আন্যপত্রিকা থেকে:
ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার ছাড়াও ১৭ প্রদেশ এবং ৭ অঞ্চলে বিজেপির নিয়ন্ত্রণে থাকায় বেপরোয়া হয়ে উঠেছেন হিন্দুত্ববাদী আরএসএসের কর্মী সমর্থকরা। এতগুলো রাজ্যে প্রাদেশিক সরকার বিজেপির নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদের উত্থান ঘটেছে। কেন্দ্রীয় বিজেপি সরকারের মন্ত্রী এবং কয়েকটি প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর সংখ্যালঘু (মুসলিম) বিদ্বেষী লাগামহীন ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা বিপন্ন করে তুলেছে দেশটিতে বংশ পরম্পরায় বসবাসরত নানা ধর্মের মানুষের জীবন। ‘ভারত মাতা কী জয় যারা বিশ্বাস করবে না তাদের ভারতে থাকার অধিকার নেই’ বিশ্ব হিন্দু পরিষদের এমন জবরদস্তিতে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাড়া অন্যান্য ধর্মের নাগরিকরা হয়ে পড়েছেন ভীত-সন্ত্রস্ত। ‘ভারত মাতা কী জয়’ প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে কেবল নিপীড়ন ও হত্যার হুমকি নয়; মানসিকভাবে সার্বক্ষণিক পীড়নের মধ্যে রাখা হয়েছে মুসলমান, খ্রিস্টানসহ সংখ্যালঘুদের। সঙ্ঘ পরিবার, আরএসএস, শিবসেনা, বিশ্বহিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি), বিজেপি’র সহযোগী সংগঠনের তরফ থেকে প্রতিনিয়ত মুসলমান বিদ্বেষ ছড়ানো, হত্যার হুমকি, মুসলমানদের কটাক্ষ অব্যাহত রয়েছে। অথচ মুসলমানরাই এই ভারত শাসন করেছে শত শত বছর। মুসলিম শাসকদের সময় যে ভারতে হিন্দু-মুসলিমসহ সব ধর্ম-বর্ণের মানুষ সমান অধিকার ভোগ করেছে; সেই দেশে চলছে হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার মহাযজ্ঞ।
বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ জনসংখ্যা অধ্যুষিত ভারতের ২৯ প্রদেশের ১৭টিতে বর্তমানে বিজেপি শাসিত সরকার ক্ষমতায়। এ ছাড়াও রয়েছে ৭টি অঞ্চল। কেন্দ্রে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী আর অন্ধ্রপ্রদেশ, অরুনাচল, আসাম, ছত্রিশগড়, গোয়া, গুজরাট, হারিয়ানা, ঝাড়খন্ড, মধ্যপ্রদেশ, মহারাষ্ট্র, মনিপুর, নাগাল্যান্ড, রাজস্থান, সিকিম, উত্তর প্রদেশ, উত্তরাখন্ড বিজেপি ও বিজেপির জোটের মুখ্যমন্ত্রীরা সরকার পরিচালনা করছেন। এছাড়াও কেন্দ্রীয় শাসিক ৭টি অঞ্চলের মধ্যে ৬টি আন্দামান ও নিকোবর দ্বীপপুঞ্চ, চন্ডীগড়, দাদরা ও নগর হাভেলি, দমন ও দিউ, লাক্ষাদ্বীপ, পন্ডিচেরী ক্ষমতাসীনদের মনোনীত ব্যক্তিরা প্রশাসন চালাচ্ছেন। দিল্লিতো দেশের রাজধানী। যারা মূখ্য মন্ত্রী হিসেবে এসব রাজ্যে দায়িত্ব পালন করছে তাদের অধিকাংশই বংশ পরম্পরায় আরএসএসের সঙ্গে যুক্ত। ৩৬ প্রদেশ-অঞ্চলের (২৯ প্রদেশ ৭ অঞ্চল) মধ্যে ২৪টিতে বিজেপির নিয়ন্ত্রণ প্রমাণ দেয় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ জনসংখ্যা অধ্যুষিত ধর্মরিপেক্ষ ভারতে উগ্র হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদের উত্থান কোন পর্যায়ে গেছে। ভারতের সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশের মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে বিতর্কিত হিন্দুত্ববাদী নেতা যোগী আদিত্যনাথ শপথ নেয়ার পর গোটা রাজ্যজুড়ে শুরু হয়েছে অস্থিরতা। নির্বাচনের পর উত্তর প্রদেশেরা মূখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসেবে বিজেপির মনোজ সিনহা, বিজেপির রাজ্য সভাপতি কেশবপ্রসাদ মৌর্য, রাজনাথ সিংহ, স্বতন্ত্রদেব সিংহ, সতীশ মাহানা, সুরেশ খান্নার মতো নেতাদের নাম উঠে আসে। কিন্তু কট্টর হিন্দুত্ববাদী যোগী আদিত্যনাথ মূখ্যমন্ত্রী করা হয়। মুসলিমবিদ্বেষী আদিত্যনাথ আরএসএসের কট্টরপন্থী নেতা হিসেবে চিহ্নিত। তিনি হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছাড়া অন্যা ধর্মাবলম্বীদের সহ্য করতে পারেন না। বাবরী মসজিদে রাম মন্দির নির্মাণের স্বপ্ন বাস্তবায়নে বদ্ধপরিকর এই নেতা হিন্দী সিনেমার নায়ক শাহরুখ খানকে পাকিস্তানের সন্ত্রাসী হাফিজ সাঈদের সঙ্গে তুলনা করে বলেছিলেন, এ দু’জনের মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। ২০১৫ সালে ৪ নভেম্বর তিনি বলেছিলেন, শাহরুখ খানের মনে রাখা উচিত যে মানুষ যদি তাঁর ছবি বয়কট করে, তাহলে রাস্তায় ঘুরে বেড়ানো মুসলমানদের সঙ্গে তাঁর কোনো পার্থক্য থাকবে না। একজন হিন্দু নারী ধর্মান্তরিত হয়ে মুসলিম হলে আমরা ১০০ মুসলিম নারীকে ধর্মান্তরিত হতে বাধ্য করবো। যদি অনুমতি পাই তাহলে পদশের প্রতিটি মসজিদে গৌরী গণেশের মূর্তি স্থাপন করে দেব। পুরো পৃথিবীতে গেরুয়া ঝান্ডা উড়বে। ২০১৫ সালে বারানসির একটি অনুষ্ঠানে আদিত্যনাথ বলেছিলেন, যারা সূর্য নমস্কার করে না, তাদের ভারত ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত কিংবা সমুদ্রে ডুবিয়ে মারা উচিত। ২০১৬ সালের জুনে বলেন, যেখানে অযোধ্যার বিতর্কিত স্থাপনা (বাবরী মসজিদ) ভেঙ্গে ফেলার থেকে কেউ আটকাতে পারেনি, তো মন্দির তৈরি করাকে আটকাবে। মূর্তি বিসর্জন দেয়ার সময় সবার মনে হয় পরিবেশ দূষণ হচ্ছে, কিন্তু বকরি ঈদের দিন যে হাজার হাজার নিরীহ পশু কেটে ফেলা হয় কাশীতে, ওই সব পশুদের রক্ত যখন সরাসরি গঙ্গায় গিয়ে পড়ে তখন দূষণ হয় না? তিনি শুধু মুসলিমদের নয়; খ্রিস্টান ও শান্তিতে নোবেল জয়ী কিংবদন্তী মানবাধিকার ব্যক্তিত্ব মাদার তেরেসাকেও ছাড়েননি। ২০১৬ সালে ১৬ জুলাই তিনি বলেছিলেন, ভারতীয় হিন্দুদের ষড়যন্ত্র করে খ্রিস্টান বানাচ্ছেন মাদার তেরেসা। উত্তর প্রদেশে যোগী আদিত্যনাথকে মূখ্যমন্ত্রী করার সংখ্যালঘুদের পরিণতি কোন পর্যায়ে যায় তা নিয়ে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সর্বত্রই।
