ইমরান আহমাদ
পূর্ব প্রকাশের পর :
বাইবার্স এখন সাতাশ বছরের টগবগে যুবক। বাহরি মামলুক রেজিমেন্টের মধ্যমণি। মামলুক সেনাদের প্রিয়পাত্র, কমান্ডার। তার নির্দেশে দুর্ধর্ষ মামলুক সেনারা উত্তপ্ত আগুনে ঝাঁপ দিতে, উত্তাল সাগরে লাফিয়ে পড়তেও কুণ্ঠাবোধ করে না।
১২৪২ সালে বাছাই করা মাত্র সাতশ’ সৈন্য নিয়ে মামলুক রেজিমেন্ট গঠিত হলেও; আট বছরের মাথায় এসে এখন এ বিশেষ বাহিনীর সংখ্যা দশহাজারে গিয়ে ঠেকেছে। যদিও সুলতানের দেহরক্ষী বাহিনী হিসেবে এই বিশেষ ইউনিটের অভ্যুদয়, কিন্তু কালক্রমে এরাই এখন আইয়্যূবীয় বাহিনীর সর্বশ্রেষ্ঠ রেজিমেন্ট। শক্তি, সাহস, ক্ষিপ্রতা, মেধা সর্বোপরি প্রশিক্ষণে এরা অন্য সবার চেয়ে একটু বেশিই ব্যতিক্রম। এরা এখন শুধুই রক্ষী বাহিনী নয়—নিয়মিত সেনাবাহিনীর স্পেশাল ফোর্সের কাজও এদের দ্বারা চলছে।
১২৪৪ সালে মা’ন এর যুদ্ধে তরুণ বাইবার্সের বিচক্ষণ সিদ্ধান্তের ক্ষিপ্র আক্রমণে বিশ গুণ বেশি সৈন্যের পুরো শত্রুবাহিনী নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলে, কার্যত এখানেই খৃস্টানদের মেরুদণ্ড ভেঙ্গে যায়। ফলে বাইতুল মুকাদ্দাস খুব সহজেই উদ্ধার হয়। এজন্যে তখন থেকেই লোকমানসে তিনি দ্বিতীয় সালাহউদ্দিন হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছেন। আর এ কারণেই পরবর্তী কালেও দুর্ধর্ষ বাহরি মামলুকদের কমান্ডিং তার হাতেই রেখে দেয়া হয়। এখন তিনিই এ বাহিনীর নিয়ন্তা—সর্বাধিনায়ক।
এদিকে আস্ সালিহ পুত্র তুরান শাহ মসুল থেকে এখনো না ফেরায় রাষ্ট্রীয় সকল বিষয়-আশয় পরলোকগত সুলতানের নামেই চালিয়ে যাচ্ছেন তুরান শাহ’র সৎমা—সুলতানা শাজারাতুদ্ দুর। মর্মান্তিক বাহরুস্ সাগীর যুদ্ধ তারই নির্দেশনায় সংঘটিত হয়। বাহরুস্ সাগীরের বিপর্যয়ের খবর কায়রো এসে পৌছলে তিনি খুবই ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ হন। তিনি যেমন অসামান্য সুন্দরী ছিলেন, তেমনি ছিলেন বিচক্ষণ, দূরদর্শী।
তিনি বুঝে নিলেন, আদ্ দামিয়াতের পর বাহরুস্ সাগীরের এ বিপর্যয়ে ক্রুসেডারদের মনোবল নিশ্চয় বহুগুণ বেড়ে গেছে। তারা এবার নির্ঘাত মানসুরাহ’র উপর আঘাত হানবে। আর মানসুরাহ’র পতন মানেই কায়রোর পতন। তাই তুরান শাহ’র আগমনের অপেক্ষা না করে, ক্রুসেড সয়লাব প্রতিরোধে তিনি এবার তার তূণীরের সর্বশ্রেষ্ঠ তিরটাই ব্যবহার করতে চাইলেন। ডেকে পাঠালেন বাহরি মামলুক বিশেষ বাহিনীর প্রধান, সেনাপতি বাইবার্সকে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন ধেয়ে আসা বিধ্বংসী ক্রুসেডের চোয়ালভাঙ্গা জবাব যদি আইয়ূবীয় বাহিনীর কেউ দিতে পারে, তবে সে একমাত্র বাইবার্সই। তাই ঘটমান পরিস্থিতির সর্বশেষ ও আদ্যোপান্ত বর্ণনা দিয়ে সুলতানা শাজারাতুদ্ দুর তার কাঁধেই সমর্পণ করলেন মানসুরাহ অভিযানের গুরু দায়িত্ব। জাতযোদ্ধা বাইবার্সও এটাই চাচ্ছিলেন। বহুদিন ধরে অপেক্ষায় ছিলেন এমনই একটা মহেন্দ্রক্ষণের। তার তনুমন তাই নেচে উঠলো উন্মত্ত ক্রুসেডারদের রক্তের গন্ধে।
.
