আলেম ভাষা সৈনিক -২
সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ|
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে আওয়ামীলীগ সভাপতি মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে ঢাকায় হরতাল পালিত হয়। হরতালে পুলিশি নির্যাতনে অনেকে আহত হন এবং শামসুল হক, বঙ্গবন্ধু, অলি আহাদসহ প্রায় ৬৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে ২৯ ফেব্রুয়ারিতেও অনেককে গ্রেফতার করা হয়েছিল।
প্রতিবাদে ১৫ মার্চ থেকে শুরু হওয়া প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার বাজেট অধিবেশনে উত্তপ্ত আলোচনা হয়। অধিবেশনে ভাষার প্রসঙ্গে আলোচনা করেন ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মওলানা ভাসানী, খাজা নাজিমুদ্দিন, ড. প্রতাপচন্দ্র গুহ রায়, প্রভাসচন্দ্র লাহিড়ী, মনোরঞ্জন ধর, ডা: এ এম মালিক, আবু তায়েব মাজহারুল হক, মফিজউদ্দিন আহমদ, শামসুদ্দিন আহমদ, মাহমুদ আলী, মহিউদ্দিন আহমদ, আনোয়ারা খাতুন, এ কে ফজলুল হক, মোহাম্মদ রুকনুদ্দিন প্রমুখ। ১৭ মার্চ মওলানা ভাসানী ভাষার প্রশ্নে সংসদে ইংরেজিতে আলোচনা না করে বাংলায় বলার দাবি জানান। তিনি বলেন- ‘এখানে যারা সদস্য আছেন, তারা সবাই স্বীকার করবেন যে, এটা বাংলা ভাষাভাষীদের দেশ, এই অ্যাসেম্বলির যিনি সদর (স্পিকার) তিনিও নিশ্চয়ই বাংলাতেই বলবেন। আপনি কি বলেন, আমরা তা কিছুই বুঝতে পারি না। আপনি যা বলেন, তার সাথে সদস্যদের ডিসকাশনের কোনো সংশ্রব থাকতে পারে না। আপনি যদি বাংলায় রুলিং না দেন, তাহলে আমরা আপনার আলোচনায় শরিক হবো কী করে? আমি আশাকরি, আপনি রুলিং দেবেন যেন সবাই বাংলাতেই বলেন এবং আপনিও বাংলাতে রুলিং দেবেন।’ জবাবে স্পিকার বলেন, ‘যিনি যে ভাষা জানেন, তিনি সেই ভাষায় বলবেন।’ মওলানা ভাসানী বাংলা ভাষাতেই যাতে সবাই বলেন, তার ব্যবস্থা করতে স্পিকারকে পীড়াপীড়ি করতে থাকেন।
১৯৩৮ সালে আসাম ব্যবস্থাপক সভায় মওলানা ভাসানীই প্রথম ব্যক্তি যিনি বাংলায় বক্তৃতা দিয়েছেন। প্রশ্নোত্তরকালে আসাম ব্যবস্থাপক সভার স্বাস্থ্যমন্ত্রী রামনাথ দাস ইংরেজিতে উত্তর দানকালে মওলানা ভাসানী বলেন ‘আমি বাংলায় উত্তর চাই’। পরবর্তীকালে স্বাধীন ভারতের আসাম বিধানসভায় বাংলা ভাষা স্বীকৃতি পায়। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে তৎকালীন বিশ্বে প্রথম বাংলা ভাষার সরকারি স্বীকৃতি অর্জিত হয়।
ভাষা সৈনিক গাজিউল হক, যিনি ভাষা আন্দোলনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিলেন, লিখেছেন- ‘মওলানা ভাসানীসহ যে ৪২ জন নেতা এই আন্দোলনের সপক্ষে ছিলেন, তাদের মধ্যে প্রভাবশালী কয়েকজন মন্ত্রিত্ব এবং রাষ্ট্রদূতের পদ নিয়ে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কচ্ছেদ করেন।’ ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় যুবলীগ, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ, তমদ্দুন মজলিস, ইসলামিক ব্রাদারহুড, পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সমন্বয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ গঠিত হয়।
৪০ সদস্যবিশিষ্ট এই পরিষদে ছিলেন মওলানা ভাসানী, আতাউর রহমান খান, কামরুদ্দীন আহমদ, খয়রাত হোসেন, আনোয়ারা খাতুন, শামসুল হক, আবুল কাসেম, আবদুল গফুর, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, মীর্জা গোলাম হাফিজ, আবদুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব, শামসুল হক চৌধুরী, খালেক নেওয়াজ খান, সৈয়দ আবদুর রহিম প্রমুখ। পরিষদের সেই সভাতেই ‘বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি’র ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে আহূত ছাত্র ধর্মঘটের প্রতি সমর্থন জানানো হয়। ৪ ফেব্রুয়ারির সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে প্রদেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করা হয়।
