জেফরি ডি স্যাকস
সাম্প্রতিক ইতিহাসে নেতৃত্বের পরিবর্তন মানুষের এতটা দৃষ্টি আকর্ষণ করেনি, যেটা ডোনাল্ড ট্রাম্পের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার পর ঘটেছে। এই পরিবর্তনের তাৎপর্য কী বা তার ভবিষ্যৎ পরিণতি কী, তা বুঝতে তিনটি রহস্যের জট খুলতে হবে। কারণ, ট্রাম্প তিন রূপে বিরাজমান।
প্রথম—ট্রাম্প হচ্ছেন রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের বন্ধু। ট্রাম্প এ পর্যন্ত যত বাগাড়ম্বর করেছেন, এর মধ্যে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন নিয়ে উৎসাহের ব্যাপারে তিনি সবচেয়ে ধারাবাহিক। এমন একটি ধারণা আছে যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র চীন, মেক্সিকো, ইরান ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতো বিদেশি শক্তির শিকারে পরিণত হয়েছে। এর মধ্যে পুতিন নিয়ে ট্রাম্পের আশাবাদ জ্বলজ্বল করছে, যা সবার চোখেই পড়ছে।
ট্রাম্প হয় পুতিনের মতো মাস্তানের নিছক বোকা ভক্ত, অথবা তিনি দীর্ঘদিন ধরেই রুশ গোয়েন্দা বাহিনীর লোক। এই দুটির কোনটি আসলে ট্রাম্প, তার ওপরই অনেক কিছু নির্ভর করছে। এর নেপথ্যে নিশ্চিতভাবেই একটি গল্প আছে। তাঁর সম্পর্কে যদি কোনো রোমাঞ্চকর গুজব সত্য হয়, তাহলে ট্রাম্প প্রশাসন ভেঙে যেতে পারে। আমরা এখন জানি, ট্রাম্প-পুতিন সম্পর্ক নিয়ে ব্রিটিশ গোয়েন্দারা যেসব কুখ্যাত নথিপত্র জোগাড় করেছিলেন, তার কিছু গুরুত্বপূর্ণ তারিখ ও তথ্য-উপাত্তের সত্যতা মিলেছে।
ক্রমবর্ধমান হারে যেসব পারিপার্শ্বিক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে, ট্রাম্প অনেক দিন ধরেই রাশিয়ার টাকায় চলছেন। রুশ ধনকুবেরেরা হয়তো ট্রাম্পকে ব্যক্তিগতভাবে দেউলিয়া হয়ে যাওয়া থেকে বাঁচিয়েছেন। অভিযোগ আছে, তাঁদের একজন ট্রাম্পের প্রচারণা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন। সম্ভবত, সেই ব্যক্তি ট্রাম্প ও ক্রেমলিনের মধ্যে দূতিয়ালি করেছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের শীর্ষ ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের রাশিয়া ও রুশ ধনকুবেরদের সঙ্গে ব্যবসায়িক সম্পর্ক আছে। তাঁরা হলেন ট্রাম্পের প্রথম প্রচারণা ব্যবস্থাপক পল মানাফোর্ট, এক্সনমবিলের সাবেক প্রধান নির্বাহী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন, হেজ ফান্ডের বড় খেলোয়াড় ও বাণিজ্যমন্ত্রী উইলবার রস।
ট্রাম্পের দ্বিতীয় রূপটি হচ্ছে, তিনি একজন লোভী ব্যবসায়ী। তাঁকে দেখে মনে হয়, তিনি এই প্রেসিডেন্সিকে ব্যক্তিগত ধনসম্পদ আহরণের আরেকটি উৎস বানাতে চান। অধিকাংশ মানুষের কাছে হয়তো প্রেসিডেন্ট হওয়াটাই বড় ব্যাপার। তাঁরা এটা ভাঙিয়ে কিছু করতে চাইবেন না। তবে ট্রাম্পের বেলায় তা সত্য নয়। আগের সব রীতিনীতি অগ্রাহ্য করে এবং নৈতিকতার সরকারি মানদণ্ড পায়ে মাড়িয়ে ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হয়েও ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখছেন। অন্যদিকে ট্রাম্পের পরিবারের সদস্যরা নানা কায়দাকানুন করে তাঁর নাম ভাঙিয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে বিনিয়োগের পসরা নিয়ে হাজির হচ্ছেন।
তৃতীয়, ট্রাম্প একজন লোকরঞ্জনবাদী ও বক্তৃতাবাগীশ। তিনি অনর্গল মিথ্যা কথা বলে যেতে পারেন, আবার গণমাধ্যম তাঁর ভুল শুধরে দিলে তিনি অভিযোগ করেন—এসব ‘ভুয়া’ খবর। আধুনিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে তিনিই প্রথম প্রেসিডেন্ট, যিনি
অত্যন্ত আগ্রাসীভাবে গণমাধ্যমের সমালোচনা করছেন। হোয়াইট হাউস সম্প্রতি নিউইয়র্ক টাইমস, সিএনএন, পলিটিকো ও লস অ্যাঞ্জেলেস টাইমসকে প্রেসিডেন্টের প্রেস সচিবের ব্রিফিংয়ে ঢুকতে দেয়নি।
