ইমরান আহমাদ
আলমুত। বর্তমান ইরানের কাযভীন শহর থেকে ১০২ কিলোমিটারের দূরত্বে একটি পাহাড়ী শহর। সেখানে তখন সেলজুক শাসন চলছে। কাস্পিয়ান হ্রদের তীরে, আলবুর্জ পর্বতমালার কোলে অবস্থিত এ শহরকে ঘিরেই দানা বেঁধে উঠেছিল বিরাট এক ফিতনা—হাশাশিনদের উপদ্রব। ইতিহাসে যারা এসাসিন নামে কুখ্যাত। মুসলিম ইতিহাসে এরা বাতিনী, ইসমাঈলী, ফেদাইন (গুপ্তঘাতক) নামেও পরিচিত। এই কুচক্রের জন্মদাতা হচ্ছে, ইসমাঈলী শীয়া—কুলাঙ্গার হাসান বিন সাবাহ [১০৫০-১১২৪]। সর্বশেষ খাওয়ারিজম শাহ জালালউদ্দিন অতঃপর হালাকু খানের হাতে চুড়ান্ত নিশ্চিহ্ন হবার আগ পর্যন্ত পারস্যের এই হাশাশিনরা প্রায় দেড়শ’ বছর ধরে দুনিয়ার ত্রাস হয়েই টিকে ছিল। বিশেষত ইসলামী বিশ্বের জন্য এরা ছিল গলার কাঁটা। এরা যাকে চাইতো নির্ধিদ্বায় খুন করে ফেলতো। হোক সে সুলতান বা দেশের প্রধানমন্ত্রী। এদের পক্ষে অসম্ভব ছিল না কিছুই। এদের দৌরাত্ম্যে ইসলামী দুনিয়া বহুকাল চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভোগেছে। যুগে যুগে মুসলিম বিশ্বের শত শত মনীষী এদের অসহায় শিকারে পরিণত হয়েছেন। সেলজুক সালতানাতের কিংবদন্তিতূল্য উজীরে আজম নিযামুল মুলক, সুলতান মুহাম্মাদ ঘোরী এদের হাতেই নিহত হন। এমনকি সেলজুক সালতানাতের সর্বশ্রেষ্ঠ সুলতান মালিক শাহকেও এরা একাধিকবার হত্যার চেষ্টা করেছে। কথিত আছে, অবশেষে এই কুচক্রিরাই তাকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করেছে। ইমাম রাযি, গাজ্জালীসহ অনেক মুসলিম মনিষীই এদের হাতে নিগৃহীত হন। এমনকি সালাহউদ্দিন আইয়ূবী, নূরুদ্দিন জঙ্গীদের ওপরও এরা বারবার আঘাত হেনেছে। ততোদিনে গুপ্তহত্যাকে এরা একটা শিল্পের পর্যায়ে নিয়ে গেছে। এরা এতোটাই শক্তিশালী হয়ে ওঠেছিল যে, সেলজুকরা সর্বশক্তি দিয়ে পরপর দু’বার সেনা অভিযান চালিয়েও এদের উচ্ছেদে ব্যর্থ হয়। ফলে সেলজুক সালতানাতের মধ্যেই এরা আরো একটি সমান্তরাল রাষ্ট্র কাঠামো গড়ে তুলেছিল। শেষদিকে এরা এমনই বেপরোয়া হয়ে ওঠেছিল যে, এদেরকে রুখার সাধ্য কার্যত কোন মুসলিম রাজ্যের ছিল না। আলমুতের অজেয় প্রধান দু্র্গ ঘিরে কালক্রমে এরা আরো চল্লিশটি মজবুত কেল্লা গড়ে তুলে। এদের আরো একটি দুর্গম আখড়া ছিল ভূমধ্যসাগরের পূর্ব তীরে এন্টিয়ক-ত্রিপলির মাঝামাঝি ভূখণ্ডে। শামের পশ্চিমে মাসইয়াফ কেন্দ্রিক তাদের ঊনিশটি দুর্গের সে আখড়াও ছিল চরম দুর্লঙ্ঘ। বাইবার্সের হাতে বিধ্বস্ত হবার আগে কোন মুসলিম সুলতানই সেখানে অভিযান চালাতে সাহস করেননি। অতিষ্ঠ হয়ে সালাহউদ্দিন আইয়ূবী একবার এদেরকে অবরুদ্ধ করলেও গুপ্তঘাতক নেতা রশীদউদ্দিন সিনানের পাল্টা হুমকিতে অবরোধ প্রত্যাহার করে নেন। ফলে মোঙ্গল ও ক্রুসেডারদের বাইরে এরা মুসলিম বিশ্বের তৃতীয় কঠিন শত্রুতে পরিণত হয়।
