২০১১ সালে বিবিসির রব ওয়াকার কথা বলেছিলেন ওই প্রকল্পের বিজ্ঞানী সামার মুবারকমান্দ এর সাথে যিনি ছিলেন পাকিস্তানের পরমাণু শক্তি কমিশনের পরীক্ষা সংক্রান্ত পরিচালক। জনাব মুবারকমান্দ বর্ণনা করেছেন কিভাবে পাকিস্তান প্রথমবারের পারমাণবিক পরীক্ষা চালাতে সক্ষম হলো। খবর বিবিসির।
১৯৯৮ সালের মে মাসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী ঘোষণা করেছিলেন, ১৪ বছর পর এই প্রথম ভারত একটি পারমাণবিক বোমার পরীক্ষামূলক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। পোখরান রেঞ্জে মাটির তলায় তিনটি ভিন্ন ভিন্ন ধরণের পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
সাথে সাথে সারা বিশ্বের নানা দেশ থেকে এর নিন্দা জানানো হলো। তবে সবারই নজর ছিল প্রতিবেশী পাকিস্তানের দিকে কারণ ১৯৪৭-এ স্বাধীনতা পাবার পর থেকেই এ দুটি দেশ যে কোন সময় যুদ্ধ বেধে যাবার সম্ভাবনার মধ্যে বাস করছিল। তাই সবাই দেখতে চাইছিলেন, ভারতের এই পারমাণবিক পরীক্ষার একটা জবাব দেবার জন্য যে প্রচন্ড চাপ তা পাকিস্তান কিভাবে সামলায় ।
প্রথমে অবশ্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ একটু সাবধানী নীতিই নিয়েছিলেন। তিনি বলেন, ‘আমরা দায়িত্বশীলতার সাথে পদক্ষেপ নিতে চাই। আমাদের এই বোমা তৈরির সক্ষমতা আছে কিন্তু আমরা গত ১৫ – ২০ বছরেও এর পরীক্ষা চালাই নি। ভারতের পরীক্ষার পরই আমাদেরও এ পরীক্ষা চালাতে হবে – এমন কোন তাড়াহুড়োও আমরা করছি না।’
কিন্তু পর্দার অন্তরালে পাকিস্তানের সরকারের মধ্যেই অনেকে মনে করছিলেন, তাদের অবিলম্বে একটা পাল্টা পরীক্ষা চালানো উচিত। বিশেষ করে যেহেতু এর পক্ষে ব্যাপক জনসমর্থন আছে।
সেই সময়টা ড. সামার মুবারকমান্দ ছিলেন পাকিস্তানের পরমাণু শক্তি কমিশনের একজন অন্যতম প্রধান ব্যক্তিত্ব। সে সময় কমিশনের প্রধান ছিলেন দেশের বাইরে। তাই তাকেই বলা হলো প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে।
তিনি বলছিলেন, ‘প্রথমেই প্রধানমন্ত্রী আমার কাছে জানতে চাইলেন, আমাদের এ পরীক্ষা চালানো উচিত কিনা এবং এ ব্যাপারে আমার মতামত কি । আমার কাছে ব্যাপারটা একটু অদ্ভূত লাগলো। কারণ আমি যে পদে ছিলাম তাতে আমার দেশের প্রধানমন্ত্রীকে কোন পরামর্শ দিতে পারার কথা নয়। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী সেই সৌজন্য দেখিয়েছিলেন। আমি তাকে বললাম, ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী তাদের পরীক্ষার পর যেসব কথা বলেছেন তাতে আমরা যদি নিজেরা একটা পারমাণবিক পরীক্ষা না চালাই, তাহলে এ উপমহাদেশে আমাদের স্বাধীন অবস্থান, মর্যাদা এবং প্রভাবের একটা বড় ক্ষতি হয়ে যাবে।’
কিন্তু পারমাণবিক পরীক্ষা চালালে পাকিস্তানকে অবধারিতভাবেই আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার শিকার হতে হবে। দেশের ভঙ্গুর অর্থনীতির ওপর এর প্রতিক্রিয়া হবে অত্যন্ত গুরুতর। এই পটভূমিতে পাকিস্তানের মন্ত্রিসভার প্রতিরক্ষা-সংক্রান্ত কমিটি বিষয়টি নিয়ে আলোচনার জন্য একটা সভা ডাকলেন।
ড. মুবারকমান্দ বলছিলেন, ওই সভায় যা আলোচিত হয়েছিল তা ছিল খুবই গোপনীয়। ‘আমি এর বিস্তারিত বলতে পারবো না। যেটুকু বলতে পারি, তা হলো ওই সভায় প্রায় সবারই মত ছিল এই যে আমাদের পারমাণবিক পরীক্ষা চালানো উচিত’।
ড. মুবারকমান্দ এবং তার সহযোগীরা এর পর পারমাণবিক পরীক্ষা যেখানে হবে সেখানে নানারকম সরঞ্জাম ও লোকজন পাঠাতে শুরু করলেন। এই জায়গাটি ছিল বালুচিস্তানের চাগি পর্বতমালার একটি প্রত্যন্ত এলাকায়, মাটির নিচে।
তিনি বলছিলেন, ‘আমি চাগির উদ্দেশ্যে রওনা হবার আগে প্রধানমন্ত্রী আমাকে ফোন করলেন, জানতে চাইলেন, এ পরীক্ষায় সফল হবার সম্ভাবনা কতটুকু। আমি তাকে বলেছিলাম যে যদিও আমরা আগে এটা কখনো করিনি, কিন্তু আমরা নিশ্চিত যে আমরা পারবো।’
এটা ছিল এমন একটি ব্যাপার যাতে ব্যর্থ হলে তার প্রতিক্রিয়াও হতো গুরুতর। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এ ব্যাপারে পুরোপুরি সচেতন ছিলেন। তিনি বলেছিলেন, আমরা যদি ব্যর্থ হই তাহলে আমাদের মানসম্মান থাকবে না, আমাদের প্রতিবেশী আমাদের ওপর কর্তৃত্ব করবে। কাজেই এতে সফল হওয়াটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
ব্যাপারটা এতই গোপনীয় ছিল যে ড. মুবারকমান্দ তার পরিবারেরও কাউকে বলেন নি তিনি কোথায় যাচ্ছেন।
তিনি বলেন, ‘আমি স্ত্রী-সন্তানদের বলেছিলাম, আমি করাচি যাচ্ছি। কেন যাচ্ছি, তাও বলি নি।’
ততদিনে পাকিস্তানের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্য পশ্চিমা দেশগুলো চাপ তৈরি করছিল। বড় অংকের আর্থিক সহায়তার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল। মনে করিয়ে দেয়া হয়েছিল, পরমাণু পরীক্ষা চালালে কি ধরণের নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে।
তবে পরীক্ষার জায়গাটিতে যেখানে ড. মুবারকমান্দ এবং তার সহকর্মীরা ছিলেন, তাদের উদ্বেগ ছিল অন্য ধরণের।
‘চূড়ান্ত দিন, ২৭শে মে অবস্থাটা ছিল এই রকম। আমি ঘুরে ঘুরে সব যন্ত্রপাতি, কেবল সংযোগ এবং অন্যান্য সরঞ্জাম ঠিকমতো বসানো হয়েছে কিনা তার তদারকি করছিলাম। আমি সেই টানেল আর বাংকারগুলোর ভেতর বার বার ঢুকছি আর বের হচ্ছি। মাঝে মাঝে আমার ঘরে গিয়ে একটু চা খেয়ে নিচ্ছি। আমি একবার ভাবলাম আমি এটা কি করছি? যে পরিমাণ ছুটোছুটি করেছি, তা নিশ্চয়ই ১০-১২ কিলোমিটারের কম হবে না। সন্ধ্যে নাগাদ আমার মনে হলো, এবার ব্যাপারটা আল্লাহর হাতে ছেড়ে দিই- যথেষ্ট হয়েছে। কালন পরের দিনই পরীক্ষাটা চালানো হবে। আমি একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলাম। দেখলাম, রাতের আকাশে অসংখ্য গ্রহ-উপগ্রহ দেখা যাচ্ছে। মনে হলো যেন সবাই আমরা কি করছি তার ওপর নজর রাখছে।’
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আসলেই পাকিস্তানের ওপর কড়া নজর রাখছিল। পাকিস্তান খুব শিগগীরই পরমাণু পরীক্ষা চালাতে যাচ্ছে, বুঝতে পেরে প্রেসিডেন্ট ক্লিনটন ফোন করলেন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে। তাকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন পরীক্ষা থেকে বিরত থাকতে।
কিন্তু ২৮শে মে’র ভোরের আলো ফুটতে ফুটতে শুরু হয়ে গেল পাকিস্তানের চূড়ান্ত প্রস্তুতি।
‘সেটা ছিল খুবই রোদঝলমলে একটা দিন। তা ছাড়া বাতাসও খুব একটা জোরালো ছিল না। আমরা ভেবেছিলাম, আল্লাহ না করুন যদি খারাপ কিছু হয়, তাহলে বাতাস জোরালো না হলে তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ বেশি দূর যেতে পারবে না। তবে আমরা অনেক রকমের সতর্কতামূলক ব্যবস্থা নিয়েছিলাম।
এরপর আমরা বিস্ফোরণস্থলের ২০-৩০ কিলোমিটার দূরে গিয়ে অবস্থান নিলাম। তার পর যখন নির্ধারিত মুহুর্তটা এলো – আমরা বললাম ‘চলো, কাজটা সেরে ফেলি’। আমার সহকর্মী বললো, ডক্টর, আসুন,আপনিই বোতামে চাপ দিন।
কিন্তু আমি বললাম, না আমাদের যে ইলেকট্রিক ইঞ্জিনিয়ার এই যন্ত্রটি বানিয়েছে – তাকেই আমি এ সম্মান দিতে চাই। তখন সেই ইঞ্জিনিয়ার এগিয়ে এলেন এবং বললেন, আমি কি তাহলে কাউন্টডাউন শুরু করবো?
আমি বললাম এটা একটা সাবেকি রীতি। ওসব বাদ দিন। শুধু বলুন ‘আল্লাহু আকবর’ এবং বোতামটিতে চাপ দিন।
তিনি তাই করলেন। তার পর আমরা গাড়িটি থেকে বেরিয়ে এলাম, এবং সেই পর্বতটির দিকে তাকালাম। কয়েকটা সেকেন্ড পার হয়ে গেল , কিছুই ঘটলো না। ৩২টি সেকেন্ড পার হয়ে গেল। আমি খুবই দুশ্চিন্তায় পড়ে গেলাম কেন কিছুই হচ্ছে না? অনুভব করলাম আমার হৃৎস্পন্দন খুব দ্রুত হচ্ছে। কিন্তু করার কিছুই ছিল না।’
‘যাই হোক ৩২ সেকেন্ড পর, আমরা অনুভব করলাম একটা শক্তিশালী ভূকম্পন। তখনই আমরা বুঝতে পারলাম যে কিছু একটা ঘটেছে। এরও তিন সেকেন্ড পর দেখলাম ওই কালচে-ধূসর রঙের পর্বতটার গায়ের রঙটা পাল্টে সাদা হয়ে গেল।
সেই সাদা রঙটা ছড়াতে লাগলো বাঁ দিক থেকে ডান দিকে, প্রায় ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত। পুরো পর্বতমালাটাই বরফের মতো সাদা হয়ে গেল। সে ছিল এক দেখার মতো দৃশ্য। আমরা জানতাম যে এমনটা হয়ে থাকে। ফ্রান্স পারমাণবিক পরীক্ষা চালিয়েছিল আলজেরিয়ার পার্বত্য এলাকায়, সেখানে এমন হয়েছিল।
কিন্তু সত্যিই যে এমনটা হতে পারে, তা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এ এক দারুণ দৃশ্য পরমাণুর ভেতরে যে শক্তি লুকিয়ে আছে তা বেরিয়ে এসেছে একটা পর্বত এমনভাবে সাদা হয়ে যাচ্ছে, যেন তার ওপর তুষারপাত হয়েছে। আমরা এর পর মাথা নিচু করে সেজদা দিয়ে এই সাফল্যের জন্য আল্লাহকে কৃতজ্ঞতা জানালাম।’
এর পর ইসলামাবাদে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী এই পরীক্ষা চালানোর কথা সারা বিশ্বের কাছে ঘোষণা করলেন, ‘নিরাপত্তা হুমকির ব্যাপারে নির্বিকার থাকা আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এত বড় হুমকিকে উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না। জাতীয় সুরক্ষার স্বার্থ থেকেই এই পারমাণবিক বিকল্প বেছে নেয়া হয়েছে’।
এই পারমাণবিক পরীক্ষার ব্যাপারে আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়াও হলো খুব দ্রুত। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা আরোপের কথা ঘোষণা করলেন। তবে এ জন্য ড. সামা মুবারকমান্দ-এর কোন দু:খ নেই। তিনি মনে করেন ওই পরীক্ষা দুই প্রতিবেশীর মধ্যে যুদ্ধের সম্ভাবনা ঠেকিয়ে দিয়েছে।
‘আমি মনে করি তখন উপমহাদেশে একটা বিশেষ ধরণের ভূ-রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিরাজ করছিল। আমি আমার কাজের জন্য কোন গ্লানি বোধ করি না। পারমাণবিক পরীক্ষার ফলে পাকিস্তান তার বৃহৎ প্রতিবেশীর সাথে ক্ষমতার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিল। এর ফলে দু দেশের প্রধানমন্ত্রীদের জন্য আলোচনার টেবিলে বসে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করা সম্ভব হয়েছে’।