আশরাফ আলী নিজামপুরী ::
উপমহাদেশের সংস্কার আন্দোলনের জনক শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ.-এর ওফাতের পর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন তাঁরই যোগ্যতম বড় সাহেবজাদা শাহ আব্দুল আজিজ মুহাদ্দিসে দেহলভী রহ.। ইনিই সেই মহান ব্যক্তি যিনি সর্বপ্রথম ফার্সিতে পবিত্র কুরআনের তাফসীর লিখেন (উল্লেখ্য, সে সময় উপমহাদেশের রাষ্ট্রীয়ভাষা ছিল ফার্সি) ‘তুহফায়ে ইছনা আশারিয়া’ রচনা করে শীয়া মতবাদের ভিত ভেঙে চুরমার করেন এবং ১৮০৩ সালে সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজ বাহিনীর বিরুদ্ধে ‘জিহাদ ফরজ’ ফাতওয়া দানের মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনের শুভ সূচনা করেন। তাঁরই ভাসিয়ে দেয়া রণতরী, সিতানা, বালাকোট সিপাহী বিদ্রোহ, রেশমী রুমাল আন্দোলন প্রভৃতি ঘাট অতিক্রম করে ১৯৪৭ সালে কূলে ভিড়ে। যারা মনে করেন, ইংরেজ সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খল থেকে ভারতকে কংগ্রেসই স্বধীন করেছে তাদের মনে রাখা উচিত- শেষ লোকমায় পেট ভরে না। কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ৮২ বছর পূর্ব থেকেই উলামায়ে কেরাম স্বাধীনতা সংগ্রাম করে আসছেন অথচ হিন্দুজাতি তখন ইংরেজের সহযোগী ছিল।
ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন পতনের সূচনা: উত্থান ও পতন প্রকৃতির এক অমোঘ বিধান। অমাবস্যার নিকষ কালো তিমির রাতের পর আলোর মাইলফলক হিসেবে উদিত হয় একফালি চাঁদ। ধীরে-ধীরে তা পরিণত হয় পূর্ণ শশীতে। অতপর জোসনার স্নিগ্ধ আলোয় জগৎকে গোসল করিয়ে আবার ক্ষয় পেতে থাকে। আবার আসে অমাবস্যা। একটি ফুটফুটে অবলা শিশু তেজোদ্দীপ্ত যুবকে পরিণত হয়ে আবারো ঢলে পড়ে বার্ধক্যের কোলে। অর্থাৎ বস্তুর মাঝে যে মুহূর্তে আসে পূর্ণতা, তার পরের মুহূর্ত থেকে শুরু হয় পতনের ধারা। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের বেলায়ও তা ঘটেছিল।
ভারতবর্ষের ইতিহাসে সম্রাট আলমগীর রহ.-এর ইতিহাসকে বলা হয় স্বর্ণযুগ, এ সময়েই ভারতে মুসলিম শাসনের পূর্ণতা লাভ হয়। ভারতবর্ষে এত বিশাল সাম্রাজ্য গঠন ইতোপূর্বে কারো পক্ষে সম্ভব হয়নি। কাবুল থেকে চট্রগ্রাম এবং কাশমীর থেকে কাবেরী পর্যন্ত তাঁর সাম্রাজ্য বিস্তৃত ছিল। লেনপুল বলেন, ‘তিনি আকবরের চেয়েও অধিক শক্তিশালী শাসক ছিলেন।’ তাঁর সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা ও ন্যায়পরায়ণতা দিয়েছিল সকল নাগরিকের ব্যক্তি ও ধর্মীয় স্বধীনতার নিশ্চয়তা। মুসলিম, খ্রিস্টান, বৌদ্ধ ও হিন্দু নির্বিশেষে সকলের জন্যই ছিল সমান নিরাপত্তা। ব্যক্তি জীবনে তিনি ছিলেন একজন বিশিষ্ট আলিম, কামিল মুর্শিদ আদর্শবান ও ধার্মিক মুসলমান। তাহাজ্জুদ কাযা হত না। রাতে মাত্র তিন ঘণ্টা ঘুমাতেন। নিজ হাতে কুরআন নকল ও টুপি সেলাই করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। তারই তত্ত্বাবধানে ভারতের সংবিধান হিসেবে রচিত হয় বিখ্যাত ফাতওয়ায়ে আলমগীরী। এটি থেকে ইংরেজরা বহু আইন গ্রহণ করে। হযরত আলমগীর রহ.-এর ওফাতের (১৭০৭) পরবর্তী যুগ হলো মুসলিম শাসনের পতনের সূচনাকাল। পরবর্তীদের অযোগ্যতা, বিলাসিতা, ক্ষমতার লিপ্সা এবং দালালদের বিশ্বাসঘাতকতাই ছিল এর মূল কারণ। কেন্দ্রের হাতে শক্তি না থাকলে এলাকাগুলি কেন্দ্রের ওপর প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করে। মোঘলদের শেষ যুগে তাই ঘটেছিল। মারাঠা, শিখ, জাঠ ও রাজপুত প্রভৃতি বিদ্রোহী দল নতুন সাম্রাজ্য স্থাপন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়। এহেন পরিস্থিতিতির সুযোগ নিয়ে ইংরেজ বেনিয়া দল এদেশে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পথ খুঁজতে থাকে।
