মুসা আল হাফিজ কবি, দার্শনিক ও গবেষক
স্বীকৃতি দিয়ে শুরু করি। প্রচণ্ড ভিন্নমত ছিলো আলেমদের মধ্যে। যথেষ্ট দ্বিধা,শংকা ও দোদুল্যমানতা সত্তেও শেষ অবধি উলামার ঐক্য হয়েছে এবং প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার মধ্য দিয়ে সম্মানজনকভাবে একটি প্রেক্ষাপট তৈরি হয়েছে। যৌক্তিক কিছু প্রশ্নে অনেকেই বিদ্যমান বাস্তবতায় স্বীকৃতি কী পরিণতি ডেকে আনে, তা নিয়ে ভীত ছিলেন, আছেন। সেই ভীতি নিজেও অনুভব করছি। আর অনুভব করছি বলেই কিছু কথা নিবেদন করছি।
এক. জমহুর উলামার ঐক্য নিশ্চিত হবার পরে এ বিষয়ে ভিন্নমতের ময়দানী প্রচার থেকে বিরত থাকাতেই কল্যাণ। সকলেই বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে যেন ভাবি।
দুই. স্বীকৃতির ঘোষণা মানেই স্বীকৃতি হয়ে যাওয়া নয়। অতীতে প্রজ্ঞাপন জারির পরেও তা আটকে গেছে। এ নিয়ে অতীশয় আহ্লাদ করার সুযোগ নেই। অনেক পথ বাকি রয়ে গেছে। সে পথ পাড়ি দিতে হবে মিলিত প্রচেষ্টায়।
তিন. স্বীকৃতি আমাদের কোনো সাফল্য নয়,লক্ষ্যও নয়। সাফল্য হচ্ছে, এর সুফলকে ইতিবাচকভাবে দ্বীনের কাজে লাগাতে পারা। লক্ষ্য হচ্ছে, এলায়ে কালিমাতুল্লাহ।
চার. এ পথে স্বীকৃতির অভিঘাত সমূহ হয়ে উঠতে পারে প্রবল প্রতিবন্ধক। এর মোকাবেলা করতে হবে প্রতি দিন,প্রতি রাত। স্বীকৃতি আসা মানেই এ লড়াই শুরু করতেই হবে। এতে হারলে সব কিছু হারাবো।
পাঁচ. তায়াল্লুক মায়াল হুকামা প্রবলভাবে সামনে হাজির হবে। স্বভাবগতভাবে সে চাইবে আধিপত্য। সেখানে তায়াল্লুক মায়াল্লাহকে প্রাধান্য দিয়ে হুকামার চাহিদাকে তার অধিনে আনতে হবে।বজায় রাখতে হবে তাকওয়াভিত্তিক ভারসাম্য।
ছয়. ছাত্রদের মধ্যে আধুনিক সাজার প্রবণতা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে চাইবে। কিন্তু আমাদের আধুনিকতা হচ্ছে সুন্নাতে রাসূল (সা,) সেই আধুনিকতাকে আরো প্রবলভাবে নিশ্চিত করতে হবে।
সাত. এক শ্রেনীর তরুণ আলেমের মধ্যে অতিমাত্রায় ছাড় দেয়ার প্রবণতা বাড়বে। জাহিলিয়াতের চৈন্তিক ও সাংস্কৃতিক উপাদানগুলোকে সহনীয়ভাবে দেখা ও দেখানো চলবে। একে মোকাবেলা করতে হবে শক্ত হাতে।
আট. আমাদের মধ্যে বিরোধ আছে, থাকবেই।সেই বিরোধের কোনো পর্যায়ে আমাদের কেউ সরকারের দ্বারস্থ হবে এবং তার মাত্রা বাড়তে থাকবে। ফলে তাদের কর্তৃত্বের হাতে আপনা আপনি আবদ্ধ হবো। সে পরিস্থিতি যেন ডেকে না আনে আমাদের কেউ।
নয়. সিলেবাসের প্রশ্নটি খুবই জরুরী। সিলেবাসকে সত্যি সত্যিই নবরুপায়ন করতে হবে। মৌলিক বিষয়সমূহ অক্ষুন্ন রেখে জীবন ও জগতের অপরাপর জ্ঞানকে যথাস্থান দিতে হবে।আজ যদি তা না করা হয়,কাল সেটা জোর করে চাপিয়ে দেয়া হবে। নিশ্চয় এ বিষয়ে সচেতন রয়েছেন দায়িত্বশীলগণ।
দশ. কারিকুলামে আধুনিকায়ন ও অান্তর্জাতিক মান এবং পরিচালনা ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা ও শৃঙ্খলা নিশ্চিত করতেই হবে। ঘরওয়ালা জানে,ঘরের কোন অংশ ভাঙ্গা। সময় নেই,মেরামত অপরিহার্য। ঝুঁকি বেড়েছে,দায়িত্ব না বাড়িয়ে উপায় নেই।
এগারো. সরকার স্বীকৃতি দিচ্ছে, তার স্বার্থের দিক পরিষ্কার।আমরা নিচ্ছি,আমাদের অধিকারের দিক পরিষ্কার। সরকার সে অধিকার প্রদান করে রাষ্ট্রিয় দায়িত্ব আদায় করবেন মাত্র। সে জন্য কৃতজ্ঞ আমরা।
সে কৃতজ্ঞতার হক আমরা আদায় করবো, আমর বিল মারুফ নাহি আনিল মুনকারের মাধ্যমে। অন্য যে কোন স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠান বা বেসরকারি ইউনিভার্সিটির চেয়ে কওমি মাদ্রাসার দায়িত্ব বহুগুণ বেশি। কওমি মাদ্রাসা জাতিয় জীবনে যেখানে দ্বীনি স্থলন দেখবে, চুপ থাকবে না। সে বলবে, রোগ দেখা দিয়েছে এখানে। এখানে চিকিৎসা করুন। এটা বিরোধিতা নয়, এ হচ্ছে ভালোবাসা ও দায়িত্বশীলতা। সরকারকে মনে রাখতে হবে, এটাই কওমি মাদ্রাসার চরিত্র। এটাই তার প্রাণশক্তি।
বারো. নতুন এ প্রেক্ষাপটে কওমি মাদ্রাসা তার দায়িত্ব পালন করবে নতুবা নিজের বিপন্নদশা নিজেই রচনা করবে।সন্দেহ নেই,দায়িত্বগুলো খুবই চ্যালেঞ্জিং। এ জন্য উলামার ঐক্য অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে বহুগুণ বেশি দরকার। হিকমাহ ও তাকওয়ার প্রয়োজন খুবই বেশি। খুবই প্রয়োজন আবেগের চেয়ে বুদ্ধিবৃত্তি, উত্তেজনার চেয়ে স্থিরতা। সংলাপ ও কৌশলী প্রক্রিয়া এখন যে কোন দাবি আদায়ের সবচে কার্যকর মাধ্যম। সেখানে আমাদের পারদর্শিতা বাড়াতে হবে। আবেগকে শাসন করতে হবে জাগ্রত প্রজ্ঞার মাধ্যমে। আকাশ সেলাইয়ের দাবির জামানা শেষ। বাস্তব ও যথাযত দাবি এবং পরিকল্পনা নিয়েই এগুতে হবে।