বৃহস্পতিবার, ১২ই ডিসেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ রাত ১:৩৪
Home / ইতিহাস ঐতিহ্য / সমুদ্র ঈগল ২০ (খ)

সমুদ্র ঈগল ২০ (খ)

কুতায়বা আহসান

– শুরু হয়ে গেল মুসলমানদের উপর অত্যাচারের কালো অধ্যায়। হিস্পানীয় মুসলমানদের নাসারাকরণ প্রক্রিয়া শুরুতেই প্রচণ্ডরকম হোঁচট খায়। দ্বীনদার মুসলমানরা প্রক্রিয়াটিকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করার পাশাপাশি প্রতিবাদও জানাতে থাকেন।
– তবে জিমি কর্তৃক অব্যাহত উস্কানী দেয়ার প্রেক্ষিতে শুরু হয় প্রতিবাদী মুসলমানদের বিদ্রোহী সাব্যস্ত করে কয়েদ করার প্রক্রিয়া।
– এই প্রক্রিয়ায় বন্দীকরণ চলাকালে এক নিভৃত পল্লীর জনৈকা মহিলাকেও কতিপয় নাসরানী সৈন্য গ্রেফতার করে নেয়।
– মহিলাটিকে যখন শহরের জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল তখন শহরের কতিপয় মুসলিম যুবক একত্রিত হয়ে এর তীব্র প্রতিবাদ জানায়। সৈন্যরা তাদের প্রতিবাদে কোনো কান না দিলে যুবকরা সম্মিলিতভাবে সৈন্যদের উপর হামলে পড়ে মহিলাটিকে ছাড়িয়ে নেয়।
– ঘটনাটির সংবাদ দাবানলের মতো শহরে ছড়িয়ে পড়ল, এরপর প্রতিটি অলিগলিতে তলোয়ারের ঝনঝনানি শুরু হয়ে গেল।
– এ অবস্থা দেখে বিশপের ডেপুটি জিমি নাসারাদেরকে কাতলে আমের হুকুম দিয়ে দেয়। কিন্তু রহমদিল আর্ক বিশপ মধ্যস্ততায় ঢুকে নাসারা এবং মুসলমানদের জযবাকে ঠাণ্ডা করত যার যার অবস্থানে পাঠিয়ে দেন।
– খুনখেকো ডেপুটিটা আর্ক বিশপের এ হস্তক্ষেপকে তার নিজের জিল্লতির কারণ মনে করছিল। সে কিছুতেই এ অপমান হজম করতে পারছিল না।
– সে অব্যাহত যোগাযোগ আর কুমন্ত্রণার মাধ্যমে স্পেন সরকারের পক্ষ থেকে এ ফরমান জারি করিয়ে নিতে সক্ষম হয়ে যায়— মুসলমান হিসেবে কেউ এদেশে থাকতে পারবে না। হয় তাদেরকে দেশ ছেড়ে চলে যেতে হবে অথবা নাসরানিয়াত গ্রহণ করে নিতে হবে। মুসলমানদের এ কথাও বলা হয়— তোমার পূর্ব পুরুষরা মুসলমান ছিলেন না। তারাও ছিলেন ক্যাথোলিক খ্রিস্টান। আফিকান বারবার মুসলিমরা জোরপূর্বক দেশটা দখল করে অস্ত্রের বলে এখানকার অধিবাসীকে মুসলমান বানিয়ে নিয়েছিল। অতএব তোমাদের উচিৎ এ অনুকুল সময়ে তোমরাও তোমাদের পিতৃপুরুষদের ধর্মে ফিরে আসবে।
– এরপর মসজিদগুলো তালাবদ্ধ করা শুরু হয়ে যায়। এক পর্যায়ে মুসলমানদের শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে জমানো ইলমী খাজানা- সমৃদ্ধ লাইব্রেরীগুলো খালি করত গ্রানাডার এক জায়গায় জড়ো করে আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
– চুক্তি ভঙ্গ করে এহেন পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে কেবল গ্রানাডায় নয়, আমাদের আলবাশারাত ওয়াদিতেও ভয়ঙ্কর বিদ্রোহ জেগে ওঠে। নাসারাদের রাজকীয় শক্তি গ্রানাডার বিদ্রোহ চড়ামূল্যে সামাল দিয়ে উঠলেও আলবাশারাতের বিদ্রোহকে মোটেও কাবু করতে পারেনি।
– অনেক চেষ্টা তদবির করে ব্যর্থতার পর আলবাশারাতকে পদানত করার লক্ষে নাসারারা তাদের সর্বাপেক্ষা হিংস্র ও রক্তপায়ী সালার এগিলার অধীনে এক বিরাট সৈন্যদল আলবাশারাত অভিমুখে প্রেরণ করে।
– এগিলারকে তারা অপরাজেয় সালার মনে করতো। বিগত চল্লিশ বৎসরের ইতিহাসে তার মতো বাহাদুর কোনো সালার স্পেন জন্ম দেয়নি। পুরো ইউরোপ জুড়ে ছিল তার শৌর্যের সুখ্যাতি।
– কিন্তু সেই এগিলার যখন এখানে এসে পৌঁছালো, তখন সে নিজেকে খাঁচায় আবদ্ধ সিংহের মতো অসহায় আবিস্কার করলো। আলবাশারাতের জাগ্রত ঈমানদার মুসলমানরা এমন জোশ আর জযবা নিয়ে এগিলার সেনাবাহিনীর মোকাবেলা করলেন যে, ওরা ওয়াদিতে পা জমানোর আগেই পাহাড়ি এলাকার ফাঁদে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। যুদ্ধে স্বয়ং এগিলারও নিহত হয়।