ভাষা আন্দোলনের আরেক পুরোধা অলি আহাদ লিখেছেন- ‘৬ ফেব্রুয়ারি পূর্ববঙ্গ কর্মীশিবির অফিস ১৫০ নম্বর মোগলটুলিতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর সভাপতিত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়।…সরকার যদি ১৪৪ ধারা ইত্যাদি নিষেধাজ্ঞা জারি করে, তাহা হইলে আইন ভঙ্গ করা হইবে কি হইবে না সভায় তাহাও আলোচিত হয়। বেশির ভাগ উপস্থিত সদস্যই আইন ভঙ্গের বিরুদ্ধে মত জ্ঞাপন করেন। কিন্তু আমি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে দৃঢ় মতপ্রকাশ করি। বৃদ্ধ মওলানা ভাসানী সভাপতির আসন হইতে আমার বক্তব্যের সমর্থনে জোরালো ভাষায় ঘোষণা করিয়া বলেন, যে সরকার আমাদের নিয়মতান্ত্রিক শান্তিপূর্ণ গণ-আন্দোলনকে ইচ্ছাকৃতভাবে বানচাল করিবার জন্য অন্যায়ভাবে আইনের আশ্রয় গ্রহণ করে, সে সরকার কর্তৃক জারিকৃত নিষেধাজ্ঞাকে মাথা নত করিয়া গ্রহণ করিবার অর্থ, স্বৈরাচারের নিকট আত্মসমর্পণ।’
২১ ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে ঢাকার আবহাওয়া ক্রমেই উত্তপ্ত হয়ে উঠলে ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে আওয়ামী মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় অফিস ৯৪ নবাবপুরে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। মওলানা ভাসানী ১৮ ফেব্রুয়ারি থেকে মোমেনশাহী, পাবনা, কুমিল্লা সফরে থাকায় বৈঠকে উপস্থিত থাকতে পারেননি। সভায় ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গের ব্যাপারে কর্মপরিষদের সদস্যদের মধ্যে তুমুল বাগি¦তণ্ডা সৃষ্টি হয় এবং ছাত্রদের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও ১১-৪ ভোটে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত বাতিল করা হয়। এদিকে আবদুল মতিনের নেতৃত্বে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার এবং ১০ জনের মিছিল নিয়ে মাঠে থাকার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। সিদ্ধান্ত মতো, ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই তারা ১০ জনই মিছিল নিয়ে স্লোগান দিয়ে মাঠে নেমে পড়েন। দুপুর নাগাদ ছাত্রদের সাথে পুলিশের ব্যাপক সংঘর্ষ বাধে। পুলিশ নির্বিচারে গুলি বর্ষণ করলে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ অনেকে শহীদ হন। মফস্বল থেকে মওলানা ভাসানী এ ঘটনা জানতে পেরে পরদিন ঢাকায় এসে শহীদদের গায়েবানা জানাজা পড়ান। জানাজা শেষে তিনি মুনাজাতের সময়ে শাসকগোষ্ঠীর উদ্দেশ্যে কঠোর হুঁশিয়ারি ও হত্যাকাণ্ডের সুষ্ঠু বিচার দাবি করেন।
পরদিন তিনি এই হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে বিবৃতি দেন। এদিকে সরকার দমননীতি অব্যাহত রেখে মওলানা ভাসানীসহ নতুন করে আবুল হাশিম, মওলানা তর্কবাগীশ, শামসুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আবদুল মতিন, কাজী গোলাম মাহবুব, খয়রাত হোসেন, খান সাহেব ওসমান আলী, খোন্দকার মোশতাক আহমদ, মোজাফ্ফর আহমদ চৌধুরী, অজিত গুহ, খালেক নেওয়াজ খান, মীর্জা গোলাম হাফিজ, সরদার ফজলুল করিমসহ অনেককে গ্রেফতার করে। কারাগারে মওলানা ভাসানী রাজবন্দীর মুক্তি ও অন্যান্য দাবিতে লেবুর রস পান করে রোজা রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৫৩ সালের ১৮ এপ্রিল থেকে তিনি আমরণ অনশন ধর্মঘট শুরু করায় তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে ২১ এপ্রিল তাকে মুক্তি দেয়া হয়। এরপরও তিনি রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে জোরালো ভূমিকা রেখেছিলেন। উল্লেখ্য, ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম শহীদ দিবসেও তিনি শহীদদের স্মরণে অনশন করেছিলেন।
