শুক্রবার, ২৬শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ সকাল ৬:৪৬
Home / কওমি অঙ্গন / বড়দের সমালোচনা, তরুণ প্রজন্ম যাচ্ছে কোথায়?

বড়দের সমালোচনা, তরুণ প্রজন্ম যাচ্ছে কোথায়?

মুফতি রেজাউল কারীম আবরার :

দারুল উলূম দেওবন্দ। একটি চেতনার নাম। বৃটিশের নখরদন্তে যখন উপমহাদেশ কাতরাচ্ছে, তখন মুসলমানদের হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনার লক্ষে  কাসেম নানুতবী রহ. প্রতিষ্টা করেছিলেন দারুল উলূম দেওবন্দ। স্বপ্নযুগে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের নির্দেশপ্রাপ্ত হয়ে। শুরু হয়েছিল মোল্লা মাহমুদ এবং মাহমুদ হাসান দিয়ে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া একটি ডালিম গাছের নিচে! এরপর পত্র, পল্লবে বিস্তৃত হয়েছে দারুল উলূম। দারুল উলূমের প্রসবিত ফলে পরিতৃপ্ত হয়েছে পুরো পৃথিবী। বৃটিশও ছাড়তে বাধ্য হয়েছে উপমহাদেশ।

দেওবন্দ গতানুগতিক কোন শিক্ষা প্রতিষ্টানের নাম নয়। দেওবন্দ একটি বিপ্লবী চেতনার নাম। দেওবন্দি আলেমদের সব সময় ছিলো কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট। দারুল উলূম দেওবন্দ প্রতিষ্টা হওয়ার পর আকাবিরে দেওবন্দের বিরুদ্ধে আলেম নামধারী কিছু বিশ্রি লোককে লাগিয়ে দিয়েছিলো! ফতোয়া বাণে তারা জর্জরিত করেছে আকাবিরে দেওবন্দকে। ধেয়ে এসে আকাবিরের বিরুদ্ধে কুফরীর ফতোয়া! রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দুশমন হওয়ার ফতোয়া! কিন্তু আকাবিরে দেওবন্দ। তারাতো নববী ইলমের ধারক ও বাহক। জবাব দিয়েছেন বিনয়ের চূড়ান্ত পরাকাষ্টা প্রদর্শন করে। লোকটি তাঁদের চরম শত্রু। জায়গায় জায়গায় তাঁদের কুৎসা রচনা করে বেড়ায়! তারপরও আমাদের আকাবির তাঁর বিরুদ্ধে অযাচিত সমালোচনা করেননি। যেগুলো ইলমী বিশ্লেষণের অবকাশ রাখে, সেগুলো তারা জবাব দিয়েছেন ইলমী ধাচে। আদাবুল ইখতেলাফের প্রতি সজাগ দৃষ্টি রেখে। রশীদ আহমদ গাংগুহীর ‘আল বারাহিনুল ক্বাতিয়া’ থেকে আপনি শায়খুল ইসলাম তাকী উসমানীর ‘হযরত মুয়াবিয়া আওর তারিখি হাকায়িক’ পর্যন্ত আসেন, সকলেই প্রতিপক্ষের আপত্তির জবাব দিয়েছেন কুরআন, হাদীসের আলোকে শক্তভাবে। কিন্তু কারো বিপক্ষে ফতোয়ার হাট খুলে বসেননি। এজন্য আকাবিদের দেওবন্দের কিতাবাদিতে একথা পরিস্কারভাবে পাওয়া যায় যে, উলামায়ে দেওবন্দের একটি উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হলো: সুপ্রাজ্ঞ ভাষার অধিকারী হওয়া। এখানে আমি কয়েকজন আকাবিরের হাওয়ালা উল্লেখ করছি।

১৪০০ হিজরীতে দারুল উলূম দেওবন্দের শতবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্টিত হয়েছিল। সেখানে মুফাক্কিরে ইসলাম আল্লামা সায়্যিদ আবুল হাসান আলী নদভী রহ. একটি যুগান্তকারী বক্তব্য পেশ করেছিলেন। সে ভাষণে তিনি দেওবন্দের বৈশিষ্ট নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন: দেওবন্দের বৈশিষ্ট হল চারটি।

“এক: এ দরসগাহের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট হল সে মতনৈক্যকে পিছনে ফেলে তাওহীদ এবং সুন্নতের উপর নিজের দৃষ্টি রাখবে।আর এটা এমন ওয়রাছাত এবং আমানত, যা শাহ ওয়ালিউল্লাাহ মুহাদ্দিসে দেহলভী, শাহ ইসমাইল শহীদ এবং সায়্যিদ আহমদ শহীদ এর ওসীলায় এ প্রতিষ্টান পেয়েছে এবং এখন পর্যন্ত শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে আছে।

দুই: সুন্নাতের অনুসরণের জযবা এবং ফিকির থাকতে হবে।

তিন: আল্লাহর সাথে সম্পর্ক তৈরী করার ফিকির, যিকির এবং গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার জযবা থাকতে হবে।

চার: আল্লাহর কালেমা বুলন্দীর জযবা থাকতে হবে এবং চেষ্টা করতে হবে। এ চারটি শিরোনাম যার মধ্যে থাকবে, সে দেওবন্দি। যদি এর মধ্যে কোন একটি কমে যায়, তাহলে সে পূর্ণ দেওবন্দি নয়”। (কারওয়ানে জিন্দেগী, ৩/৩১০-৩১১)

