মুহিউদ্দীন কাসেমী:
কিছুদিন আগে কী এক কাজে যেন ঢাকায় গেলাম। এশার সময় ট্রেনে ফিরলাম। স্টেশনে নেমে কুরআন তেলাওয়াত শুনে চমকে উঠলাম। কোত্থেকে তেলাওয়াতের আওয়াজ আসছে?! পরে খেয়াল করলাম, গাজীপুর কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে এশার জামাত হচ্ছে। মসজিদ বেশ দূরে। উচ্চৈঃস্বরে মাইক ছেড়ে নামায পড়াচ্ছে। উপরন্তু আমাদের দেশে মাহফিলগুলোতে বিকট আওয়াজে মাইক ব্যবহার করা হয়। অনেকের কষ্ট হয়। বিশেষত যারা ওয়াজ শুনতে আসেনি তাদেরকে ওয়াজ শুনানোর কী দরকার? এ বিষয়ে একটি তাহকীকী আলোচনা পেশ করলাম। ভিন্নমত থাকলে জানাবেন। উপকৃত হবো।
কোথাও ওয়াজের মাহফিল করতে চাইলে যারা ওয়াজ শুনতে আসবে তাদেরই ওয়াজ শুনানো কর্তব্য। ওয়াজের মাহফিলের বাইরে মাইক ব্যবহার করার কোনো প্রয়োজন নেই। তাতে অপব্যয় হওয়ার সমূহ আশঙ্কা রয়েছে। এর চেয়ে ভয়ানক কথা হল, অতিরিক্ত সাউন্ড ব্যবহার করার দ্বারা ঘরে-বাড়িতে বা দোকানপাটে অবস্থারত মানুষের কষ্ট হতে পারে। তাদের ওপর তো ওয়াজ শোনা ফরজ/ওয়াজিব নয়। তাদের মাঝে অনেকে অসুস্থ থাকতে পারে। আবার অনেকে বিভিন্ন কাজে ব্যস্ত রয়েছে; তারাও ওয়াজ শুনতে আগ্রহী না। তাদের কষ্ট হবে। অথচ ইসলামের পরিষ্কার নির্দেশ হল, রাসুলে কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন :
مَنْ سَلِمَ الْمُسْلِمُونَ مِنْ لِسَانِهِ وَيَدِهِ
অর্থ : যার মুখ ও হাতের অনিষ্ট থেকে মুসলমানগণ নিরাপদ থাকে সেই প্রকৃত মুসলিম। (সহিহ বুখারি, হাদিস নং- ১১)
কাউকে কোনোরূপ কষ্ট দেওয়া যাবে না। শুধু মুসলিম না, অমুসলিমকেও অযথা কোনো কষ্ট দেওয়া যাবে না। অমুসলিম কেন, কোনো জীব-জন্তুকেও কারণ ছাড়া কষ্ট দেওয়া নিষেধ।
ওমর রা. এর যুগের কথা। হযরত আয়েশা রা. এর ঘরের সামনে এক লোক উচ্চৈঃস্বরে ওয়াজ করত। তখন তো মাইক ছিল না, তবুও ওই লোকের আওয়াজ বেশ উঁচু ছিল। ফলে আয়েশা রা. এবং আশপাশের মানুষের ভীষণ কষ্ট হতো। আয়েশা রা. খলিফাতুল মুসলিমিন ওমরকে অবহিত করেন। তিনি ওয়ায়েজকে ওয়াজ করতে নিষেধ করে দেন। কিছুদিন পর সে আবার এভাবে ওয়াজ শুরু করল। ওমর রা. আবার জানতে পেরে তাকে শাস্তি দেন। (আখবারুল মদীনা : খ. ১, পৃ. ১৫)
এখানে আয়েশা রা. ইসলামী সমাজের শিষ্টাচার, রীতিনীতি, কালচার, ভদ্রতা এবং ওয়াজ-নসিহত করার আদব শিক্ষা দেওয়ার জন্যই এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। দীনের দাওয়াতের সম্মানজনক পদ্ধতি প্রতিষ্ঠিত করতেই তিনি ওমরের কাছে অভিযোগ দায়ের করেন। তাই তো একটি হাদিসে এসেছে হযরত আয়েশা রা. মদীনার এক ওয়ায়েজকে ওয়াজের আদব বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন :
‘নিজের আওয়াজকে তাদের পর্যন্ত সীমিত রাখো যারা তোমার মজলিসে উপস্থিত। সেসময় পর্যন্ত কথা বলো যখন মানুষজনের দৃষ্টি তোমার দিকে থাকে, আগ্রহভরে কথা শুনে; বিরক্ত হওয়ার পূর্বপর্যন্ত…। (মাজমাউয যাওয়ায়েদ : খ. ১, পৃ. ১৯১)
প্রখ্যাত তাবেয়ি আতা ইবনে আবী রাবাহ রহ. বলেন : আলেমের উচিত নিজের আওয়াজ মজলিস পর্যন্তই সীমিত রাখা। (আদাবুল ইমলা ওয়াল ইসতিমলা : পৃ. ৫)
ওয়াজ-নসিহত ও দাওয়াতের এ আদব রাসূল সা. এর আমল-আখলাক ও জীবনপদ্ধতি হতে গৃহীত। এ শিষ্টাচারই তিনি গ্রহণ করেছিলেন। প্রসিদ্ধ ঘটনা। তিনি এক রাতে আবুবকর রা. এবং ওমর রা. এর বাড়ি যান। তাহাজ্জুদের নামাযে ওমর রা. উচ্চৈঃস্বরে তেলাওয়াত করছিলেন। তাঁকে নির্দেশ দিলেন, আরেকটু আস্তে পড়ো। তদ্রƒপ রাসূল সা. তাহাজ্জুদের জন্য শেষরাতে জাগ্রত হওয়ার সময় খুব সতর্কতার সাথে সজাগ হতেন, যেন স্ত্রীর কোনো কষ্ট না হয়।
এ কারণেই ফুকাহায়ে কেরামের সম্মিলিত সিদ্ধান্ত হল, তাহাজ্জুদের নামাযে উঁচু আওয়াজে তেলাওয়াত করা নাজায়েয– যদি মানুষের কষ্ট হয়। (খুলাসাতুল ফাতাওয়া : খ.১, পৃ. ১০৩)
মাওলানা তাকি উসমানি সাহেবের কাছে একবার জিজ্ঞেস করা হয়, তারাবির নামাযে মসজিদের বাইরের মাইক ছেড়ে দিয়ে তেলাওয়াত করা কেমন? উত্তরে তিনি নাজায়েয বলেন। আরও বলেন, বিষয়টি নাজায়েয হওয়ার বিষয়ে কারও দ্বিমত নেই। এ বিষয়ে দৈনিক জং পত্রিকায় নীতিদীর্ঘ কলাম লেখেন তিনি। যা ‘জিকর ওয়া ফিকর’ নামক কিতাবে সংকলিত হয়েছে।
সুতরাং নামাযে ও মাহফিলে প্রয়োজনের অতিরিক্ত অর্থাৎ নামাযী ও শ্রোতাদের বাইরে মাইকের আওয়াজ পৌছানো নাজায়েয।