সাম্রাজ্যবাদীদের উত্থান: ১৪৯৪ খ্রিস্টাব্দ। পর্তুগীজ নাবিক ভাস্ক-দা-গামা আবিষ্কার করেন ভারতের নৌপথ। তখনই নতুন পথে পল্লবিত হয় হৃদয়ে পোষে রাখা ইউরোপিয়ানদের দীর্ঘদিনের স্বপ্নসাধ। তাহলো ভারতীয় ধনৈশ্বর্য লুট। পূর্বকাল থেকেই ভারতবর্ষ ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। এদেশের প্রয়োজন পূরণের জন্য একটি পয়সা বা দেশীয় শ্রমিকদের শ্রম বিদেশে চালান করতে হতো না। বরং দেশে উৎপাদিত অভিজাত দ্রব্য বিদেশে চালান করে কোটি কোটি স্বর্ণমুদ্রা আয় করা হতো। সম্রাট মুহাম্মদ ইবনে তুঘলকের আমল থেকেই ভারতীয় অর্থ বিদেশে চালান আইনগতভাবে নিষিদ্ধ করা হয়। ফলে ভারতবর্ষের জাতীয় সম্পদ পৃথিবীর সর্ববৃহৎ ধনভা-ারে পরিণত হয়। ভারতবর্ষে জাতীয় অর্থ কী পরিমাণ ছিল, সম্রাট আলমগীরের একটি ঘটনা থেকে অনুমান করা যায়। তিনি সিংহাসনে আরোহণের পর দিল্লী ও আগ্রায় অবস্থিত ধনদৌলত পরিমাপের নির্দেশ দেন। তখন কয়েক হাজার শ্রমিক রৌপ্যমুদ্রা পরিমাপের কাজে দীর্ঘ ৬ মাস অতিবাহিত করলে দেখা গেল রাজকোষের একটি কোণও শেষ করা সম্ভব হয়নি। স্বর্ণমুদ্রা, হীরা, জহরত ইত্যাদি অবশিষ্ট রয়েই গিয়েছিল। এমতাবস্থায় তিনি পরিমাপের কাজ স্থগিত রেখে দক্ষিণ ভারতের অভিযানে নেমে পড়েন। এত সমৃদ্ধিশালী ছিল যে, দেশের অর্থ ব্যবস্থা, সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের উত্থান এবং জুলুম, শোষণ, লুটতরাজ ও দেশীয় অর্থ বিদেশে পাচারের কারণে সে দেশেই শুরু হয় ক্রমাগত দুর্ভিক্ষ। স্যার উইলিয়াম ডিগবীর মতে, ১৭৯৩ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত ভারতবর্ষে শুধু দুর্ভিক্ষের কারণে মৃতের সংখ্যা ছিল তিন কোটি ৭০ লক্ষেরও বেশি। বর্ণিত আছে, সম্রাট শাহজাহানের কন্যা জাহানারা একবার তার গৃহপরিচালিকার গায়ে লেগে যাওয়া আগুন নেভাতে গিয়ে তার পরিহিত রেশমী পোশাকে আগুন ধরে যায়। ঝলসে যায় সম্রাটকন্যার সারা শরীর। অনেক চিকিৎসার পরেও আরোগ্য লাভ হয়নি। বিচলিত হয়ে পড়েন বাদশাহ। এ সময় জনৈক ইউরোপিয়ান চিকিৎসকের মাধ্যমে শাহাজাদী জাহানারা সম্পূর্ণ আরোগ্যলাভ করেন। সম্রাট চিকিৎসককে পুরষ্কৃত করার মনস্থ করলে সে বাণিজ্যিক চুক্তির মিনতি জানায়। সম্রাট তা কবুল করেন। ফলে ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে ২১৮ জন ইংরেজ ‘ইস্ট ইন্ডিয়া’ নামে একটি বাণিজ্যিক সংস্থার গোড়াপত্তন করেন।
পরবর্তীতে সম্রাট শাহ জাফরের আমলে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বড় কারখানা তৈরির অনুমতি প্রদান করা হয়। তাদেরকে নিজস্ব নিরাপত্তা বাহিনী ও বন্দুক রাখার অধিকার দেওয়া হয়। আধুনিক উন্নত প্রযুক্তি, পুঁজিবাদ ও চাতুরতার আশ্রয়ে কমদিনেই তারা বিশাল অর্থশালী কম্পানিতে পরিণত হয়। ইংরেজরা ভারতবর্ষে কোনো মহৎ উদ্দেশ্যে আগমন করেনি। তারা এসেছে নিছক বাণিজ্য বিস্তার ও অর্থ লুট করার জন্য। তারপর ধীরে ধীরে দালালদের সহায়তায় তারা উপমহাদেশের শাসনক্ষমতা দখল করে নেয়। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক মাওলানা মুহাম্মদ মিয়া বলেন, বড়ই অবাক বিষয় যে, ইংরেজকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার পেছনে যারাই মদত যুগিয়েছিল তথা বাংলার মীর জাফর, মহীশুরের মীর সাদেক, অযোধ্যার শুজাউদ্দৌলা ও দিল্লির নজফ খান সকলেই ছিল শিয়া মতাবলম্বী। উল্লেখ্য, যুগে-যুগে শিয়ারাই ইসলামের সর্বাধিক ক্ষতিসাধন করেছে। কুখ্যাত মুনাফিক আব্দুল্লাহ ইবনে সাবাই ছিল এই বাতিল ফিরকার জনক। হযরত উসমান রা.-এর নির্মম হত্যাযজ্ঞ, জঙ্গে জামাল, হযরত তালহা ও যোবায়ের রা.-এর শাহাদাত, হযরত আলী রা. ও মুয়াবিয়া রা.-এর মাঝে বিরোধ সৃষ্টি, সন্ধির অবাস্তবায়ন ও জঙ্গে সিফফিন, খারেজীদের উৎপত্তি ও হযরত আলী রা.-এর শাহাদত সবই ছিল এই কুখ্যাত সাবায়ী চক্রের হীন ষড়যন্ত্রের ঘৃণ্য বাস্তবায়ন।
যারা শিয়া-সুন্নী ঐক্যের স্লোগান তোলেন, তাদের উদ্দেশে বলতে চাই- ইসলামকে ধ্বংস করার জন্য যে দলের উদ্ভাবন, যারা ইসলামের মূলনীতিতে ইখতিলাফ করে, যাদের দাবি পবিত্র কুরআনের কিছু অংশ গোপন করা হয়েছে, হাদীসের সহীহ কিতাবগুলি যারা মানে না। নিজেদের বাতিল আকিদা প্রমাণ করার জন্য যারা হাজার হাজার জাল হাদীস রচনা করেছে, ইজমায়ে সাহাবাকে যারা হুজ্জাতে শরয়ী মানে না, হযরত আবু বকর, উমর ও উসমান রা.-কে যারা কাফের বলে গালি দেয়, কুরআনের অকাট্য আয়াত অস্বীকার করে, যারা উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রা.-এর প্রতি অপবাদ আরোপ করে, তাদের তথাকথিত ইমাম মাহদীকে যারা রসুলুল্লাহ সা.-এর ওপর প্রাধান্য দেয়, হকপন্থী সুন্নীদের বিরুদ্ধে যারা কাফিরদের সহায়তা করে, তাদের সাথে আমাদের কেনো এবং কিসের ভিত্তিতে ঐক্য হবে?
