শামসীর হারুনুর রশীদ::
চিন্তার হাওয়া-গাড়িতে উঠেছেন তিনি ফুসফুসের হাওয়া নিয়ে, চিত্তের নির্যাস নিয়ে। বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষা বিশেষ করে কওমি মাদরাসা শিক্ষার মানন্নোয়নে প্রত্যয় ও সাহস নিয়েই কলম ধরেছেন একবিংশ শতাব্দির শুরুর দিকে। চোখে মুখে তারুণ্য, টগবগে তাগড়া জোয়ান। তাঁর রোমান্টিক জীবনাবেগ যেমন আধুনিক, তেমনি জীবনকামনায় তীব্র আশ্লেষের ভাষা নির্মাণের অঙ্গীকার। জীবনের কূট-বিষ-ধুতরাবীজ গলানিতে নিয়ে সুন্দর জীবনের স্বপ্ন দেখেন তিনি। বিষাদ ও বিভ্রমের তীব্র জ্বালা হ্রদয়ের মদিরায় তুলে নিয়েই এই লেখক স্বপ্ন-মানুষ। তাঁর লেখার একটা স্থৈর্য আছে, আছে রহস্যময়তাও। আত্নবৃত্তির সঙ্গে বহিবৃত্তির সমন্বয় তাঁর সমূহ লেখাজোখা তাঁকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা ও আয়তন। দিয়েছে দীপ্রতা। অনেকটাই নির্ভৃতচারী। তাঁর কর্মের স্বীকৃতির জন্য অস্থির হয়ে জান না। তিনি তাঁর লেখার জগতে এমন এমন বিষয়ের অবতারণা করেছেন, যেখানের শুরুর আরম্ভেই সমালোচনার ঢোল পেটানো সহ্য করতে হয়! তাঁর ফুসফুসের পাটাতন কতটুকু সমালোচনা সহ্য করার?
বলছিলাম তারুণ্যের প্রিয় লেখক ও গবেষক খতিব তাজুল ইসলামের কথা।
লিখেছেন তিনি ‘হ্রদয়ে কওমি মাদরাসা’ এ যেন সৌন্দর্য ও জীবনবোধের অমৃত চিন্তার রসায়ন। গবেষণালব্ধ তাঁর এ বইটিতে কওমি শিক্ষাব্যবস্থার উপর আতশ কাচের আলো ফেলে বিচার বিশ্লেষণ করেছেন। তুলে ধরেছেন নানা অসঙ্গতি, সাথে সাথে সুপারিশ। তা আবার উচ্চ মার্গের। বইটিতে ইনিয়েবিনিয়ে এশিক্ষাব্যবস্থার প্রাপ্তি-প্রত্যাশা, সমস্যা-সম্ভাবনা, উপমা-উৎপেক্ষার সাথে তুলে ধরেছেন সফলভাবে। সহজ কথা বলতে গেলে তাঁর এ বইটিকে সংস্কার আন্দোলনের পাথেয় বলা যায় ।
শক্ত মলাটের 128 পৃষ্ঠার এ বইটিতে প্রকৃতি ও নিসর্গের সমগ্রতা-অখণ্ডতা ফুটে উঠেছে জিঙেফুলের মতো। এর সাথে যুক্ত হয়েছে বিষাদ, আধুনিক যন্ত্রণাবোধ, স্বপ্নভারাতুরতা, আত্নকেন্দ্রিক কালান্তরের পরিক্রমা, প্রতিবেশ-পৃথিবীবোধ।
একচল্লিশটি সাবহেডিং বা পরিচয়সূচক শব্দের আড়ালে মনস্তাত্ত্বিক ঔৎসুক্য এবং অন্তর্জগতের মোজাইকের সাক্ষাত পাওয়া যায় ‘হ্রদয়ে কওমি মাদরাসায়’।
