আনু মুহাম্মদ :
‘আমারে চিনস?’ বাংলাদেশে এটা একটা পরিচিত বাক্য। কাউকে লাইনে দাঁড়াতে বললে, কাউকে ট্রাফিক আইন মানতে বললে, কারও অন্যায়ের প্রতিবাদ করলে, কারও জবরদখল সরাতে বললে এ রকম কথা শোনা যায়। কারা এ রকম বলেন? যাঁরা ক্ষমতার ভারে আক্রান্ত। এটা হতে পারেন ক্ষমতাবান ভিআইপি কেউ, হতে পারেন ক্ষমতার ছোঁয়া লাগা তাঁদের ভাই, ভাতিজা, বন্ধু বা বন্ধুর ভাই কিংবা চেলা-শাগরেদ। পুলিশ, র্যাব, আইন, নীতি, শৃঙ্খলা—সবই তাঁদের ক্ষমতার অধীন। সর্বজনের টাকা তাঁদের টাকা।
এটা একটা রোগ, এই রোগ ভিআইপি রোগ। ভিআইপি কারা? যাঁরা ইচ্ছা করলে আইন ভঙ্গ করতে পারেন। মানুষকে লাইনে
দাঁড় করিয়ে যেখানে-সেখানে যখন-তখন ঢুকে যেতে পারেন। উল্টো রাস্তায় ভোম্বা সাইজের গাড়ি নিয়ে মানুষকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে যেতে পারেন।
ভিআইপি কারা? আইন যাঁদের ধরতে পারে না। যাঁদের কলমের খোঁচায় বা মুখের বাণীতে নদী হয় জমি, পাহাড় হয় সমতল, বিষাক্ত খাদ্য হয় উপকারী, খুনি হয় সাধু।
ভিআইপি কারা? যাঁরা যেখানেই যান না কেন সেখানে প্রশাসন, পুলিশ, র্যাব অন্য সব কাজ ফেলে তাঁদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
ঢাকা শহরে যানজটে মানুষ যখন অতিষ্ঠ, কাজে যাওয়ার পথে কিংবা সারা দিনের কাজ শেষে ঘরে ফেরার পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জীবন থেকে চলে যায় প্রতিদিন, তখন উল্টো পথে যে গাড়িগুলো যায়, সেগুলোতে থাকেন ভিআইপিরা। এই ভিআইপিদের কারণে উল্টো পথে চলাচল বিঘ্নিত হয়, যানজট আরও বাড়ে। তাঁদের জায়গা দিতে গিয়ে মানুষের যন্ত্রণা আরও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এটা প্রমাণিত হয় যে তাঁরা ক্ষমতাবান, তাঁরা যা খুশি তা-ই করতে পারেন। এটাই তাঁদের চাওয়া, এটাই তাঁদের সুখ। তাঁদের যেতে হবে কোথাও, দ্রুত। গিয়ে তাঁরা উন্নয়নের কথা বলবেন, বলবেন দেশের মানুষ খুব সুখে আছে!