কেউ কেউ ব্যাখ্যা করেন, ট্রাম্প নাকি এসব বাগাড়ম্বর করে তাঁর প্রধান কৌশলবিদ স্টিফেন ব্যাননের সেবা করেন। যে ব্যানন সভ্যতার আসন্ন যুদ্ধের পক্ষাবলম্বন করেন, ট্রাম্পভীতিকে চূড়ান্ত জায়গায় নিয়ে গিয়ে তিনি সহিংস প্রকৃতির যুক্তরাষ্ট্র-প্রথম গোছের জাতীয়তাবাদ সৃষ্টি করতে চান। নাৎসি নেতা হেরম্যান গোরিং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নু্যরেমবার্গের কারাগারের প্রকোষ্ঠ থেকে একটি সূত্রের ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন: ‘মানুষকে সব সময়ই নেতাদের সেবায় লাগানো যায়। তাদের বলতে হবে, আক্রমণ হতে যাচ্ছে। আর শান্তিকামীদের দেশপ্রেমহীনতার জন্য নিন্দা করতে হবে, যারা দেশকে বিপদের মুখে ঠেলে দিচ্ছে। সব দেশেই ব্যাপারটা একইভাবে কাজ করে।’
আরেকটি তত্ত্ব হচ্ছে, ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই তিনটি রূপ প্রকৃতপক্ষে একই জিনিস। ব্যবসায়ী ট্রাম্প তো দীর্ঘদিন ধরে রুশদের সমর্থন পেয়ে আসছেন; যাঁরা তাঁকে দীর্ঘদিন ধরে টাকা পাচারের ফ্রন্ট হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন। ভবিষ্যতে রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্কের আরও গোমর যদি তাঁরা ফাঁস করে দেন, সম্ভবত সে জন্য তিনি রক্ষাকবচ হিসেবে আগেভাগেই গণমাধ্যম, গোয়েন্দা সংস্থা ও এফবিআইকে ধারাবাহিকভাবে আক্রমণ করে যাচ্ছেন।
আমাদের প্রজন্মের যে মানুষেরা ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি দেখেছেন, তাঁদের নিশ্চয়ই মনে আছে, তখনকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের জবাবদিহি চাওয়া কতটা কঠিন ছিল। হোয়াইট হাউসের ওই গোপন টেপ ফাঁস না হলে নিক্সন নিশ্চিতভাবেই অভিশংসিত হতেন না। সে ক্ষেত্রে তিনি পুরো মেয়াদই পার করে দিতেন। ফ্লিনের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছে; যিনি জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা হওয়ার আগে রুশ রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যোগাযোগের ব্যাপারে বারবার মানুষের কাছে মিথ্যা বলেছেন। নিক্সনের মতো তাঁর মিথ্যাচারও রেকর্ড হয়েছিল। তাই তিনি ধরা পড়ে যান।
ফ্লিনের মিথ্যা যখন উন্মোচিত হয়ে গেল, তখন স্বভাবসুলভ ঢঙে ট্রাম্প মিথ্যাচারের সমালোচনা না করে ফাঁস-কাণ্ডের সমালোচনা করেন। এখান থেকে ওয়াশিংটন ও পেশিশক্তির রাজনীতি এই শিক্ষা নিতে পারে যে, মিথ্যা বলা প্রথম কাজ হতে পারে, শেষ নয়। কংগ্রেসে যদি যথেষ্টসংখ্যক সৎ সদস্য থাকেন, তাহলে তাঁদের রাশিয়ার সঙ্গে ট্রাম্পের সম্পর্ক নিয়ে স্বাধীন তদন্ত দাবি করা উচিত।
বক্তৃতাবাগীশ ব্যক্তিরা জনসমর্থনের কারণে টিকে যান। লোভ, জাতীয়তাবাদ, বর্ণবাদ, ভীতি—এসব উসকে দিয়ে তাঁরা জনসমর্থন ধরে রাখার চেষ্টা করেন। এর বিনিময়ে তাঁরা সমর্থকদের কর হ্রাস, আয় স্থানান্তর, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ঘাড়ে ঋণের বোঝা চাপানো প্রভৃতি নগদ পুরস্কার দিয়ে ভরিয়ে দেন। ট্রাম্প এখন পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ধনীদের সন্তুষ্ট রাখতে পেরেছেন। আবার অবৈধ শ্রমিকদের ফেরত পাঠানো এবং মুসলিম দেশের মানুষদের আগমন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে নির্বাহী আদেশ জারি করে তিনি শ্বেতাঙ্গ শ্রমিক-সমর্থকদের সন্তুষ্ট করেছেন।
তবে এসব কারণে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জনপ্রিয়তা বাড়েনি। নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি ইতিহাসের সবচেয়ে অজনপ্রিয় প্রেসিডেন্ট। তাঁর কর্মকাণ্ডের কারণে জনপ্রিয়তা উবে যেতে পারে। তবে তিনি ভীতি ও সহিংসতা উসকে দিতে পিছপা হবেন না। পুতিন যদি তাঁর সঙ্গে থাকেন, তাহলে তঁার জোশ আরও বাড়বে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট।
জেফরি ডি স্যাকস: কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের টেকসই উন্নয়নের অধ্যাপক।