১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের ব্যাপক বিজয়ের পর ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি মওলানা ভাসানী, মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার ও শহীদ বরকতের মা কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের ভিত্তি স্থাপন করেন। ওইদিন অপরাহ্নে আরমানিটোলা ময়দানে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের সভাশেষে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে এক বিরাট মিছিল ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে। আজিমপুর গোরস্তানে শহীদদের কবর জিয়ারত শেষে ক্রন্দনরত বরকতের মাকে মওলানা ভাসানী বাংলার সাড়ে চার কোটি সন্তানের জননী বলে উল্লেখ করেন। ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের ২১৪ (১) অনুচ্ছেদে বাংলা রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি পায়। এরপর ১৯৬২ সালের সংবিধানে বলা হয়, পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা হবে বাংলা ও উর্দু। সূত্র- এম আমজাদ খান ভাসানী, সভাপতি- মওলানা ভাসানী কৃষক সমিতি।
ভাষা আন্দোলনকে ব্যর্থ করে দেয়ার উদ্দেশ্যে সরকার অসংখ্য ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতাকে গ্রেফতার করেছিল। মওলানা ভাসানীকে গ্রেফতার করতে না পেরে তার বিরুদ্ধে জারি করেছিল গ্রেফতারি পরোয়ানা। মওলানা ভাসানী আদালতে হাজির হয়ে গ্রেফতার বরণ করেছিলেন ১০ এপ্রিল। কারাগারেও তাঁর সংগ্রাম অব্যাহত ছিল। রাষ্ট্রভাষা ও স্বায়ত্তশাসনসহ পূর্ব বাংলার বিভিন্ন দাবি পূরণ এবং আন্দোলনকালে গ্রেফতার করা রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি আদায়ের জন্য মওলানা ভাসানী এ সময় নতুন ধরনের অনশন শুরু করেন। সারাদিন তিনি রোজা রাখতেন অর্থাত্ পানাহার করতেন না। অনশন ভাঙতেন সন্ধ্যার পর। তাঁর অনুপ্রেরণায় অন্য বন্দিদের অনেকেও একইভাবে অনশন শুরু করেন। রাজবন্দি অলি আহাদ ও ধনঞ্জয় দাশ লিখেছেন, মওলানা ভাসানীর পরামর্শে তারা ৩৫ দিন রোজা রেখেছিলেন এবং এর ফলে কারাগারের ভেতরে-বাইরে বন্দিদের মুক্তির জন্য আন্দোলন জোরদার হয়েছিল। পর্যায়ক্রমে অনেকে মুক্তিও পেয়েছিলেন। মওলানা ভাসানীকে মুক্তি দেয়া হয়েছিল ১৯৫৩ সালের ২১ এপ্রিল। রোজা রাখার ধারাবাহিকতায় ১৮ এপ্রিল থেকে তিনি আমরণ অনশন শুরু করেছিলেন। এতে তাঁর শরীর খারাপ হতে থাকে, সে খবর প্রকাশিত হলে জনগণের মধ্যে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। জনমতের চাপে সরকার তাঁকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। উল্লেখ্য, বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি কারাগারে মওলানা ভাসানী একদিনের অনশন করেছিলেন।
এভাবেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার সংগ্রামে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেছিলেন মওলানা ভাসানী। সেকালের আরও অনেক নেতাও প্রাথমিক পর্যায়ে অংশ নিয়েছিলেন সত্য, কিন্তু তাদের সবাইকে শেষ পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। যেমন ভাষা আন্দোলনের অন্যতম ছাত্রনেতা গাজীউল হক জানিয়েছেন, ‘মওলানা ভাসানীসহ যে ৪২ জন নেতা এ আন্দোলনের সপক্ষে ছিলেন তাঁদের মধ্যে প্রভাবশালী কয়েকজন মন্ত্রিত্ব ও রাষ্ট্রদূতের পদ নিয়ে আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্কছেদ করেন। (ধানসিঁড়ি সংকলন, চতুর্থ প্রকাশনা, ১৯৮০, পৃ-৫৮)