আল্লামা মুফতি তকী উছমানী
কিছুদিন আগে ওলামায়ে কেরামের সাথে উযবেকিস্তানের সফর হয়েছে। কিছু বন্ধু সে সফরের কারগুযারী শোনানোর অনুরোধ করলেন। আমারও মনে হল যে, এ সফরে আল্লাহ তাআলা অনেক শিক্ষণীয় বিষয় দান করেছেন, যা আলোচনা করা আমাদের সবার জন্য ফায়েদাজনক হতে পারে। তাই এখন এ বিষয়ে কিছু আলোচনা করার ইচ্ছা করেছি।
উযবেকিস্তান দীর্ঘ দিন যাবৎ রাশিয়ার আগ্রাসনের শিকার ছিল। অল্প কিছু দিন পূর্বে তা স্বাধীন হয়েছে। সে সময় পরিস্থিতি এত কঠিন ছিল যে, কোনোদিন এই সব স্থান দেখার সুযোগ হবে তা ছিল কল্পনারও অতীত। অথচ এই ভূখণ্ডই একদিন ইসলাম ও ইসলামী উলূমের মারকায ছিল। আপনারা হয়তো বুখারা-সমরকন্দের নাম শুনেছেন। এই দুই বিখ্যাত শহরে মুসলিমজাহানের বহু নামজাদা মনীষী জন্মলাভ করেছেন। আপনারা ‘সিহাহ সিত্তা’র নাম শুনেছেন, যা হাদীস শরীফের সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সংকলন। আল্লাহ তাআলা এই গ্রন্থগুলোকে এমন মর্যাদা ও গ্রহণযোগ্যতা দান করেছেন যে, মুসলিমজাহানে এগুলোকে সর্বাধিক নির্ভরযোগ্যরূপে গ্রহণ করা হয়। কুদরতের আজীব কারিশমা যে, হাদীসের এই ছয় ইমামের কেউই আরবে জন্ম গ্রহণ করেননি। তাঁরা সবাই ছিলেন অনারব এবং এই ভূখণ্ডের অধিবাসী। ইমাম বুখারী রাহ. যাঁর সংকলিত হাদীসগ্রন্থ ‘সহীহ বুখারী’ সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, আল্লাহর কিতাবের পর এটিই সর্বাধিক বিশুদ্ধ কিতাব, তাঁর জন্মও বুখারায়। এজন্য তাকে বুখারী বলা হয়। তাঁর ইন্তেকালও হয়েছে সমরকন্দের নিকটবর্তী একটি ছোট্ট গ্রামে। গোটা জীবন হাদীস শরীফের চর্চায় কাটিয়ে দিয়েছেন। নিজ মাতৃভূমি ছেড়ে ইরাক, হিজায, শাম সফর করেছেন। কত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যেও হাদীস অন্বেষণ অব্যাহত রেখেছেন তা একটি দৃষ্টান্ত থেকে বোঝা যাবে। ইমাম বুখারী রাহ. এক শায়খের নিকট হাজির হলেন। তিনি সম্ভবত বাগদাদের একজন মুহাদ্দিস ছিলেন। একদিন শায়খ দেখলেন, মুহাম্মাদ ইবনে ইসমাঈল (ইমাম বুখারী) দরসে অনুপস্থিত। এমন অনেক ছাত্র থাকে যারা কখনো দরসে থাকে, কখনো থাকে না। কিন্তু ইমাম বুখারী ওই সকল তালিবে ইলমের অন্তর্ভুক্ত ছিলেন যারা সময়ের আগেই দরসে উপস্থিত হয় এবং সর্বদা সামনের সারিতে থাকে। যাদের অনুপস্থিতি উস্তাদ কল্পনাও করতে পারেন না। তো হঠাৎ একদিন তাকে অনুপস্থিত দেখে উস্তাদ ভাবলেন, হয়তো কোনো অসুবিধা হয়েছে। পরের দিন শায়খ দরসে এসে দেখলেন, আজও তিনি অনুপস্থিত। শায়খ চিন্তিত হলেন সে কি অসুস্থ হয়ে পড়েছে কিংবা অন্য কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছে! সে তো না আসার মতো ছাত্র নয়। তো শায়খ একজনকে পাঠালেন, খোঁজ নাও সে কেন দরসে আসছে না। মসজিদের নিকটে একটি ছোট হুজরায় ইমাম বুখারী থাকতেন। সেই তালিবে ইলম