মুহাইমিনুল ইসলাম
কসোভোর যুদ্ধ নিয়ে আলাপ করতে গেলে আমাদেরকে যুদ্ধেরও বেশ কয়েক বছর পেছনের ঘটনাগুলো বুঝতে হবে। ১৩৩১-১৩৫৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত সার্বিয়ার রাজা ছিলেন চতুর্থ স্টিফান উরশ দুশান। তার মৃত্যুর পর সিংহাসনে আসেন তারই ছেলে পঞ্চম স্টিফান উরশ। কিন্তু বাবা আর ছেলের মাঝে ছিলো আকাশ-পাতাল পার্থক্য। চতুর্থ স্টিফান যেখানে রাজ্য পরিচালনায় অসাধারণ নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন, তার ছেলে পঞ্চম স্টিফান সেখানে ছিলেন একেবারই ব্যর্থ। ১৩৫৫-১৩৭১ সাল পর্যন্ত তার শাসনামলে কেন্দ্রের ক্ষমতা বিপুল পরিমাণে হ্রাস পায় এবং অনেকগুলো ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বাধীন রাজ্য জন্ম নেয়। ১৩৭১ সালে নিঃসন্তান অবস্থায় মারা যান পঞ্চম স্টিফান। একই বছরে মারিৎসার যুদ্ধে ওসমানীয় বাহিনী অসাধারণ রণনৈপুণ্য প্রদর্শন করে বিজয় ছিনিয়ে নেয়। ওসমানীয়দের ক্রমশ অগ্রসরমান এ সামরিক অভিযান সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিলেন সার্বিয়ান শাসক লাজার রেবেল্য়ানোভিচ। তাই তাদের থামাতে সামরিক ও কূটনৈতিক তৎপরতা চালাতে লাগলেন তিনি।
লাজারের এ তৎপরতার ফলস্বরুপ প্লচনিকের যুদ্ধ ও বিলেচার যুদ্ধে পরাজিত হয় সুলতান মুরাদের ওসমানীয় সেনাবাহিনী। এরপর সুলতান তার বাহিনীকে ফিলিপ্পোপোলিস থেকে ইহ্তিমানে সরিয়ে নেন। তারপর একসময় তার বাহিনী এসে পৌঁছায় কসোভোতে। এখানে বেশ বড় একটি অবস্থানগত সুবিধা পেয়েছিলেন সুলতান। কারণ এখান থেকে লাজার রেবেল্য়ানোভিচ কিংবা ভাক ব্রাঙ্কোভিচের রাজ্যে অনায়াসেই আক্রমণ করতে পারতেন তিনি। ১৩৮৯ সালের ১৪ জুন ওসমানীয় বাহিনী প্রিস্টিনাতে গিয়ে অবস্থান নেয়।
সৈন্য সংখ্যা
কসোভোর যুদ্ধে সুলতান মুরাদের বাহিনীতে ছিলো প্রায় ৪০,০০০ এর মতো সেনা। এদের মাঝে ছিলো ২,০০০ জেনিসারি, ২,৫০০ অশ্বারোহী সেনা, ৬,০০০ সিপাহী, ২০,০০০ আজাপ (হালকা অস্ত্রে সজ্জিত অনিয়মিত পদাতিক বাহিনী) ও আকিঞ্জি (অনিয়মিত, হালকা অস্ত্রসজ্জিত অশ্বারোহী বাহিনী)। অবশিষ্ট প্রায় ৮,০০০ সেনা এসেছিলো অধীনস্ত সামন্ত রাজ্যগুলো থেকে। তিন ভাগে বিভক্ত এ বাহিনীর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন সুলতান মুরাদ এবং তার দুই ছেলে বায়েজিদ ও ইয়াকুব সেলেবি।
