উপমহাদেশের মাদরাসাগুলোর সবচেয়ে মূল্যবান পূঁজি হলো ওইসব দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি যা তাদের পূর্বপুরুষদের থেকে তারা উত্তরাধিকার হিসেবে পেয়েছে। আমাদের প্রত্যেক দীনি প্রতিষ্ঠান মৌলিকভাবে দারুল উলুম দেওবন্দের পদচিহ্ন অনুসরণ করে চলতেই মহা আগ্রহী। দারুল উলুম দেওবন্দের যে বৈশিষ্ট্য, বিশ্বের অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তার মান মরযাদাকে অধিক সমুন্নত করেছে, তা হল তার পূর্ব পুরুষদের অবিস্মরণীয় চিন্তা- চেতনা, দর্শন ও দৃষ্টিভঙ্গি। তাদের দৃষ্টিভঙ্গিতে জ্ঞানের দৃঢ়তা, ব্যাপক অধ্যায়ন, পোক্ত ও গভীর যোগ্যতার পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পেয়েছে নিজের জীবন চলার গতি, চিন্তাধারা, আবেগ উত্তেজনা সব যেন সুন্নত ও পূর্বসূরীদের অনুসরণে হয়। আর আল্লাহর সন্তুষ্টির ভাবনা, তার প্রতি দৃঢ় বিশ্বাস ও অবিচল তাওয়াককুলের পরিপন্থী যেন না হয়। পৃথিবীতে বিভিন্ন জ্ঞান বিজ্ঞানে গবেষকদের সংখ্যা অত্যল্প কখনো ছিল না। আর নিরেট জ্ঞানচর্চা ও গবেষণার জন্য তখনো অনেক প্রতিষ্ঠান ছিল। কিন্তু ব্যতিক্রমধর্মী দারুল উলুম দেওবন্দের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছে ইলম ও আমলের সমন্বয়ের উদ্দেশ্যে। সেখানে ছাত্রদের জ্ঞান ও যোগ্যতা বৃদ্ধির প্রতি যতটুকু মনোযোগ দেওয়া হয়েছে তারচেয়েও বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে শরিয়তের ব্যবহারিক প্রশিক্ষণ ও ছাত্রদেরকে পূর্বসূরীদের রঙে রঙিন করার প্রতি। সেখানে মানবাত্মায় প্রবাহিত করা হতো খোদাভীতির অশ্রুসাগর। অন্তরে সৃষ্টি হতো এবাদতের অভিরুচি। ভাল- মন্দ, বৈধ- অবৈধ,মুসতাহাব- মাকরুহ-র শুধু জ্ঞান দিয়েই ক্ষান্ত হতো না বরং তা করে যে বাস্তবায়িত করার আগ্রহ অন্তরে সুদৃঢ় করে বসিয়ে দেয়া হতো। সেখানে এবাদত-আরাধনা ছাড়াও জীবন-যাপন,লেনদেন আচার –আচরণ সুন্নত মতে সাজানোর প্রশিক্ষণ দেওয়া হতো। হিতাকাঙ্খিতা, বদান্যতা, নম্রতা- ভদ্রতা, সরলতা, সহনশীলতা, নীতিনিষ্ঠার ঝোঁক অন্তরে সৃষ্টি করার প্রচেষ্টা হতো। সকলের চিন্তা-চেতনায় জগদ্দল পাথরের মত জাঁকিয়ে বসানো হতো যে, এলেম শুধু এলমের জন্যই নয়, পার্থিব ধনসম্পদ বাড়ানোর জন্য নয় বরং এলম অর্জনের মূল লক্ষ্য নিজেকে ইসলামের মূল উন্নত ভাবাদর্শে সুসজ্জিত করে অপরকে সে মতে গড়ে তোলা।
দারুল উলুম থেকে শুধু উপ- মহাদেশ নয় বরং ইসলামী বিশ্বকে কাঁপানো যে সব মহান ব্যক্তিত্ব সৃষ্টি হয়েছেন, তাদের সকলের অপরিহার্য কর্মসূচী ছিলো যে, তারা কিতাব চর্চাও গবেষণার পাশাপাশি যে কোন সংশোধনকারী আধ্যত্মিক পুরুষদের সাথে আত্মশুদ্ধির বিশেষ সম্পর্ক স্থাপন করত। সম্ভবতঃ এমন কোন শিক্ষা সমাপ্তকারী ছাত্র খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হবে যিনি শিক্ষা সমাপ্ত