কিলিজ। এটা শুধু একটা তরবারির নামই নয়। একটা সোনায় মোড়ানো ঐতিহ্যের স্মারক। গৌরবময় ইতিহাসের ধারক। এটা কিপচাক-কুমানদের বিশেষ একটা তরবারি। বাইবার্সের সৌজন্যে যা আজো বিশ্বখ্যাত। ভীতি জাগানিয়া এ তরবারির অনেকগুলো বৈশিষ্টের মধ্যে অন্যতম কয়েকটি হল: কিলিজের একেবারে অগ্রভাগ দু’ধারি এবং কিছুটা সোজা। ফলে প্রতিপক্ষের পেটে সেধিঁয়ে দেয়া খুবই সহজ। তাছাড়া এর বডির তুলনায় অগ্রভাগ মোটা ও কিছুটা বাঁকানো থাকায় মাথা কাটা আরো সহজ। আর অগ্রভাগ চওড়া বলে এটা দিয়ে শত্রুকে জবাই করারও কোন জুড়ি নেই।
১২৪৪ সালে বাইতুল মুকাদ্দাস উদ্ধারে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখায় সুলতান আস্ সালিহ বাইবার্সকে পুরস্কৃত করতে চাইলে, তিনি এই কিলিজ’কেই মামলুক সেনাদের মাঝে প্রবর্তনের অনুমোদন চাইলেন। সুলতান সম্মতি দিলে কিলিজ হয়ে উঠে দুর্ধর্ষ বাহরি মামলুকদের প্রধান তলোয়ার। জাতীয় অস্ত্র। যার তীব্রতা দিয়েই যুগের পর যুগ তারা বর্বর মোঙ্গল ও হিংস্র ক্রুসেডারদের উদ্ধত শির নত করে রেখেছিল। পরবর্তীতে তুর্কী উসমানীয়রা মামলুক সালতানাতের দখল নিলে, এই কিলিজ হয়ে উঠে বিশাল বিস্তৃত উসমানীয় খিলাফাহ’রও জাতীয় অস্ত্র। তারও পরে বৃটিশ রাজকীয় বাহিনীও এ তরবারি ব্যবহার করে। এমনকি দিগ্বিজয়ী নেপোলিয়ন বোনাপার্টও ছিলেন কিলিজের প্রতি চরম আসক্ত।
সেই কিলিজেই এবার চললো অবিরত শান দেয়া। সুলতানা শাজারাতুদ্ দুর এর নির্দেশে মামলুকরা শুরু করলো পূর্ণ যুদ্ধ প্রস্তুতি। মানসুরাহ ময়দানে এবার কিলিজের মাজেযা দেখার পালা।
ফেব্রুয়ারি, ১২৫০ সাল। সেনাপতি বাইবার্সের নেতৃত্বে মানসুরাহ অভিমুখে ঝড়ের বেগে এগিয়ে চললো ১০,০০০ দুর্ধর্ষ মামলুক সেনা। বাইবার্স ময়দানে এসেই প্রত্যেক গুরুত্বপূর্ণ স্থান চিহ্নিত করে প্রয়োজনীয় সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন করে দেন। মাত্র ৩,০০০ সেনা রাখেন নিজ কমান্ডে। বাহরুস্ সাগীরের যুদ্ধে ক্ষুদ্র মুসলিম বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করা প্রিন্স রবার্ট আগ থেকেই ছিলেন ময়দানে। তাদের অপর দু’টি বাহিনী এখনো নদী পেরোয়নি। বাইবার্স তার ৩,০০০ সেনা নিয়েই সরাসরি এসে রবার্টের নেতৃত্বাধীন ১৫,০০০ সৈন্যের মুখোমুখী দাঁড়ান। ক্রুসেডের এ বাহিনীতে ২৯০ জন নাইট ছিল। নাইট বলা হতো একাধিক যুদ্ধে বিজয়ী, চরম বীরত্ব প্রকাশকারী, সর্বোচ্চ প্রশিক্ষিত, সর্বাধিক দুঃসাহসী, চূড়ান্ত পর্যায়ের যাচাই-বাছাই করে তুলে আনা সেরা ও দুর্ধর্ষ সৈন্যদেরকে। যাদের অধীনে সাধারণ সৈন্যও থাকতো!
