আকাবির-আসলাফ (৪৭)
নোমান মাহফুজ :: মহান রাব্বুল আলামীন যুগে যুগে উম্মতের জন্য এমন কিছু নেককার মনীষী প্রেরণ করেন। যারা মানুষের জন্য নিয়ে আসেন হেদায়তের আলো। পথভোলা মানুষকে দেখান জান্নাতের সঠিকপথ। জনসাধারণকে দেন সীরাতে মুস্তাকিম বা সরল সঠিক পথের সন্ধান। তারা হলেন সমাজের জন্য ইসলামের বাস্তব চিত্র তথা মুর্তপ্রতীক। এ সোনালী কাফেলার অন্যতম দিকপাল ও স্বর্ণপ্রদীপ ছিলেন সিলেটের গোলাপগঞ্জের নক্ষত্র আল্লামা আব্দুল হামিদ শায়খে বারকোটি রাহ.। পবিত্র কুরআনের ভাষায় “প্রত্যেক প্রাণীকেই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করতে হবে”। পৃথিবীর এ অমোঘ নিয়মেই তিনি আমাদের ছেড়ে পরপারে চলে গেছেন ১৪১৭ হিজরি সনে।
জন্ম : আল্লামা আব্দুল হামিদ বারকোটি রাহ. বাংলাদেশের আধ্যাত্মিক রাজধানী সিলেটের ঐতিহ্যবাহী মডেল থানা গোলাপগঞ্জের বারকোট নামক গ্রামে এক সম্ভ্রান্ত দ্বীনদার পরিবারে ১৯২৬ ঈসায়ি মোতাবেক ১৩৪৬ হিজরিতে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতার নাম জনাব জহুর আলী রাহ. (তিনি ক্বায়িদুল উলামা, শায়খুল মাশায়েখ ছদরে জমিয়ত আল্লামা আব্দুল করীম শায়খে কৌড়িয়া রাহ.’র খাস মুরীদ ছিলেন)। তাঁর দাদার নাম জনাব মুছিম মিয়া।
আরও পড়ুন- তুমি ছিলে নির্ভীক নিঃস্বার্থ মানবীয় এক খাদিম
শিক্ষাজীবন: মার্তৃভূমি বারকোটেই তার প্রাথমিক শিক্ষার সূচনা হয়। প্রথমেই জামেয়া ইসলামিয়া বারকোট মাদরাসায় তিনি শিক্ষাগ্রহণ করেন। অতঃপর ইলমে দ্বীনের বিপুল আগ্রহ নিয়ে পনের বছর বয়সে ভর্তি হন রানাপিং আরাবিয়্যাহ হুসাইনিয়া মাদরাসায়। তখন উক্ত মাদরাসায় শিক্ষাদানে নিয়োজিত ছিলেন দেশের কয়েকজন খ্যাতনামা ও পারদর্শী আলেম। তন্মধ্যে হাদীস বিশারদ আল্লামা রিয়াছত আলী শায়খে চৌঘরী রাহ. ও আল্লামা তাহির আলী শায়খে তইপুরী রাহ. ছিলেন তাদের অন্যতম। আসাতিযায়ে কেরামের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধান ও স্নেহের সুশীতল ছায়াতলে থেকে তিনি তথায় মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। এরপর উচ্চ শিক্ষা লাভের প্রবল বাসনা নিয়ে গমন করেন দেওবন্দে এবং ভর্তি হন বিশ্ব বিশ্রুত বিদ্যাপীঠ দারুল উলূমে। এখানকার স্বর্গীয় পরিবেশে ইলমে দ্বীন অর্জনে নিজেকে উৎসর্গ করে দেন। অল্প দিনের ভেতরেই হাদীস তাফসীর প্রভৃতি শাস্ত্রে অগাধ জ্ঞান লাভ করে মার্তৃভূমিতে প্রত্যাবর্তন করেন। বলা বাহুল্য, মাওলানা আপ্তাবুদ্দীন রাজাগঞ্জী দেওবন্দে তখন তার সফর সাথী ও দারুল উলূমের সহপাঠি ছিলেন।
কর্মজীবন: কর্ম জীবনে আল্লামা আব্দুল হামিদ শায়খে বারকোটি রাহ. দেশের বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হাদীস তাফসীরসহ যাবতীয় দ্বীনী শিক্ষা দান করেন। দেওবন্দ থেকে বাড়ি ফেরার পরই রানাপিং মাদরাসার প্রথম শ্রেণীর উস্তাদ হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। সেখানে অত্যন্ত দক্ষতা ও সুনামের সহিত বিভিন্ন ইসলামী শাস্ত্রের উচ্চতর ও জটিল কিতাবাদীর পাঠদান করেন। অতঃপর গোলাপগঞ্জের প্রায় সব’কটি মাদরাসা, ঢাকা মিরপুর মাদরাসা, জামিয়া ইসলামীয়া মোমেনশাহী,সুনামগঞ্জের দরগাহপুর মাদরাসাসহ বিভিন্ন মাদরাসায় ইলমে দ্বীনের উল্লেখযোগ্য খিদমাত আন্জাম দেন।
