তাঁর মূল নাম তাজুল ইসলাম। পিতার নাম মাওলানা আনোয়ার আলি । তিনি ১৩১৫ হিজরি মোতাবেক ১৮৯৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার নাসিরনগর উপজেলার ভুবন গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
শিক্ষাজীবন
দশ বছর বয়সে প্রথমে তাকে নিজ গ্রাম ভুবন-এর পার্শ্ববর্তী এক স্কুলে ভর্তি করানো হয়। মাত্র নয় মাসে তিনি ৬ষ্ঠ শ্রেণি পর্যন্ত সব বই মুখস্থ করে ফেলেন। তার এ বিষ্ময়কর মেধার পরিচয় পেয়ে তিনি তাকে মাদরাসায় ভর্তি করানোর সিদ্ধান্ত নেন। সে মোতাবেক তার পিতা তাকে ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার উপকন্ঠে অবস্থিত শ্রীঘর মাদরাসায় ভর্তি করিয়ে দেন। এখানে কিছুকাল পড়াশোনা করার পর তিনি সিলেটের বর্তমান হবিগঞ্জ জেলার বাহুবল মাদরাসায় ভর্তি হন। বাহুবল মাদরাসায় তিনি কয়েক বছর অধ্যয়ন করেন।
বাহুবল মাদরাসা থেকে যথাসময়ে সুনামের সাথে উত্তীর্ণ হয়ে মাওলানা সাহেব তদানীন্তন বাংলা আসামের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সিলেটের মাদরাসা আলিয়ায় গিয়ে ভর্তি হন। ১৩৩৭-৩৮ হিজরি ফাজিল ফাইনাল পরীক্ষায় তিনি প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করে উত্তীর্ণ হন।
১৩৩৮ হিজরিতে তিনি বিশ্ববিখ্যাত আরবি বিশ্ববিদ্যালয় দারুল উলুম দেওবন্দে ভর্তি হন। এখানে তিনি মোট চার বছর পড়াশোনা করেন। দারুল উলুমে তিনি হাদিস, তাফসির, ফিকহ, আকাইদ ও আরবি সাহিত্য অধ্যয়ন করেন। এখানে শিক্ষাজীবনে তার বিষ্ময়কর মেধাশক্তির বিকাশ ঘটেছিল। এখানে প্রতিটি পরীক্ষায় তিনি সর্বোচ্চ নম্বর পেতেন। এ সময় তিনি সনদসহ কয়েক হাজার হাদিস ও ফিকহের বিখ্যাত গ্রন্থ আল-হিদায় সম্পূর্ণ মুখস্থ করেন। দেওবন্দে তার পৃষ্ঠাপোষক ও বিশেষ শিক্ষক ছিলেন তদানীন্তন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেম যুগের ইমামখ্যাত আল্লামা আনোয়ার শাহ কাশমিরি রহ. (১৮৭৫-১৯৩৩)।
বিবাহ ও পারিবারিক জীবন
মাওলানা তাজুল ইসলাম পাঁচ ভাই ও এক বোনের মধ্যে সবার বড় ছিলেন। তিনি উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ কেরাত বিশেষজ্ঞ ও বাংলণাদেশে ইলমে কেরাতের প্রবর্তক উজানীর কারী ইবরাহিম সাহেবের তৃতীয় কন্যাকে বিবাহ করেছিলেন। এ স্ত্রী থেকে তার দুই ছেলে ও এক মেয়ে জন্মগ্রহণ করেন। প্রথম সন্তান ফাতেমাকে বিযে দেন চাঁদপুর এলাকার মাওলানা মুদদাসসির রহ. এর সঙ্গে। তার বড় ছেলের নাম ছিল আব্দুল্লাহ। তিনি মজ্জুব প্রকৃতির লোক ছিলেন। দ্বিতীয় ছেলের নাম হাফেজ হাবিবুল্লাহ। প্রথম স্ত্রীর ইন্তেকালের পর তিনি সরাইল থানার দেওরা গ্রামের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে দ্বিতীয় বিবাহ করেন। এ স্ত্রীর দুই ছেলে ও এক মেয়ে জন্ম গ্রহণ করে। প্রথম ছেলের নাম হাফেজ ইমদাদুল্লাহ আর দ্বিতীয় ছেলের নাম হাফেজ ওয়ালি উল্লাহ। মেয়ের নাম নাসিমা খাতুন।
