শনিবার, ২৩শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ দুপুর ২:২৫
Home / ইতিহাস ঐতিহ্য / সমুদ্র ঈগল ২০ (ক)

সমুদ্র ঈগল ২০ (ক)

কুতায়বা আহসান

– – নাবিল, বাসিত এবং মা’আয সমুদ্র উপকুলের দিক থেকে তীব্র গতিতে তাঁদের ঘোড়া হাঁকিয়ে সেই উপত্যকার পাশে এসে পৌঁছালো যেখানে মুনযির বিন যুবাইর তাঁর ভেড়ার পাল চড়াচ্ছিলেন।
– ঘোড়া দৌড়িয়ে তারা পাহাড়ের উপর ঠিক সে জায়গায় পৌঁছে গেল যেখানে মুনযির বিন যুবাইর বড় একটা চাটানের উপর বসা ছিলেন। তাদেরকে আসতে দেখে মুনযির দাঁড়িয়ে গেলেন।
– মা’আয কিছু বলার জন্য মুখ খুলতে যাচ্ছিল তার আগেই মুনযির বিন যুবাইর তাকে সম্বোদন করে বললেন: আজ তোমরা তিনজন বাড়ি ফিরতে বড্ড দেরি করলে। কারণ কী? কোথাও কোনো সমস্যা হয়নি তো?
– মা’আয ওখানে একটি পাথরের উপর বসে গেল। তার দেখাদেখি নাবিল এবং বাসিতও বসে পড়ল। মুনযির বিন যুবাইর যেখানে বসা ছিলেন সেখানে বসে পড়লেন।
– সবাই বসে গেলে মা’আয বলতে শুরু করলো চাচা! আমরা হাসান ক্রুসুর দাদুর কবরে গিয়েছিলাম। তাঁর কবরের চারপাশে খুশবুদার ফুলের চারা লাগিয়ে এসেছি। এতে ফিরতে একটু দেরি হয়েছি। চাচা! আগে যেমন প্রত্যহ আমরা জাবির বিন মুগীসকে সেবা শুশ্রূষা দেয়ার জন্য যেতাম, এখন তেমনিভাবে প্রতিদিন তাঁর কবরে ফাতেহা পড়তে এবং কবরে লাগানো ফুলের চারাগুলোর যত্ন নেয়ার জন্যে যাব।
– এইটুকু বলে মা’আয একটু থামলো এরপর চেহারায় গোলাবের ফুল্লতা ফুটিয়ে বলতে লাগলো: চাচা! আমাদের কাছে কিন্তু একটি খুশখবরি রয়েছে।
– মুনযির বিন যুবাইর মুচকি হেসে মা’আযের দিকে তাকিয়ে বললেন:
– বেটি! আমার জন্যে সবচেয়ে বড় খুশখবরি তো হচ্ছে আমি আজ তোমাকে হেসে কথা বলতে দেখতে পাচ্ছি। তোমাকে আগের মতো অনেকটা প্রাণবন্ত দেখাচ্ছে। আচ্ছা মা! তোমার খুশখবরিটি কী বলো!
– চাচা! সাহিল এলাকার কতিপয় মাল্লার কাছ থেকে জানতে পেরেছি, গত রাতে হাসান ক্রুসু আর কাকাদদের নৌবহরটা আমাদের উপকুল অতিক্রম করে পূর্ব দিকে এগিয়ে গেছে। তাঁরা যে অভিযানে বেরিয়েছিলেন তাতে শতভাগ কামিয়াব হয়েছেন। নয়া দুনিয়া থেকে আগত সবগুলো জাহাজ কব্জা করে তাঁরা সেগুলো নিয়ে পূর্ব দিকে চলে গেছেন।
– মা’আয কথা বলে নীরব হতেই মুনযির বিন যুবাইর গম্ভীর হয়ে উঠলেন। বললেন:
– বেটি! তুমি সত্যি একটা সুসংবাদ শুনিয়েছ। কিন্তু আমার কাছে রয়েছে একটা দুঃসংবাদ।
– মা’আয পেরেশান হয়ে উঠল। বলল: কী দুঃসংবাদ চাচা?