সাংবিধানিকভাবে ‘ধর্ম নিরপেক্ষ’ ভারতে হিন্দুত্ববাদের উত্থানে সর্বত্রই শুরু হয়েছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা। অন্ধত্ব হিন্দু জাতীয়তাবাদ ছড়িয়ে দেয়ায় মুসলিমসহ সংখ্যালঘুদের বসবাসের অনুপেযোগী হয়ে পড়ছে দেশটির কয়েকটি প্রদেশ। আরএসএস ও সংঘ পরিবারের ভারত মাতা জজবায় আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন খোদ ভারতের বুদ্ধিজীবী, সুশীলসমাজ কবি-সাহিত্যিক, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব ও রাজনীতিকরা। বিজেপি নেতা ও মন্ত্রীদের হিন্দুত্ববাদের ছায়াতলে ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে দেশের সব নাগরিককে ‘সমবেত করার’ খামখেয়ালীপনার জজবা সর্বত্রই। বিশ্ব সম্প্রদায়ের কাছে ধর্মনিরপেক্ষার মুখ রক্ষার চেষ্টায় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দমোদর মোদীর সতর্কবার্তা কল্কে পাচ্ছে না। বরং আরএসএসের কর্মকৌশল বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হচ্ছে মোদী সরকার। গান্ধী পরিবারের নেতৃত্বাধীন কংগ্রেসের অদূরদর্শিতায় বিগত নির্বাচনে আরএসএসের ভাবশীর্ষ বিজেপির বিপুল বিজয়ে এ পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। নির্বাচনে বিজয় এবং গুজরাটের কসাইখ্যাত নরেন্দ্র মোদীর নেতৃত্বে সরকার গঠনের পর মন্ত্রী, বিজেপি নেতাদের বেপরোয়া আচরণ, ঔদ্ধত্যপূর্ণ কথাবার্তা, লাগামহীন বার্তা, প্রতিবেশী দেশকে তুচ্ছজ্ঞান করা অব্যাহত রয়েছে। হিন্দু জাতীয়তাবাদের নামে ইসলাম বিদ্বেষী প্রচারণা, হিন্দু মৌলবাদী সংঘ পরিবার, বিশ্ব হিন্দু পরিষদ, আরএসএস ও শিবসেনার নানামুখী অপতৎপরতা, আধিপত্য বিস্তারের লাগামছাড়া আচরণে ঝুঁকির মুখে পড়ে গেছে অন্য ধর্ম ও রাজনৈতিক বিশ্বাসীদের বসবাস। মুসলিম খেদাও, গরু জবেহ নিষিদ্ধ, প্রতিবেশি দেশে গরু দেয়া বন্ধ এবং বিভিন্ন ধর্মের নাগরিকেরা হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করলেই নানান সুবিধা দেয়ার ঘোষণা সর্বত্রই সৃষ্টি করেছে অস্থিরতা। নোবেল জয়ী অমত্য সেন, সাহিত্যিক অরুণন্ধতি রায়, সাংবাদিক কুলদ্বীপ নায়ারের মতো প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব এবং শাহরুখ খান-সালমান খান-আমির খানের মতো জগৎখ্যাত সংস্কৃতির ব্যক্তিত্বরাও উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন; প্রতিবাদ করে আরএসএসের হিন্দুত্ব জাতীয়তাবাদের মরণ খেলার খামখেয়ালীপনা থেকে সরে আসার পরামর্শ দিয়েছেন। কিন্তু কোনো কিছুই কর্ণপাত করছে না বিজেপির নীতি নির্ধারকরা। অটল বিহারী বাজপায়ী, নরেন্দ্র মোদী, নীতিন গাদকারী, লাল কৃষ্ণ আদভানী, সিবরাজ চৌহান, বিএস ইয়াধুরাপ্পা, সুষমা স্বরাজ, অমিত শাহ, মুরলি মোনহর, রাজনাথ সিং নীরব। সংঘ পরিবারের দাম্ভিকতায় উগ্রদেশপ্রেমে মুসলিম খেদাও, আসামের সংখ্যালঘু মুসলিম খেদাও শ্লোগানে নির্যাতন চলছে, পাঞ্জাবে শিখদের কোণঠাসা করে রাখায় সংকুচিত হয়ে আসছে মত প্রকাশের স্বাধীনতা। আর ভোট হারানোর ভয়ে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছে কংগ্রেসসহ বামপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো।
