আবুল কালাম আজাদ
বাংলাদেশে ইসলামের নামে সন্ত্রাসবাদ মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। সরকার, বুদ্ধিজীবিমহল, সুশীলসমাজ আর সাংবাদিকরা এর সঠিক কারণ নির্ণয় করতে পারছে বলে মনে হচ্ছে না। তারা কেউই এর গভীরে যাওয়ার চেষ্টা করছে না। কেন শিক্ষিত যুবকরা সন্ত্রাসে জড়িয়ে পড়ছে, কার ইন্ধনে, কী উদ্দেশ্যে-কেউই এসবের মূল কারণ খোঁজে বের করছে না। এমনকি চেষ্টা করছে বলেও মনে হচ্ছে না। সবাই শুধু শুধু একে অপরকে দোষারোপ করছে। আওয়ামীলীগ বিএনপিকে, বিএনপি আওয়ামীলীগকে। আবার সরকার কোনো কোনো সময় জামায়াতে ইসলামীকে। কেউ কেউ আবার কওমি মাদরাসার দিকেও অঙ্গুলিনির্দেশ করছে। যদিও এ পর্যন্ত যতটা সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটেছে, কোনোটির সাথেই কওমি মাদরাসার কোনো ছাত্র-শিক্ষকের সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।
এই যে একে অপরকে দোষারোপ করছেন, এরই ফাঁকে কিন্তু মূল কারণগুলো লুকিয়ে আছে। চিন্তাশীলরা ঠিকই এসব বোঝার কথা।
যাইহোক, যে যেভাবেই বিষয়টা ভাবেন না কেন, আমি বিষয়টি নিয়ে অনেক দিন থেকে চিন্তা করেছি। আমার চিন্তার সাথে অনেকের মিল নাও হতে পারে; হবার দরকারও নেই।
ইসলাম সম্পর্কে আংশিক শিক্ষা বা নূন্যতম ধারণা না থাকা। যেমন, আজকাল কিছু মানুষ যেভাবে ধর্মীয় অনুশাসন থেকে দূরে সরে যাচ্ছে, ধর্মকর্ম পালন করছে না বা মানছে না; ঠিক তেমনিভাবে কিছু জেনারেল শিক্ষিত ভাই বা সাধারণ মানুষ ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হচ্ছে। এই যারা আকৃষ্ট হচ্ছে, তারা ইসলাম সম্পর্কে জানতে বিভিন্নভাবে চেষ্টা করে। তারা যেসব সোর্স থেকে ইসলাম সম্পর্কে টুকিটাকি জানে, সেই সোর্সগুলোই ভ্রান্তিতে ভরা।
সেটা কীভাবে? আপনারা যারা ইন্টারনেট দুনিয়ায় বিচরণ করেন হয়ত লক্ষ্য করেছেন, যেসব সাইটে ইসলামের প্রচার-প্রসার করা হয়; তার অধিকাংশই ভ্রান্ত মতবাদি দ্বারা পরিচালিত। এরা হচ্ছে শিয়া, বেদাতি, কট্টর সালাফি আর খারিজী। এমনকি ইসলাম বিদ্ধেষীরাও ইসলামের নামে বিভিন্ন সাইট পরিচালনা করে। এরা ইসলামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো এমনভাবে তুলে ধরে, যেগুলো পাঠ করে সাধারণ শিক্ষিত ছেলেরা আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। তারা খণ্ডিতভাবে জিহাদের আয়াত-হাদিস তুলে ধরে উদ্ভট ব্যাখ্যা লিখে রাখে, অপব্যাখা করে। আর এগুলো পাঠ করেই আমাদের যুবক ভাইরা বিভ্রান্তিতে পড়ে। তারা আর সেটাকে যাচাই বাচাই করারও প্রয়োজন মনে করে না। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তারা এতই ইন্টারনেট নির্ভর হয়ে পড়ে যে, যুগ যুগ ধরে চলে আসা ইসলামের প্রচলিত চর্চাকে অস্বীকার করে বসে। আলেম-উলামাদের মর্যাদাকে খাটো করে দেখতে শুরু করে। এমনকি বিজ্ঞ উলামায়ে কেরামের অনেককে তারা বিভিন্ন বানোয়াট উপাধীতে ভূষিত করা শুরু করে, গালাগালি করতেও কার্পণ্য করে না। আর এসব যারা করে তাদের অধিকাংশই কট্টর সালাফি মতবাদ বা ইসলাম বিদ্ধেষীদের দ্বারা প্রভাবিত।
