আলেম ভাষাসৈনিক ১
সৈয়দ আনোয়ার আবদুল্লাহ :
সালাম বরকত রফিক জব্বার এর শাহাদতের সাথে সাথে বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারি হাজার হাজার ছাত্র জনতা প্রাণের বাংলা ভাষার জন্য লড়াই করে কারাবরণ করেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়ে বঙ্গবন্ধুসহ তৎকালিন ছাত্র নেতাদের সাথে মুহিউদ্দীন খান দেড় মাস জেল কেটেছিলেন। যে মানুষটি ছাত্রজীবন থেকে পাকিস্তান আমল হতে এদেশের গণমানুষের প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রাম ও রক্তঝরা দিনে বলিষ্ট নেতৃত্ব দিয়েছেন আমরা নিভৃতচারী এই সংগ্রামী সাধকের জীবনের অনেক কৃর্তিগাথা ঘটনাপ্রবাহ জানি না।
১৯৫১ সালে পাঁচবাগ সিনিয়র মাদরাসা থেকে আলিম পাশ করে ঢাকাতে আসেন মুহিউদ্দীন খান। ৫১ সালের নভেম্বর মাস। প্রথমে উঠেন লালাবাগ মাদরাসায়। শামসুল হক ফরিদপুরীর কাছে থাকতেন। সেখানে নিয়মিত যাতায়ত ছিল আল্লামা ফরিদপুরীর সম্পর্কীয় নাতি তরুণ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে। সহজে মিশে যাওয়া মুহিউদ্দীন খানের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের সম্পর্কটা এতোটাই গভীর হয়ে উঠে মাত্র ক’দিন মুজিব সম্পর্কে তুই তোকারে নিয়ে যান। ফরিদপুরীর সাথে তার সম্পর্ক এতোই গভীর ছিল যে, যেই কালো মুজিব কোটটি মুজিবুর পরতেন তা শামসুল হক ফরিদপুরীর পরনেরই ছিল যা নাতিকে দিয়েছিলেন। তিনি শ্রদ্ধা করে তা আর কখনো গা থেকে খুলেন নি”।
ফরিদপুরী মুহিউদ্দীন খানকে পরামর্শ দিলেন, তুমি ঢাকা আলিয়াতে ভর্তি হয়ে যাও। সেখানে হাদীসের দরস দেন আল্লামা শিব্বির আহমদ উসমানী, মুফতি আমিমুল এহসান, আল্লামা আব্দুর নহমান কাশগড়ীর মতো যামানাবিখ্যাত বিদগ্ধ আলেমরা। (জীবনের খেলাঘরে, মুহিউদ্দীন খান)
পাঁচবাগ পড়ালেখা অবস্থায় তিনি বুদ্ধিভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠন তমদ্দুনে মজলিসের কার্যক্রমের সাথে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন। সংগঠনপ্রিয় সাহিত্যমোদী এই তরুণ ঢাকাতে এসে একদিন দেখা করতে যান ভাষা আন্দোলনের জনক প্রিন্সিপাল আবুল কাসেমের সাথে। তিনি ছিলেন ভাষা আন্দোলনের জনক সংগঠন তমদ্দুন মজলিসের সভাপতি। আজিমপুরের তার বাসভবনটি ছিল ভাষা আন্দোলনের একমাত্র মূখপত্র “সাপ্তাহিক সৈনিক পত্রিকা” ও মজলিসের কার্যালয়। সৈনিকের সম্পাদক ছিলেন ভাষাসৈনিক আব্দুল গফুর। দুজন খানকে সৈনিকে কিছু সময় দিতে বলেন। এরপর থেকে ৩৭ আজিমুর তমদ্দুন অফিসে তিনি প্রতি বিকালে যেতেন। তার প্রথম প্রবন্ধ প্রকাশ হয় ভাষার পত্রিকা সৈনিকে। সেখানেই তার সাথে পরিচয় ঘটে বাংলাদেশের সকল ভাষাসৈনিক আর তমদ্দুনেরর মহানায়কদের সাথে। মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মাওলানা তর্কবাগীশ, প্রিন্সিপাল ইব্রাহিম খাঁ, মাওলানা আকরাম খাঁ, অধ্যাপক শাহেদ আলী, দেওয়ান মোহাম্মদ আজরফ, অলী আহমদ, আব্দুল মতিন প্রমূখের সাথে। অগ্রজদের সেই কাফেলার সর্বকনিষ্ট ভাষাসৈনিক ছিলেন মুহিউদ্দীন খান। (জীবনের খেলাঘরে, মুহিউদ্দীন খান)
তখন ভাষার দাবীতে উত্তাল হয়ে উঠে ঢাকা। সে সময়কার অবস্থা সম্পর্কে ভাষাসৈনিক অধ্যাপক আবদুল গফুর লিখেছেন, ‘১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঢাকা সফরে এসে পল্টন ময়দানে এক জনসভায় বলে বসেন, ‘পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু’। যে নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবি নিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। তার এই বিশ্বাসঘাতকতায় স্বভাবত পূর্ববঙ্গের জনমত বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এর প্রতিবাদের জন্য তমদ্দুন মজলিসের প্রচেষ্টায় রাজনৈতিক সংগঠন ও বিভিন্ন পেশার প্রতিনিধিদের নিয়ে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদ দিবস পালনের সিদ্ধান্ত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি মেডিকেল কলেজের সামনে বাংলা ভাষা সমর্থকদের ওপর পুলিশের গুলিতে রফিক, শফিক, সালাম,বরকত প্রমুখ তরুণদের রক্তে রাজপথ সিক্ত হয়ে উঠলে ভাষা আন্দোলনের নতুন গতিবেগ সৃষ্টি হয়’ (সূত্র : দৈনিক ইনকিলাব, ২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৮)।