উপমহাদেশে ইংরেজ শাসন: দীর্ঘ ১৯০ বছর (১৭৫৭-১৯৪৭) ইংরেজরা দেশের একটি অংশবিশেষ থেকে শুরু করে গোটা ভারত উপমহাদেশে শাসন করে। ইংরেজ শাসনের একশ বছর ( ১৭৫৭-১৮৫৭) ছিল ‘ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির’ শাসন আর নব্বই বছর (১৮৫৭-১৯৪৭) ছিল সরাসরি বৃটিশ সরকারের শাসন। এই একশ নব্বই বছরে ভারতীয়দের উপর জুলূম, শোষণ ও নির্যাতন ছিল বর্ণনাতীত। এ সাম্রাজবাদী অপশক্তি ভারতবাসীর জীবিকা নির্বাহের সমুদয় উপকরণ, তাদের চারিত্রিক গুণাবলি, সংস্কৃতি ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের যে পরিমাণ ধ্বংস ও ক্ষতিসাধন করেছে অতীতে ও বর্তমানে কোনো গোষ্ঠি কোনো সম্প্রদায়ের এ পরিমাণ ধ্বংস সাধনে সক্ষম হয়নি।
তারা ভারতীয়দের গোলামের জাতিতে পরিণত করে, তাদের আত্মসম্মান ভূলুণ্ঠিত করে। রাজপথ, সকাল-বিকাল পায়চারির স্থান, এমনকি সভা-সমিতির বৈঠকে আসন বণ্টনেও তাদের প্রতি বৈষম্য করা হয়। তারা কৃষকদের উৎকৃষ্ট জমিতে নীলচাষে বাধ্য করত। তাদের প্রাপ্য পরিশোধ করত না। যেসব কৃষক নীলচাষে সম্মত হতো না তাদের ওপর চালাত অমানুষিক নির্যাতন। এশলি ইডেন বলেন, খুন, দাঙ্গা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ, অপহরণ প্রভৃতি এমন কোনো নির্যাতন নেই যা তাদের উপর করা হত না। তারা চাষীদের উৎপাদিত শস্য, দরিদ্র দেশবাসীর দোকানের মাল যথেচ্ছভাবে নিয়ে দাম দিত না। ভূমি বন্দোবস্তের নতুন নিয়ম চালু করে ভূমি রাজস্ব কয়েকগুণ বৃদ্ধি করা হয়। তাতে কৃষক শ্রেণির ব্যাপক ভরাডুবি ঘটে। ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের ওপরেও আরোপিত হয় মাত্রাতিরিক্ত করের বোঝা। তারা ভারতীয় ব্যবসা, বাণিজ্য, মসলিন সিল্ক, কাপড়ের শিল্প, নৌশিল্প ইত্যাদি ধ্বংস করে।
প্রশাসনিক পদ্ধতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আনয়ন করে। গুরুত্বপূর্ণ সকল পদ থেকে দেশীয়দের সরিয়ে দেওয়া হয়। নিম্ন থেকে নিম্নতর কোনো পদের জন্যও কোন ইংরেজ পাওয়া গেলে দেশীয়দের তা থেকে বাদ দেওয়া হয়।
মোটকথা, ইংরেজদের জুলুম-শোষণের ফলে সমাজের গোটা কাঠামো ভেঙে পড়ে। দারিদ্র ছেয়ে যায় এবং দুর্ভিক্ষ সৃষ্টি হয়। তারা ইসলামী রাষ্ট্রব্যবস্থা অকার্যকর করে। উল্লেখ্য; মুসলিম শাসনামলে প্রশাসন, বিচার বিভাগ প্রভৃতি পরিচালিত হতো কুরআন-সুন্নাহ ও ইসলামী ফিকাহের আলোকে। বিজ্ঞ উলামায়ে কেরাম ছিলেন এসবের ব্যাখ্যাকারক।
তারা ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থার ওপর বিধি নিষেধ আরোপ করে। ইসলামী প্রতীকসমূহের অবমাননা করে। ১৮০৩ সালে ইংরেজ বেনিয়া গোষ্ঠী মুুসলিম ভারতের প্রাণকেন্দ্র দিল্লী দখল করে এবং সগর্বে ঘোষণা করে “এখন থেকে ভারতবর্ষের শাসনের নীতি হবে সৃষ্টি স্রষ্টার, সাম্রাজ্য সম্রাটের আর কর্তৃত্ব থাকবে কোম্পানি বাহাদুরের।” তখন গর্জে ওঠেন শাহ ওয়ালীউল্লাহর জানশীন, তৎকালীন মান্যবর শ্রেষ্ঠতম ইসলামী ব্যক্তি শাহ আব্দুল আজীজ মুহাদ্দিসে দেহলভী রাহ.। মাদরাসায়ে রহীমিয়্যার হাদীসের মসনদ থেকে দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষণা দেন- ভারতবর্ষ ‘দারুল হরব’-এ পরিণত হয়েছে এবং মুসলমানদের জন্য ইংরেজ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক জিহাদ ফরয। দারুল হরব সংক্রান্ত বিস্তারিত ফাতওয়ার একস্থানে তিনি বলেন-“এই শহরে ইমামুল মুসলিমীন এর আদেশ কার্যকর হচ্ছে না। বড় বড় ইংরেজ নেতার আদেশ নির্দ্বিধায় পালিত হচ্ছে। দেশটি দারুল হরব কুফরে পরিণত হওয়ার কারণ হলো- বর্তমানে দেশের রক্ষণাবেক্ষণ, প্রজাদের লালন-পালন, দুর্বৃত্তদের প্রতিরোধ, মামলা-মোকাদ্দামার রায় প্রদান, অপরাধীদের শাস্তি বিধান ইত্যাকার রাষ্ট্রীয় বুনিয়াদী কর্তৃত্ব ইংরেজদের হাতে চলে গেছে। যদিও ইংরেজরা ধর্মীয় কিছু-কিছু কাজ যেমন জুমআ, ঈদ, আযান, গরু যবেহ ইত্যাদিতে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করে না, তাতে কি? এসব ধর্মীয় কাজের যেটি বুনিয়াদ, সেটিই ইংরেজদের হাতে কুক্ষিগত ও নিগৃহীত। ১৮০৩ সালে হযরত আব্দুল আজীজ মুহাদ্দিসে দেহলবী রহ.-এর জিহাদের ফাতোয়ার পর থেকে শুরু হয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন। এরই ফলে ১৪৪ বছর পর ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের স্বধীনতা লাভ হয় এবং বিশ্ব মানচিত্রে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুইটি স্বাধীন ভূখ-ের অভ্যুদয় ঘটে।