কংগ্রেসের ভরাডুবিতে বিজেপি ক্ষমতায় আসার পর থেকে হিন্দুত্বের বীজ ছড়ানো সর্বত্রই কার্যকর করতে মরিয়া হয়ে উঠেছে ভারতের সংঘ পরিবার। দ্য হিন্দু পত্রিকার খবর মতে গরুর গোশত খাওয়ায় মুসলিম হত্যা, রাজধানী দিল্লিতে চার্চ পোড়ানো, নিরঞ্জন জ্যোতির মুসলিম খেদাও আন্দোলন, মুজাফ্ফরবাদে সংখ্যা লঘু হত্যা, আসমে শিখ হত্যা, সুষমা স্বরাজের গীতাকে জাতীয় গ্রন্থ করার দাবি, আগ্রায় গণধর্মান্তরকরণ, আসামে মুসলিম খেদাও যেন থামছেই না। বেপরোয়া হয়ে পড়েছে দিল্লীর নীতি-নির্ধারকরা। ২০০২ সালে গুজরাট দাঙ্গার পর সেখানে হাজার হাজার মুসলমানের ঠাঁই হয়েছিল রিলিফ ক্যাম্পে। ওই সময়ের গুজরাটের মূখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কেন্দ্রীয় সরকারের তত্ত¡াবধানে পরিচালিত লঙ্গর খানার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে মুসলমানদের কটাক্ষ করে বলেছিলেন, ‘লঙ্গর খানাগুলো প্রজননকন্দ্র ছাড়া আর কিছু নয়’। প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পরও মোদী সেই মানসিকতা থেকে সরে আসেননি। আরএসএসের পরামর্শে তাতে সিদ্ধান্ত নিতে হচ্ছে। যার কারণে উত্তরপ্রদেশে নির্বাচনী প্রচারণায় গিয়ে লাল কৃষ্ণ আদভানীকে ভারতের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করার ঘোষণা দিতে হয়েছে। মোদীর মন্ত্রিসভার মন্ত্রী প্রতিমন্ত্রীদের প্রতিমাসে আরএসএসে সদরদফতরে হাজিরা দিতে হয়। শুধু ভারতের অভ্যন্তরেই নয় প্রতিবেশি দেশগুলো সম্পর্কেও ঔদ্ধত্যপূর্ণ বক্তব্য দিচ্ছেন বিজেপির মন্ত্রীরা। বর্তমানে গোয়া’র মূখ্যমন্ত্রী ও সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মনোহর পারিকার বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয়কে ‘রামের লঙ্কা বিজয়ে’র সঙ্গে তুলনা করে বলেছেন, ‘লঙ্কা বিজয় করে রাম যেমন তা বিভীষণকে দিয়ে দিয়েছিলেন; বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রেও ভারত তাই করেছে’। বিজেপির মন্ত্রী সুব্রামনিয়াম সোয়ামী তার ভাষায় বাংলাদেশ থেকে ভারতে স্বেচ্ছায় চলে যাওয়া হিন্দুদের পুনর্বাসনের জন্য বাংলাদেশের সিলেট থেকে খুলনা পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্তবর্তী বাংলাদেশের মোট ভূখন্ডের এক-তৃতীয়াংশ ভারতের সাথে যুক্ত করার খায়েশ প্রকাশ করেন’। বিজেপি’র সংসদ সদস্য সাক্ষী মহারাজ ভারতের বসবাসরত মুসলমানদের কবর দেয়ার বদলে দাহ করার প্রস্তাব দিয়ে বলেন, ‘কবরস্থান হোক কিম্বা শ্মশান, সবাইকে দাহ উচিত। কাউকে কবর দেয়ার প্রয়োজন নেই’। দিল্লীর আয়নায় বাংলাদেশকে দেখতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়ে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের উচিত হবে ভারতের দৃষ্টিভঙ্গীকে গুরুত্ব দেয়া।’ ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারী নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি মন্তব্য করেন ‘এটা আমাদের অঞ্চল ঃ এই এলাকার ভালমন্দ আমরাই বুঝি।’ ওই সময় ঢাকা সফর করে ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব সুজাতা শিং জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদকে প্রস্তাব দেন আওযামী লীগ যেভাবে চায় সে ভাবে নির্বাচন করুন। বিগত লোকসভা নির্বাচনের সময় বিহারের বিজেপি প্রার্থী গিরিরাজ সিং এক জনসভায় মুসলমান ভোটারদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন ‘মোদীকে যাঁরা ভোট দেবে না আগামী দিনে তাঁদের স্থান ভারতে নয় পাকিস্তান আর বাংলাদেশে হবে। বিশ্ব হিন্দু পরিষদের সভাপতি প্রবীণ তোগাড়িয়া হিন্দু মৌলবাদী বজরং দলের কর্মীসভায় বলেছেন, ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের হিন্দু প্রধান এলাকায় মুসলিমদের ঘর বাড়ি কিনতে দেয়া হবে না। হিন্দু প্রধান পাড়ায় মুসলিমদের বাড়ি খালি করে চলে যেতে হবে। নাহলে বজরং দলের কর্মীরা মুসলিমদের বাড়ি দখল করে বজরং দলের স্টিকার লাগাবে’। বিশ্বহিন্দু পরিষদের (ভিএইচপি) শীর্ষ নেতা অশোক শিঙ্ঘোল বলেছেন, ‘প্রত্যেক হিন্দু পরিবারের উচিত কমপক্ষে ৫টি করে সন্তান নেয়া, নয়তো অতিশীঘ্রই ভারতে হিন্দুদের সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে’। আরএসএস’র যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক দত্তত্রেয়া হোসাবেলি বলেন, ‘মুসলমানদের সন্তান নেয়ার উপর বিধিনিশেধ দিয়ে হিন্দুদের বেশি করে সন্তান নেয়া উচিত, নয়তো খুব শীঘ্রই হিন্দুরা ভারতে সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়ে যাবে’। মহারাষ্ট্রের মুখ্যমন্ত্রী বিজেপি নেতা দেবেন্দ্র গংগাধর ফাদনবিস বলেছেন, যে ব্যক্তি ‘ভারত মাতা কী জয়’ শ্লোগান দেবে না তার ভারতে থাকার কোনো অধিকার নেই। ভারতে কার হিম্মত আছে যে ভারত মাতা কী জয় বলবে না?’ বিজেপি’র জোট শরিক বালঠাকরে প্রতিষ্ঠিত শিবসেনা নেতা প্রতাপ সরনাইক হুমকি দিয়ে বলেছেন, ‘ভারতে থাকতে হলে ‘ভারত মাতা কী জয়’ বলতে হবে। যদি তা না বলা হয়, আমরা শিবসেনা স্টাইলে তার জবাব দেব।’ সিবসেনার সভাপতি বালঠাকরের পুত্র বলেছেন, ‘যারা ভারত মাতা কী জয় বলবে না তাদের নাগরিকত্ব এমনকি ভোটাধিকারও কেড়ে নেয়া উচিত।’ আর শিবসেনার রাজনৈতিক কৌশলই হলো মুসলিম বিদ্বেষ প্রচার। তারা মুম্বাই সিনেমায় মুসলিম অভিনেতা অভিনেত্রীদের অভিনীত ছবি হলে বন্ধ করাও ঘোষণা মাঝে মাঝেই দেন। ‘বিশ্ব হিন্দু পরিষদ নেতা অশোক সিঙ্ঘল, প্রবীণ তোগাড়িয়ার নির্দেশে রাজস্থান সরকার গত ফেব্রæয়ারী মাস থেকে প্রদেশের ৪৮ হাজার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সব ধর্মের ছাত্রছাত্রীদের বাধ্যতামূলক গীতা পাঠ, সূর্য নমস্কার করার সার্কুলার জারী করা হয়। সংঘ পরিবারের সমর্থক ভারতীয় রাজনৈতিক বিশ্লেষক এমভি ক্যামাথ ২০০৩ এক প্রবন্ধে লিখেছেন: ‘সহজ ও সাধারণ ভাষায় এটা বলা যায়, বাংলাদেশের ভৌগলিক অস্তিত্ব থাকার কোন দরকার নেই। ১৯৪৭ সনে এদেশ ভাগ ছিল একটি ঐতিহাসিক ভ্রান্তি; যেমনটি ১৯০৫ সনে লর্ড কার্জন বাংলা-বিভক্তির মাধ্যমে করেন। বাংলাদেশ যদি বাঁচতে চায়, তা হলে একে অবশ্যই ভারতে ফিরে আসতে হবে। বাংলাদেশকে এটা করতে ভারত অবশ্যই সাহায্য করবে।’ বিজেপির শীর্ষ নেতা শ্রভ্রামনিয়াম স্বামী আসাম সফরে গিয়ে বলেছিলেন ‘বিজেপি সরকার বাংলাদেশ থেকে হিন্দু অনুপ্রবেশকারীদের শরণার্থী এবং মুসলমান অনুপ্রবেশকারীদের ‘বেআইনি অনুপ্রবেশকারী’ চিহ্নিত করবে। মুসলমানরা হিন্দু ধর্ম গ্রহণ করলে তাদের নাগরিকত্ব ও আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে’। ভারতের বিজেপি নেতাদের এসব লাগামহীন বক্তব্য ও কর্মকান্ড প্রমাণ দেয় দেশটি অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি এখন কোন পর্যায়ে? গরুর গোশত খাওয়ার অভিযোগে বাসায় গিয়ে মুসলিম হত্যার একাধিক ঘটনাও ঘটেছে। রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস ও সংখ্যালঘুদের প্রতি বৈরিপূর্ণ আচরণে মুসলিম নাগরিকদের বসবাস কত ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে। অথচ ভারতের এক সময়ের মুসলিম শাসকদের দিকে তাকালে কি দেখি? মুসলিম শাসকরাই বেশিরভাগ সময় ভারত শাসন করেছে। শত শত বছরের মুসলমান শাসনের ইতিহাসে হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার ঘটনা ঘটেনি। হিন্দু নেতাদের নেতৃত্বে ধর্মনিরপেক্ষতা ও বহুমুখী সাংস্কৃতি চর্চার নামে সেই ভারতে এখন হিন্দুত্ববাদের দোহাই দিয়ে মুসলিম নিধন ও মুসলমানদের ধ্বংসের ডাক, দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলছে। গত (শনিবার) মধ্যপ্রদেশের তেকানপুরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীবাহিনীর এক অনুষ্ঠানে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং হুংকার দিয়ে বলেছেন, শিগগিরই বাংলাদেশের সঙ্গে আন্তর্জাতিক সীমান্ত বন্ধ করে দেয়া হবে। প্রশ্ন হলো বাংলাদেশের সীমান্ত বন্ধ করে দেয়ার রাজনাথ কে? প্রতিবেশি দেশ নিয়ে ভারতের মন্ত্রী ও প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রীদের এসব ঔদ্ধত্যপূর্ণ মন্তব্যের শেষ কোথায়?
উৎসঃ ইনকিলাব
27 Mar, 2017: