফেরেশতা নন; কিংবা কর্তৃপক্ষ হয়তো টপ-টু বটমের খবর রাখে না বা রাখতে পারে না। তাই আপনাকে সতর্ক থাকা চাই।
প্রাইমারির পর অবশ্যই আপনার ছেলে-মেয়েকে সহ-শিক্ষার আসরে ভর্তি করাবেন না। ছেলেদের বেলায়ও সমান বক্তব্য। আপনার কচি-কিশোর ছেলেকে এমন কোন বোর্ডিংব্যবস্থার স্কুল বা মদারাসায় দিবেন না, যে প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে আপনি এ বিষয়ে আগে থেকে শতভাগ নিশ্চিত না হয়েছেন। আর নিশ্চিত না হয়েছেন ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরীণ পরিবেশ সম্পর্কে।
শিক্ষক, হুজুর বা বুজুর্গ যেই হোন না কেন, অবশ্যই শিশু-কিশোরদের যে কোনো প্রকার খেদমতে ছাত্রদের লাগানো নিষেধ। এমনকি সহপাঠীদের সাথেও একত্রে একবিছানায় থাকা অশুভনীয়। ৫-১৫ বছর বয়সের ছেলেদের বেলায়ও তাই প্রযোজ্য।
আজকাল বিভিন্ন চটকদার বিজ্ঞাপন থাকে বোর্ডিং মাদরাসা সম্পর্কে। উন্নত থাকা-খাওয়া এবং ভালো লেখাপড়ার নিশ্চয়তা দেয়া হয়। আমি মনে করি, সাথে সাথে এই নিশ্চয়তাও থাকা দরকার যে, কঁচি-কাঁচাদের সাথে কোন প্রকার শারীরিক, মানসিক, চারিত্রিক হয়রানির ঝুকি আছে কি-না তাও খতিয়ে দেখা।
সাধারণ পাবলিক হুজুর দেখলে ভাবে জান্নাতি মানুষ। নিজের কলিজার টুকরো সন্তানকে হাতে সমজিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। কিন্তু মানুষরূপী অনেক জানোয়ার আছে হুজুরের বেশ ধরেছে। সে বিষয়গুলোতে তাকওয়া আর বুজুর্গীর দিকে না চেয়ে নিয়ম এবং আইনের দিকে দৃষ্টিপাত করবেন। যত বড় পীর, ফকির, বুজুর্গ হোন, মায়া মমতার-নামে আদরের নামে, খেদমতের নামে আপনার সন্তানকে নিয়ে বিছানায় উঠা-বসা বা অধিক মাখামাখির অধিকার কারো নেই।
এজন্য যে সকল প্রতিষ্ঠানে ইবতেদাইয়াহ, মুতাওয়াসসিতাহ বিভাগের পাশাপাশি ছানুবিয়্যাহ-ফযিলত ও টাইটেল ক্লাসসমূহ একত্রে, একই ক্যাম্পাসে সহাবস্থান; সেখানে নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে অনেকের ঘোর আপত্তি আছে। আবাসিক হলে তো আর কথাই নেই।
বড় ছাত্রদের লোলুপ দৃষ্টি কঁচি কাঁচাদের উপর পড়া স্বাভাবিক। শিশু-কিশোরদের মনে বড় ক্লাসের বা প্রতিষ্ঠানের বড় ভাইয়ের সামান্য আদর-স্নেহে পাগলপারা থাকে। কিন্তু এই চকলেট, ড্রিংক, বিস্কিটের আড়ালে কি সর্বনাশা প্লান আছে তা কি সে জানে? আমি ঢালাওভাবে কথাটি বলছি না; বা সবাই যে খারাপ এমন না। কিন্তু কিছু কিছু খারাপ লোকের কারণে পুরো প্রতিষ্ঠানের বদনাম হয়।
অতএব আমরা স্বাভাবিক নিয়মের কথাই বলবো যে, মক্তব-মুতাওয়াসসিতাকে দূরে রাখুন ছানুবিয়্যাহ-ফজিলত ও টাইটেলের ক্লাসসমূহ থেকে। এটাই হলো আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে যৌন আচরণ ও সতর্কীকরণ সংক্রান্ত আলোচনা। চলবে।
লেখক : খতিব ও গবেষক
আরও পড়ুন
যৌনশিক্ষা ও আমাদের করণীয় (১ম পর্ব)
যৌনশিক্ষা ও আমাদের করণীয় (পর্ব-২)