উল্লেখ্য,জিহাদের উদ্দেশ্য হলো-কুফুরী শক্তির প্রভাবকে চুরমার করে তাদের দাপট ও দৌরাত্ম দমন করা। জুলুম, শোষণ, নৈরাজ্য ও অশান্তি দূর করা এবং আল্লাহর বিধান ও ইনসাফ কায়েম করা। এক কথায়, আল্লাহর কালিমাকে বুলন্দ করা। এজন্যই খোদাদ্রোহী অপশক্তি জিহাদকে সর্বাধিক ভয় করে কুরআন-সুন্নাহর অপব্যাখ্যা দিয়ে দালালদের মাধ্যমে মুসলিম সমাজে জিহাদ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা সৃষ্টির প্রয়াস পায়। কারণ তারা ভালো করে জানে মুসলিম সম্প্রদায় যদি জিহাদী প্রেরণায় জেগে ওঠে, তবে তাদের প্রভুত্বের অবসান ঘটবে।
শাহ আব্দুল আজীজ দেহলভী রহ.-এর জিহাদী ফাতওয়ার সর্বপ্রথম বাস্তবরূপ দান করেন তারই হাতে গড়া শাগরিদ, তার চিন্তাচেতনার অনন্য ধারক ও বাহক সৈয়দ আহমদ শহীদ রহ.। তিনি ১৮০৮ সালে হযরত শাহ আব্দুল আজীজ থেকে তরীকতের খেলাফত প্রাপ্ত হয়ে মুজাহিদ আন্দোলন শুরু করেন। দেশব্যাপী পরিভ্রমণ করে কুসংস্কার বর্জন, চরিত্র সংশোধন, ইত্তিবায়ে সুন্নত এবং সরল-শুদ্ধ ধর্ম পদ্ধতি গ্রহণের আন্দোলন চালাতে থাকেন। ইংরেজরা মুসলমানদের ঐক্যে ফাটল সৃষ্টির জন্য আরব থেকে ‘ওহাবী’ শব্দটি আমদানী করে এবং শাহ ওয়ালীউল্লাহ রহ.-এর সংস্কার ও পূণর্জাগরণ আন্দোলনের এ মহান বীর সেনানীর বিরুদ্ধে প্রয়োগ করে। তাদের পোষ্য দালালদের মাধ্যমে স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারক বাহক হক্কানী উলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে ‘ওহাবী কাফের’ ফাতওয়া রচনা করে এবং হকপন্থীদের বিভিন্ন আকীদা বিকৃতভাবে উপস্থাপন করে মক্কা-মদিনা থেকে ফাতওয়া জাল করে। পরিতাপের বিষয়- একদল মুসলমান না বুঝে হক্কানী উলামায়ে কেরামের বিরুদ্ধে এখনও পর্যন্ত ইংরেজদের শিখানো ‘ওহাবী কাফের’ ‘ওহাবী কাফের’ বুলি প্রতিনিয়ত আওড়িয়ে যাচ্ছে।
১৮২৪ সালে ৬ মে শাহ আব্দুল আজীজ রহ. মৃত্যু বরণ করেন। তার স্থলাভিষিক্ত হন তারই ঘনিষ্ঠ শাগরিদ শাহ মুহাম্মদ ইসহাক মুহাদ্দিসে দেহলবী রহ.। তখন ওয়ালীউল্লাহ আন্দোলনের গৃহীত কর্মসূচি দুইভাগে বিভক্ত ছিল। একটি বিভাগে সৈয়দ আহমদ শহীদকে প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব দেওয়া হয়। অন্য বিভাগে শাহ মুহাম্মদ ইসহাক মাদরাসায়ে রহীমিয়্যায় বসে তালিম তরবিয়্যাত প্রদান, মন মানসিকতা সৃষ্টি, প্রশিক্ষণ দান ও সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতার দায়িত্ব পালন করেন। সৈয়দ আহমদ শহীদ ইঙ্গ মিত্রদের সাথে ১২টির অধিক যুদ্ধ করেন। ১৮৩১ সালের ১লা মে দশ হাজার মুজাহিদের বিরাট বাহিনী নিয়ে সৈয়দ আহমদ শহীদ উপস্থিত হন বালাকোটের প্রান্তরে। অত্যাচারী ইংরেজ মিত্র রাজা রঞ্জিত সিংহের বিরুদ্ধে জিহাদ করার জন্য। গভীর রাত চারদিকে সুনসান নীরবতা, সবাই ঘুমে বিভোর। ঘুম নেই শুধু দুটি চোখে; প্রভুর আশিক দাঁড়িয়ে গেলেন অবনত মস্তকে প্রভুর সামনে। আহ্ কী অপূর্ব ছিল সে নামাজ! জমিনে মাতা ঠুকে প্রাণভরে যখন উচ্চারণ করছেন ‘সুবহানা রাব্বিয়াল আলা’ ঠিক তখনই অপ্রত্যাশিতভাবে তুমুল অক্রমণ চালায় রাজার বাহিনী, সিজদাবনত অবস্থায়ই তিনি চিরদিনের জন্য চলে যান মহান প্রভুর সান্নিধ্যে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঝরে যায় অনেক তাজাপ্রাণ, ময়দানে আসেন শাহ ইসমাইল শহীদ রহ. এবং লড়াই করে শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেন। উম্মাহ্র