করেই কোন মুরব্বির সাথে যথারীতি সম্পর্ক স্থাপন না করে তার সঙ্গ ও সান্নিধ্যার্জনের মাধ্যমে সংশোধিত না হয়েই কর্মজীবনে পদার্পন করেছেন। ওলামায়ে দেওবন্দের যে কোন মহান ব্যক্তিত্ব আপনার দৃষ্টিগোচর হয়, তিনি কোন না কোন আধ্যাত্মিক শায়খের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ও তার সঙ্গ-সান্নিধ্যে সংশোধিত। কিন্তু কিছু কাল ধরে আমাদের মাদরাসাসমূহে এ রুচি-চিন্তাধারা ও দৃষ্টিভঙ্গিতে শোচনীয় ঘাটতি পরিদৃষ্ট হচ্ছে। এখন কিতাব পঠন-পাঠনকে একমাত্র দায়িত্ব ও যোগ্যতা মনে করা হচ্ছে। আত্ম ও আমল শুদ্ধির কোন ভাবনাই আর উপস্থিত নেই। যার অশুভ প্রতিক্রিয়া হল বর্তমান স্বয়ং মাদরাসা পরিচালনার ক্ষেত্রেও বৈধ- অবৈধ, উচিত অনুচিতের তেমন একটা তোয়াক্কা নেই। আগে মাদরাসার পরিচালকগণ ও শিক্ষকদের অবস্থা এমন ছিল যে, তারা মাদরাসার পয়সা পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবেচনা করেই ব্যয় করতেন। তাদের উৎকণ্ঠা ছিল অর্থব্যয়ে আবার সীমাতিক্রম হচ্ছে না তো? তাদের বেতন বৃদ্ধির চিন্তার পরিবর্তে মনে প্রচণ্ড ভীতি ঘুরপাক খেত যে, যে বেতন গ্রহণ করা হচ্ছে তা হালাল হচ্ছে তো? তার যথাযথ হক কি আদায় হচ্ছে? দারুল উলুম দেওবন্দের ইতিহাসে এমন দৃষ্টান্ত প্রচুর পরিমাণে আছে। অসংখ্য শিক্ষক কর্মচারীরা বেতন বৃদ্ধি নয় বরং বেতন কমানোর জন্য আবেদন করেছিলেন। হযরত মাওঃ রফিউদ্দিন (সাবেক পরিচালক, দারুল উলুম দেওবন্দ)- এর গাভী একবার মাদরাসার উন্মুক্ত উদ্যানে বেধেঁ দিয়েছিল। অন্য একজন এ নিয়ে অভিযোগ করলে তিনি বাক-বিতণ্ডার পরিবর্তে গাভীই সদকা করে দিয়েছেলেন। মোজাহেরুল উলুম সাহারানপুরের মুহতামিম হযরত মাওঃ এনায়েত এলাহী মাদরাসার বার্ষিক মাহফিল উপলক্ষ্যে লক্ষ লক্ষ মানুষের খাবারের আয়োজন করতেন কিন্তু তিনি নিজে কখনো তাতে অংশ নিতেন না। রাতে মাহফিলের কাজ সমাধা করে এক কোণে বসে নিজ বাড়ি থেকে আনা ঠাণ্ডা তরকারি দিয়ে খানা খেয়ে নিতেন তৃপ্তিসহকারে। ঐ মাদরাসার অন্য এক মুহতামিম মাওলানা হাফেজ আব্দুল লতিফ কখনো মাদরাসার বাবুর্চিখানার রান্না তদারকির জন্য তরকারিরে স্বাদ পরীক্ষা করতে হলে প্রথমে তিনি একজনের খোরাকি নিজ পয়সায় কিনতেন। সামান্য একটু জিহ্বা দিয়ে আস্বাদন করে নিয়ে অবশিষ্ট তরকারি ফেরত দিতেন। দারুল উলুম দেওবন্দের ছাত্র-শিক্ষক ও পরিচালকদের ইতিহাস এ ধরণের অসংখ্য বিরল ঘটনাপঞ্জী দিয়ে পরিপূর্ণ। কিন্তু আজ যখন আমরা নিজেদের অবস্থান খতিয়ে দেখি, সে সব বুজুর্গদের সাথে আমাদের দূরবর্তী সংযোগও আর নজরে পড়ে না। তবে আজো যে বাহ্যিক লেবাস-পোশাকের এবং ওয়াজিব আমলগুলোতে সামান্য সামঞ্জস্য বিদ্যমান তা-ও কম কি? (কোন কোন স্থানে এটুকুও নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে) কিন্তু খোদাভীতি ও সুন্নত অনুসরন তো জীবনের বিশেষ দিকের