– নাসারা জগৎ এগিলারকে তার বীরত্বের জন্য সীমাহীন মুহাব্বাত করতো। এগিলার পরাজিত হতে পারে এ তাদের কল্পনায় ছিল না। কিন্তু যখন কেবল পরাজয়ের নয় এগিলার মৃত্যুসংবাদ তাদের কাছে এসে পৌছালো তখন তারা হতাশায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ল।
– এগিলার মৃত্যুশোকে জনৈক নাসরানি কবি যে শোকগাথা রচনা করেছিল সে শোকগাথার কিছু পংক্তি দীর্ঘদিন আমার মুখস্ত ছিল। আমি সে শোকগাথার সারাংশ তোমাদের কাছে তুলে ধরছি।
– সেই তৃণহীন প্রান্তর যা তামান্নার আঁচলের মতো দৃষ্টির প্রান্তসীমা পর্যন্ত বিস্তৃত, যার মধ্যে ময়াবি মরিচিকা তার প্রতারণার হাত উচিয়ে অসহায় পথিককে স্বাগতম জানাচ্ছে, সেই পান্তরের ওপারে সবুজের সমারোহের ভেতর পাষাণ পাথরের ফাঁকে ফাঁকে সহস্রাব্দ প্রাচীন আকাশ উঁচু বৃক্ষগুলো কৈশোরিক আনন্দে নৃত্যরত। সে পাথুরে পাহাড়গুলো এতোটাই দুর্গম যে, ওখানে গুণে গুণে কদম ফেলতে হয়।
– পাহাড়গুলোর চড়াই-ওতড়াই-এর সাথে তাল মিলিয়ে পাথরের দুর্লঙ্ঘ্য, আর স্বল্প ও গভীর খাদগুলো সমান্তরালে এগিয়ে গেছে আজানা দূর পর্যন্ত। এগুলো মুসলমানদের জন্য হয়ে উঠেছিল কুদরতী প্রহরা আর নাসারাদের জন্য প্রতি পদে পদে মৃত্যুশিহরণ জাগানিয়া ভীতি। সেই মৃত্যুর আবাসে ভোরের সূর্য যখন আগুনের লিবাস পরে হেসে উঠেছিল তখন সেই ফাঁদে হাজার হাজার বুজদীল শেরদিল এগিলার ও তাঁর বাহিনীর জন্যে ওঁত পেতে অপেক্ষা করছিল।
– হঠাৎ পঙ্গপালের ন্যায় অসংখ্য মুসলিম জওয়ান যখন যমদূত হয়ে এগিলার ও তার বাহিনীর উপর ঝাপিয়ে পড়ল তখন এগিলার সৈন্যরা পাকা আপেলের ন্যায় জীবনের বোঁটা থেকে ঝরে পড়তে লাগলো। দিশেহারা সৈন্যরা এগিলারকে একা ফেলে পালিয়ে যেতে জীবন থেকেই পালিয়ে যেতে লাগলো। এগিলার একা দাঁড়িয়ে রইল। অজস্র মুসলিম জওয়ান তাকে ঘেরাও করে ফেলল। তাদের সালার এগিয়ে এলো এবং এগিলারকে টুকরো টুকরো করে ফেলল।
– এ পর্যন্ত বলে মুনযির বিন যুবাইর আবার একটু বিরতী নিলেন। এরপর কথার ধারা অব্যাহত রেখে বলে যেতে লাগলেন: মা মা’আয ও নাবিল! সেই বিদ্রোহ স্পেন রাজার রাজ তখতে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। প্রেরিত সৈন্যদের অতি অল্পসংখ্যকই জীবন নিয়ে পালিয়ে যেতে পেরেছিল। ওদের মুখে যুদ্ধের বিভিষিকার কথা শুনে আর কখনো আল বাশারাত অভিমুখে সৈন্য প্রেরণের সাহস করতে পারেনি। বাধ্য হয়েই তখন স্পেন সরকারকে এ ঘোষণা জারি করতে হয়— গ্রানাডা সহ দেশের অন্যপ্রান্তের মুসলমানদের জন্য যেসব বাধ্যবাধকতা রয়েছে আলবাশারাতবাসী এসব থেকে মুক্ত। এ ছিল আলবাশারাতবাসীর বিজয় ও সৌভাগ্যের কারণ। সেই বিদ্রোহে জয়ী হওয়ার দরুণই আজও আলবাশারাত তার স্বায়ত্বশাসন নিয়ে টিকে আছে।
– এবার তারা রাহিবদের ইহতেসাবী আদালত প্রতিষ্ঠার আড়ালে ফের আলবাশারাতে কব্জা জমানোর অপপ্রয়াসে লিপ্ত হতে চাচ্ছে। আমার আশা— এবারও তারা আগের মতোই নাকানি চুবানি খেয়ে এখান থেকে বিতাড়িত হতে বাধ্য হবে।
– মুনযির বিন যুবাইরের দীর্ঘ বক্তব্য শুনে মা’আয, নাবিল এবং বাসিত উদাস হয়ে পড়লেন। তারা কেউ কোনো কথা বলতে পারছিল না।
– সূর্য তখন পশ্চিমাকাশে হারিয়ে যাবার উপক্রম হয়ে পড়েছিল। সুতরাং সবাই উঠে দাড়ালেন এবং চিন্তিত পদবিক্ষেপে বাড়ির দিকে এগিয়ে যেতে লাগলেন।

আরও পড়ুন : সমুদ্র ঈগল : ২০ (ক)

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...