প্রতিপক্ষের নেতৃত্ব ছিলেন লাজার রেবেল্য়ানোভিচ, ভাক ব্রাঙ্কোভিচ ও ভ্লাত্কো ভুকোভিচ। এ বাহিনীতে ছিলো প্রায় ২৬,০০০ এর মতো সেনা। এদের মাঝে ১২,০০০ সেনা ছিলো লাজারের নেতৃত্বাধীন, যাদের ১০,০০০ ছিলো পদাতিক ও ২,০০০ অশ্বারোহী। অপরদিকে ভাক ব্রাঙ্কোভিচ ও ভ্লাত্কো ভুকোভিচ প্রত্যেকেই প্রায় ৭,০০০ জন করে সেনা নিয়ে এসেছিলেন। এদের মাঝে ৫,০০০ ছিলো পদাতিক এবং ২,০০০ অশ্বারোহী। এছাড়া ক্রোয়েশিয়ান নাইট জন অফ পালিস্নার নেতৃত্বে কয়েক হাজার নাইটও সেই মিত্রপক্ষে যোগ দিয়েছিলেন বলে জানা যায়।
সৈন্য সমাবেশ
কসোভোর ময়দানে মুখোমুখি হলো সুলতান প্রথম মুরাদের ওসমানীয় বাহিনী এবং লাজার-ব্রাঙ্কোভিচ-ভুকোভিচের মিত্রবাহিনী।
তিন ভাগে বিভক্ত মুরাদের বাহিনীর মাঝেখানে ছিলেন মুরাদ নিজে। তার ডান ও বামের বাহিনীর দায়িত্বে ছিলেন যথাক্রমে বায়েজিদ ও ইয়াকুব সেলেবি। বায়েজিদ ও ইয়াকুবের বাহিনীতে শুরুতেই ছিলো ১,০০০ জন করে তীরন্দাজ সেনা। এদের পরে ছিলো ৮,০০০ জন করে পদাতিক সেনা। আর সবার শেষে ছিলো ৩,০০০ জন করে অশ্বারোহী সেনার অবস্থান। মাঝখানে থাকা মুরাদের বাহিনীর শুরুতেই ছিলো জেনিসারি দল। এদের পেছনেই অশ্বারোহী দলের সাথে ছিলেন সুলতান মুরাদ।
সার্বিয়ান বাহিনীও তিন ভাগে ভাগ করা হয়েছিলো। মাঝখানের অংশের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন লাজার। তার ডান ও বামে ছিলেন যথাক্রমে ভাক ও ভ্লাত্কো। তাদের সৈন্য সমাবেশ ছিলো ওসমানীয়দের উল্টো। সম্মুখভাগে ছিলো ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত অশ্বারোহী বাহিনী। অশ্বারোহী তীরন্দাজ বাহিনীর অবস্থান ছিলো দুই পাশে। আর পেছনে অবস্থান নিয়েছিলো পদাতিক বাহিনী।
যুদ্ধ
১৩৮৯ সালের ১৫ জুন কসোভোর ময়দানে সংঘটিত হয় ওসমানীয় ও সার্বিয়ান বাহিনীর মধ্যকার ঐতিহাসিক ‘কসোভোর যুদ্ধ’।
শুরুটা করেছিলেন লাজার রেবেল্য়ানোভিচ। ভারী অস্ত্রে সজ্জিত অশ্বারোহী বাহিনীকে তিনি সামনে এগিয়ে যেতে নির্দেশ দেন। সাথে সাথেই ঘোড়ার পিঠে চড়ে ধুলোর ঝড় তুলে এগিয়ে যেতে থাকে হাজার হাজার যোদ্ধা। ওসমানীয় সেনারাও সাথে সাথে নিজেদের প্রস্তুত করে নেয়। সামনের দিকে থাকা প্রায় ২,০০০ তীরন্দাজের হাত থেকে যেন তীরের বৃষ্টি বর্ষণ শুরু হয়ে যায়। তীরের আঘাতে সার্বিয়ানদের ক্ষতি হলেও তারা পিছু না হটে সামনে এগোতে থাকে।
সার্বিয়ান ও ওসমানীয় বাহিনীর মধ্যকার দূরত্ব যখন মাত্র ১,০০০ গজের কাছাকাছি, তখনই হঠাৎ করে বিন্যাস পরিবর্তন করে ফেলে সার্বিয়ানরা। ইংরেজি ‘V’ অক্ষরের মতো হয়ে গিয়ে তারা আঘাত হানে ওসমানীয়দের উপর।