নেতৃস্থানীয় শ্রেষ্ঠ উলামায়ে কেরামের রক্তে রঞ্জিত হয় বালাকোট প্রান্তর। হায় বালাকোট প্রান্তর! কত রক্ত ঝরালে তুমি! বালাকোট প্রান্তরে মুজাহিদদের পরাজয় হলেও সৈয়দ আহমদ শহীদ রহ. সমগ্র ভারতবর্ষে জনগণের মাঝে স্বাধীনতার যে চেতনা গড়ে তুলেছিলেন, হান্টারের মতে সেই চেতনাই পরবর্তী ৫০ বছরে ভারতে ইংরেজ বিরোধী বিদ্রোহী কর্মকা- জিইয়ে রাখে। বাংলার সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর এবং ফারায়েজী আন্দোনের প্রতিষ্ঠাতা হাজী শরীয়তুল্লাহ ছিলেন সৈয়দ আহমদ শহীদের রহ.-এর শিষ্য। বালাকোটের পর ইংরেজদের বিস্তদ্ধে সবচেয়ে কঠিন আন্দোলন ছিল সৈয়দ আহমদ শহীদের দীক্ষাপ্রাপ্ত সাদিকপুরী আলিমদের স্বাধীনতা আন্দোলন। ইংরেজরা উদ্দেশ্যমূলকভাবে এ আন্দোলনকে “ওহাবী আন্দোলন’ নাম দিয়ে ব্যাপক অপপ্রচার চালায়। অপর দিকে শাহ মুহাম্মদ ইসহাক দেহলবী ১৮৩৫ সালে পুনঃজিহাদের জন্য নিজ জামাতা সৈয়দ নাসীরুদ্দীনকে সিতানা দুর্গে পাঠান। তুর্কি সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠতা স্থাপন করে আন্দোলনের শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৮৪৪ সালে শাহ ইসহাক দেহলবী রহ. হিজাযে হিজরত করেন। তখন মাদরাসায়ে রহীমীয়ায় তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন তাঁরই বিশিষ্ট শাগরিদ শাহ আব্দুল গনী মুজাদ্দেদী রহ.। হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. হজের উদ্দেশ্যে মক্কা শরীফ পৌঁছলে শাহ ইসহাক রহ. তাঁকে আন্দোলনের পরবর্তী যিম্মাদার নিযুক্ত করেন। তখন থেকে আন্দোলনের সাথে জড়িত হন হুজ্জাতুল ইসলাম কাসেম নানুতবী, ফকীহুননাফস রশীদ আহমদ গাঙ্গোহী, মাওলানা রহমাতুল্লাহ কিরানুবী, মাওলানা ইয়াকুব নানুতবীসহ অনেক বিখ্যাত উলামায়ে কেরাম। ১৮৪৬ সালে শাহ মুহাম্মদ ইসহাক দেহলবী রহ. মক্কায় ইন্তিকাল করেন। তখন থেকে হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ.-এর নেতৃত্বে আন্দোলন পরিচালিত হতে থাকে।
সিপাহী বিপ্লব ও শামেলীর যুদ্ধ: ১৮৫৭ সালে সমগ্র ভারতজুড়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের যে দাবানল জ্বলে ওঠে, বৃটিশরা তার নাম দিয়েছে সিপাহী বিদ্রোহ। প্রকৃত পক্ষে তা ছিল সর্বস্তরের জনগণের মহাবিপ্লব। এ বিপ্লবে ওয়ালীউল্লাহী কাফেলার অনেক অবদান রয়েছে। বিপ্লবীগণ দিল্লী দখল করে সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে নিজেদের সম্রাট বলে ঘোষণা দেন। এ বিপ্লবের প্রধান নায়ক ছিলেন সৈয়দ আহমদুল্লাহ খান ও সেনাপতি বখত খান। তারা উভয়ে ছিলেন সৈয়দ আহমদ শহীদ ও শাহ ইসমাইল শহীদ রহ.-এর শিষ্য। বিশেষজ্ঞগণ বলেন এই বিপ্লবের মূল প্রেরণা ছিল শাহ আব্দুল আজীজ রহ.-এর দারুল হরব ফাতওয়া ও স্বাধীনতার উদাত্ত আহ্বান। এ বিপ্লবে স্বয়ং হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ নেতৃত্ব দেন শামেলীর ঘাটিতে। তারা বিরাট এলাকা থেকে ইংরেজদের হটিয়ে দেন এবং অস্থায়ী সরকার গঠন করেন। সেখানে হাজী সাহেব রহ.-কে আমীরুল মুমিনীন, কাসেম নানুতবী রহ.-কে প্রধান সেনাপতি এবং রশীদ আহমদ গঙ্গুহী রহ.-কে প্রধান বিচারপতি নিয়োগ করা হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এ বিপ্লবেও দেশবাসী সফল হতে পারেনি। বিপ্লবী আলিমগণ গোপনে আন্দোলনের প্রাথমিক কাজ সম্পন্ন করার পর দেশবাসী এক যোগে মহাবিদ্রোহের লক্ষ্যে ১৮৫৭ সালে ৩১ মের দিনটি ধার্য করেছিলেন এবং সে অনুসারে অবশিষ্ট কাজ চূড়ান্ত করতে থাকেন। ইত্যবসরে কোলকাতার ব্যারাকপুরে ২৯ মার্চ মঙ্গলপা–নামক একজন সিপাহীর ধৈর্যচ্যুতি ঘটে এবং হঠাৎ বিদ্রোহ শুরু হয়। মুহূর্তের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে দিগি¦দিক। শায়খুল ইসলাম হযরত মাদানী রহ বলেন, নির্ধারিত সময়ের ২ মাস পূর্বে ব্যারাকপুরে মঙ্গল পা-ের হাতে এ আগুন জ্বলে ওঠে। অথচ অন্যান্য