বিলেতে বসবাসকারী এ মানুষটি কওমি শিক্ষাব্যবস্থার মুল্যায়নে কেন লিখেন, শুরুতে তাকে সনন্দেহের চোখে দেখি, সাংবাদিকতায় কলম ধরায় আমাকে যেমন অনেকেই সন্দেহ জ্ঞান করেন। তাকে না চেনার আগ পর্যন্ত মনে করতাম যশ-খ্যাতি লুপাট করতে হয়ত এ উদ্যোগ, কিন্তু এ বইটি রচনা করে নিজের উদ্দেশ্য জানান দিয়েছেন সফলভাবে। এবইটি হাতে আসায় তাঁর কাছাকাছি হতে চেষ্টা করি এবং একপর্যায়ে তাঁর হ্রদয় শিল্পের কাছাকাছি খুব না হলেও কিছুটা হয়ছি যে এ আমি নিশ্চিত।
খতিব তাজুল ইসলাম নানা সমীক্ষার আলোকে বুঝাতে চেয়েছেন কওমি মাদরাসা নিছক লেখাপড়ার ঘর কিংবা শুধু আধ্যাত্মিক ডিপাটমেন্টাল ষ্টোর নয়, বরং ইসলামি জীবনাদর্শের এক আন্দোলনি ত্রীমোহন। তিনি হুংকার ছুড়ে বুঝাতে চেয়েছেন এগুলো এখন মূর্দা কেন? নিশ্চয় কোন অজানা পথে গলদকরন ঢুকে গেছে এবং তা স্থায়ীত্বতা লাভ করে ফেলছে?
সুতরাং তা নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে এবং আমাকেও ভাবতে হব?
সেই বিশ্বাস থেকে নিয়েছেন গভীর নি:শ্বাস। কারণ তাঁর সামনে কাজ আর কাজ। খুব কঠিন কাজে হাত বাড়িয়েছেন তিনি। কারণ তাজদিদি কাজ, মানে? সংস্কার আন্দোলন। একদিকে তো সংখ্যাগরিষ্ঠের বুঝে আসে না, ফলে তাঁরা এটাকে যুদ্ধ ভাবে! অন্যদিকে যাঁরা এই মৌলিক জিহাদে জড়িয়েছেন, সমাজ তাঁকে একঘরে করে রাখে, প্রয়োজনে কারাগার কিংবা দেশান্তর হওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিয়েই অনগ্রসর হতে হয় এদিকে ওদিকে! যাঁর দৃষ্টান্ত মুজাদিদে আলফে আওয়াল থেকে ছানি, মধ্যেখানে আইম্মায়ে কেরামের দীর্ঘ সারি।
যা-হোক বিলাতের ব্যস্ত জীবনে থেকেও সুন্দরের নিক্ষণ-নিস্বনে তুমুল ও প্রগাঢ় একটি মদির জগৎ বসবাস করে লেখক তাজুলের মধ্যে । অমেয় অনুতাপ খতিবের লেখার পরাণশক্তি। তীব্র দহনজ্বালা এবং তীব্র সংক্ষোভও তখন রোমান্টিক আশ্লেষে প্রাণময় হয়ে উঠে। এক ধরনের আত্নমগ্নতা লেখককে ঘিরে রাখে। এই আত্নমগ্নতার কারণে খুচরা অনুভূতিসমূহ তাঁর লিখনির মূলভূমি স্পর্শ করতে সক্ষম হয় । ‘হ্রদয়ে কওমি মাদরাসা’য় ভাষার অবগুন্ঠনবতী সৌন্দর্যকে চিত্রকল্প, রূপক, উপমা ও উৎপেক্ষার মাধ্যমে ইসলামি শিক্ষা তথা কওমি শিক্ষাব্যবস্থাকে নূরেমদিনার সুন্দরের ভেতর দিয়ে প্রত্যক্ষ করেন তিনি। মাদরাসা শিক্ষার উন্নয়নে এ গ্রন্থটি এক অতুলনীয় ঐশ্বর্য । গ্রন্থটির প্রচ্ছদ, মুদ্রণ, বাধাই দৃষ্টিনন্দন । প্রথম প্রকাশ অমর একুশে বইমেলা 2017। প্রকাশক ফজলু মিয়া, কমাশিসা পাবলিকেশন্স সিলেট, বাংলাদেশ।
লেখক : মুহাদ্দিস ও প্রাবন্ধিক
12/ 05/ 2017