গিয়ে দরজায় কড়া নাড়ল। ভিতর থেকে আওয়াজ এল, কে? কেন এসেছেন? সেই তালিবে ইলম বলল, একটু বাইরে আসুন, শায়খ আমাকে আপনার কাছে পাঠিয়েছেন। ইমাম বুখারী বললেন, ভাই! আমি বাইরে আসতে অপারগ। আপনি ওখান থেকেই বলুন কেন এসেছেন? আগন্তুক বললেন, আপনি কেন দরসে আসছেন না? আপনি যদি অসুস্থ হয়ে থাকেন তাহলে আমরা আপনার সেবা-শুশ্রূষা করব। অন্য কোনো সমস্যা থাকলে তা দূর করার চেষ্টা করব। আপনার অনুপস্থিতির কারণে শায়খ অত্যন্ত উদ্বিগ্ন হয়েছেন। তার বারংবার পীড়াপীড়ির পর ইমাম বুখারী বললেন, পরিধানের একটি মাত্র কাপড় ছিল যা ধুয়ে ধুয়ে পরিধান করতাম। কিন্তু এখন তা বিভিন্ন জায়গায় এতই ছিড়ে গিয়েছে যে, সতর আবৃত রাখা সম্ভব নয়। তাই আমি অপারগ হয়ে ঘরে বসে আছি।
চিন্তা করুন, কী অবস্থার মধ্য দিয়ে ইমাম বুখারী ইলম হাসিল করেছেন। এমনি এমনি ইমাম বুখারী হওয়া যায় না এবং এমনি এমনি জগৎ কাউকে ইমাম ও মুকাতাদা হিসেবে গ্রহণ করে না।
আজ আমাদের সামনে তৈরি-রুটির মতো হাদীসের কিতাবসমূহ বিদ্যমান। কত আরামে বসে হাদীস পড়ছি ও শুনছি। অথচ মুহাদ্দিসগণ এক একটি হাদীস অর্জনের জন্য যে ত্যাগ ও কুরবানী স্বীকার করেছেন তা চিন্তা করলেও অভিভূত হয়ে যেতে হয়। এভাবে ইলম হাসিল করার পর ইমাম বুখারী নিজ দেশ বুখারায় ফিরে যান। সেখানে একটি মাদরাসা আছে ‘মীরে আরব’ নামে, আজো বিদ্যমান রয়েছে। সে মাদরাসা যিয়ারতের সৌভাগ্য আমার হয়েছে। ওই মাদরাসায় তিনি তাঁর সংকলিত হাদীসগ্রন্থ আলজামিউস সহীহ লিপিবদ্ধ করিয়েছেন। সে যুগে ছাপাখানা ছিল না যে, কিতাব ছাপা হয়ে সবখানে ছড়িয়ে যাবে। তখন উস্তাদ হাদীস লেখাতেন, আর তালিবে ইলমরা তা লিপিবদ্ধ করত। এভাবে সেই মাদরাসায় ইমাম বুখারী রাহ. সহীহ বুখারীর নব্বই হাজার কপি লিখিয়েছেন।
এখন তো লাউড স্পীকারের যুগ। কিছু লোক উপস্থিত হলেই লাউড স্পীকার প্রয়োজন হয়। অথচ সে যুগে মুহাদ্দিসীনে কেরামের এক এক দরসে তালিবে ইলমের সংখ্যা এত বেশি হত, যা আজ বড় বড় সমাবেশেও হয় না। এক মুহাদ্দিস সম্পর্কে লিখেছে যে, তাঁর এক দরসে পনের হাজার দোয়াত-কলম গণনা করা হয়েছে। অর্থাৎ হাদীস লিপিবদ্ধকারী তালিবে ইলম ছিল এই পরিমাণ। আর যারা শুধু হাদীস শোনার জন্য উপস্থিত হয়েছিলেন তাদের সংখ্যা এর বাইরে।
হযরত ইমাম আলী ইবনুল মাদীনী রাহ. যিনি অনেক বড় মুহাদ্দিস ছিলেন, তাঁর দরস সকালে ইশরাকের পর শুরু হত। দরসে শরীক হওয়ার জন্য লোকেরা আগের দিন আসরের সময় গিয়ে জায়গা দখল করত।
এই বিপুল সমাবেশে দরস এভাবে হত যে, উস্তাদ সনদের একটি শব্দ বা হাদীসের একটি বাক্য বলতেন, যতদূর আওয়াজ যেত সবাই লিখত। এরপর একজন দাঁড়িয়ে উচ্চ স্বরে পুনরায় ওই শব্দ বা বাক্যটি বলত। যতদূর আওয়াজ যেত, তার শেষ মাথায় আরেকজন দাঁড়িয়ে উস্তাদের ওই শব্দ উচ্চারণ করত।
মাসিক আল-কাউসারের সৌজন্যে