মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প ও ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী নেতানিয়াহুর মধ্যে ভালোবাসার উৎসব শুরু হয়েছে। ফলে ফিলিস্তিনি নেতাদের অগ্রাহ্য করার বিষয়টি আবারও সামনে চলে এসেছে।
ট্রাম্পের ক্ষমতা গ্রহণের পর দুই নেতার মধ্যকার প্রথম বৈঠকে বারবার ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের মধ্যে শান্তি স্থাপনের প্রয়োজনীয়তায় জোর দিয়েছেন ট্রাম্প। কিন্তু তিনি ফিলিস্তিনি নেতৃত্ব সম্পর্কে একটি কথাও বলেননি। যুক্তরাষ্ট্র টের পেয়েছে, দুই-রাষ্ট্র সমাধানের প্রস্তাব থেকে তারা যদি সমর্থন তুলে নেয় বা ফিলিস্তিনি নেতাদের স্বীকৃতি না দেয়, তাহলে বিপদ হতে পারে। তাই তারা সিআইএ-প্রধান মাইক পম্পিওকে ফিলিস্তিনি প্রেসিডেন্ট মাহমুদ আব্বাসের সঙ্গে বৈঠক করার জন্য রামাল্লায় পাঠিয়েছিল।
কোনো রাজনীতিককে না পাঠিয়ে সিআইএ-প্রধানকে পাঠানোর মধ্য দিয়ে তারা ফিলিস্তিনের রাজনৈতিক ও জাতীয় আকাঙ্ক্ষার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দিল ইসরায়েলের নিরাপত্তাকে।
ট্রাম্প দুই-রাষ্ট্র সমাধানের পথ থেকে সরে গেলেন, যে ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রসহ আন্তর্জাতিক মহলের দীর্ঘদিনের মতৈক্য ছিল। তিনি বললেন, দুই-রাষ্ট্র বা এক-রাষ্ট্র যে সমাধানই হোক না কেন, তাঁর ‘কোনোটিতেই সমস্যা নেই।’ এ কথা বলে তিনি কার্যত চলমান দখলদারিকে দীর্ঘায়িত করলেন।
১৯৬৭ সালের দখলদারির পর থেকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ বারবার বলেছে, এই দখলদারি অবৈধ। ২৪২ নম্বর প্রস্তাবের মুখবন্ধে বলা হয়েছে, ‘যুদ্ধের মাধ্যমে ভূমি দখল গ্রহণীয় নয়’। ট্রাম্প প্রশাসন একদিকে সমাধানের বিষয়টি দুই দেশের হাতে ছেড়ে দিয়েছে, অন্যদিকে তারা ইসরায়েলের ক্ষমতায়ন করছে, যাতে তারা ফিলিস্তিনিদের হুকুম দিয়ে নিজ স্বার্থ হাসিল করতে পারে। এ থেকে বোঝা যায়, ইসরায়েলের বর্তমান কৌশল কীভাবে বহুদিন ধরে কাজে আসছে না।
দুই-রাষ্ট্র সমাধান থেকে ট্রাম্পের সমর্থন প্রত্যাহারের কারণে যুক্তরাষ্ট্র সৎ মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করতে পারবে না। আরব নেতারা ফিলিস্তিনিদের পক্ষ হয়ে ইসরায়েলের সঙ্গে শান্তিচুক্তি করবেন, এই আশা করাও ভুল হবে। অতীতে আরবের নেতারা, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র ফিলিস্তিনের জন্য বিকল্প নেতৃত্ব খোঁজার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে। যেমন, মিসর ও জর্ডান ইসরায়েল ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চাপ উপেক্ষা করেছে, যারা এটা নির্ধারণ করার চেষ্টা করছিল ১৯৭০ সালে কারা ফিলিস্তিনকে প্রতিনিধিত্ব করবে। এরপর ১৯৭৪ সালের আরব সম্মেলন প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনকে (পিএলও) ফিলিস্তিনি জনগণের একমাত্র বৈধ প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
১৯৬৭ সালের দখলদারির পর ইসরায়েল পিএলওকে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। ফলস্বরূপ গাজায় হামাসের জন্ম হয়। ১৯৮০-এর দশকে পশ্চিম তীরের গ্রামাঞ্চলে পিএলওকে খাটো করার জন্য ‘ভিলেজ লিগ’ নামের একটি সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করা হয়। অর্থাৎ ইসরায়েল ফিলিস্তিনিদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে সেখানকার নেতৃত্বকে হটানোর যে চেষ্টা করেছিল, সেটাও শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়।
সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ ডব্লিউ বুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস বেকারকে নিয়ে চেষ্টা করেছিলেন, যাতে পিএলওর বাইরের ফিলিস্তিনি নেতারা জর্ডান-ফিলিস্তিন যৌথ প্রতিনিধিদলের মধ্যে যেন তারা জনগণকে প্রতিনিধিত্ব করে ১৯৯১ সালের মাদ্রিদ শান্তি সম্মেলনে যোগ দেয়। এর প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল ও পিএলও কর্মকর্তারা ১৯৯৩ সালে অসলোতে এক গোপন চুক্তি করেন, যেটা সম্পর্কে ওয়াশিংটন অবগত ছিল না।
২০০৯ সালে এক বক্তৃতায় নেতানিয়াহু দুই-রাষ্ট্র সমাধান গ্রহণের ব্যাপারে যে শর্ত আরোপ করেছিলেন, এখন তার মধ্যে কিছু অতিরিক্ত ব্যাপার আছে, যা স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্রের ধারণা খারিজ করে দেয়। এখন দুই-রাষ্ট্র সমাধান ছুড়ে ফেলার মানে হলো, ফিলিস্তিনি ভূমিতে ইসরায়েলি সেনার চিরস্থায়ী উপস্থিতি। ৪০ লাখ ফিলিস্তিনি ইহুদি রাষ্ট্র মেনে নেবে—এমন সম্ভাবনা কম। যে রাজনৈতিক অধিকার ইহুদিদের দেওয়া হয়, সেই অধিকার তাদের দেওয়া হবে না, এটা তারা মেনে নেবে না।
নেতানিয়াহু ও ট্রাম্প যে মনোভাব গ্রহণ করেছেন, তাতে এই অঞ্চলটি আরও খোলামেলা ও আইনসিদ্ধ রূপে বর্ণবাদের দিকে ঝুঁকছে। অধিকৃত ভূমিতে সংখ্যাগরিষ্ঠ ফিলিস্তিনিদের রাজনৈতিক অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে, যেখানে ইহুদি বসতি স্থাপনকারীরা পূর্ণাঙ্গ রাজনৈতিক ও জাতীয় অধিকার ভোগ করছে।
আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত এ ধরনের ‘প্রাতিষ্ঠানিক বৈষম্য’কে বর্ণবাদী আখ্যা দিয়েছেন। তাঁরা এটাকে ‘মানবতাবিরোধী অপরাধ’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন। তা ছাড়া, আরব দেশগুলোকে নিয়ে যে ‘বড় চুক্তির’ ধারণা করা হয়েছিল, সেটাও একইভাবে ব্যর্থ হবে। ইসরায়েল-ফিলিস্তিন আলোচনায় অংশ নেওয়া সাবেক দূত মার্টিন ইনডাইক এ ধারণাকে ‘বাইরে থেকে ভেতরে আসা’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।
ইনডাইকের প্রস্তাবে এটা ছিল যে প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প জর্ডান, মিসর, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করবেন, যার সঙ্গে থাকবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘ ও রাশিয়া। যারা ‘ঐকমত্যের ভিত্তিতে এমন এক নীতিমালা তৈরি করবে, যেটা দুই-রাষ্ট্র সমাধানের ভিত্তিতে ইসরায়েল ও ফিলিস্তিনের আলোচনায় দিকনির্দেশনা দেবে।’ এ ধরনের আলোচনা থেকে ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর কাঙ্ক্ষিত ফল আসবে না। ২০০২ সালের আরব শান্তি পরিকল্পনা খুবই পরিষ্কার। এতে বলা হয়েছিল, আরব দেশগুলো শুধু ইসরায়েলের সঙ্গে দেখা করে সম্পর্ক স্বাভাবিক করবে তখনই, যখন ইসরায়েল ১৯৬৭ সালের সীমান্তে চলে যাবে। তবে যুক্তরাষ্ট্র ছাড়া আর কেউ দুই-রাষ্ট্রভিত্তিক সমাধান বাতিল করতে চাইবে না।
ট্রাম্প ও নেতানিয়াহুর বৈঠক থেকে যদি রাজনৈতিক সফলতা আনতে হয়, তাহলে এই মৌলিক নীতিটি মাথায় রাখতে হবে যে চুক্তির সময় মধ্যস্থতাকারীকে নিরপেক্ষ ও সৎ থাকতে হবে। আর বিবদমান পক্ষগুলোকে পরস্পরকে স্বীকৃতি দিতে হবে, যুক্ত থাকতে হবে।
অনুবাদ: প্রতীক বর্ধন, আল-জাজিরা থেকে নেওয়া।
দাউদ কাতাব: ফিলিস্তিনি সাংবাদিক।