তখন ভাষা আন্দোলন সর্বমহলে একটি গণআন্দোলন হিসেবে ছড়িয়ে পড়ল। জনসভা, মিছিল আর স্লোগানে সমগ্র বাংলাদেশ যেন কেঁপে কেঁপে উঠতে লাগল। রাস্তায়, দেয়ালে-দেয়ালে পোস্টার- ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই’ দাবি আদায়ের জন্য ভাষা সংগ্রাম কমিটি অক্লান্তভাবে কাজ করে যেতে লাগলো। এই ভাষা সংগ্রাম কমিটির সঙ্গে ওতপ্রোত সম্পর্কে যাঁরা নিরলস কাজ করেছেন সেই সব ছাত্রনেতার মধ্যে মুজিব ছিলেন অন্যতম। শোভাযাত্রা ও বিক্ষোভে নেতৃত্ব দেয়ার বেলায় অন্যান্যের মধ্যে শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়।” (সূত্র : ভাষা আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধু, পূর্বোক্ত. পৃ. ৩) ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের বিস্ফোরণের সময় একটি মিছিল থেকে শেখ মুজিবুর রহসানসহ তরুণ ছাত্রনেতাদের আটক করে জেলে পাঠানো হয়। (সূত্র : একুশে ফেব্রুয়ারি জাতীয় থেকে আন্তর্জাতিক- ড. মোহাম্মদ হান্নান, পৃ. ৫৩)।
বকশীবাজার আলিয়া মাদরাসা থেকে ঢাকা আলিয়ার ছাত্রদের একটি মিছিল মুহিউদ্দীন খানসহ কজন ছাত্রনেতার নেতৃত্বে সেই উত্তাল সংগ্রামে শরিক হয়। তখন তরুণ ছাত্রনেতাদের সাথে পুলিশি আক্রমনে শিকার হয়ে গেপ্তার হন এবং দেড় মাস কারাবরণ করেন মুহিউদ্দীন খান। (আলেম মুক্তিযোদ্ধার খোজে, শাকের হুসেন শিবলী)
মুহিউদ্দীন খানের ভাষা আন্দোলনে অবদান ও ভাষা আন্দোলনের জনক সংগঠন তমদ্দুনে মজজলিসে অবদান সম্পর্কে, ভাষা আন্দোলনের মূখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিকের সম্পাদক, খ্যাতিমান ভাষা সৈনিক অধ্যাপক আব্দুল গফুর লিখেছেন, “এদেশে স্বাধীনতাকে সার্থক করে তোলার লক্ষ্যে স্বাধীন পাকিস্তান ও স্বাধীন বাংলাদেশে ইসলামী আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে মুহিউদ্দীন খানের উল্লেখযোগ্য অবদান ছিল। তিনি ৫২র ভাষা আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন। এ লক্ষ্যেই তিনি ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংস্থা তমদ্দুন মজলিসের সাথে কাজ করেছেন। এককালে মজলিসের নিয়মিত আলোচনা সভা মাসিক মদীনার বাংলাবাজার অফিসে এবং পুরানা পল্টনে তাঁর কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত হতো। তাছাড়া তিনি দীর্ঘদিন ধরে তমদ্দুন মজলিসের বিভিন্ন কর্মকাণ্ড- পৃষ্ঠপোষকতা ও সহযোগিতা দান করেন। তমদ্দুন মজলিসের সদস্য কর্মীদের হাতেকলমে আদর্শিক শিক্ষাদানের লক্ষ্যে বার্ষিক শিক্ষাশিবির অনুষ্ঠানের যে ব্যবস্থা রয়েছে। একবার মরহুম মওলানা মুহিউদ্দীন খানের ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানাধীন তার নিজ গ্রাম আনসারনগরে সে শিক্ষাশিবির আয়োজিত হয় এবং তিনি নিজে তার যাবতীয় তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পালন করেন। এ ছাড়াও আমার ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে নানা পর্যায়ে তার ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ছিল। অনেকেই জানেন না তমদ্দুন মজলিসের আহ্বানে অনার্স পরীক্ষার দুই মাস আগে ১৯৫০ সালে মজলিসের সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে যোগদানের কারণে আমার এমএ ডিগ্রি অর্জন ১২ বছর পিছিয়ে যায়। এর মধ্যে ১৯৫৮ সালে আমি বিয়ে করায় সংসারের প্রয়োজনে আমার চাকরি নিতে হয়। সে সময় ইসলামিক ফাউন্ডেশনের পূর্বসূরি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম (ইসলামী একাডেমি)-এর সুপারিনটেনডেন্টের চাকরি গ্রহণ করি। ওই বেসরকারি প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম (ইসলামী একাডেমি)-এর ডিরেক্টর ও ডেপুটি ডিরেক্টর ছিলেন যথাক্রমে ফ্রাঙ্কলিন পাবলিকেশন খ্যাত আলহাজ এটিএম আবদুল মতিন ও মওলানা মুহিউদ্দীন খান। “
এই কিংবদন্তির মনীষা ভাষা সৈনিক মুহিউদ্দীন খানকে ভাষা আন্দোলনে অবদানের জন্য অনেক পরে হলেও তমদ্দুন মজলিস গত বছর জাতীয় প্রেসক্লাবে “শান্তি পদক” প্রদান করে। এতে বিচারপতি আব্দুর রউফ, ভাষা সৈনিক অধ্যাপক আব্দুল গফুর, সৈয়দ আলী আশরাফের মতো মনীষীরা তার হাতে সম্মানজনক পদক তুলে দেন।
মাওলানা মুহিউদ্দীন খান রহ.কে ভাষার জন্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরুপ ২১শে পদক দেয়া হোক।