বাইবার্সের হাতেগোনা সৈন্য দেখেই প্রিন্স রবার্ট বেসামাল হয়ে মুসলিম বাহিনীর ওপর হামলে পড়েন। আরে, বাইবার্স তো এটাই চাচ্ছিলেন। ক্রুসেডাররা এগিয়ে আসা মাত্রই দু’পাশে আগ থেকে লুকিয়ে রাখা, ২,০০০ মামলুক সেনা একসাথে বজ্র হয়ে ভেঙ্গে পড়ে ক্রুসেড বাহিনীর মাথার উপর। আর সামনের দিকে “দ্য প্যান্থার” হয়ে উঠলেন সত্যিকারের চিতা। চিতাবেগেই বাইবার্স তার ৩,০০০ সেনা নিয়ে ক্রুসেডারদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। পাঁচগুণ বেশি হয়েও খৃস্টানরা চোখে দিব্যি সর্ষে ফুল দেখতে লাগলো। কার সাথে টক্কর লড়ছে জানার আগেই মারা পড়তে লাগলো পাইকারী হারে। মানসুরাহ প্রান্তরে ক্রস-ক্রিসেন্টের লড়াই চললো প্রচণ্ড। এটাই ইতিহাসের বিখ্যাত মানসুরাহ যুদ্ধ। বাইবার্স শৌর্য্য-বীর্যের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করলেন। অবশেষে বাইবার্স ঝড়ে ক্রুসেডের সম্পূর্ণ বাহিনীই বিধ্বস্ত হয়ে গেল। প্রায় সবাই কিলিজের এসিড টেস্টে পরিণত হল। যে দু’চারজন বাঁচলো, তাড়া খেয়ে তারাও বাহরুস্ সাগীরে ঝাঁপিয়ে মরলো। এমনকি মাত্র পাঁচজন ছাড়া সকল নাইটই বেঘোরে প্রাণ হারালো। আর প্রিন্স রবার্ট! তিনি স্বয়ং বাইবার্সের হাতেই যুদ্ধক্ষেত্রে নিহত হন।
.