সাথে সীমাবদ্ধ নয়। আচার- আচরণ, চাল-চলন, চরিত্র সব দিকের সাথে ওৎপ্রোতভাবে সম্পৃক্ত। তবে এসব ক্ষেত্রে খোদাভীতি ও দীনের পূঙ্খানুপুঙ্খ অনুকরণ আমাদের মধ্যে দুর্লভ ও বিরল হয়ে যাচ্ছে। কোন বস্তুচেতনাসমৃদ্ধ ব্যক্তি প্রশ্ন করতে পারে মাদরাসার উদ্দেশ্য এবং যোগ্য ছাত্র বের করার সাথে এসবের কী সম্পর্ক ? কিন্তু আমরা যারা দেওবন্দের অগ্রসেনাদের নাম উচ্চারণ করি তারা এসব বিষয়কে মাদরাসার উন্নতি-অবনতি, সফলতা ও ব্যর্থতার সাথে কিছুতেই সম্পর্কহীন সাব্যস্ত করতে পারি না। দীনি মাদরাসাসমূহের ভিত্তি প্রস্তর এখলাস ও খোদাভীতির উপর স্থাপিত। তার ভিত্তি যখন ক্ষীণ নড়বড়ে হয়ে যায়, বাহিরের সুরম্য প্রাসাদ যতই সুদৃশ্যই হোক ফল-ফসলের দিক দিয়ে পুরো অকেজো হয়ে পড়বে। সুতরাং মাদরাসা শিক্ষার পাঠ্য ও পদ্ধতি পরযালোচনা করার পূর্বেই সবচেয়ে অধিক গুরুত্বপূর্ণ হল তার প্রাণশক্তি সুদৃড় করতে হবে। যদিও এদিকটির সম্পর্ক মাদরাসা কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতার সাথেই সম্পৃক্ত তারপরও নিচের কর্মসূচীগুলো গ্রহণের প্রস্তাব দেয়া হল।
১। প্রত্যেক মাদরাসা আধ্যাত্মিক বিদ্যাকে রীতিমত পাঠ্যসূচীর অবিচ্ছেদ্য অংশ করে নিতে হবে।
২। ছাত্র শিক্ষক সকলের জন্য আবশ্যক করে দেওয়া হবে যেন তারা সপ্তাহে অন্তত একবার সমবেত হয়ে বুজুর্গদের বিশেষ করে দেওবন্দের অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বদের জীবনী, স্মরনীয় বাণী ঐক্যবদ্ধভাবে অধ্যয়ন করে। তম্মধ্যে হযরত আশরাফ আলী থানবীর ‘‘আরওয়াহে সালাসা’’ ‘‘তাজকিরাতুর রশিদ” হায়াতে কাসিমী” তাজকিরাতুল খলিল” হায়াতে শায়খুল হিন্দ” আশরাফুসসাওয়ানেহ” এবং হযরত শায়খুল হাদীস জাকারিয়া (রহঃ)-র আপবীতী ’’ ফাজায়েলে এলম’’ আল্লামা যরনুজীর ‘তা’লীমুল মুতায়াল্লিম’’ আল্লামা খাফাজীর‘ তাজকেরাতুসামে’ ওয়াল মুতাকাল্লিম’’ এবং থানভী র. এর বিভিন্ন মাওয়ায়েজ ও মালফুজাত বিশেষ উপকারী হবে।
৩। মুহতামিম ও শিক্ষকদের জন্য কোন আধ্যাত্মিক শায়খের সাথে নিয়মিত শুদ্ধির সম্পর্ক গড়াকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে। শিক্ষক নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রেও এ বিষয়টির প্রতি সবিশেষ দৃষ্টি রাখতে হবে।
৪। মাদরাসার কাছে কোন আধ্যাত্মিক মহান ব্যক্তিত্ব থাকলে তার সঙ্গ ও সান্নিধ্যকে ছাত্র শিক্ষকগণ সুবর্ণ সুযোগ মনে করতে হবে। মাঝে মাঝে মাদরাসায় সম্মিলিতভাবে সকলের জন্য তার ওয়াজের ব্যবস্থা করতে হবে। আশা করা যায় ইনশা আল্লাহ এসব পদক্ষেপের দ্বারা মাদরাসার পরিবেশ উন্নত হবে এবং যে বিন্দু থেকে আমরা ক্রমে ক্রমে দূরে সরে আসছি সেখানে ফিরে যেতে সহায়ক হবে।
মূল : আল্লামা তকি উসমানি
ভাষান্তর : কাজী মোহাম্মদ হানিফ
শাইখুল হাদিস, জামিয়া আরাবিয়া মারকাজুল উলুম, কাঁচপুর, নারায়ণগঞ্জ