অধ্যাপনা জীবনের কৃতিত্ব ও অবদান: শায়খে বারোকোটির অধ্যাপনা জীবনে বহু ইলমপিপাসু তাঁর জ্ঞান সাগর থেকে ইলমের অমীয় সুধা পান করে নিবৃত্ত করেছেন তাদের জ্ঞানতৃষ্ণা। তাঁর ইলমী সরোবরে অবগাহন করে সিক্ত করেছেন নিজেদের হৃদয় মনকে। তাঁর কাছ থেকে দীক্ষা গ্রহণকারী অনেকেই আজ দ্বীন ও মিল্লাতের উল্লেখযোগ্য খিদমাতে নিয়োজিত আছেন।
তাঁর কয়েকজন বিশিষ্ট শাগরীদের নাম- *আল্লামা কাজী মু’তাছিম বিল্লাহ রাহ. ঢাকা, *আল্লামা আপ্তাবুদ্দীন, *আল্লামা শায়খ নুরুল হক ধরমন্ডলী, *জামেয়া দরগার মুহাদ্দীস, মাওলানা সালেহ আহমদ জকিগঞ্জী, *মাওলানা নজির আহমদ বারকোটি, *মাওলানা আব্দুস সামাদ মক্তবের হুজুর রাহ., *মাওলানা আহমদ আলী ভাদেশ্বরী, *মাওলানা মুখলিছুর রহমান নিশ্চিন্ত প্রমুখ উলামায়ে কেরাম।
চারিত্রিক গুণাবলী: তিনি ছিলেন সুন্নতে নববীর সঠিক উত্তরসুরী। তাক্বওয়া ও পরহেজগারী ছিল তার জীবনের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট। তাঁর তাক্বওয়া ও খোদাভীরুতা ছিল পরিচিত মহলে নির্দ্বিতভাবে স্বীকৃত। কুরআন শরীফ তেলাওয়াত ছিল আত্মার খোরাক। তাই অধিকাংশ সময় কুরআন শরীফ তেলাওয়াতে নিমগ্ন থাকতেন। সহজ-সরল জীবন-যাপন ছিল তাঁর জীবনের অন্যতম ভূষণ। এটাই ছিল তাঁঁর জীবনের বাস্তব চিত্র।
রাজনৈতিক জীবন: রাজনীতির ময়দানে আল্লামা আব্দুল হামীদ বারকোটি রহঃ হক্ব ও হক্কানিয়্যাতের পতাকাবাহী সংগঠন জমিয়তে উলামায়ে হিন্দ ও জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশের সাথে ওতঃপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন।
সন্তানসন্ততি: মৃত্যুকালে তিনি ৪ ছেলে, ৩ মেয়েসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন, শাগরীদ ও গুণগ্রাহী রেখে যান। ছেলেরা হলেন: *মাওলানা মাসউদ হামিদী *হাফিজ মাওলানা মনছুর হামিদী, নায়েবে নাযিমে তা’লিমাত, জামেয়া ইসলামিয়া বারকোট, গোলাপগঞ্জ *হাফিজ মাহবুব হামিদী *মাওলানা মাহফুজ আহমদ, শিক্ষক জামিয়া মাদানিয়া আঙ্গুরা মুহাম্মদপুর বিয়ানীবাজার।
শিক্ষকবৃন্দ: আল্লামা আব্দুল হামিদ বারকোটি রাহ. যে সমস্ত আসাতিযায়ে কেরামের সার্বক্ষণিক তত্ত্বাধানে ও স্নেহের সুশীতল ছায়াতলে থেকে ইলমে দ্বীন আহরণ করেছেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য কয়েকজন হলেন- *শায়খুল ইসলাম আল্লামা হুসাইন আহমদ মাদানী রাহ. *আল্লামা ইবরাহিম বলয়াবী রাহ. *আল্লামা তজম্মুল আলী লাউড়ীর হুজুর রাহ. *আল্লামা রিয়াছত আলী শায়খে চৌঘরী রাহ. *আল্লামা তাহির আলী শায়খে তইপুরী রাহ. প্রমুখ।
ওফাত: ইলমে দ্বীনের এ মহান সুর্য ১৪১৭ হিজরিতে স্বীয় মাওলার সাথে মিলিত হন। জানাযার ইমামতি করেন তার প্রিয় মুর্শিদ আল্লামা তফজ্জুল আলী শায়খে ধরমন্ডলী রাহ.।