ভাক ব্রাঙ্কোভিচের বাহিনী গিয়ে আঘাত হানে ইয়াকুব সেলেবির বাহিনীর উপর। শুরুতে ভারী অস্ত্রে সজ্জিত অশ্বারোহী বাহিনীর সামনে দাঁড়াতে পারে নি হালকা অস্ত্রে সজ্জিত সেলেবির বাহিনী। এরপর লাজার ব্রাঙ্কোভিচের অশ্বারোহী বাহিনীকে নির্দেশ দেন ওসমানীয়দের মধ্যভাগে আঘাত হানতে, কারণ সেখানেই রয়েছেন সুলতান মুরাদ। তার নির্দেশে অশ্বারোহী সেনারা নিজেদের দিক পরিবর্তন করতে শুরু করে। ঠিক এমন সময়ই ইয়াকুব সেলেবি নিজের খেল দেখিয়ে দেন। প্রতিপক্ষের এমন অবস্থায় নিজের অশ্বারোহী বাহিনী নিয়ে ঝড়ের বেগে তাদের উপর চড়াও হন ইয়াকুব। এমন প্রতি-আক্রমণের জন্য একেবারেই প্রস্তুত ছিলো না ব্রাঙ্কোভিচের বাহিনী। অন্যদিকে ভারী অস্ত্রশস্ত্র তাদের চলাফেরাতেও সমস্যা করছিলো। ফলস্বরুপ মারাত্মক ক্ষতির শিকার হতে হয় তাদের।
শুরুতে সার্বিয়ানদের আক্রমণের তীব্রতায় সুলতানের নেতৃত্বাধীন বাহিনীও পিছু হটতে বাধ্য হয়। ডান পাশে থাকা বায়েজিদের বাহিনী অবশ্য ভ্লাত্কো ভুকোভিচের বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছিলো। এরপরই সুলতানের নির্দেশে সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়া শুরু করে বায়েজিদের বাহিনী। ততক্ষণে বাম দিকে ইয়াকুব সেলেবির বাহিনী সার্বিয়ানদের বেশ ক্ষতি সাধন করেছিলো। এদিকে এবার বায়েজিদের বাহিনীও ভুকোভিচের বাহিনীকে চেপে ধরলো। ওসমানীয়দের আক্রমণের মুখে টিকে থাকতে না পেরে ভুকোভিচ তখন ক্ষতি পোষাতে মধ্যভাগে থাকা সার্বিয়ান বাহিনীর সাথে যোগ দিলেন।
নিজের বাহিনীর এমন অবস্থা দেখে প্রতিশোধস্পৃহা দাউদাউ করে জ্বলে উঠলো লাজারের মনে। তাই অবশিষ্ট বাহিনী নিয়েই মরণপণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়লেন মুরাদের বাহিনীর সাথে। এমন বেপরোয়া আক্রমণে ওসমানীয় বাহিনী বেশ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। আক্রমণ চলাকালেই আহত হয়ে ঘোড়া থেকে পড়ে যান লাজার। ওসমানীয় সেনারা সাথে সাথেই তাকে বন্দী করে সুলতানের সামনে নিয়ে আসে। মুহুর্তের মাঝেই শিরশ্ছেদ করার হয় লাজারের।
সার্বিয়ান বাহিনীর ডান প্রান্তে থাকা ব্রাঙ্কোভিচ লাজারকে বন্দী হতে দেখেছিলেন। যুদ্ধক্ষেত্রের সামগ্রিক অবস্থা বিবেচনা করে জয়ের আশা তিনি ছেড়ে দেন। তাই সাথে থাকা প্রায় ৫,০০০ সেনা নিয়ে তিনি যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে যান।
অল্প সময়ের মাঝেই লাজারের মৃত্যু ও ব্রাঙ্কোভিচের পলায়নের খবর ছড়িয়ে পড়ে সবদিকে। সার্বিয়ান সেনারা আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে তখন যে যেভাবে পারে পালাতে শুরু করে।