এসব সমস্যা থেকে আমাদের উত্তরণের কয়েকটি উপায় আছে। প্রথমেই আমাদের কওমি উলামায়ে কেরামকে সচেতন হতে হবে। সরকারকে পরিষ্কার ধারণা দিতে হবে যে, ইসলামে বিচ্ছিন্নতাবাদের কোনো জায়গা নেই, সুযোগও নেই। সাধারণ মানুষ হত্যা করে, বোমা মেরে ইসলাম প্রতিষ্ঠা হয় না। এটা ইসলামের শিক্ষা নয়।
আমাদের উলামায়ে কেরামকে আরেকটি কাজ করা জরুরি মনে করছি। আর সেটা হচ্ছে, এই যে আমরা বিভিন্নভাবে মানুষকে ওয়াজ-নসীহতের মাধ্যমে ইসলামের দিকে আহ্বান করছি, ইসলামের বিধিবিধান পালনের প্রতি উদ্বুদ্ধ করছি। কিন্তু যারা আগ্রহী হচ্ছে তাদেরকে প্র্যাক্টিকেলি শিক্ষা দেয়ার ব্যবস্থা করছি না। কীভাবে নামায পড়বে, শরিয়তসম্মতভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য করবে, জিহাদের প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব, কখন জিহাদ ফরজ, কোথায় ফরজ ইত্যাদি কিন্তু তাদেরকে আমরা প্র্যাক্টিকেলি শিক্ষা দিচ্ছি না। তাদেরকে আমরা কাছে ডাকি না। কেউ কাছে আসতে চাইলে অনেক সময় এড়িয়ে চলি। তারা অনেক সময় আমাদের কথায় আকৃষ্ট হয় ঠিকই; কিন্তু ব্যবহার হয় ভ্রান্তদের দ্বারা। আমরা মাটি উর্বর করি; তাদেরকে ডাইভার্ট করে নিয়ে যায় অন্যরা।
আর সরকারকে যেটা বুঝতে হবে, আমাদের বর্তমান যে শিক্ষাব্যবস্থা (জেনারেল) তা অসম্পূর্ণ। স্কুল-কলেজ, ভার্সিটি থেকে দিনে দিনে ইসলাম শিক্ষা, নৈতিক শিক্ষাকে অবজ্ঞা করা হচ্ছে। ইসলাম শিক্ষাকে একপ্রকার উঠিয়ে দিয়ে সেখানে এমন সব শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, যেখান থেকে ছাত্ররা নৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারছে না। যারা ইসলাম সম্পর্কে নূন্যতম জানতে চায়, আমাদের এই শিক্ষাব্যবস্থা তাদের সে চাহিদা পূরণ করতে পারছে না। যার দরুণ তারা বিচ্ছিন্নভাবে খণ্ডিত ইসলাম শিখছে। এমনও দেখা যায়, কোনো কোনো ছেলে সারাজীবন ইসলাম বিরোধি বা ভোগবাদে জড়িত ছিল, হঠাৎ ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছে; কিন্তু ইসলাম সম্পর্কে জানতে চেয়ে সে হতাশ হয়ে পড়ে। বাধ্য হয়ে বা সহজ মনে করে সে ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি শুরু করে। কিন্তু সেখান থেকে সে যা শিখে তা অসম্পূর্ণ, ভ্রান্ত, মনগড়া আর ইসলামের সাথে সম্পর্ক নেই এমন সব বিষয়। তাই সরকারকে এসব বিষয় নিয়ে গভীরভাবে ভেবে দেখা উচিৎ। স্কুল-কলেজ ভার্সিটিতে প্রয়োজনীয় ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা উচিৎ।
আরা যারা এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনার সাথে শান্তির ধর্ম ইসলামকে জড়ানোর চেষ্টা করেন, তারা আসলে মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক। এদেরকে এক শ্বাসে গণনা করা যাবে। তাদের কথার সাথে জনসাধারণের কোনো সম্পর্ক নেই। তাদের এসব অপপ্রচার জনগণ অতীতে বিশ্বাস করেনি; আর করবেও না।
যুগ যুগ ধরে চলে আসা কুরআন-হাদিসের ব্যাখ্যা, চর্চাকে যারা অস্বীকার করছে, মাদরাসা শিক্ষাকে এড়িয়ে চলছে, তাদের মনে রাখা উচিত, এ উপমহাদেশে ইসলামের সঠিক প্রচার-প্রসার আর চর্চা কওমি মাদরাসার মাধ্যমেই বেশি হচ্ছে। ইন্টারনেট ঘাটাঘাটি করে, গুগল আলেম হয়ে, চটি বই পড়ে (অধিকাংশ ভ্রান্ত মতবাদিদের লেখা) ইসলামের সঠিক শিক্ষা আশা করা বোকামি।