ঢাকা শহর এখন গাড়ির শহর। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ঢাকা মহানগরীর প্রায় ৪০ শতাংশ সড়ক দখল করে রাখে ব্যক্তিগত গাড়ি, চলাচল করেন মাত্র ৭ শতাংশ মানুষ। এর মধ্যে বড়জোর ১ শতাংশ ভিআইপি। এর বাইরে ৪২ শতাংশ মানুষ চলেন বাসে, ৪০ শতাংশ মানুষ রিকশায়। বাসের অবস্থা আমরা সবাই জানি। ঢাকা মহানগরীতে নতুন ভবন, নতুন গাড়ি, নতুন বিলবোর্ড—সবই আছে কিন্তু বেশির
ভাগ মানুষের জন্য যে বাস, সেখানে প্রাচীন বাতিল ভাঙাচোরারই আধিক্য। ঢাকা শহরের আয়তন অনুযায়ী সড়ক যা থাকার কথা, তার অর্ধেকও নেই। তার ওপর ব্যক্তিগত গাড়ির পার্কিং, নির্মাণকাজ ইত্যাদিতে সেই রাস্তাও ব্যবহার করা যায় না। হকার উচ্ছেদে শোরগোল হয়, কিন্তু এই হকারদের বসানো, উঠিয়ে আবার বসানো—সব ক্ষেত্রেই হকারদের খাজনা দিতে হয়। এদিকে খেলার মাঠ, জলাশয় দখল হয়ে বহুতল ভবন ওঠে। সবকিছু যাঁদের অঙ্গুলিহেলনে চলে, যাঁদের পকেট ভারী হয়, তাঁরা ভিআইপি।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উচ্ছেদ হয়ে কিংবা কাজের খোঁজে ঢাকায় যাঁরা আসেন, তাঁদের থাকার জায়গা বস্তি। বস্তি করে
যাঁরা জমি দখল নেন, যাঁরা বস্তির ভাড়া আদায় করেন, প্রয়োজন ফুরালে যাঁরা সেখানে বহুতল ভবন করতে বস্তি উচ্ছেদে আগুন দেন, তাঁদের শনৈঃশনৈঃ উন্নতি হয়। কেননা, তাঁরা ভিআইপি।
যে বাসগুলো ঢাকায় চলা বেআইনি, ফিটনেস ছাড়া সেসব বাস কীভাবে চলতে পারে? চলে, মাঝেমধ্যে ধরপাকড়ে কেবল টাকাপয়সার লেনদেন বাড়ে। শুধু বাসের ক্ষেত্রে নয়, লঞ্চের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। পরিবহনের ক্ষেত্রে নৈরাজ্যের জন্য প্রতিদিন রেকর্ডসংখ্যায় হতাহত হয় মানুষ। বর্তমানে হরহামেশাই দুর্ঘটনা ঘটছে ঢাকা শহরেও। যাঁদের অনুগ্রহে অচল বাস-লঞ্চ সচল হয়, মানুষ ভোগে, মানুষ মরে, তাঁরা ভিআইপি।
সবচেয়ে জনবহুল এলাকা যেগুলো, যেসব রাস্তা সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ ব্যবহার করে, সেই রাস্তাগুলোর অবস্থা এখন সবচেয়ে খারাপ। রাস্তার সঙ্গে সঙ্গে পয়োনিষ্কাশন, বিদ্যুৎ–সংযোগ, গ্যাস–সংযোগ নিয়েও অনেক ভোগান্তি। বড় বড় সেতু, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেলে হাজার হাজার কোটি টাকার সংস্থান হয় খুব সহজে, কিন্তু প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষের দুর্দশা লাঘবে হাজারের এক ভাগ টাকারও সংস্থান হয় না। কেন? হয়তো হয়, কিন্তু তার দেখা পাওয়া যায় না। কোথায় যায়? কারা এগুলো দেখাশোনা করেন? জনগণের ভোগান্তি দূর করার জন্য সর্বজনের টাকায় রাষ্ট্র কাদের প্রতিপালন করে? অর্থমন্ত্রীর ভাষায়, দেশে এখন পুকুরচুরি নয় সাগরচুরি হচ্ছে। তিনিই বলেন, মেগা প্রকল্পে এত আগ্রহের কারণ, এতে মেগা চুরি সম্ভব হয়। এসবের সুফলভোগী কারা? দিনের পর দিন জনগণের ভোগান্তির কারণ কারা? তাঁরা ভিআইপি।