২৮ ফেব্রুয়ারি, ১২৫০ সাল। সুলতান তুরান শাহ অভিষিক্ত হয়েই মানসুরাহ’র পথ ধরলেন। অবশ্য বাইবার্স ততোক্ষণে ক্রুসেডারদের এক তৃতীয়াংশ—প্রিন্স রবার্টের বাহিনীকে সাবাড় করে ফেলেছেন। অন্যদিকে ক্রুসেডারদের অপর দুই বাহিনী, প্রিন্স চার্লস ও সম্রাট নবম লুইয়ের সেনাদল তখন নদী পেরিয়ে বাইবার্সের মুখোমুখী চলে এসেছে।
সুলতান তুরান শাহ ময়দানে এসেই বাহরুস্ সাগীরের আরো ভাটিতে চলে যান। উদ্দেশ্য, আদ্ দামিয়াত থেকে মানসুরাহ-এ আসার পথে খৃস্টানদের রসদ সামগ্রীর দখল নেয়া।
১৫ মার্চ, ১২৫০ সাল। মিসরীয় নৌবাহিনী খৃস্টানদের সরবরাহ জাহাজগুলোর উপর সর্বাত্মক হামলা শুরু করলো। অল্প সময়ের ব্যবধানে আশিটিরও বেশি জাহাজ আটক করা হয়। ফলে ক্রুসেড শিবিরে খাবারের অভাবে মারাত্মক দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। হাহাকার উঠে গোটা খৃস্টান বাহিনীতে।
এর কয়েকদিন পর। নদীপথে মানসুরাহ’র উদ্দেশে আরো একটি খৃস্টান নৌবহর এগিয়ে আসলো। ৬ এপ্রিল, ১২৫০ সাল। সুলতান তুরান শাহ্ ক্রুসেডারদের এই নৌবাহিনীর উপরও চড়াও হন। এবারে খৃস্টানরাও ছেড়ে কথা বললো না। তারা তুমুল প্রতিরোধ গড়ে তুললো। ফলে ফারিসকুর নামক স্থানে মুসলিম ও ক্রুসেডারদের মধ্যে একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ইতিহাসে এটি ফারিসকুর এর যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধে ৫,০০০ খৃস্টান সেনা নিহত হয়। এখানেও মুসলিম বাহিনীর হাতে ক্রুসেডারদের শোচনীয় পরাজয় ঘটে।
অপরদিকে ফারিসকুর এর অদূরে সেনাপতি বাইবার্স তখন তার পুরো মামলুক বাহিনীকে মানসুরাহ দুর্গের পাদদেশে একত্রিত করেন। এবং ধেয়ে আসা ফরাসি সম্রাট নবম লুই’র নেতৃত্বাধীন সম্মিলিত বাহিনীর মুখোমুখী হন। অবশেষে সেখানে এক ভয়ঙ্কর ফয়সালামূলক ও ব্যাপক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হয়। ইতিহাসে এটিও মানসুরাহ্’র যুদ্ধ নামে পরিচিত। এ যুদ্ধে মামলুকরা তাদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি সৈন্যের বিরুদ্ধে যে বীরত্ব প্রদর্শন করে, তা এক কথায় অবর্ণনীয়। বাইবার্সও তার নামের সার্থকতার প্রমাণ দেন খুব বেশি করে। দুর্ধর্ষ জাতযোদ্ধা মামলুকদের টর্নেডো গতির কাছে লজ্জাস্করভাবে পরাস্ত হয় সম্রাট লুই’র নেতৃত্বাধীন ক্রুসেড বাহিনী। যুদ্ধে ৭,০০০ ক্রুসেডার ময়দানেই নিহত হয়। ২০,০০০ হয় ধৃত। দুর্ভিক্ষ, মহামারী ও পালাতে গিয়ে নিহত হয় আরো প্রায় ১০,০০০ সৈন্য। সম্রাট নবম লুই বন্দী হন স্বয়ং বাইবার্সের হাতে। টানা ক্রুসেডের ইতিহাসে এই প্রথমবারের মতো কোন ইউরোপীয় দেশের সম্রাট ধরা পড়লেন। ইউরোপের যে শ্রেষ্ঠ সম্রাট বাইতুল মুকাদ্দাস, দামেশক, কায়রো জয়ের স্বপ্নে বিশাল বাহিনী নিয়ে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়েছিলেন, ভাগ্যের পরিহাসে তিনি আজ যুদ্ধবন্দী হয়েই কায়রো যাচ্ছেন। জেরুজালেম তো বহুদূর! বাইবার্সের বজ্রাঘাতে কায়রোর ধার ঘেঁষার আগেই সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস হয়ে যায় ক্রুসেডের এ বিশাল বাহিনীটি। অভাবনীয় এ বিজয়ের ফলে মুসলিম বিশ্বের সর্বত্র, এমনকি ইউরোপীয় খৃস্টানদের ঘরে ঘরেও আলোচিত হতে থাকে একটিমাত্র নাম—রুকনুদ্দিন বাইবার্স, দ্য প্যান্থার।