❏
১২৪০ সাল। কায়রো। ক্ষয়িষ্ণু আইয়ূবী সালতানাতের তখতে আসীন হন সুলতান আস্ সালিহ। সালাহউদ্দিন পরবর্তী অথর্ব আইয়ূবী শাসকদের মধ্য তিনিই ছিলেন উজ্জ্বল ব্যতিক্রম। রাজ্যাভিষেকের পরপরই তিনি ফেদাইনদের তরফে চরম নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করেন। তাই নিয়মিত দেহরক্ষীদের বাইরে তিনি আলাদা একটা স্পেশাল গার্ড ফোর্স গঠনে উদ্যোগী হন। গুপ্তঘাতকদের রোখার জন্য কিপচাক উপত্যকা থেকে দাস হিসেবে কিনে আনা কুমান ও অন্যান্য তুর্কী গোত্রের মামলুকদের নিজ দেহরক্ষী হিসাবে নিয়োগ দেন। কারণ, আইয়ূবী বাহিনীর সকল সেনাদের মধ্য এরা ছিল অত্যধিক কর্মঠ, তেজস্বী ও নিষ্ঠাবান। সুলতানের নির্দেশে কায়রোর অদূরে নীলনদের বুকে জেগে ওঠা আর রাওদাহ্ দ্বীপে এদের জন্য আলাদা সেনানিবাস নির্মিত হয়। বাছাই করা সাতশ’ মামলুককে পাঠানো হলো দ্বীপ সেনানিবাসে। সুলতান আস্ সালিহ এই সাতশ’ মামলুককে দিলেন কঠোরতম প্রশিক্ষণ। কারণ, এরাই হবে তার দেহরক্ষী। সেনাবাহিনীর শ্রেষ্ঠতম রেজিমেন্ট। যেহেতু এদেরকে দাস হিসেবে কিনে আনা হয়েছিল, এজন্যে এদেরকে মামলুক বলা হতো। এবার দ্বীপবাসী হওয়ায় ইতিহাসে এরাই বাহ্রী মামলুক নামে পরিচিতি লাভ করে। ১২৪২ সালে মাত্র উনিশ বছর বয়সে সেরা সাতশ’ জনের একজন মনোনীত হয়ে বাইবার্স এই রাওদাহ সেনানিবাসে আসলেন। তরুণ বয়সেই হয়ে গেলেন আইয়ূবী সেনাবাহিনীর স্পেশাল ইউনিটের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য।
❏
৪ জুলাই। ১১৮৭। হাতিনের যুদ্ধে জেরুজালেমের রাজা গাই অব লুজিনান ও তৃতীয় রেমন্ডের সম্মিলিত বাহিনীর মুখোমুখি হন সালাহউদ্দিন আইয়ূবী। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ক্রুসেড সেনাবাহিনী প্রায় সম্পূর্ণরূপে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। ক্রুসেডারদের জন্য এ ছিল এক লজ্জাস্কর মহাবিপর্যয়। এ বিজয়ের পথ ধরেই টানা ৮৮ বছরের জবরদখলের হাত থেকে তিনি উদ্ধার করেন বাইতুল মুকাদ্দাস—জেরুজালেম।
কিন্তু আফসুস! উদ্ধারের মাত্র ৪২ বছরের মাথায় ১২২৯ সালে তারই অযোগ্য ভাতিজা আল কামিল—রোমান সম্রাট ২য় ফ্রেডরিখের বন্ধুত্ব ও আভ্যন্তরীণ গৃহযুদ্ধে আল কামিলকে পূর্ণ সাহায্যের শর্তে বাইতুল মুকাদ্দাসকে ক্রুসেডারদের হাতে তুলে দেয়। আল কামিল এভাবেই ইসলামের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ফ্রেডরিখের বন্ধুতে পরিণত হন। আর এভাবেই পবিত্র নগরী আবারো খৃস্টানদের অধিনস্ত হয়। পনেরো বছর পর আল কামিলের এই অপরিণামদর্শী আঁতাতের প্রতিবিধানে এগিয়ে আসেন সুলতান আস্ সালিহ!