খাদ্য নিয়ে সংবাদপত্র–টিভিতে প্রায়ই বিভিন্ন অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে। শিশুখাদ্য থেকে বড়দের খাদ্য, পানীয় থেকে সবজি মাছ মাংস ফল, কাঁচাবাজার থেকে রেস্তোরাঁর খাবার সবকিছু নিয়েই ভীতিকর সব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণা থেকেও আসে ভয়াবহ সব খবর। এসব তথ্য থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বাংলাদেশের নাগরিকেরা প্রতিদিন কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করেও নিজেদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিপদ ডেকে আনছেন। কোমল পানীয়, শিশুখাদ্য যতই বিষাক্ত হোক, বিজ্ঞাপনের জোরে সেগুলোই মোহনীয় আকারে উপস্থিত হয়। এর বিষময় ফল এক দিনে বোঝা যায় না। দীর্ঘ মেয়াদে তার প্রভাবে জীবনমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, জটিল রোগ-দুর্ভোগ নানা মাত্রায় আক্রমণ করতে পারে। সবার তো আর ক্ষতি হয় না। যাঁরা এসব ব্যবসার বড় ভাগীদার, তাঁদের স্বজনেরা এ দেশে থাকেই না। যাঁরা অনুমতি দেন, যাঁরা এসব ব্যবসায় পৃষ্ঠপোষকতা দেন, তাঁরা কি ছোটখাটো মানুষ? না। তাঁরা ভিআইপি।
চোখের সামনে খুন হচ্ছে নদী। হয় উন্নয়ন প্রকল্প, নয়তো সরাসরি দখল-দূষণের মধ্য দিয়ে দেশের বেশির ভাগ নদী হয় নর্দমা, নয়তো জমিতে পরিণত হচ্ছে। এর ক্ষতি কতটা, তা টাকার অঙ্কে বোঝানো যাবে না। কিন্তু এর ফলে লাভবান ব্যক্তিও আছেন। যাঁরা উন্নয়নের মুখোশে নদী-বনবিনাশী প্রকল্পের কর্মকর্তা, যাঁরা নদী দখল করতে পারেন, যাঁদের জন্য নদীদূষণ হয়, যাঁদের জন্য নদী জমি হতে থাকে আর দখল হতে থাকে—তাঁরা সবাই সমাজের ক্ষমতাধর ব্যক্তি। আর যাঁদের নদীপ্রবাহ ঠিক রাখা দায়িত্ব, দখল থেকে জলাভূমি বন-নদী বাঁচানোর দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা কী করেন? তাঁরা কর্তৃত্ব বিনিয়োগ করেন মুনাফার ভাগ বাড়ানোর কাজে। তাঁরা সবাই ভিআইপি।
শিক্ষা খাতে এখন বিপুল বাণিজ্যিক কর্মচাঞ্চল্য। প্রমাণিত হয়েছে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ খুব আকর্ষণীয়, শিক্ষা খাতে এখন নিয়োগেও বিশাল বাণিজ্য। শিক্ষার জন্য গাইড বইয়ে বিপুল মুনাফা। শিক্ষার জন্য কোচিং সেন্টার খুবই প্রভাবশালী তৎপরতা। পরীক্ষার চাপ বাড়ানো হয়েছে, পরীক্ষায় পাসের হার বাড়ানোরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থাকে ‘পরীক্ষাব্যবস্থা’য় পরিণত করার কারণে কোচিং–গাইড বই ব্যবসার পথ মসৃণ হয়েছে। কোচিং সেন্টারগুলোর ভেতরে ব্যাপক প্রতিযোগিতার কারণে ব্যবসায়িক সাফল্যের সহজ পথ প্রশ্নপত্র ফাঁস। প্রতিবছর হচ্ছে, কোনো সমাধান নেই। সর্বজনীন শিক্ষার মতো সর্বজনীন চিকিৎসারও হাল একই রকম। আর এই হাল তৈরির অবদান কাদের? এতে যাঁরা বেশি লাভবান হন, তাঁরা কারা? তাঁরা ভিআইপি।
