মুনশি মুহাম্মদ উবাইদুল্লাহ
কুয়াশার চাদর সরিয়ে সূর্যটা রাঙিয়ে উঠেছে সবে। অতিথিশালা পেরোতেই ‘বাবে কাসেম’ নামটি বেশ জ্বলজ্বল করছে তাতে। দারোয়ানবাবুকে কোরআন শরিফ পড়তে দেখা যাচ্ছে। পাশের স্থানটির নাম কদিম মসজিদ। নফল ইবাদতে রয়েছে অসংখ্য ছাত্রের সমাবেশ। রোনাজারি করছে কেউ বা দু’হাত তুলে। বাইরের চত্বরটির নাম এহাতায়ে মুুলসুরি। প্রিয়নবী (সা.) স্বপ্নযোগে এখানেই বৃত্ত এঁকেছিলেন মাদরাসা তৈরির। এরই পূবপাশে সেই বিখ্যাত কূপ। যার জল পান করানো হয়েছে তাদের, কেয়ামত অবধি এখানে অধ্যয়নের সুযোগ লাভ করবে তারা। ১৮৬৬ খৃস্টাব্দের ৩০ মে তখন। মোল্লা মাহমুদ উস্তাদ, মাহমুদ নামে আরেকজন শিক্ষার্থী। আরম্ভ হয় মাদরাসাশিক্ষার ইতিহাস রচনা। বৃত্তটির অদূরেই ছাত্তা নামক মসজিদ। দরোজা বরাবর গজিয়ে ছিলো সেই ইতিহাসখ্যাত ডালিমবৃক্ষ। এর তলেই দুজনের কোরআন-হাদিস নিয়ে রোজ লেগে থাকা হতো। সাধারণের অতি ভক্তির ফলে গাছটি আজ আর নেই। ভ্রষ্টতায় পৃথিবীর সমস্তটা ছেয়ে ছিলো তখন। ইংরেজদের স্বৈরাচারী শাসন তার ওপর বেগ টানলো আরও। মুসলমানদের তহজিব, তমদ্দুন সমূলে ধ্বংস হতে লাগলো। হজরত কাসেম নানুতাবি (রহ.)-সহ পাঁচজন মনীষী এগিয়ে এলেন। নবীজির ইশারায় প্রতিষ্ঠা করলেন এই পৃথিবীখ্যাত দারুল উলুম দেওবন্দ।
দিল্লির লাল কেল্লার মতো লালে লাল হয়ে রয়েছে এখনও এর ঐতিহাসিক দেয়ালে মোড়া পুরোনো ইমারতগুলি। নওদারাখ্যাত জায়গাটিতে এখনও জানাজা আদায় করা হয় পূন্যস্থান মনে করে। বহু বুজুর্গের পদচারনা ছিলো, রয়েছে স্থানটিতে। পাশেই রয়েছে উচ্চতর ফিকহ, তাফসির, কেরাতসহ কারিগরি সব শিক্ষাবিভাগ। এহাতায়ে মুলসুরিজুড়ে নজর আটকায় হাতে লেখা দেয়ালিকাগুলিতে। মাতৃভাষা উর্দুর পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় ভাষা হিন্দিসহ আরবি, ইংরেজি, তামিল, অসমীয়া, তেলেগু, ইত্যাদি ভাষার প্রচ্ছদে লেখা চোখে পড়ে রোজ। ক্লাসের ফাঁকে ফাঁকে সাহিত্যামোদিদের ভীড় লেগেই থাকে সারাটাক্ষণ। এর ঠিক পশ্চিমে এগোলেই নতুন নতুন ইমারতের মনোরম এক ঝলক। ইংরেজিবর্ণ এল-আদলের দালানটির নাম ‘দারে জাদিদ’। দক্ষিণে রোয়াকে খালিদ, পূবে পুরোনো ফার্সিখানা, দারে জাদিদ কদিম, বোর্ডিং, কুতুবখানা, তাবলিগবিভাগ। আর বরাবর রয়েছে বাবুজ জাহির নামক একটি পুরোনো ফটক। আফগানিস্তানের সুলতান জাহিরের দেয়া তোহফা এটি।