❏
১২১৯ সাল। বিশাল বিস্তৃত খাওয়ারিজম সাম্রাজ্য। মেসোপটেমিয়া, পারস্য আফগানিস্তান সহ পুরো মধ্য এশিয়া এ সাম্রাজ্যের অধীনে। অর্থ, যশ আর সামরিক শক্তিতে তৎকালীন বিশ্বসেরা। হঠাৎ করেই খাওয়ারিজমের আকাশে দেখা দিল দুর্যোগের ঘনঘটা। দু’লাখেরও বেশি সৈন্য নিয়ে মোঙ্গল সম্রাট চেঙ্গিস খান একদিন ঢুকে পড়লেন খাওয়ারিজম সাম্রাজ্যে। বুখারা, সমরকন্দ, তিরমিযসহ চোখের পলকে একে একে অন্যান্য শহরগুলিও ধ্বংসস্তুপে পরিণত করলেন তিনি। বীর কেশরি শাহজাদা জামালউদ্দিন বারবার আবেদন করেও কার্যকর প্রতিরোধ যুদ্ধের অনুমোদন পাননি। না হলে ইতিহাস হয়তো অন্যভাবেই লেখা হতো। তাই কয়েক লাখ সৈন্য থাকার পরেও সুলতান আলাউদ্দিনের কাপুরুষতা ও অদূরদর্শিতার কারণে পুরো সাম্রাজ্য হজম করে নিল মোঙ্গলরা। সেখানে চললো কিয়ামতেে বিভীষিকা। সবগুলি বাড়ি-স্থাপনা মাটির সাথে মিশিয়ে দেয়া হল। নারী-পুরুষ-শিশুসহ প্রায় সবাইকে নির্বিচারে হত্যা করা হল। অঘোরে মারা পড়লো দোর্দণ্ড প্রতাপশালী একটা সেনাবাহিনীর অধিকাংশ সদস্য। মুষ্টিমেয় যে ক’জন বাঁচলো; তারা এসে আশ্রয় নিল মিসর ভিত্তিক আইয়ূবীয় সালতানাতে। পরবর্তীতে এরাই হল পবিত্র ভূমি উদ্ধারের গর্বিত অংশীদার।
❏
১২৪৪ সাল। দ্বিতীয়বার বাইতুল মুকাদ্দাস হাতছাড়া হবার পনের বছর পর সুলতান আস্-সালিহ সেটি পূণরুদ্ধারের ঘোষণা দিলেন। তিনি ছিলেন ভিন্ন ধাতুতে গড়া। অনেকটাই সালাহউদ্দিন আইয়ূবীর ধাঁচে। তাই পূর্বসুরী অপদার্থ আল-কামিলের ক্ষমাহীন ঔদাসিন্যের প্রায়শ্চিত্য করতে তের হাজার সৈন্য নিয়ে জেরুজালেম অভিমুখে রওয়ানা হলেন। যাদের মধ্যে ছিল মোঙ্গল নির্মমতা থেকে পালিয়ে আসা ছয় হাজার খাওয়ারিজমী পদাতিক সৈন্য। চার হাজার অশ্বারোহী ও দু’হাজার বেদুইন যোদ্ধা। ঠিক পেছনেই চললো বাহ্রী মামলুকের একহাজার বিশেষ সৈন্য। বিস্ময়কর ভাবে, তাদের কমান্ড ছিল একুশ বছরের আনকোরা তরুণ বাইবার্সের হাতে। অসম সাহস, অসাধারণ রণকৌশল আর মামলুকদের ওপর তার অসম্ভব প্রভাবের কারণেই হয়তো জীবনের প্রথম যুদ্ধেই তার হাতে কমান্ডিং ছেড়ে দেয়া হয়।
❏
অবাক করা ব্যাপার হলো, এমন একটা যুদ্ধেও ক্রুসেডারদের সাথে হাত মেলালো হিমস, হলব ও ক্রাকের আইয়্যূবী যুবরাজরা। কিন্তু বিশ হাজার সৈন্যের নামধারী মুসলিম ও ক্রুসেডারদের সম্মিলিত এ বাহিনী জেরুজালেম না গিয়ে ধূর্ততা বশতঃ ঘোরপথে মা’ন-এ গিয়ে জড়ো হলো। উদ্দেশ্য, অন্তিম মুহুর্তে আচমকা পেছন থেকে অবরোধকারী মুসলিম বাহিনীকে আক্রমণ করে পরাস্ত করা। ক্রুসেডারদের এ পরিকল্পনার বিন্দু বিসর্গও সুলতান সালিহ জানতেন না।