– বেটি এই যে ফারদিশ নদীর কিনারে রাহিবদের খানকা দেখতে পাচ্ছ ————- মুনযির বিন যুবাইর তাঁর কথাটা পূর্ণ করতে পারলেন না। মা’আয তাঁর কথাটা মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে বলে উঠল হ্যাঁ চাচা! অনেক দিন ধরে এ ব্যাপারে আপনাকে জিজ্ঞেস করবো করবো করে করা হয়নি। এ খানকাগুলোতে কেমন রাহিবরা থাকেন। আমাদের হাসান ক্রুসু এদিকে আসলে তো ওখানেই থাকেন।
– মুনযির বিন যুবাইরের চেহারায় রহস্যভরা মৃদু হাসি খেলে গেল। তিনি বলতে লাগলেন:
– বেটি! মা’আয ও নাবিল! কারো কাছে জীবনের বিনিময়ে হলেও এ রহস্যটা উদ্ঘাটন করতে যেও না। এ রহস্যের সাথে কিন্তু জাতির অস্তিত্ব নির্ভরশীল। শুনো! খানকাগুলোতে যে রাহিবরা থাকেন ওদের একজনও নাসারা নন। এরা সবাই মিল্লাতের অতন্দ্র প্রহরী মুসলমান। এরা কওমের কল্যাণের লক্ষেই এ ছদ্মবেশ ধরেছেন। দিনের বেলা নাসরানিয়াতের মিশন নিয়ে পুরো ওয়াদি জুড়ে ঘোরাফেরা করে মুসলমানদের স্বার্থের বিপরীতে যা হচ্ছে তার খুঁজখবর নেন। এরপর এগুলোকে সাধ্যের শেষ চেষ্টা করে তাঁরা সেগুলো দূরিভূত করেন।
– আমি যে দুঃসংবাদের কথা বলতে যাচ্ছিলাম তা ঐ বিশ্বস্ত রাহিবদের সূত্রেই পাওয়া। তাঁরা আমাকে জানিয়েছেন, গ্রানাডার প্রশাসন আলবাশারাতে ব্যাপারে একটা সাংঘাতিক পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে।
– ইতোপূর্বে স্পেনের যেসব এলাকায় মুসলমানদের সংখ্যা বেশি ছিল সে সব এলাকায় রাহিবদের ইহতেসাবী আদালত বসানো হয়েছিল। ওসব আদালতে নিরপরাধ মুসলমানকে ধরে নিয়ে গোনাহ স্বীকার করতে বাধ্য করা হতো। এরপর তাদের উপর ভারি অংকের জরিমানা আরোপ করা হতো। জরিমানা আদায়ে ব্যর্থ হলে হয় তাদেরকে আদালতের জিন্দানখানায় পাঠিয়ে দেয়া হতো নতুবা তাঁদেরকে নাসরানিয়াত কবুল করতে বাধ্য করা হতো। এখন শুনা যাচ্ছে গ্রানাডার সরকার ঐ সব ইহতেসাবী আদালতের বৃত্ত বাড়িয়ে নিতে চলেছে। আলবাশারাত ওয়াদিতেও তারা অনুরূপ কয়েকটা আদালত প্রতিষ্ঠা করতে বদ্ধ পরিকর। স্পেন সম্রাট চার্লস যে ধরণের উগ্র সাম্প্রদায়িক ব্যক্তি, তাতে সংবাদটিকে উড়ো খবর বলে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছে না। আমার ধারণা— অবশ্যই তারা এ প্রয়াস চালাবে। আর এমনটি হলে এ ওয়াদিতেও জোরপূর্বক নাসারাকরণ প্রক্রিয়া চালু হয়ে যাবে।
– মা’আয গভীর চিন্তিত কন্ঠে বলল: ওরা এমনটি করলে পরিস্থিতি কেমন হবে বলে আপনার ধারণা?
– মুনযির বিন যুবাইর কিছুটা ভেবে নিয়ে বললেন: শুন মা! অতীতেও বার কয়েক তারা এমন প্রয়াস চালিয়েছিল। কিন্তু প্রতিবারই তাদের সে প্রয়াস ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। একবারতো এমনটা করতে গেলে এখানে ভয়ঙ্কর বিদ্রোহ জেগে উঠেছিল। যে বিদ্রোহ হিস্পানীয় সরকারের তখতে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছিল। ফলে তারা পিছু হটে আলবাশারাতকে তার অবস্থানেই রেখে দিয়েছিল। আমার ধারণা— এমনটি করতে গেলেও এবারও এখানে বিদ্রোহের ভয়াবহ আগুন জ্বলে উঠবে।
– চিন্তায় মা’আযের ঘাড় ঝুকে পড়ল। সে সাথে সাথে কোনো কথা বলতে পারলনা। খানিকটা ভেবে নিয়ে সে ইবনে যুবাইরকে প্রশ্ন করল:
– চাচা! আমরা কেবল সে বিদ্রোহের কথা শুনেছি। পুরো ইতিহাস জানি না। আপনি কি অনুগ্রহ করে সে ইতিহাসের সারাংশটা বলবেন?
