মুহাম্মদ মুহিউদ্দীন কাসেমী
আলিয়া মাদরাসা ধ্বংসের নেপথ্য কারণ
কামিলের একজন ভাইভা পরীক্ষার্থীকে আরবিতে তার নাম লেখতে বললাম। লেখল : اشرفل اسلام
এভাবে ৯০ জন পরীক্ষার্থীর ১৩ জন নিজের নাম লেখতে ভুল করল। আলিয়ায় আরবির করুণ অবস্থা আজকে আর কারো কাছে গোপন নেই। শতকরা ৯৫%ই আরবি পড়তে জানে না। সূরা ফাতিহা লেখে যদি বলেন, ইসিম ফেল হরফ নির্ণয় করো; দুয়েকজন ছাড়া কেউ পারবে না। বিষয়টি এতই স্পষ্ট ও সুবিদিত যে, স্বয়ং আলিয়া মাদরাসার কর্ণধার ও শিক্ষকগণও অবলীলায় স্বীকার করেন। বাস্তবে আলিয়ার পরিস্থিতি দেখে এখন আর মাদরাসা বলার কোনো সুযোগ নেই। পড়ালেখা ব্যতীত সহশিক্ষা, দাড়ি কাটা, প্যান্ট-শার্ট পড়া, নামায না পড়া ইত্যাদি শরীয়তের স্পষ্ট নির্দেশগুলোর অবমূল্যায়ন তো আছেই।
অথচ আলিয়া মাদরাসা এক সময় প্রাজ্ঞ আলেম উপহার দিয়েছে। মাও. শামছুল হুদা পাঁচবাগী, আমীমুল ইহসান মুজাদ্দেদী, শামছুল উলামা বেলায়েত হুসেন, আবদুর রহমান কাশগড়ী, তর্কবাগীশ, নুর মুহাম্মদ আজমী, মুহিউদ্দীন খান রহ. এবং হালের মাও. কামাল উদ্দীন জাফরীর মতো বিশ্বনন্দিত আলেমগণ আলিয়ার ছাত্র। যাঁদের নাম শুনলে শরীরের পশম দাঁড়িয়ে যায়। কিন্তু কালপরিক্রমায় আলিয়া মাদরাসা তার ঐতিহ্য হারিয়েছে। অধঃপতন ও ধ্বংসের প্রান্তসীমায় দাঁড়িয়ে আছে। এমনটি হল কেন? কেবল সরকারি স্বীকৃতি নেওয়ার কারণে?
এক্ষেত্রে অনেক কারণ থাকতে পারে। তবে আমার ধারণায় একটি কারণ বেশি ক্রিয়াশীল। এটিই মৌলিক কারণ। অন্যগুলো পারিপার্শ্বিক। কারণটি হল, অনৈক্য। নিজেদের ঐতিহ্য ধরে রাখার ক্ষেত্রে তারা সম্মিলিতভাবে কোনো ভূমিকা রাখতে চরম ব্যর্থ হয়েছে। মনে রাখতে হবে, স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ইসলামপন্থী কোনো সরকার আসেনি। সব সরকারই চেয়েছে মাদরাসাশিক্ষাকে আধুনিক করতে। এখানে তাদের অসৎ নিয়ত রয়েছে একথা বলা যায় না। থাকতেও পারে, নাও থাকতে পারে। প্রত্যেক সরকারের অযোগ্য আমলা-কামলারা মাদরাসার সিলেবাসে হাত দিয়েছে। একটু একটু করে। ধীরে-ধীরে। অতি সন্তর্পণে। আলিয়া মাদরাসার গত ত্রিশ বছর আগের সিলেবাস ও বর্তমান সিলেবাস নিয়ে বসলেই বিষয়টি ধরা পড়বে। আমি একটি বিখ্যাত আলিয়া মাদরাসায় দশম শ্রেণির আরবি ব্যাকরণ পড়াই। এ বই দিয়ে ১০০ বছরেও কেউ নাহু পারবে না। ইবারত পড়তে পারবে না। উদাহরণ দিলেই বুঝবেন। আরবি দ্বিতীয়পত্র মানে নাহু-সরফ মিলে মোট ১০০ নম্বর। নম্বর বণ্টন এমন :
নাহু : ২৫, সরফ : ১৫, কাওয়ায়েদ : ১৫, তরজমা-ইনশা : ২০, চিঠিপত্র : ১০, রচনা : ১৫।