নানা রকম মাদকদ্রব্যে ছেয়ে যাচ্ছে দেশ। এর সমাধানে পুলিশ-র্যাবের তৎপরতায় দুর্বল লোকজনদের মাঝেমধ্যে ধরপাকড় করতে দেখা যায়। কিন্তু যাঁরা এর প্রধান জোগানদার, তাঁদের ব্যবসায় তিলমাত্র ক্ষতি হয় না। তাঁরা বরং মাঝেমধ্যে ‘মাদককে “না” বলুন’-মার্কা অনুষ্ঠান ধন্য করে ফুলের মালা নিয়ে হাজির হতে পারেন। কারণ, তাঁরা ভিআইপি।
বায়ুদূষণে ঢাকা মহানগরী বিশ্বে এখন দ্বিতীয় অবস্থানে। এর ফলে শিশু থেকে শুরু করে কত মানুষ প্রতিদিন অসুস্থ হচ্ছে, তার কোনো হিসাব নেই। কিন্তু তবু এর সমাধান নেই। প্রতিদিন রাস্তায় চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়লে মনে হয় আজকেই সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। না, পরদিন দেখি অবস্থা আরও খারাপ। এই অবস্থা যাঁদের স্বার্থে বা অবহেলায় অনির্দিষ্টকাল চলতে থাকে, তাঁরা ভিআইপি। দূষিত বায়ু তাঁদের স্পর্শ করে না, যানজট স্পর্শ করে না, শিক্ষা-চিকিৎসার অব্যবস্থা স্পর্শ করে না। তাঁরা এগুলো সৃষ্টি করেন মাত্র।
বাংলাদেশের মানুষের অনেক ধৈর্য! চোখের সামনে তাঁরা দেখছেন যাঁদের কারণে তাঁদের ভোগান্তি, তাঁদের হাতেই ক্ষমতার দণ্ড।
মানুষের ভোগান্তি বাড়লে, জীবন-সম্পদ নষ্ট হলে তাঁদের কিছু আসে-যায় না। বরং সেগুলোই তাঁদের গর্ব। কারণ, তাঁরা ভিআইপি। কিন্তু কত দিন মানুষ এই ভুল ধৈর্য ধরে থাকবে বা থাকতে পারবে?
এটা একটা রোগ, এই রোগ ভিআইপি রোগ। ভিআইপি কারা? যাঁরা ইচ্ছা করলে আইন ভঙ্গ করতে পারেন। মানুষকে লাইনে
দাঁড় করিয়ে যেখানে-সেখানে যখন-তখন ঢুকে যেতে পারেন। উল্টো রাস্তায় ভোম্বা সাইজের গাড়ি নিয়ে মানুষকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে চলে যেতে পারেন।
ভিআইপি কারা? আইন যাঁদের ধরতে পারে না। যাঁদের কলমের খোঁচায় বা মুখের বাণীতে নদী হয় জমি, পাহাড় হয় সমতল, বিষাক্ত খাদ্য হয় উপকারী, খুনি হয় সাধু।
ভিআইপি কারা? যাঁরা যেখানেই যান না কেন সেখানে প্রশাসন, পুলিশ, র্যাব অন্য সব কাজ ফেলে তাঁদের সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, আরাম-আয়েশ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।
ঢাকা শহরে যানজটে মানুষ যখন অতিষ্ঠ, কাজে যাওয়ার পথে কিংবা সারা দিনের কাজ শেষে ঘরে ফেরার পথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা জীবন থেকে চলে যায় প্রতিদিন, তখন উল্টো পথে যে গাড়িগুলো যায়, সেগুলোতে থাকেন ভিআইপিরা। এই ভিআইপিদের কারণে উল্টো পথে চলাচল বিঘ্নিত হয়, যানজট আরও বাড়ে। তাঁদের জায়গা দিতে গিয়ে মানুষের যন্ত্রণা আরও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু এটা প্রমাণিত হয় যে তাঁরা ক্ষমতাবান, তাঁরা যা খুশি তা-ই করতে পারেন। এটাই তাঁদের চাওয়া, এটাই তাঁদের সুখ। তাঁদের যেতে হবে কোথাও, দ্রুত। গিয়ে তাঁরা উন্নয়নের কথা বলবেন, বলবেন দেশের মানুষ খুব সুখে আছে!