কর্মজীবন
দেওবন্দ ফারেগ আলেমগণ শিক্ষা সমাপনান্তে নিজ দেশে ফিরে এসে দীনি ইলমের খেদমত ও মাদরাসা প্রতিষ্ঠাকে নিজের দায়িত্ব বলে মনে করতেন। ১৯৫০ এর দশকে তদানীন্তন শিক্ষামন্ত্রী তাঁকে ঢাকা আলিয়া মাদরাসার সদরুল মুদাররিসিন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আরবি বিভাগের অধ্যাপকের পদ গ্রহণের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। এছাড়াও অনেক বড় বড় চাকুরির প্রস্তাব এসেছিল। কিন্তু সেগুলো প্রত্যাখান করে তিনি আরবি ও ইসলামি শিক্ষা বিস্তারেই আত্ননিয়োগ করেছিলেন। ১৩৪২ হিজরিতে দেওবন্দ থেকে ফিরে এসে তিনি প্রথমে ঢাকায় এবং পরে কুমিল্লাস্থ জামিয়া মিল্লিয়ায় (বর্তমান কাসিমুল উলুম মাদরাসা) শাইখুল হাদিস হিসেবে ইলমে খেদমত শুরু করেন। এই সময়ে এক পর্যায়ে তিনি কলকাতা আলিয়া আদরাসায়্র কিছু দিন ইলমে হাদিসের অধ্যাপক হিসেবে কাজ করেন।
ব্রাক্ষণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুসিয়ার প্রতিষ্ঠাতা মাওলানা ইউনুস রহঃ এর সবিশেষ অনুরোধে তিনি ১৩৪৫ হিজরিতে ব্রাক্ষণবাড়িয়ার জামিয়া ইউনুছিয়া মাদরাসার অধ্যক্ষের পদ গ্রহণ করেন। ইন্তেকাল পর্যন্ত সুদীর্ঘ ৪২ বছর তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এ দায়িত্ব পালন করেন।
বৃহত্তর পরিসরে সমাজসেবার জন্য রাজনীতিতে প্রবেশ
ফখরে বাঙ্গাল মাওলানা তাজুল ইসলাম রহঃ বৃহত্তর পরিসরে সমাজসেবা , ইসলামি শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং আরবি ও ইসলাম শিক্ষা বিস্তারের প্রেরণা নিয়ে তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দের তিনি একজন নিঃস্বার্থ কর্মী ও নেতা ছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্মলগ্নে তিনি তদীয় শায়খুল ইসলাম আল্লামা শাব্বির আহমদ ওসমানি রহঃ এর পরামর্শে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামে যোগদান করে পাকিস্থান আন্দোলনে ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। পূর্ব পাকিস্তানে সর্বপ্রথম তিনি ও হযরত মাওলানা আতাহার আলি রহঃ বিরোধী দল হিসেবে পূর্ব পাকিস্তানে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও নিযামে ইসলাম পার্টি গঠন করেন। তদানীন্তন স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে তিনি ওলামায়ে কেরামকে