রশীদ জামীল:
উনিশশ’ একাত্তরের পর বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের নামে হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মীর জীবন নষ্ট করেছিলেন মঈনুদ্দিন খান বাদলরা। বঙ্গবন্ধুকে ‘স্বৈরাচারি’ আখ্যা দিয়ে স্বৈরশাসন বিরোধী আন্দোলনের নামে গণবাহিনী সৃষ্টি করে অসংখ্য রাজনৈতিক কর্মীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়েছিলেন সেদিন। প্রতি-বিপ্লবের স্বপ্ন দেখিয়ে হাজার হাজার মেধাবী যুবককে হত্যা করা হয়েছিল তাদের নেতৃত্বে। অথচ আজ তাঁরা বড় বড় কথা বলেন। সারা জীবন সমাজতন্ত্রের পূজা করে এখন গণতন্ত্রের তসবিহ জপেন! বাংলাদেশের রাজনীতিতে মুষ্ঠিমেয় কিছুলোক যারা ডবল স্ট্যান্ডার্ড রাজনীতির ফায়দা হাসিল করতে সক্ষম হয়েছেন, তার মধ্যে অন্যতম এক সুবিধাভোগি হলেন এই মাইনুদ্দিন খান বাদল।
♦️♦️কথা হচ্ছিলো ‘কওমি সনদের স্বীকৃতির যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে। ইচ্ছা ছিল আজ কথা বলব যোগ্যতার মানদণ্ড নিয়ে। যোগ্যতা কাকে বলে, যোগ্যতার ভ্যালুয়েবিলিটি কী, যোগ্যতার যথাযোগ্যতা অনুধাবনে কেমন যোগ্যতার দরকার হয়, ঠিক করেছিলাম আজ সেগুলো নিয়ে কথা বলব। কিন্তু মাইনউদ্দিন খান বাদল তালগোল পাকিয়ে দিলেন। ভদ্রলোক বাংলাদেশের আলেম-উলামা এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সরাসরি ‘কুকুরের বাচ্চা’ বলে সম্বোধন করে বসলেন! সঙ্গতকারণেই আজ একটু মাইনুদ্দিন বাদলের আমলনামা অপেন করা যাক।
♦️♦️যারা হাইকোর্টের সামনে থেকে মুর্তি সরাতে বলেছেন, তাদের সবাইকে বাদল বলেছেন কুকুরের বাচ্চা! মূর্তি সরানোর পক্ষে কথা বললে সেটা যদি ‘কুকুরের বাচ্চা’র কাজ হয়, তাহলে একই কথা তো প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন। সুতরাং বাদল শুধু আহমদ শফিকে কুকুরের বাচ্চা বলেননি, বাদল শুধু মাওলানা ফরিদ উদ্দিন মাসউদকেই কুকুরের বাচ্চা বলেননি, বাদল শুধু বাংলাদেশের আলেম-উলামাকেই কুকুরের বাচ্চা বলেননি, কুকুরের বাচ্চা তিনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেও বলেছেন। কারণ, হাইকোর্টের সামনা থেকে মূর্তি সরানোর কথা প্রধানমন্ত্রীও বলেছেন। আর রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রচারিত বলে বাদলও এটা জানেন। সুতরাং তিনি জেনেবুঝেই প্রধানমন্ত্রীকে কুকুরের বাচ্চা বলার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন।
বাঁনরকে গাছে চড়তে শেখালে গাছ থেকে নামানো মুশকিল হয়ে যায়। বাদলরা ছিলেন পল্টন মোড়ে হ্যান্ড মাইক নিয়ে গলাবাজি করা লিডার। শেখ হাসিনা তাদেরকে দয়া করে তাঁর নৌকায় তুলে সংসদে নিয়ে গিয়েছিলেন। এতদিন পরে বাদল সাহেব তাঁর মায়ের ভাষায় প্রধানমন্ত্রীকে কৃতজ্ঞতা জানালেন। এখন দেখবার বিষয় প্রধানমন্ত্রী বাদলের এই কৃতজ্ঞতাবার্তা কীভাবে গ্রহণ করেন।