ঢাকা শহর এখন গাড়ির শহর। এক সমীক্ষায় দেখা যায়, ঢাকা মহানগরীর প্রায় ৪০ শতাংশ সড়ক দখল করে রাখে ব্যক্তিগত গাড়ি, চলাচল করেন মাত্র ৭ শতাংশ মানুষ। এর মধ্যে বড়জোর ১ শতাংশ ভিআইপি। এর বাইরে ৪২ শতাংশ মানুষ চলেন বাসে, ৪০ শতাংশ মানুষ রিকশায়। বাসের অবস্থা আমরা সবাই জানি। ঢাকা মহানগরীতে নতুন ভবন, নতুন গাড়ি, নতুন বিলবোর্ড—সবই আছে কিন্তু বেশির
ভাগ মানুষের জন্য যে বাস, সেখানে প্রাচীন বাতিল ভাঙাচোরারই আধিক্য। ঢাকা শহরের আয়তন অনুযায়ী সড়ক যা থাকার কথা, তার অর্ধেকও নেই। তার ওপর ব্যক্তিগত গাড়ির পার্কিং, নির্মাণকাজ ইত্যাদিতে সেই রাস্তাও ব্যবহার করা যায় না। হকার উচ্ছেদে শোরগোল হয়, কিন্তু এই হকারদের বসানো, উঠিয়ে আবার বসানো—সব ক্ষেত্রেই হকারদের খাজনা দিতে হয়। এদিকে খেলার মাঠ, জলাশয় দখল হয়ে বহুতল ভবন ওঠে। সবকিছু যাঁদের অঙ্গুলিহেলনে চলে, যাঁদের পকেট ভারী হয়, তাঁরা ভিআইপি।
দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে উচ্ছেদ হয়ে কিংবা কাজের খোঁজে ঢাকায় যাঁরা আসেন, তাঁদের থাকার জায়গা বস্তি। বস্তি করে
যাঁরা জমি দখল নেন, যাঁরা বস্তির ভাড়া আদায় করেন, প্রয়োজন ফুরালে যাঁরা সেখানে বহুতল ভবন করতে বস্তি উচ্ছেদে আগুন দেন, তাঁদের শনৈঃশনৈঃ উন্নতি হয়। কেননা, তাঁরা ভিআইপি।
যে বাসগুলো ঢাকায় চলা বেআইনি, ফিটনেস ছাড়া সেসব বাস কীভাবে চলতে পারে? চলে, মাঝেমধ্যে ধরপাকড়ে কেবল টাকাপয়সার লেনদেন বাড়ে। শুধু বাসের ক্ষেত্রে নয়, লঞ্চের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটে। পরিবহনের ক্ষেত্রে নৈরাজ্যের জন্য প্রতিদিন রেকর্ডসংখ্যায় হতাহত হয় মানুষ। বর্তমানে হরহামেশাই দুর্ঘটনা ঘটছে ঢাকা শহরেও। যাঁদের অনুগ্রহে অচল বাস-লঞ্চ সচল হয়, মানুষ ভোগে, মানুষ মরে, তাঁরা ভিআইপি।
সবচেয়ে জনবহুল এলাকা যেগুলো, যেসব রাস্তা সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ ব্যবহার করে, সেই রাস্তাগুলোর অবস্থা এখন সবচেয়ে খারাপ। রাস্তার সঙ্গে সঙ্গে পয়োনিষ্কাশন, বিদ্যুৎ–সংযোগ, গ্যাস–সংযোগ নিয়েও অনেক ভোগান্তি। বড় বড় সেতু, ফ্লাইওভার, মেট্রোরেলে হাজার হাজার কোটি টাকার সংস্থান হয় খুব সহজে, কিন্তু প্রতিদিন লাখ লাখ মানুষের দুর্দশা লাঘবে হাজারের এক ভাগ টাকারও সংস্থান হয় না। কেন? হয়তো হয়, কিন্তু