এবার দেখুন, একটা রচনা ৫ম শ্রেণিতে মুখস্থ করলে মোটামুটি আলিম পর্যন্ত চালানো যায়। অথচ একসময় কেবল নাহু ও সরফ আলাদা আলাদা ১০০ নম্বর ছিল। অন্যান্য সাবজেক্ট ঢুকাতে গিয়ে আরবির মৌলিক বিষয়গুলোতে কাঁচি চালায়। ফলে দিন-দিন আলিয়া মাদরাসাগুলো মাদরাসার বৈশিষ্ট্য হারায়। তবে ব্যক্তি উদ্যোগে মিল্লাত, দারুন নাজাত, কাসেমিয়া, ফালাহিয়াসহ কিছু মাদরাসার আরবিচর্চা মোটামুটি হলেও সন্তোষজনক।
এছাড়া নাস্তিক-মুরতাদ ও হিন্দুদের রচনা দিয়ে মাদরাসার বইগুলো ভরিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এসবের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার কেউ নেই। জমিয়াতুল মুদাররেসীন নামে পঙ্গু, লোলা ও খোঁড়া একটি সংগঠন আছে যারা কেবল তৈলমর্দনে পারদর্শী। সবসময় তেল নিয়ে ঘুরে। সরকার যাই করুক তেল মারা শুরু। বস্তুত আলিয়া মাদরাসাগুলোর মাঝে ন্যূনতম কোনো ঐক্য নেই। কওমি মাদরাসাগুলোর মাঝে বাহ্যত অনেক মতবিরোধ পরিলক্ষিত হলেও কিছু বিষয়ে তারা একমত। আলিয়া মাদরাসার বিশাল একটি গোষ্ঠী জামায়াতের। রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে তাদের পিঠ দেওয়ালে ঠেকেছে। তাদের সঙ্গে বিশেষ কিছু কারণে জমিয়তুল মুদাররিসীনের মিল নেই। জমিয়ত বিদআতী ও মাজারপূজারী। এ দুই গ্রুপ ছাড়াও চরমোনাই, শর্ষিনা, ফুরফুরা, মানিকগঞ্জ, বায়তুশ শরফ, লীগ, বিএনপি আরও কত যে দল-মতের লোক তাদের মাঝে রয়েছে। এসব মতানৈক্যের কারণে সাধারণ বিষয় নিয়েও তারা কখনো মুখ খুলেনি। অথচ এমন কিছু কমন বিষয় রয়েছে যেগুলো তাদের কেউই পছন্দ করে না। অথচ নিজেরা বিভিন্ন মতাদর্শের অধিকারী হওয়া সত্ত্বেও আলিয়া মাদরাসার স্বকীয়তা, বৈশিষ্ট্য ও স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখার জন্য সকলে এক প্লাটফরমে আসা দরকার ছিল। অথচ তারা টু শব্দটি পর্যন্ত করেনি। লোকদেখানো প্রতিবাদও করেনি। তাদের সিলেবাস নিয়ে কওমিরা মিছিল করে! কী আজব ব্যাপার!! হেফাজতের আন্দোলনের কারণেই হোক কিংবা অন্য কারণেই হোক সরকার সিলেবাসে কিছু পরিবর্তন এনেছে; কিন্তু এটা নিশ্চিত যে, এ পরিবর্তন আলিয়া মাদরাসার দাবির কারণে এ পরিবর্তন হয়নি। বিষয়টা বেশ চিন্তার।
কওমিরও কি আলিয়ার পরিণতি হবে?
সহজ উত্তর, নিজেদের মাঝে কঠিন ঐক্য না থাকলে কওমরিও আলিয়ার পরিণতি হবে নিশ্চিত। তবে আস্তে আস্তে। প্রত্যেক সরকারের আমলেই একটু একটু পরিবর্তন হলে আজ থেকে ত্রিশ বছর পরে কওমি কেবল ইতিহাস হয়ে থাকবে। আজকে আমাদের যাদের বয়স ত্রিশের কোঠায় ইনশাল্লাহ ত্রিশ বছর পরের অবস্থা দেখে কবরে যেতে পারব!