এপ্রসঙ্গে কারী তায়্যিব সাহবে রহ. এর বক্তব্য অবশ্যই বেশ চমৎকার । তিনি বলেন: উলামায়ে দেওবন্দের গুণ হল ‘দিলে দরদমন্দ, ফিকরে আরজুমন্দ, যবানে হুশমন্দ’। অর্থাৎ তারা হবেন দরদী হৃদয়, সমুন্নত চিন্তা এবং সুপ্রাজ্ঞ ভাষার অধিকারী”।

এবিষয়ে শায়খুল ইসলাম তাকী উসমানী দা.বা. এর ছোট রেসালা “আকাবিরে দেওবন্দ কিয়া তে” অবশ্যই পাঠ করার মত একটি বই। আমাদের আকাবিরদের জীবনের বাকেঁবাঁকে ঘটে যাওয়া ঘটনা পড়ে চোখে অশ্রু চলে আসে! বুক ফুলিয়ে বলতে পারি যে, এরাই আমাদের পিতৃ পুরুষ। আমরা তাদের উত্তরসুরী।

আর আমরা! আকাবিরদের সেই ‘সুপ্রাজ্ঞ ভাষার অধিকার হওয়া’র গুণকে বানিয়ে ফেলেছি মানতিকের ‘আনকা’ পাখির মত। প্রতিপক্ষকেতো অন্যায়ভাবে ধুমড়ে মুচড়ে দেই! এখন আমাদের শব্দবাণ থেকে রক্ষা পাননা আকাবিররাও! আমার মতের সাথে না মিললেই  শুরু করি সমালোচনা। অথচ আমরা দেখতে পাই যে, বিভিন্ন ফিকহী মাসআলা নিয়ে আমাদের আকাবিরদের মাঝে মতভিন্নতা হয়েছে। একজন আরেকজনের জবাবে কিতাব লিখেছেন। উদাহরণ স্বরুপ আল্লামা ইউসুফ বানুরী রহ.  আল্লামা উবায়দুল্লাহ সিন্দী রহ. এর ‘যাল্লাত’ এর জবাবে পুস্তিকা রচনা করেছেন। আল্লামা সুলাইমান নদভী রহ. এর একটি ফতোয়ার বিরুদ্ধে মুফতী শফী রহ. কিতাব লিখেছিলেন। শায়খুল ইসলাম হুসাইন আহমদ মাদানী রহ.  এর একটি ফতোয়ার জবাব লিখেছেন শায়খুল ইসলাম তাকী উসমানী দা.বা.। কিন্তু তাঁদের আলোচনা পর্যালোচনায় ব্যক্তি কটাক্য ছিলোনা! ঈমান এবং দেওবন্দিয়ত নিয়ে ফতোয়া চালাচালি ছিলোনা।  একে অপরের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধাশীল ছিলেন।

পিতা এবং চাচার মাঝে কোন বিষয় নিয়ে মতভিন্নতা হতেই পারে। কিন্তু সেখানে আমি পিতার পক্ষ নিয়ে চাচাকে গালিগালাজ করতে পারিনা। কিন্তু বর্তমানের উঠতি তরুণ প্রজন্মের কাছে বিষয়টি দুঃখজনকভাবে হ্রাস পাচ্ছে! বড়দের মাঝে সর্বযুগে মতভিন্নতা ছিলো এবং থাকবে। কিন্তুৃ আগেরকার তরুণরা সবাইকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতো! কিন্তু বর্তমানে যিনি আমার দল বা মতের হবেন, তাঁর কথা আমরা চোখ বুঝে বিশ^াস করি। তিনি যদি রাতকে দিন বলেন, তাহলে আমরা দলীল দ্বারা প্রমাণের চেষ্টা করি যে, রাতকে দিন বলা ভুল না! আর যিনি আমার দলের না, অথবা কোন কারণে তাকে আমার ভালো লাগেনা, তখন আমি তাঁর পায়ের ধুলোর সমান না হলেও দেদারসে আমার মুখ এবং কলম থেকে ফতোয়া বের হতে থাকে। পৃথিবীতে সবচেয়ে সঙ্গীন ফতোয়া হলো নাস্তিক এবং মুরতাদের। এ প্রসঙ্গে কেউ যদি মুফতী শফী রহ. এর লিখিত ‘উসূলুত তাফকীর ফি উসূলিত তাকফীর’ অধ্যয়ন করেন, তাহলে বিষয়টি সহজেই অনুধাবন করতে পারেন। অথচ বর্তমানের ফেইসবুক প্রজন্ম প্রতিদিন কতজন আলেমকে কুফরের ফতোয়া দেয়! একবারও তাঁদের হৃদয়াত্বা কেঁপে উঠেনা যে কার বিরুদ্ধে আমি কুফরের ফতোয়া দিচ্ছি! যে মানুষটা সারা রাত নির্জনে কথা বলে আল্লাহর সাথে, তাঁর একটি বাহ্যিক কাজ আমার মণঃপূত না হওয়ার কারণে আমি তাকে একেবারে ‘কাফের’ বানিয়ে ফেলেছি! অথচ আপনি হাফেজ ইবনে হাজার আসকালানী লিখিত ‘আদ দুরারুল কামিনাহ’ থেকে শায়খুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়ার জীবনী পড়–ন, এতগুলো ‘যাল্লাত’ থাকার পরও উম্মতের ইমামগণ তাঁর ব্যাপারে কত চমৎকার দোয়া করেছেন! আল্লাহ পাক আমাদের সুমতি দান করুন। বড়দের অযথা সমালোচনা করে নিজের ধ্বংশ ডেকে আনা থেকে আমাদের রক্ষা করুন।

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...