[ জানুয়ারি দু’হাজার পনেরোতে মাইনুদ্দিন খান বাদলের আমলনামা নিয়ে কিছু কথা বলেছিলাম। অনেকের মনে থাকবার কথা। লেখার কিছু অংশ আজ আবার সামনে নিয়ে আসি। বাদলচরিত জানার জন্য কথাগুলো সামনে আনা দরকার ]♦️♦️ স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে বাদলরা যে তাণ্ডব চালিয়েছিলেন, জাতি সেটা ভুলে যায়নি। আজকের বাংলাদেশে তাঁরা আবার সেই চিত্র ফিরিয়ে আনতে চাইছেন। তখনকার সেই জোর আজ আর নেই বলে চেষ্টা করছেন যে কোনো উপায়ে বাংলাদেশে একটা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগাতে। ৭২ থেকে ৭৫ পর্যন্ত রক্ত খেয়ে রক্ত পিপাসা মিটেনি তাদের। কবে মিটবে কেউ জানে না। দোজখে গিয়ে মিটবে কিনা-বলতে পারছি না। দোজখে তাঁকে আমি পাঠাচ্ছি না। তিনি নিজেই কনফার্ম করেছেন যে, তিনি দোজখে যাচ্ছেন। ৫ নভেম্বর ২০১৩ জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন- “ওই সমস্ত হুজুরদের কাছে আমি বলতে চাই, আপনি যেমন খোদার কাছে একলা দাঁড়াবেন, আমিও একলা দাঁড়াবো। আমি ইনশাল্লাহ বিশ্বাস থেকে বলছি, আমার আগেই আপনারা দোজখে যাবেন”। তার মানে তিনি যে দোজখে যাচ্ছেন, সে ব্যাপারে তাঁর নিজেরই কোনো সন্দেহ নাই। সংশয়টা শুধু আগু-পিছু নিয়ে।
♦️♦️ জাসদের কার্যকরি সভাপতি মইনুদ্দিন খান বাদল একজন বেয়াদব। তিনি যে বেয়াদব, এ ব্যাপারে কারো কোনো সন্দেহ থাকবার দরকার নাই, কারণ, তিনি আত্মস্বীকৃত বেয়াদব। তিনি নিজেই জানিয়েছেন তিনি যে একটা বেয়াদব। তিনি তাঁর বেয়াদবির সরল স্বীকারুক্তিটা জাতীয় সংসদে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সামনেই দিয়েছিলেন। ৩ জুলাই ২০১৪ জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধুকে ‘পিতা’ সম্বোধন করে বলেছিলেন, “পিতার সঙ্গে বেয়াদবি করে যদি কোনো ভুল করে থাকি, তবে সেই ভুলের কাফফারা দিচ্ছি এখন”।
অতএব, তিনি যে একজন খাটি বেয়াদব, এটা সুষ্পষ্ট। খাটি বললাম, কারণ, যে বেয়াদব তার বাবার সাথে বেয়াদবি করতে পারে, সে কতবড় বেয়াদব! প্রধানমন্ত্রী তার সংসদে বেয়াদব পুষবেন কিনা, দেখবার বিষয়।
♦️♦️১৯ আগস্ট ২০১৩ ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি মিলনায়তনে সংখ্যালঘুদের সম্পত্তি উদ্ধারের বিষয়ে এক মত বিনিময় সভায় বলেছিলেন,
“সারা দেশের অর্পিত সম্পদ দখলকারীরাই রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারক”
একটু লক্ষ্য করলেই বোঝা যায় কথাটি তিনি কার উদ্দেশ্যে বলতে পারেন। ২০১৩ তে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ‘নীতি নির্ধারনি’ ক্ষমতায় কারা ছিলেন? সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণি সর্বোচ্চ ফোরাম যদি জাতীয় সংসদ হয়ে থাকে, তাহলে সংসদের সাড়ে তিনশ সদস্যকেই তিনি সেদিন কোন স্পর্দায় ‘অর্পিত সম্পদ দখলদার’ হিশেবে অভিযুক্ত করলেন!
আমরা সেদিন বিস্মিত হয়ে লক্ষ্য করেছিলাম, জাতীয় সংসদে কেউ একজনও প্রশ্নটি ওঠালেন না! মঈনুদ্দিন বাদল সবাইকে পাইকারি-ভাবেই ‘ভূমিখেকো’ সাভ্যস্ত করে ছাড়লেন। কোনো রকমের সংসদীয় তোপের মুখে আমরা তাঁকে পড়তে দেখলাম না। বাদল সাহেব থেকে গেলেন জবাবদিহিতার উর্ধে। বাদলরা এভাবেই থেকে যান ধরা-ছোঁয়ার বাইরে!