– অবশ্যই বলবো মা! আমার জন্যে যেমন বলা উচিত, তোমাদের জন্যেও সেটা জেনে রাখা উচিত।
– শুনো বেটিরা! সে দাস্তান বড়ই বেদনার, বড়ই মর্মন্তুদ। যদিও সেই বেদনার দাস্তান আমার পক্ষে পরিপূর্ণরূপে চিত্রায়িত করা অসম্ভব, তথাপি আমি যথাসম্ভব সংক্ষেপে তোমাদের কাছে পুরো দাসতানটাই তুলে ধরছি।
– গ্রানাডার আখেরি শাসক সুলতান আবু আব্দিল্লার যুগ থেকেই আন্দালুসিয়ার মুসলমানদের দুর্ভাগ্যের সূচনা।
– সবদিক থেকে হাত গুটিয়ে সুলতান তখন গ্রানাডায় অবরুদ্ধ। দীর্ঘ অবরোধ সুলতানকে নিরাশ ও অতিষ্ট করে তুলেছিল। সুলতান একসময় সিদ্ধান্ত নিয়ে নিলেন গ্রানাডা শহরের চাবি তিনি ফার্দিনান্দের হাতে তুলে দেবেন। আর সে সিদ্ধান্তটাই ছিল মুসলিম আন্দালুসিয়ার মুসলমানদের জন্য বহুমুখি মুসিবতের উৎস।
– গ্রানাডার মুসলমানরা যে সব শর্তের ভিত্তিতে ফার্দিনান্দের আনুগত্য কবুল করে নিয়েছিল সে শর্তগুলো তেমন কঠিন ছিল না।
– চুক্তি উত্তর গ্রানাডার পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছিল আন্দালুসিয়ার ক্যাথোলিক শাসক মুসলমানদের ধর্মীয় ব্যাপারে তেমন কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। আন্দালুসিয়ার আখেরি তাজদার আবু আব্দিল্লাহ আর নাসরানি বাদশাহর মধ্যে গ্রানাডা হস্তান্তরের ব্যাপারে যে চুক্তি সম্পাদন হয়েছিল তাতে পঞ্চাশটির মতো শর্ত ছিল। এ সব শর্তের ভিত্তিতে মুসলমানদের ইজ্জত আবরু, জান-মাল, ধর্মকর্ম সহ অনেক কিছুর পূর্ণ জামানত প্রদান করা হয়েছিল।
– কিন্তু অল্প দিন যেতে না যেতেই চুক্তির এক একটা শর্ত উদাও হয়ে যেতে লাগলো। নাসারাদের মানবিক জযবা তখন পর্যন্ত প্রশমিত হতে পারছিল না যাবৎ না তারা আন্দালুসিয়া থেকে মুসলমানদের শেষ চিহ্নটুকুও মিটিয়ে ফেলতে পারে।
– মুনযির বিন যুবাইর একটু বিরতী নিলেন। এরপর বিষন্ন কন্ঠে বলতে লাগলেন:
– গ্রানাডার মুসলমান আর নাসরানি সরকারের মধ্যে যে চুক্তি সম্পাদন হয়েছিল তা কতকটা ছিল নিম্নরূপ:
* মুসলমান সে ধনী হোক কিংবা দরিদ্র, তাঁদের জান-মালের কোনো ক্ষতি করা যাবে না। তাঁরা শহরের ভেতরে বা বাইরে যেখানেই বসবাস করতে চাইবেন সেখানে বসবাসের অনুমতি থাকতে হবে।
* মুসলমানদের ধর্মীয় বিষয়াদিতে নাসরানিরা কোনো প্রকার নাক গলাতে পারবে না।
* কোনো নাসারা মুসলমানদের ইবাদতখানা মসজিদে প্রবেশ করতে পারবে না।
* মসজিদ এবং ওয়াক সম্পত্তিতে নাসারারা হস্তক্ষেপ করতে পারবে না, বরং এগুলোকে তার অবস্থানে টিকিয়ে রাখতে প্রশাসন মুসলমানদের সহযোগিতা করে যাবে।