নিয়ে তুমুল আন্দোলন গড়ে তোলেন। তাদের এই আন্দোলনের ফলে আদর্শ প্রস্তাব গৃহীত হয়। ১৯৫৪ সালে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্টের মাধ্যমে নির্বাচনে তিনি বিপুল অবদান রাখেন। এই নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে নিযামে ইসলাম পার্টি ৩৬টি আসন লাভ করে। আল্লামা তাজুল ইসলাম পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম ও নিযামে ইসলাম পার্টি এবং পরে নিখিল পাকিস্তান নিযামে ইসলাম দলের সহ সভাপতি পদে আসীন ছিলেন। সিলেট রেফারেন্ডামেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।
সমাজ সংস্কার ও সমাজসেবায় মাওলানার ভূমিকা
বেদাআত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি আজীবন সংগ্রাম করেছেন। সমাজে প্রচলিত মিলাদ কিয়াম ও তথাকথিত মারেফাতের নামে ভন্ড ফকিরদের নানাবিধ বিরুপ প্রচারনার বিরুদ্ধে তিনি কার্যকরি ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। ব্রাক্ষণবাড়িয়া শহর থেকে পতিতালয় উচ্ছেদ ও পতিতাদের পুনর্বাসন তার এক উল্লেখযোগ্য কীর্তি। তার পরামর্শ ও তত্ত্ববধানে ব্রাক্ষণবাড়িয়া শহরের পূর্বাঞ্চলে স্বেচ্ছাশ্রমের ভিত্তিতে একটি খাল খনন করা হয়েছিল। যা এন্ডারসন খাল নামে পরিচিত। এ খালের মাধ্যমে ব্রাক্ষণবাড়িয়া শহর জলাবদ্ধতা থেকে মুক্ত হয়।
কাদিয়ানি বিরোধী সংগ্রামে ফখরে বাঙ্গাল রহ.
সিংহপুরুষ আল্লামা তাজুল ইসলাম দেওবন্দ মাদরাসায় অধ্যয়নকালিন সময় থেকেই কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে বহস ও মোনাজারা শুরু করেন। কুরআন-হাদিসের উদ্ধৃতি দিয়ে এবং প্রামাণ্য দলিল প্রমাণের আলোকে তিনি কাদিয়ানিদেরকে পরাজিত করতেন। খোদ ব্রাক্ষণবাড়িয়া শহরে অনুষ্ঠিত এক বাহাসে ফখরে বাঙ্গালের অকাট্য যু্িক্ত ও প্রমাণের সামনে টিকতে না পেরে পাঞ্জাব থেকে আগত কাদিয়ানি মৌলভিরা সভায় তাদের কিতাবপত্র রেখে পালিয়ে যায়। এমন ঘটনা ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় বহুবার ঘটেছে। এভাবে কাদিয়ানি বিরোধী অভিযানের ফলে নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে দলে দলে লোক আবার ইসলামের ছায়াতলে ফিরে আসে।
ইসলামি শিক্ষার প্রসারে তাঁর অবদান