তার দেখা পাওয়া যায় না। কোথায় যায়? কারা এগুলো দেখাশোনা করেন? জনগণের ভোগান্তি দূর করার জন্য সর্বজনের টাকায় রাষ্ট্র কাদের প্রতিপালন করে? অর্থমন্ত্রীর ভাষায়, দেশে এখন পুকুরচুরি নয় সাগরচুরি হচ্ছে। তিনিই বলেন, মেগা প্রকল্পে এত আগ্রহের কারণ, এতে মেগা চুরি সম্ভব হয়। এসবের সুফলভোগী কারা? দিনের পর দিন জনগণের ভোগান্তির কারণ কারা? তাঁরা ভিআইপি।
খাদ্য নিয়ে সংবাদপত্র–টিভিতে প্রায়ই বিভিন্ন অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশিত হচ্ছে। শিশুখাদ্য থেকে বড়দের খাদ্য, পানীয় থেকে সবজি মাছ মাংস ফল, কাঁচাবাজার থেকে রেস্তোরাঁর খাবার সবকিছু নিয়েই ভীতিকর সব তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। বেসরকারি উদ্যোগে পরিচালিত বিভিন্ন গবেষণা থেকেও আসে ভয়াবহ সব খবর। এসব তথ্য থেকে বুঝতে অসুবিধা হয় না যে বাংলাদেশের নাগরিকেরা প্রতিদিন কষ্টার্জিত অর্থ ব্যয় করেও নিজেদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি বিপদ ডেকে আনছেন। কোমল পানীয়, শিশুখাদ্য যতই বিষাক্ত হোক, বিজ্ঞাপনের জোরে সেগুলোই মোহনীয় আকারে উপস্থিত হয়। এর বিষময় ফল এক দিনে বোঝা যায় না। দীর্ঘ মেয়াদে তার প্রভাবে জীবনমান ক্ষতিগ্রস্ত হয়, জটিল রোগ-দুর্ভোগ নানা মাত্রায় আক্রমণ করতে পারে। সবার তো আর ক্ষতি হয় না। যাঁরা এসব ব্যবসার বড় ভাগীদার, তাঁদের স্বজনেরা এ দেশে থাকেই না। যাঁরা অনুমতি দেন, যাঁরা এসব ব্যবসায় পৃষ্ঠপোষকতা দেন, তাঁরা কি ছোটখাটো মানুষ? না। তাঁরা ভিআইপি।
চোখের সামনে খুন হচ্ছে নদী। হয় উন্নয়ন প্রকল্প, নয়তো সরাসরি দখল-দূষণের মধ্য দিয়ে দেশের বেশির ভাগ নদী হয় নর্দমা, নয়তো জমিতে পরিণত হচ্ছে। এর ক্ষতি কতটা, তা টাকার অঙ্কে বোঝানো যাবে না। কিন্তু এর ফলে লাভবান ব্যক্তিও আছেন। যাঁরা উন্নয়নের মুখোশে নদী-বনবিনাশী প্রকল্পের কর্মকর্তা, যাঁরা নদী দখল করতে পারেন, যাঁদের জন্য নদীদূষণ হয়, যাঁদের জন্য নদী জমি হতে থাকে আর দখল হতে থাকে—তাঁরা সবাই সমাজের ক্ষমতাধর ব্যক্তি। আর যাঁদের নদীপ্রবাহ ঠিক রাখা দায়িত্ব, দখল থেকে জলাভূমি বন-নদী বাঁচানোর দায়িত্ব যাঁদের, তাঁরা কী করেন? তাঁরা কর্তৃত্ব বিনিয়োগ করেন মুনাফার ভাগ বাড়ানোর কাজে। তাঁরা সবাই ভিআইপি।