এদিকে ভিন্নপথে এগুবার জন্য বাইবার্স পথিমধ্যেই মূল বাহিনী থেকে আলাদা হয়ে যান। বাইবার্সের ইচ্ছা, ভিন্নপথে বাইতুল মুকাদ্দাসে হাজির হয়ে শত্রুদের তাক লাগিয়ে দেওয়া এবং কঠিন মুহুর্তে ফয়সালা মূলক লড়াইয়ে হঠাৎ ঝাপিয়ে পড়া। দুর্ধর্ষ বাইবার্স তাই বিপদসংকুল নেভেগ মরুভূমির বুক দিয়েই রওয়ানা হন। মা’ন এর কাছাকাছি পৌছলে তিনি শত্রুসেনার উপস্থিতি টের পান। ব্যাপক খোঁজ নিয়ে এদের পরিচয় ও উদ্দেশ্য জেনে গেলেন। এবার একটা দফারফা করেই সামনে আগানোর সিদ্ধান্ত নিলেন। কিন্তু মুশকিল হলো, প্রতিপক্ষের চেয়ে তার সৈন্য একেবারেই নগণ্য, সীমাহীন অপ্রতুল। কিন্তু কিশোর বাইবার্স ছেড়ে দেওয়ার পাত্র ছিলেন না। মাত্র একহাজার সৈন্য নিয়েই আচমকা নেগেভের বুক চিড়ে চিতার মতো বিশ হাজার সৈন্যর শত্রু শিবিরে হামলে পড়লেন। পরিকল্পিত একটি মাত্র তীব্র আক্রমণ; আর তাতেই সব শেষ। অজান্তেই অনেকে মারা পড়লো। বাকিরা প্রস্তুত হবার আগেই ছিণ্নভিন্ন হয়ে গেলো। অভাবনীয় এ জয়ের ফলে সর্বাত্মক যুদ্ধের আগেই বাইতুল মুকাদ্দাস কার্যত বিজিত হয়ে গেলো।
❏
এখানেই থামলেন না বাইবার্স। সোজা ছুটে গেলেন জেরুজালেম অভিমুখে। সেখানে খাওয়ারিজম ও আইয়্যূবী বাহিনীর যৌথ আক্রমণে খৃস্টানদের অবস্থা তখন টালমাটাল। এগারো হাজার সৈন্য নিয়ে পূর্ব পরিকল্পনা মতো তারা শুধু মুসলিম বাহিনীকে ঠেকিয়ে রাখছিল। তারা মনেমনে আশা করছিল মা’ন এর সেই সম্মিলিত বাহিনীর। কিন্তু বাইবার্সের তোপের মুখে মা’ন এর বাহিনী যে ততক্ষণে অতীত ইতিহাস হয়ে গেছে, সে খবর কারো ছিল না। বাইবার্স এখানে এসেই তার বিশেষ বাহ্রী মামলুক বাহিনী নিয়ে এমন প্রচণ্ড আক্রমণ করলেন যে, জেরুজালেমের দুর্ভেদ্য প্রাচীরও তা সইতে পারলো না। সাথে সাথে ভেঙে পড়লো খৃস্টানদের সব প্রতিরোধ। পনেরো বছর পর পবিত্র নগরী বাইতুল মুকাদ্দাস আবার মুসলমানদের অধিকারে আসলো। অবসান ঘটলো খৃস্টান জোচ্চড়ির। যার প্রায় পুরো কৃতিত্বই বাইবার্সের। এতে করে তরুণ বয়সেই বাইবার্সের নাম গ্রেট সালাহউদ্দিনের সাথে উচ্চারিত হতে লাগলো। বাইতুল মুকাদ্দাসের দ্বিতীয় উদ্ধারকর্তা হওয়ায়, লোকমুখে তিনি হয়ে গেলেন দ্বিতীয় সালাহ্উদ্দিন। তাই ইতিহাসে এ যুদ্ধ যতোটা বাইতুল মুকাদ্দাসের কারণে স্মরণীয়; ততোটাই আলোচিত বাইবার্সের গৌরবদীপ্ত যুদ্ধাভিষেকের কল্যাণে। আসলেই তো এ যুদ্ধের মাধ্যমে মুসলমানরা যেমন বাইতুল মুকাদ্দাস ফিরে পেলো, তেমনি ক্রুসেড জন্ম দিল তার সর্বশ্রেষ্ঠ যোদ্ধাকে। আর ইসলামী ইতিহাস আবিস্কার করলো নতুন এক সেনানায়ক—রুকনুদ্দিন বাইবার্স। দ্য প্যান্থার।