বাংলাদেশে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলন যখন তুঙ্গে এবং সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন পতনের মুখে, ঠিক এমনি মুহূর্তে ১৯৮৯ ঈসায়ী সালের ৮ ডিসেম্বর ঢাকার ইঞ্জিণিয়র্স ইণস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক জাতীয় সম্মেলনে একীভূত হয় শায়খুল হাদিস মাওলানা আজীজুল হকের নেতৃত্ত্বাধীন খেলাফত আন্দোলন ও অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদেরের নেতৃত্ত্বাধীন যুব শিবির।
৯০’র স্বৈরাচার পতন আন্দোলন, ভারতের ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ ধ্বংসের প্রতিবাদে ঐতিহাসিক বাবরী মসজিদ লং মার্চ, ৯৪ সালের নাস্তিক-মুরতাদ তাসলিমা নাসরিন বিরোধী আন্দোলনসহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সমকালীন ও ইসলামিক ইস্যুতে স্বরব রয়েছে দলটি।
প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে এ সংগঠনের আমীর-এ-মজলিস ছিলেন হযরত মাওলানা আব্দুল গাফফার রহ. এবং মহাসচিব অধ্যক্ষ মাসউদ খান। পরবর্তীকালে আমীর-এ-মজলিস ছিলেন শায়খুল হাদিস আল্লামা আজীজুল হক। বর্তমানে খেলাফত মজলিসের আমীর-এ-মজলিসের দায়িত্ব পালন করছেন প্রবীণ রাজনীতিবিদ অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাক ও মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করছেন অধ্যাপক ড. আহমদ আবদুল কাদের।
খেলাফত আন্দোলন ও যুব শিবিরের সম্মিলনে খেলাফত মজলিস প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর অতিবাহিত হয় দীর্ঘ ১৬ বছর। কিন্তু দলের কার্যক্রমে উভয় ধারার ছাপ থাকে বিদ্যমান। শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকের ব্যক্তিত্বের প্রভাবে বিভেদ রেখা স্পষ্ট হতে পারে নি। কিন্তু তার নেতৃত্ব শিথিল হওয়ার সাথে সাথে তা প্রবল হয়ে ওঠে। অবশেষে মওদুদি মতাদর্শের প্রভাব ও নেতৃত্ব কুক্ষিগত করে রাখার পারস্পারিক অভিযোগ ২০০৫ সালে বিভক্ত হয় খেলাফত মজলিস। ২০০৮ সালে নির্বাচন কমিশনে খেলাফত মজলিস নামের বরাদ্দ পায় অধ্যক্ষ মাওলানা মোহাম্মদ ইসহাকের নেতৃত্বাধীন খেলাফত মজলিস।
ভোটের রাজনীতিতে অর্জনটুকু বলা যায় অবিভক্ত খেলাফত মজলিসেরই প্রাপ্য। চারদলীয় জোটের অংশিদার ইসলামী ঐক্যজোটের ব্যানারে ৮ম জাতীয় সংসদে মুফতি শহীদুল ইসলাম খেলাফত মজলিসের প্রতিনিধিত্ব করেন। এছাড়াও ১৯৯১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সিলেট থেকে নির্বাচিত হন খেলাফত মজলিসের মাওলানা ওবায়দুল হক।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের অন্যতম অংশিদার খেলাফত মজলিস। আগামী নির্বাচন তারা জোটবদ্ধভাবেই করার ইচ্ছা রাখেন। তবুও তাদের রয়েছে নিজস্ব নির্বাচনী ভাবনা ও প্রস্তুতি। নির্বাচন বিষয়ে খেলাফত মজলিসের ভাবনা, কৌশল ও প্রস্তুতি বিষয়ে আওয়ার ইসলাম টুয়েন্টিফোর ডটকমের সাথে কথা বলেছেন দলের মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের। কথোপকথনে ছিলো আওয়ার ইসলামের বার্তা সম্পাদক আতাউর রহমান খসরু।
খেলাফত মজলিসের মহাসচিব অধ্যাপক আহমদ আবদুল কাদের মনে করেন, বর্তমান নির্বাচন কমিশন গঠনে সরকারের ইচ্ছে পূরণ হয়েছে। খেলাফত মজলিস ও জনগণের প্রত্যাশা কারোই পূরণ হয় নি।
তাহলে বর্তমান কমিশনের ব্যাপারে আপনাদের অবস্থান? তিনি বলেন, ‘আমাদের আশা প্রত্যাশা যেহেতু পূরণ হয় নি, তাই আমার আশংকায় আছি। এ কমিশন রকিব কমিশন থেকে কোনো বিবেচনায় ভালো হবে বলে আমরা মনে করি না। আমাদের আশংকা বর্তমান কমিশনও রকিব কমিশনের মতোই দলীয় এজেন্ডা বাস্তবায়ন করবে। যদিও সিইসি বলছেন, তিনি কাজে প্রমাণ করবেন। আমরা দেখবো তারা কাজে কী প্রমাণ করেন?’