যুদ্ধ শেষ হয়ে গেলো। মুরাদের সামনে দিয়েই নিয়ে যাওয়া হচ্ছিলো যুদ্ধবন্দীদের। এদের মাঝে ছিলেন সার্বিয়ান এক অভিজাত বংশীয় লোক, নাম তার মিলোস ওবিলিচ। হঠাৎ করেই হাতের বাঁধন ছুটিয়ে সাথে থাকা গোপন ছোরাটি বের করে সুলতানের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন ওবিলিচ। উপর্যুপরি আঘাত করে সেখানেই সুলতানকে খুন করেন তিনি। এরপর অবশ্য ওবিলিচকেও হত্যা করেন সুলতানের দেহরক্ষীরা। কিন্তু ক্ষতি যা হবার তা তো ঠিকই হয়ে গেছে, মারা গেছেন ওসমানী সাম্রাজ্যের তৃতীয় সুলতান প্রথম মুরাদ।
অবশ্য আরেক বর্ণনা থেকে জানা যায় যে, মুরাদ আসলে যুদ্ধ চলাকালেই মারা গিয়েছিলেন। ১২ জন সার্বিয়ান অভিজাত বংশীয় লোক ওসমানীয়দের বাঁধা ভেঙে সামনে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়। তাদের মাঝেই একজন সুলতানের গলা ও পেটে তলোয়ার ঢুকিয়ে দিয়ে হত্যা করেন তাকে।
ফলাফল
যুদ্ধে উভয় পক্ষই মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। সার্বিয়ানদের প্রায় ৬,০০০ অশ্বারোহী ও ১৪,০০০ পদাতিক সেনা এতে নিহত হয়। যুদ্ধবন্দীর সংখ্যা দাঁড়ায় প্রায় ১,০০০। ওদিকে ওসমানীয় বাহিনীর ক্ষতিও ছিলো ব্যাপক। তাদের প্রায় ৫,০০০ অশ্বারোহী ও ২০,০০০ পদাতিক সেনা এতে প্রাণ হারায়। এ যুদ্ধে সার্বিয়ানরা তাদের অধিকাংশ সেনা হারিয়েছিলো। ফলে কিছুদিনের মাঝেই সার্বিয়ার বিভিন্ন ক্ষুদ্র রাজ্য একে একে ওসমানীয়দের সামন্ত রাজ্যের তালিকায় নাম লেখাতে শুরু করে।
সুলতান প্রথম মুরাদের মৃত্যুর পর ওসমানীয় বাহিনীর অগ্রযাত্রা কিছুদিনের জন্য হলেও থমকে যায়। এরপর সিংহাসনে আসেন তার ছেলে বায়েজিদ। ওসমানীয়রা আবার নজর দেয়া শুরু করে বাইজান্টাইন সাম্রাজ্য দখলের দিকে।
ওসমানীয় সাম্রাজ্যের গল্প আজকের মতো এখানেই শেষ করছি। পরবর্তী পর্ব আসছে ইনশাআল্লাহ কিছুদিন পরই। ততদিন পর্যন্ত সবার সুস্বাস্থ্য ও দীর্ঘায়ু কামনা করে আজ এখানেই বিদায় নিচ্ছি। রোয়ার বাংলার সৌজেন্য
আরও পড়ুন :
১. অটোম্যান সাম্রাজ্যের অভ্যুদয়ঃ ওসমানের স্বপ্ন
২. অটোম্যান সাম্রাজ্যের অভ্যুদয়ঃ দ্বিতীয় সুলতান ওরহান গাজী
৩. ওসমানী সাম্রাজ্যের অভ্যুদয়ঃ তৃতীয় সুলতান প্রথম মুরাদ
তথ্যসূত্র (১) en.wikipedia.org/wiki/Murad_I (২) en.wikipedia.org/wiki/Battle_of_Kosovo (৩) greatmilitarybattles.com/html/the_battle_of_kosovo.html