♦️♦️আওয়ামীলীগের নৌকায় না উঠলে যে লোকের জীবনেও সংসদে যাওয়ার মুরোদ ছিলো না। নিজের চেহারা নিয়ে ইলেকশন করলে ইউনিয়ন পরিষদের মেম্বার হবার ক্ষমতাও নেই যার, সেই মঈনুদ্দিন বাদলের আসল চেহারাটা কেমন, সেটা জানবার জন্য চলুন একবার চট্টগ্রাম থেকে আসি।
১৯ আগস্ট ২০১২, সংখ্যালঘুদের হয়ে গলার রগ ফুলিয়ে ঢাকায় মায়াকান্না করলেন মঈনুদ্দিন বাদল। তাঁর ঠিক ছয় মাস পরের আরেকটি ১৯ তারিখ অর্থাৎ ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৩ চট্টগ্রামে তারই নিজ নির্বাচনী এলাকায় (বোয়ালখালী-চান্দগাঁও) উন্মোচিত হয়ে গেল তার আসল চেহারা। বাংলাদেশ বৌদ্ধ সমিতির চেয়ারম্যান অজিৎ রঞ্জন বড়ুয়া শত শত বছরের পুরোনো ‘আর্য্য ভাবনা কুটির’ বৌদ্ধমন্দিরের শ্মশানের জায়গা এমপি মাঈনুদ্দিন খান বাদল দখল করবার প্রকাশ্য পায়তারা চালিয়েছেন বলে সংবাদ সম্মেলন ডেকে অভিযোগ জানালেন। একেই মনেহয় বলে, চুরের মায়ের বড় গলা।
♦️♦️মইনুদ্দিন বাদল বরাবরই যত বড় মুখ নয় তারচে’ও বড় কথা বলে অভ্যস্ত। কেউ কিছু বলে না বলে ধীরে ধীরে তাদের জিহ্বাটা অনেক লম্বা হয়ে গেছে। ৫ নভেম্বর ২০১৩ জাতীয় সংসদে দাঁড়িয়ে খালেদা জিয়ার ব্যাপারে শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্য করে বলেছিলেন, “এই কুলাঙ্গার নেত্রীকে কেন বারবার ছাড় দেয়া হচ্ছে”!
এটা তো তাও মোটামুটি একটা সীমারেখায় ছিল। কিন্তু ৩০ মার্চ ২০১৪ জাতীয় সংসদে বাদল যে ভাষায় কথা বলছিলেন, তাতে মনে হয়নি কোনো নারীর গর্ভে জন্ম নিয়েছেন তিনি! মনে হয়নি লোকটি মানসিকভাবে সুস্থ। খালেদা জিয়ার ‘গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে গিনেস বুকে নাম ওঠানো’র ঘোষণাকে ব্যঙ্গ করে তিনি বললেন, “বেগম খালেদা জিয়া রেকর্ড ভেঙে গিনেস বুকে নাম ওঠাতে পারেন। আর সেটা হলো নারীরা যে নিষিদ্ধ কাজ করেন, সেই রেকর্ড ভেঙে”। একটা মানুষের মনুষ্যত্ব কতটা পশুত্বের পর্যায়ে চলে গেলে একজন নারীকে জড়িয়ে, তাও জাতীয় সংসদের মত স্থানে দাঁড়িয়ে, এমন জঘন্য ভাষায় কথা বলতে পারে?
♦️♦️ মাইনুদ্দিন বাদলরা নিজেদের যত যাই ভাবুন, জাতি তাঁদের কখনো দু’আনারও মূল্য দেয়নি। শেখ হাসিনার পায়ের ধুলো নিয়ে এমপি হওয়া এই বাদলরা ভুলে গেছেন নিজেদের কোমরের জোর কত! বাদলরা বাংলাদেশের রাজনীতিতে মোটেও প্রভাব বিস্তারের ক্ষমতা রাখা কেউ না। তারপরেও তাঁরা বড় বড় কথা বলেন। সময় তাদের বলবার সময় করে দিয়েছে। মনে রাখা দরকার ছিল সময় সব সময় সমান থাকে না। তাই সময় থাকতেই মুখে লাগাম দিয়ে দিলেই ভাল হত।