শিক্ষা খাতে এখন বিপুল বাণিজ্যিক কর্মচাঞ্চল্য। প্রমাণিত হয়েছে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ খুব আকর্ষণীয়, শিক্ষা খাতে এখন নিয়োগেও বিশাল বাণিজ্য। শিক্ষার জন্য গাইড বইয়ে বিপুল মুনাফা। শিক্ষার জন্য কোচিং সেন্টার খুবই প্রভাবশালী তৎপরতা। পরীক্ষার চাপ বাড়ানো হয়েছে, পরীক্ষায় পাসের হার বাড়ানোরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। শিক্ষাব্যবস্থাকে ‘পরীক্ষাব্যবস্থা’য় পরিণত করার কারণে কোচিং–গাইড বই ব্যবসার পথ মসৃণ হয়েছে। কোচিং সেন্টারগুলোর ভেতরে ব্যাপক প্রতিযোগিতার কারণে ব্যবসায়িক সাফল্যের সহজ পথ প্রশ্নপত্র ফাঁস। প্রতিবছর হচ্ছে, কোনো সমাধান নেই। সর্বজনীন শিক্ষার মতো সর্বজনীন চিকিৎসারও হাল একই রকম। আর এই হাল তৈরির অবদান কাদের? এতে যাঁরা বেশি লাভবান হন, তাঁরা কারা? তাঁরা ভিআইপি।
নানা রকম মাদকদ্রব্যে ছেয়ে যাচ্ছে দেশ। এর সমাধানে পুলিশ-র্যাবের তৎপরতায় দুর্বল লোকজনদের মাঝেমধ্যে ধরপাকড় করতে দেখা যায়। কিন্তু যাঁরা এর প্রধান জোগানদার, তাঁদের ব্যবসায় তিলমাত্র ক্ষতি হয় না। তাঁরা বরং মাঝেমধ্যে ‘মাদককে “না” বলুন’-মার্কা অনুষ্ঠান ধন্য করে ফুলের মালা নিয়ে হাজির হতে পারেন। কারণ, তাঁরা ভিআইপি।
বায়ুদূষণে ঢাকা মহানগরী বিশ্বে এখন দ্বিতীয় অবস্থানে। এর ফলে শিশু থেকে শুরু করে কত মানুষ প্রতিদিন অসুস্থ হচ্ছে, তার কোনো হিসাব নেই। কিন্তু তবু এর সমাধান নেই। প্রতিদিন রাস্তায় চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়লে মনে হয় আজকেই সবচেয়ে খারাপ অবস্থা। না, পরদিন দেখি অবস্থা আরও খারাপ। এই অবস্থা যাঁদের স্বার্থে বা অবহেলায় অনির্দিষ্টকাল চলতে থাকে, তাঁরা ভিআইপি। দূষিত বায়ু তাঁদের স্পর্শ করে না, যানজট স্পর্শ করে না, শিক্ষা-চিকিৎসার অব্যবস্থা স্পর্শ করে না। তাঁরা এগুলো সৃষ্টি করেন মাত্র।
বাংলাদেশের মানুষের অনেক ধৈর্য! চোখের সামনে তাঁরা দেখছেন যাঁদের কারণে তাঁদের ভোগান্তি, তাঁদের হাতেই ক্ষমতার দণ্ড।
মানুষের ভোগান্তি বাড়লে, জীবন-সম্পদ নষ্ট হলে তাঁদের কিছু আসে-যায় না। বরং সেগুলোই তাঁদের গর্ব। কারণ, তাঁরা ভিআইপি। কিন্তু কত দিন মানুষ এই ভুল ধৈর্য ধরে থাকবে বা থাকতে পারবে?
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।
anu@juniv.edu/anujuniv@gmail.com
anu@juniv.edu/anujuniv@gmail.com