* মুসলমানদের সামাজিক ও ধর্মীয় বিষয়াদি তাঁদের শরীয়তের আলোকে নিষ্পত্তি হবে। সামাজিক সমস্যাদিতে মুসলিম কাজিরা পৃথক আদালতে তা সমাধান করবেন।
* লড়াইয়ে যে সব মুসলমানকে বন্দী করা হয়েছে তাদেরকে তাৎক্ষণিকভাবে মুক্তি দিয়ে দিতে হবে। আর ইতোপূর্বে যে সব কয়েদি পালিয়ে এসে গ্রানাডায় আশ্রয় নিয়েছিল তাঁদেরকে পুনরায় গ্রেফতার করা যাবে না।
* যদি কোনো মুসলমান এখান থেকে হিজরত করে আফ্রিকা বা অন্য কোথাও যেতে চায় তাহলে তাঁদেরকে বাঁধা দেয়া যাবে না।
* যে সমস্ত নাসারা মুসলমান হয়েছেন তাদেরকে ইসলাম ত্যাগে বাধ্য করা যাবে না।
* যদি কোনো মুসলমান স্বেচ্ছায় নাসরানিয়াত কবুল করতে চায় তাহলে সে অধিকার তাদের থাকবে।
* লড়াই চলাকালে মুসলমানদের হাতে যেসব মালে গনিমত পৌঁছেছে, সেগুলো ছিনিয়ে নেয়া যাবে না।
* মুসলমানদের ঘরে, তাদের ইবাদতখানা ও প্রতিষ্ঠান সমূহে কোনো নাসরানি সৈন্য মোতায়েন করা যাবে না।
* মুসলমানদের উপর নতুন কোনো ট্যাক্স আরোপ করা যাবে না।
– আমার সন্তানরা শুনো! শর্তগুলো তেমন খারাপ ছিল না। এগুলোতে মুসলমানদের তাঁদের পৃথক বৈশিষ্ট নিয়ে বসবাসের নিশ্চয়তা ছিল। তাছাড়া তখনকার সময়ে হিস্পানিয়ার আর্ক বিশপ তথা সর্বোচ্চ ধর্মগুরু একজন গুণি ব্যক্তি ও স্বাধীনচেতা বিবেকমান মানুষ ছিলেন। তিনি কাউকে জোরপূর্বক নাসারা বানিয়ে নেয়ার পক্ষে ছিলেন না। তিনি দীলের গভীর থেকেই মুসলিম অধিকারগুলোকে শ্রদ্ধা করতেন। কিন্তু মুসলমানদের দুর্ভাগ্য সত্তরই তার ডেপুটি হিসেবে মানবরুপী এমন এক হিংস্র হায়েনাকে নিয়োগ দেয়া হয় যার ফলে আর্ক বিশপের সব চাওয়া ব্যর্থতায় বদলে যায়।
– হিংস্র চরিত্রের এ লোকটা ছিল মুসলমানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ব্যাপারে অত্যুৎসাহী। মুসলমানদের ক্ষতিই ছিল তাদের জীবনের একমাত্র চাওয়া। সেই হিংস্র পশুটার নাম ছিল জিমি নাস।
– মানবতার শত্রু জিমি নামক পশুটি ধর্মীয় উন্মাদনা জাগিয়ে রাজশক্তিতে এ ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণে উৎসাহী করে তুলে যে, মুসলমানদের সাথে যে সব ওয়াদা করা হয়েছে ওগুলো পিছনে পেছনে ফেলে স্পেনে বসবাসরত সবাইকে ঈসা মাসিহের ধর্মের অনুসারি বানিয়ে নেয়া উচিত। জবরদস্তিমূলকভাবে হলেও এ নেক কাজে পিছিয়ে থাকার কোনো অবকাশ নেই। যদি কোনো মুসলমান নাসরানিয়াত গ্রহণ করতে না চায় তাহলে তাদেরকে কঠোর শাস্তি প্রদান করা হোক।

আরও পড়ুন : সমুদ্র ঈগল-১৯

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...