স্থানে তখনও পরিকল্পনা অনুসারে প্রস্তুতির কাজ চূড়ান্ত হয়নি। ফল দাঁড়ায় যে, দিল্লীতে যথানিয়মে যুদ্ধ শুরুর পূর্বে বাংলার বিপ্লব প্রায় শেষ হয়ে যায়। তারপর পাঞ্জাবে এমন সময়ে বিপ্লব শুরু হয় যখন ইংরেজ সরকার দিল্লী ও কানপুর পুনরুদ্ধারে সক্ষম হয়ে গেছে। মাদরাজ, বোম্বাই ও হায়দ্রাবাদ তথা দক্ষিণ ভারতে তখন পর্যন্ত কোনো কাজই চূড়ান্ত হয়নি। তাই ওই সকল প্রদেশে বিদ্রোহ ঘটেছিল খুবই সামান্য। ইংরেজ ওই প্রদেশগুলি সহজেই পুনরুদ্ধার করে ফেলে এবং সেখানকার সৈন্যবাহিনী উত্তর ভারতের দিকে প্রেরণের সুযোগ পেয়ে যায়। মোট কথা, নির্ধারিত সময়ের পূর্বে যুদ্ধ শুরু হওয়াই ছিল ব্যার্থতার প্রধান কারণ। অন্যান্য কারণের মধ্যে রয়েছে ইংরেজদের উন্নত অস্ত্র ও কর্মদক্ষতা, শিখ ও নেপালী সৈন্যদের সহায়তা এবং দালালদের দালালী।
আন্দোলনের পট পরিবর্তন: সিপাহী বিপ্লবের ব্যর্থতার পর এ দেশবাসীর ভাগ্যাকাশে নেমে আসে দুর্যোগের ঘনঘটা। শুরু হয় প্রবল ঝড়-তুফান এবং নির্যাতনের ভয়ঙ্কর বজ্রাঘাত। সে নির্যাতনের ইতিহাস লিখতে কলম থমকে গেছে, রক্তের কালি শুকিয়ে গেছে। সুতরাং ক্ষমা কর হে পাঠক! ফাঁসি, গুলি, জ্বলন্ত অগ্নিকু-ে নিক্ষেপ, জলন্ত লৌহ শলাকার দ্বারা দাগ দিয়ে গলা টিপে হত্যা, শূকরের চামড়ার ভিতরে ঢুকিয়ে জীবন্ত সেলাই, কামানের নলের মুখে পুরো দেহ ছিন্নভিন্নকরণ, উলঙ্গ করে নির্যাতন এবং ………..। মোট কথা জুলুম ও নির্যাতনের এমন কোনো পথ ও পন্থা অবশিষ্ট ছিলনা যা কোনো হৃদয়হীন ব্যক্তি কিংবা হিংস্র পশুর কল্পনায় আসতে পারে? আর আন্দামান! উহ! আর নিওনা এ নাম। হত্যার অন্যান্য পদ্ধতি ব্যতিরেকে শুধু ফাঁসিতে কম করে হলেও ২৮ হাজার মুসলমানকে ঝুলানো হয়েছে। শুধু এক দিনেই ১৪ হাজার উলামায়ে কেরামকে ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলানো হয়েছে। দিল্লীর চাঁদনী চক থেকে খায়বর পর্যন্ত এমন কোনো গাছ ছিলনা, যার শাখায় উলামায়ে কেরামের লাশ ঝুলেনি। সম্রাট বাহাদুর শাহ-এর পরিবারের ১৯ জন সদস্যকে সম্রাটের সামনেই গুলি করে হত্যা করা হয়। ইংরেজরা শাহজাদাদের কর্তিত মস্তক একটি তশতরীতে সাজিয়ে নাশতার সময়ে বন্দী সম্রাটের সামনে পেশ করলে তিনি দুঃখের হাসি হেসে বলেন, তৈমুর বংশের বীর সন্তানেরা শেষ পর্যন্ত এভাবে কর্তিত মস্তক হয়ে পিতার সামনে হাজির হলো। শুধু কি নির্যাতন? ইংরেজ লাল কুকুরগুলো কুরআনের লক্ষ লক্ষ কপি জ্বালিয়ে দেয়। উল্লেখ্য, তখনও এদেশে ছাপাখানা ছিল না। তারা মাদরাসাসমূহের ‘ওয়াক্ফ’ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে সব মাদরাসাকে অচল করে দেয়। উল্লেখ্য ইংরেজদের পূর্বে এদেশে শুধু একমুখী শিক্ষাব্যবস্থা চালু ছিল। অর্থাৎ মাদরাসা শিক্ষাই ছিল এ জাতির একমাত্র শিক্ষাব্যবস্থা। তারা শাহ ওয়ালীউল্লাহ রহ.-এর ঐতিহাসিক রহীমিয়া মাদরাসা কামানের আঘাতে ওড়িয়ে দেয়। ঐতিহাসিক আকবরী মসজিদকে মদ্যপানের ক্লাবে পরিণত করে। বিপ্লবে ব্যর্থতা এবং ব্যাপক গণহত্যার ফলে মুসলমানগণ শক্তিহীন হয়ে পড়েছিলেন। অপরদিকে কম্পানি শাসনের অবসান ঘটিয়ে বৃটেনের মহারাণী সরাসরি দেশ পরিচালনার ভার গ্রহণ করেন। তিনি তখন রাজ্য সম্প্রসারণের পরিবর্তে বস্তুবাদী শিক্ষা ও সভ্যতা সম্প্রসারণের নীতি প্রবর্তন করেন। তাদের শিক্ষাব্যবস্থার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে লর্ড ম্যাকলে বলেন, আমাদেরকে এমন একটি দল গড়ে তুলতে হবে, যারা বস্তুত আমাদের ও আমাদের কোটি-কোটি প্রজার মধ্যে অনুবাদকের ভূমিকা পালন করবে। এ দলটি এমন হবে, যেনো তারা রক্ত ও বর্ণের দিক থেকে থাকে ভারতীয়, অথচ রুচি, চিন্তাধারা, কথাবার্তা ও অনুভূতির দিক থেকে হবে ইংরেজ। এ শিক্ষাব্যবস্থার ফলাফল সম্পর্কে স্যার উইলিয়াম হান্টার বলেন “আমাদের স্কুলগুলি থেকে উত্তীর্ণ কোনো তরুণ, হিন্দু হোক কিংবা মুসলিম, এমন কেউ নেই যে পূর্বপুরুষের ধর্মকে অস্বীকার করতে শিখেনি। ইংরেজ সরকারের উচ্চপদস্থ এসব কর্মকর্তার বক্তব্য থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, ভারতবর্ষে শিক্ষা বিস্তারের মাধ্যমে ইংরেজদের উদ্দেশ্য এ দেশবাসীর হিতকামনা ছিল না। বরং উদ্দেশ্য ছিল স্বার্থরক্ষা ও নিজেদের দর্শনে এদেশবাসীকে প্রভাবিত করা। তাদের শিক্ষাব্যবস্থায় একদিকে ছিল নাস্তিক্যবাদী বস্তুবাদী দর্শনের প্রভাব, অপরদিকে ছিল খৃস্টধর্ম ও বাইবেল শিক্ষালাভ বাধ্যতামূলক। এদিকে ভারতবর্ষে ইসলাম ও মুসলমানদের অস্তিত্ব আশংঙ্কাময় হয়ে পড়েছে। তারা ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি হারিয়ে ফেলেছে। তাদের শিক্ষাব্যবস্থা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বস্তুবাদী ও খৃস্টবাদী শিক্ষাব্যবস্থা বিস্তার লাভ করছে। জীবিকার তাগিদে মুসলিম সন্তানগণ এসব শিক্ষা গ্রহণ করে ঈমান হারাচ্ছে। সরকারী খরচে খৃস্টান মিশনারী ব্যাপক তৎপরতা চালাচ্ছে। ভারতবাসী মুসলমানদেরও জাতীয় সমস্যা তিনটির স্থলে চারটিতে পরিণত হয়েছে। এহেন কঠিন পরিস্থিতি ইসলাম, দেশ ও মুসলিমদের স্বার্থে শাহ ওয়ালী উল্লাহ রহ.-এর অনুসারী উম্মাহর চিন্তাশীল হকপন্থী উলামায়ে কেরাম দু’টি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। এক ইংরেজী শিক্ষার সাথে বয়কট। দুই কওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা।
ইংরেজি শিক্ষার সাথে বয়কট: ভাষা আল্লাহর সৃষ্টি। ভাষা বিদ্বেষ জাহেলিয়্যাতের অংশ। ভাষার ভিন্নতা স্রষ্টার নিদর্শন। ইরশাদ হচ্ছে: “আসমান যমীন সৃষ্টি এবং তোমাদের ভাষা ও বর্ণের ভিন্নতা আল্লাহর নিদর্শনসমূহ থেকে একটি নিদর্শন। (সূরা লোকমান: ২২) অতএব ভাষা হিসেবে ইংরেজির সাথে হকপন্থী উলামায়ে কিরামের বিরোধ থাকতে পারে না। তাহলে কেনো তাঁরা ইংরেজি শিক্ষার বিরোধী ছিলেন? এ প্রসঙ্গে শায়খুল হিন্দ রহ. বলেন, আপনাদের মধ্যে যেসব চিন্তাশীল ও সচেতন ব্যক্তি রয়েছেন তারা অবশ্যই জানেন যে, আমার বুযুর্গ ও মুরব্বীগণ কখনও ভিনদেশীয় ভাষা শিক্ষা অথবা ভিনদেশীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান অর্জনের উপর কুফরীর ফতোয়া প্রদান করেননি। অবশ্য তাঁরা এতটুকু বলেছিলেন যে, ইংরেজি ভাষা শিক্ষার সর্বশেষ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে মানুষ খৃস্টবাদের কালচারে প্রভাবিত হয়ে পড়বে, অথবা নাস্তিকতামূলক ঔদ্ধত্যে স্বধর্ম ও স্বধর্মের অনুসারীদেরকে বিদ্রƒপবাণে জর্জরিত করবে কিংবা স্বৈরাচারী সরকারের পদলেহন করতে থাকবে। একজন মুসলমানের জন্য এধরণের কুশিক্ষা অর্জনের চেয়ে অজ্ঞ থাকা অনেক ভালো। উপরিউক্ত বক্তব্য থেকে উলামায়ে কেরামের ইংরেজি শিক্ষার বিরোধিতার কারণ খুঁজে পাওয়া গেল। বিষমিশ্রিত মধু কোনো বিবেকবান গ্রহণ করবে কি? উলামায়ে কেরাম প্রগতি বিরোধী নন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল এদেশবাসী যেন ইংরেজদের দাসে পরিণত না হয়, সর্বদিক থেকে তারা স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকে, বিশেষত মুসলমানদের দ্বীন ও ঈমান যেন হেফাযতে থাকে। উলামায়ে কিরামের পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হলে আজ আমরা জাতীয়ভাবে বিধর্মীদের গোলামে পরিণত হতাম না। ১৯৪৭ সালে আমরা এদেশ থেকে ইংরেজদের বিতাড়ণ করেছি সত্য। কিন্তু প্রকৃত অর্থে স্বাধীনতা অর্জন করিনি। তাদের শিক্ষানীতি প্রসূত অনুকরণপ্রিয় দাসরা এদেশের হর্তাকর্তা হয়ে জাতির জন্য অভিশাপে পরিণত হয়েছে। আমরা এখনো পারি নিজেদের শিক্ষাব্যবস্থা নাস্তিকতা, ধর্মবিদ্বেষী ও অনৈতিকতামুক্ত করতে। পারি ধর্মীয় শিক্ষা সর্বস্তরে বাধ্যতামূলক করতে।