মাওলানা নিজে আরবি ভাষায় সুপন্ডিত ও অনুপম কাব্য-প্রতিভার অধিকারী ছিলেন। আল্লাহ তাআলা তাকে এমন বিষ্ময়কর মেধা দান করেছিলেন যে, ছাত্রজীবনেই তিনি সুন্দর সুন্দর ও উঁচুমানের আরবি কবিতা অনায়াসেই রচনা করে ফেলতেন। তিনি যখন ‘দিওয়ানে আলি’ পড়তেন তখন দিওয়ানে আলির সমপর্যায়ের কবিতা তিনি সহজেই মুখে মুখে রচনা করে শুনিয়ে দিতেন। দারুল উলুম দেওবন্দে অধ্যয়নকালে (১৩৩৮-৪২হিজরি) একবার তিনি আরবি কবিতার মাধ্যম কাদিয়ানিদের বিরুদ্ধে বহস করেন। এ বহসে তিনি ৭০ টি আরবি কবিতা শ্লোক) রচনা করে তাদের দাঁতভাঙ্গা জবাব প্রদান করেন। মাওলানার বিরল এ আরবি জ্ঞান ও কাব্যপ্রতিভা বিকশিত করার জন্য তিনি মাদরাসায় অধ্যাপনার পাশাপাশি অনেক মাদরাসাও প্রতিষ্ঠা করেন। এখানে তার হাতে গড়া কয়েকজন খ্যাতিমান আরবি ও ইসলামি শিক্ষায় শিক্ষিত ব্যক্তির নাম ও তাদের কর্মক্ষেত্র উল্লেখ করা হলো যারা বিভিন্ন অঙ্গনে এবং জাতীয় জীবনে বিরাট অবদান রেখেছেন।
ইসলামি অনুশাসন পালনে প্রজ্ঞা ও সাহসিকতা
একবার ব্রাক্ষণবাড়িয়া মহকুমা প্রশাসক শহরের নিয়াজ পার্কে এক আনন্দ মেলা অনুষ্ঠানের বিজ্ঞাপন মহকুমাব্যাপী প্রচার করেন। মাওলানা তাজুল ইসলাম সাহেব তখন এর বিরুদ্ধে পাল্টা বিজ্ঞাপন প্রচার করেন। ঘটনাক্রমে একদিন এক অনুষ্ঠানে মহকুমা প্রশাসক ও তাজুল ইসলাম সাহেব মিলিত হলেন। মহকুমা প্রশাসক কথা প্রসঙ্গে মাওলানা সাহেবকে বললেন- মাওলানা, আপনার তো অনেক সাহস আপনি সরকারি আদেশের বিরুদ্ধে বিজ্ঞাপন প্রচার করেছেন। মাওলানা সাহেব সাথে সাথে জবাজ দিলেন- আপনার এতো স্পধা যে, সকল সরকারের বড় সরকার আল্লাহ্ পাকের বিরুদ্ধে লিফলেট প্রকাশ করেছেন। প্রশাসক মহোদয় এ জবাব শুনে একেবারে থ বনে যান।
আরেক দিনের ঘটনা। পাকিস্তানের তৎকালিন প্রদানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দি ১৯৫৭ সালে একবার ব্রাক্ষণবাড়িয়ায় এসেছিলেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি ফখরে বাঙ্গালকে বললেন- ‘মাওলানা সাহেব আপনারা রাজনীতি করেন কেন? আলেম বুজুর্গ মানুষ মাদরাসা মসজিদে বসে বসে আল্লাহর নাম ইয়াদ করবেন। আপনারা রাজনীতির কী বুঝেন?’ এ ব্যাঙ্গাত্মক মন্তব্যে ফখরে বাঙ্গাল বাঘের গর্জে ওঠে বললেন- ‘মিস্টার সোহরাওয়ার্দি আপনাদের রাজনীতির দৈর্ঘ কত? এ প্রশ্ন শুনে সোহরাওয়ার্দি তো একেবারে হতবাক। উত্তরের উপক্ষে না করে ফখরে বাঙ্গাল নিজেই জবাব দিলেন- আপনাদের রাজনীতির দৈর্ঘ মাত্র সাড়ে তিন হাত আর আমাদের রাজনীতির দৈর্ঘ দুনিয়া থেকে আখেরাত পর্যন্ত বিস্তৃত।
ফখরে বাঙ্গালের ইন্তেকাল
মহান রব্বুল আলামিনের ডাকে সাড়া দিয়ে ১৯৬৭ সালের ৩রা এপ্রিল মোতাবেক ১৩৭৩ বঙ্গাব্দে ২০ চৈত্র রোজ সোমবার ৭১ বছর বয়সে এ আদর্শ সমাজসেবক, শিক্ষানুরাগী, আরবি ও ইসলামি শিক্ষার একনিষ্ঠ পৃষ্ঠপোষক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার ইন্তেকালে ব্রাক্ষণবাড়িয়া থেকে প্রকাশিত মাসিক ভেলা পত্রিকায় বিশেষ সম্পাদকীয় নিবন্ধ ছাপা হয়েছিল।