ছোটোখাটো মতানৈক্য পাশ কাটিয়ে মাদরাসার মূল বৈশিষ্ট্য অক্ষুণ্ন রাখতে সকল মত ও পথের কওমিরা যদি কাজ করে, তাহলে ইনশাল্লাহ কওমির কোনো ক্ষতি হবে না।
সরকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করার সামর্থ্য কারোরই নেই
এদেশে একসময় প্রকাশ্যে হরকতের কার্যক্রম ছিল। আফগানফেরত মুজাহিদদের সংবর্ধনা দেওয়া হতো। আর এখন হরকত কেবল নুরানি-মক্তবে আছে– এক যবর, এক যের, এক পেশকে হরকত বলে; এ ছাড়া আর কোনো হরকত নেই!
মূলত সকারের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করার সামর্থ্য কারোরই নেই। সরকারকে টেক্কা দেওয়ার শক্তি নিরস্ত্র মানুষের থাকবে কোত্থেকে? তবে প্রত্যেক সরকারই নিজের ক্ষমতার প্রতিবন্ধক গোষ্ঠী ও মতবাদকে ধ্বংস করতে চায়। ক্ষমতা নিরাপদ হলে তেমন কোনো পদক্ষেপ তারা নিবে না। নেয় না। সুতরাং কওমি মাদরাসাকে সরকান নিয়ন্ত্রণ করতে চাইবেই; কিন্তু সরকারের কাছে সবাই সম্মিলিতভাবে দাবি উত্থাপন করলে সরকার মানবে।
এখানে এ কথাও স্মরণ রাখা দরকার, বুখারা-সমরকন্দ-উন্দুলুসসহ অনেক ভূখণ্ডে দীনি শিক্ষা ছিল। ইমাম বুখারী, মুসলিম, তিরমিযীসহ বড় বড় ইমামরা যেসব দেশে জন্মগ্রহণ করেছেন; কিন্তু সেগুলো আজ ইতিহাস। তাই আল্লাহর মর্জি হলে দীন ও দীনি শিক্ষা উঠে যাবে, আমাদের করার তেমন কিছু নেই। তবে আমাদের দায়িত্ব চেষ্টা করে যাওয়া।
স্বীকৃতি আরো আগেই দরকার ছিল
সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে চলতি মাসেরই ১১ তারিখে স্বীকৃতির পূর্ণাঙ্গ ঘোষণা আসার কথা। আমি মনে করি, বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই কওমি মাদরাসার সরকারি স্বীকৃতি নেওয়া দরকার ছিল। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের দেশে বিরাট সংখ্যক জনগোষ্ঠী মূল স্রোতের বাইরে থাকা মোটেও ঠিক নয়। কওমির স্বীকৃতি থাকলে তাদের মাধ্যমে দেশের মানুষ প্রকৃত ইসলামের খেদমত আরও বেশি পেত। রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে তাদের বিচরণ থাকত। আসলে কওমি মাদরাসার আদর্শিক কেন্দ্র দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষাব্যবস্থা প্রণীত হয়েছিল একটি বিশেষ অবস্থায় বিশেষ লক্ষ্য সামনে রেখে। বাংলাদেশে হুবহু সেটা অনুসরণ করা সঙ্গত হয়নি। আমার কথাটা আপনার পছন্দ না হলে নিচের বক্তবটি পড়ার অনুরোধ করছি।
মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থা কেমন হওয়া চাই?