অভিজ্ঞ এ রাজনীতিবিদ মনে করেন, ‘নির্বাচন কমিশনের মতো নির্বাচনকালীন সরকারও গুরুত্বপূর্ণ। সরকার নিরপেক্ষ না হলে, কমিশন নিরপেক্ষ হলেও তারা নিরপেক্ষভাবে কাজ করতে পারবে না। বড় বিষয় হচ্ছে নির্বাচনকালীন সরকার কেমন হবে। আমরা প্রেসিডেন্টের কাছে দাবী জানিয়েছি, নির্বাচনকালীন সময়ে তার নেতৃত্বে একটি দলনিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের।’
তার প্রত্যাশা প্রেসিডেন্ট ও সরকার উভয়েই দলনিরপেক্ষ সরকারের গুরুত্ব অনুধাবন করবেন।
বর্তমান কমিশন ও সরকারের অধীনে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে এখনো দলীয় কোনো সিদ্ধান্ত হয় নি বলে জানান খেলাফত মহাসচিব। তারা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে আরও পরে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নিবেন। তবে একদম অপেক্ষায় হাত গুটিয়ে বসে নেই দলটি। ছোট আয়োজনে হলেও নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারা।
শুরু হওয়া কাজগুলোর মধ্যে রয়েছে, সম্ভাব্য প্রার্থী বাছাই, মাঠ পর্যায়ে তাদের জনপ্রিয়তা জরিপের মতো প্রাথমিক কাজগুলো।
জোট নির্বাচন না করলে নির্বাচন করবেন কী না সে বিষয়ে এখনি ভাবতে নারাজ দলটির মহাসচিব। তবে (নিবন্ধন) আইনি বাধ্য-বাধকতার কথাও মাথায় আছে তাদের বলে জানা তিনি।
জোটের কাছে কতোটি আসন দাবি করবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, দলে এ বিষয়ে এখনো কোনো আলোচনা হয় নি।
নির্বাচনী ইশতেহারে খেলাফত মজলিসের অগ্রাধিকার প্রদান করা বিষয়গুলো সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘আমরা প্রথমেই নির্বাচন প্রক্রিয়া, নির্বাচনী সহিংসতার সমাদানের কথা বলবো। সাথে সাথে অর্থনৈতিক, সামাজিক, রাজনৈতিক সংকট ও শিক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে ইশতেহার তৈরি করবো।’
ইসলামি দল হিসেবে ইসলামিক কোন বিষয়কে সামনে নিয়ে আসবেন? প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘শিক্ষা বিষয়ের অন্তর্ভূক্ত থাকবে। আমরা ইসলামি ও নৈতিক শিক্ষার উপর জোর দিবো। কিছু বিষয় এমন রয়েছে যা বাহ্যত ইসলামি মনে হয় না, কিন্তু তা ইসলামি বিষয় যেমন, ন্যায়বিচার, সুশাসন, ধর্মপালনে স্বাধীনতা ইত্যাদি।’
বর্শীয়ান এই রাজনীতিবিদ মনে করেন, ইসলামি দলগুলো জনগণের মনের কথা বলতে পারছে না বলেই জনগণ তাদের ডাকে সাড়া দিচ্ছে না। ইসলামি দলগুলো যেসব এজেন্ডা নিয়ে কাজ করছে জনগণের কাছে তার খুব বেশি মূল্য নেই। আবার জনগণের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ইসলামি দলগুলো কথা বলছে না। জনগণের দৃষ্টি সব সময় সমকালীন বিষয়ের উপর থাকে। কিন্তু আমরা বিষয়গুলো এড়িয়ে যাই। জনগণ যেগুলোকে তাদের জীবন-মরণ সমস্যা মনে করে আমাদের এক ঘণ্টার বক্তৃতায় তার এক ভাগও থাকে না। এ বিষয়গুলো নিয়ে তারা আন্দোলন ও সংগ্রামও খুব সামান্য করেন।
এছাড়াও ইসলামি দলগুলোও রাজনৈতিক ব্যর্থতার অন্যতম কারণ বলে তিনি বিশ্বাস করেন। জনসম্পৃক্ত এবং ঐক্যবদ্ধ রাজনীতি করতে পারলে জনগণ এখনো সাড়া দিবে বলে তিনি মনে করেন।
আওয়ার ইসলামের সৌজন্যে