কাওমী মাদরাসা প্রতিষ্ঠা: মহান প্রভুর একমাত্র মনোনীত ধর্ম ইসলাম। এর হিফাযত স্বয়ং আল্লাহ করেন। তাঁর চিরন্তন নীতি এই যে, স্বীয় দ্বীনের হিফাযতের জন্য তিনি এমন মোবারক জামাত পয়দা করে দেন যাঁরা চোখের তপ্ত অশ্রু, দেহের সিক্ত ঘাম এবং বুকের তাজা রক্তের বিনিময়ে দ্বীনের পতাকা উড্ডীন রাখেন। ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিপ্লবের পর হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কী রহ. ও শাহ আব্দুল গনী মুজাদ্দেদী রহ. মক্কা মুকাররমায় হিজরত করেন। উপমহাদেশে ইসলামের হিফাযতের জন্য বায়তুল্লায় তাঁরা অনবরত অশ্রুর নযরানা পেশ করতে থাকেন। এদিকে শামেলীর প্রধান সেনাপতি কাসেম নানুতবী রহ.-এর অন্তরে ইলহাম হয় এক মহান পরিকল্পনা। বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে তিনি এ বিষয়ে মাশোয়ারা করতে থাকেন। তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সর্বপ্রথম সাড়া দেওয়ার সৌভাগ্য লাভ করেন দেওবন্দের হাজী আবিদ হোসাইন রহ.। তাঁদের যৌথ প্রচেষ্টায় অবশেষে আসে সেই শুভদিন; যার প্রতীক্ষায় প্রহর গুনছিলেন শত-শত ওলী বুযুর্গ, সেই শুভদিন যা ইতিহাসে জ্বলজ্বল করতে থাকবে চিরদিন। ১৮৬৬ সালের ৩০ শে মে বুধবার ছাত্তা মসজিদের বারান্দায় একটি ডালিম গাছের নিচে মোল্লা মাহমূদ সাহেব এবং প্রথম ছাত্র মাহমূদ হাসান (পরবর্তীতে শায়খুল হিন্দ) এর মাধ্যমে দারুল উলূমের প্রথম সবক উদ্বোধন হয়।
প্রিয় পাঠক! এই সেই দারুল উলূম দেওবন্দ, যা সমস্ত কওমী মাদরাসার জননী। সেই দেওবন্দ মাদরাসা, যার নামে হক্কানী উলামায়ে কেরাম পরিচিতি লাভ করেন উলামায়ে দেওবন্দ নামে এবং পরবর্তীকালীন তাদের সর্বপ্রকার আন্দোলনের নাম হয় দেওবন্দ আন্দোলন। এই সেই মাদরাসা যা রসুলুল্লাহ সা.-এর নির্দেশিত স্থানে স্থাপিত হয়। চারটি মহান লক্ষ্য সামনে রেখে আটটি মূলনীতির উপর স্থাপিত হয় দারুল উলূম দেওবন্দ। চারটি লক্ষ্য হল-১. তাওহীদের বিশুদ্ধ আকীদা সংরক্ষণ ২. রসূলুল্লাহ সা.-এর সুন্নতের অনুসরণ ৩. তাআল্লুক মাআল্লাহ ৪. ইলায়ে কালিমাতিল্লাহ। কে জানে এক উস্তাদ ও এক শাগরিদ দিয়ে শুরু হওয়া এ প্রতিষ্ঠান যুগ-যুগ ধরে ইলমে দ্বীনের প্রতিটি শাখায় খিদমতের এমন সুউচ্চ দৃষ্টান্ত স্থাপন করবে, যা ইতিহাসে বিরল! এখানে জন্ম নিয়েছেন উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের রাহনুমা শায়খুল হিন্দ মাহমূদ হাসান রহ., উবায়দুল্লাহ সিন্ধী রহ., হোসাইন আহমদ মাদানী রহ.। এছাড়া এ মাদরাসার কৃতি সন্তানদের মধ্যে রয়েছেন ইলমে তাসাওউফের যুগশ্রেষ্ঠ রাহবর আশরাফ আলী থানবী রহ., তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইলিয়াস রহ.। বিশিষ্ট দার্শনিক কারী তৈয়ব রহ., বিখ্যাত মুহাদ্দিস আনওয়ার শাহ কাশ্মিরী রহ.। বিশ্ববরেণ্য মুফতি কিফয়াতুল্লাহ দেহলবী রহ., শায়খুত তাফসীর ইদরীস কান্ধলবী রহ., মুফাক্কিরে ইসলাম আল্লামা আবুল হাসান আলী নদবী রহ., ইলাউস সুনান রচয়িতা যাফর আহমদ উসমানী রহ. মুফতী শফী রহ. মোহাম্মদুল্লাহ হাফেজ্জী হুযুর রহ. শামছুল হক ফরিদপুরী রহ. আল্লামা তকী উসমানী দা. বা. প্রমুখ এ মাদরাসারই কৃতিসন্তান। বাংলাদেশে দারুল উলুম দেওবন্দের অদর্শ উদ্দেশ্য নিসাব ও শিক্ষা ব্যবস্থার অনুসরণে স্থাপিত সর্বপ্রথম কওমী মাদরাসা হলো দারুল উলূম মুঈনুল ইসলাম হাটহাজারী। ১৯০১ সালে চারজন মহান আলিম ও বুযুর্গের যৌথ প্রচেষ্টায় এ মাদরাসা স্থাপিত হয়। তারপর থেকে বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে ক্রমান্বয়ে হাজার-হাজার মাদরাসা স্থাপিত হয়। তাই হাটহাজারী মাদরাসাকে বলা হয় বাংলাদেশের উম্মুল মাদারিস তথা কওমী মাদরাসাগুলির মূলকেন্দ্র। বললে অত্যুক্তি হবে না, আমাদের সমাজে এখনও দ্বীনের যতটুকু অস্তিত্ব রয়েছে, তা এই কওমী মাদরাসাগুলির অবদান। সর্বশেষ মুসলিম কওম বা সমাজের কাছে আকুল আবেদন, তারা যেনো এই প্রতিষ্ঠানগুলি হিফাজতের জন্য সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন, এর সার্বিক সমস্যা সমাধান ও উন্নয়নের ফিকির করেন এবং বাতিল পন্থীদের অপপ্রচারে বিভ্রান্ত না হন।
লেখক: শিক্ষক, হাটহাজারী মাদরাসা ও বহু গ্রন্থপ্রণেতা।