এ বিষয়ে মাও. তাকি উসমানি হাফিজাহুল্লাহুর একটি ভাষণের চুম্বকাংশ তুলে দিলাম :
“আমার শ্রদ্ধেয় পিতা পাকিস্তানের সাধারণ শিক্ষাকারিকুলাম পর্যবেক্ষণ করে রাষ্ট্রের দায়িত্বশীলদেরকে বলেছিলেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর আমাদের বাস্তবে নতুন একটি ব্যাপকভিত্তিক ও সার্বজনীন শিক্ষা কারিকুলামের প্রয়োজন।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বে ভারতবর্ষে বড় বড় তিনটি শিক্ষাব্যবস্থা প্রসিদ্ধ ও প্রচলিত ছিল :
এক. দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষাব্যবস্থা।
দুই. মুসলিম ইউনিভার্সিটি আলীগড়ের শিক্ষাব্যবস্থা।
তিন. দারুল উলুম নদওয়াতুল ওলামার শিক্ষাব্যবস্থা।
আমার শ্রদ্ধেয় পিতা প্রায় ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে বলেছিলেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর সরকারিভাবে এদেশে না আলীগড়ের শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন, না নদওয়াতুল ওলামার শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন, না দারুল উলুম দেওবন্দের শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন। বরং সরকারিভাবে আমাদের এমন এক শিক্ষাব্যবস্থার প্রয়োজন যা আমাদের পূর্বসূরিদের শিক্ষাব্যবস্থার ধারাবাহিকতার সাথে যুক্ত। আমার একথা শুনে আপনারা হয়তো অবাক হবেন যে, দারুল উলুম দেওবন্দের মুফতি আজম এবং দারুল উলুম দেওবন্দের এক কৃতী সন্তান ও বরপুত্র বলছেন, ‘পাকিস্তানে এখন আর দেওবন্দের শিক্ষাকারিকুলামের প্রয়োজনীয়তা নেই বরং আমাদের নতুন একটি শিক্ষা করিকুলামের প্রয়োজন।’
আমার শ্রদ্ধেয় পিতা যে কথা বলেছিলেন তা অত্যন্ত গভীর ও সূক্ষ্মদর্শী কথা। তা না বুঝার কারণে আমাদের অনেকে ভুল বোঝাবুঝির শিকার হয়েছেন। এ তিনটি শিক্ষাব্যবস্থা যা ভারতবর্ষে প্রচলিত ছিল সেগুলো মূলত ইংরেজদের প্রবর্তিত শিক্ষাব্যবস্থার ফলাফল ছিলো। ইংরেজদের ষড়যন্ত্রমূলক ব্যবস্থার পাল্টা ব্যবস্থা ছিল। নতুবা আপনি যদি এর পূর্বের মুসলিম বিশ্বের হাজার বছরের শিক্ষাব্যবস্থা নিয়ে পড়াশোনা ও চিন্তা ভাবনা করেন, তাহলে তাতে মাদরাসা ও স্কুলের পার্থক্য দেখতে পাবেন না; সেখানে ইসলামের শুরু থেকে নিয়ে আধুনিককাল পর্যন্ত অব্যাহতভাবে মাদরাসা ও জামেয়াসমূহে একই সময়ে ধর্মীয় শিক্ষাও দেয়া হতো এবং সাথে সাথে যুগোপযুগী দুনিয়াবি শিক্ষাও দেওয়া হতো।”
পুরো বক্তব্যটি পড়লে বিষয়টি আরও খোলাসা হতো। মুফতি শফী সাহেব রহ. এর উপর্যুক্ত ভাষণ সামনে রেখে আমাদের দেশে মাদরাসা শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনা দরকার। আমি তো মনে করি, আলিয়া ও কওমি– একই দেশে দুটি ইসলামী শিক্ষাব্যবস্থা থাকার কোনো দরকার নেই। এর দ্বারা জনগণ বিভ্রান্তিতে পড়ছে; এবং আমরা বিভক্ত হচ্ছি। ইসলামবিরোধীদের সামনে আমরা এক কাতারে দাঁড়াতে পারছি না। জানি, বিষয়টি অলীক, কাল্পনিক ও স্বপ্নতুল্য। তবুও স্বপ্ন দেখতে কোনো নিষেধ তো নেই।
সারকথা
কওমি সনদের স্বীকৃতি হোক; তবে স্বকীয়তা যেন অক্ষুণ্ন থাকে। এর জন্য প্রধান ও প্রথম পদক্ষেপ হল, নিজেদের ভেতর মতানৈক্য, মতবিরোধ এমনকি বিবাদ হলেও কওমির স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখতে সব ভেদাভেদ ভুলে এক কাতারে দাঁড়িয়ে যাবো। নয়তো কওমিও আলিয়ার পরিণতি বরণ করতে তেমন সময় লাগবে না, এটা হলফ করেই বলা যায়।