এর ওপরে এখনও বিখ্যাত ইসলামি আইনগ্রন্থ ফতোয়া শামি অধ্যয়নাগার, উচ্চতর হাদিস কক্ষ রয়েছে। দেওবন্দে পড়াশুনোকালে বাঙলার বিখ্যাত বুজুর্গ হজরত মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরি (রহ.) এখানেই থাকতেন। ছাদের ওপর চড়ে কিতাব অধ্যয়ন করতেন। বাবুজ জাহির বরাবর ঠিক সামনেই নির্মিত হচ্ছে আরেক নয়া ইতিহাস। রোজ শতো শতো পর্যটক এখানে একনজর বুলিয়ে যায়। নির্মাধীন ইমারতটির নাম ‘মাকতাবা শায়খুল হিন্দ’। গোলবৃত্তের এটি একটি সুবিশাল লাইব্রেরি। যা এশিয়া মহাদেশের সবচে বড়, বিস্তৃত, সমাদৃত, উন্নত ও আধুনিক কারিকুলামে সমৃদ্ধ থাকবে। ইতোমধ্যেই আন্ডারগ্রাউন্ডসহ পুরো স্ট্রাকচারটির কাজ সম্পন্ন হয়েছে। এই দালানের ছাদ থেকেই গোটা দেওবন্দ শহর একপলকে উপভোগ করা যায়। চোখ পড়ে উত্তর-পশ্চিমে থাকা আরেকটি সুদর্শন ইমারতে। দালানটি দেখতে অনেকটা ঘরোয়া বাঙলোর মতোন। নাম মসজিদে রশিদ। বাবুজ জাহির, দারে জাদিদ পেরিয়ে আরেকটি ফটকের আশ্রয় নিতে হয় ওদিকে যেতে। নাম মাদানি গেট। বিখ্যাত বুজুর্গ হজরত হুসাইন আহমদ মাদানি (রহ.) এ পথ ধরেই হাঁটতেন। সেজন্য তাঁর নামেই পথটি আজও ধ্বনিত। এর পূবে তাঁর সেই বিখ্যাত বাড়ি, যেখানে তাঁর পরিবারের নিবাস আজকাল। পশ্চিমেই এই মসজিদে রশিদ। প্রেমসমাধি তাজমহল আর দিল্লির শাহি জামে মসজিদের নান্দনিক প্রতিচ্ছবির যেনো এক অপূর্ব মিলন মসজিদের এই অবকাঠামোটি। পাথরে পাথরে অভিনব কারুকার্য, নয়া নয়া নকশা দর্শককে দারুণভাবে মুগ্ধ করে।
সাদা সাদা মর্মর ও বেলে পাথরে তৈরি মসজিদটির স্রেফ চত্বরটিই বিশাল জায়গাজুড়ে। বেসমেন্টে রয়েছে কওমিশিক্ষার প্রাথমিক ধাপের সর্বোচ্চ ক্লাস দাওরায়ে হাদিসের ক্লাসরুম। প্রায় আঠারোশো শিক্ষার্থীর অপূর্ব সমাবেশ প্রতিনিয়ত যেখানে। বাইরে রয়েছে মনোরম হাউজে জল গড়াবার দৃশ্য। মসজিদটির দক্ষিণেই সুবিশাল চারটে দালান। এর ফটক পেরিয়েই লাগোয়া ইমারতটির নাম শায়খুল হিন্দ মঞ্জিল। আজমি মঞ্জিল নামে যার সর্বাধিক পরিচিতি। সুবিশাল, মনোমুগ্ধকর দৃশ্যের নকশায় তৈরি ইমারতটি পেরিয়ে পুরোনো আরেকটি ইমারত। নাম আফ্রিকি মঞ্জিল। এর পেছনে নয়া বোর্ডিংঘর ও আসামি মঞ্জিলখ্যাত শায়খুল ইসলাম মঞ্জিল। পাশেই দারুল কোরআন জাদিদ নামের আরেকটি অপূর্ব ইমারত। পশ্চিমে রয়েছে কাসেমি সমাধিস্থল। যেখানে শুয়ে আছেন উপমহাদেশের সমস্ত মহারথি বুজুর্গ উলামায়ে কেরাম।
মাদরাসাটির ক্লাস রুম, আবাসিক হল সব আলাদা। সার্বক্ষণিক জল-বিদ্যুৎ ব্যবস্থা, দু’বেলা আহার একদম ফ্রি। কেবল ভর্তি পরীক্ষায় নাম এলেই হলো। প্রতিষ্ঠানটির আশপাশে রয়েছে আরও শ’খানেক মসজিদ-মাদরাসা।
নামাজ পড়তে কিংবা ক্লাস থেকে বেরোতে শিক্ষার্থীদের এতো বড় বহর যখন একসঙ্গে এগোয়, মনে হয় শুভ্রসফেদ ফেরেশতার সম্মিলন।
লেখক : শিক্ষার্থী, দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত