মঙ্গলবার, ২৩শে এপ্রিল, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৩:৪২
Home / খোলা জানালা / মুক্তিযুদ্ধ ধর্ম রাজনীতি নিয়ে পিনাকীর জরুরি প্রশ্ন ও দরকারি জবাব

মুক্তিযুদ্ধ ধর্ম রাজনীতি নিয়ে পিনাকীর জরুরি প্রশ্ন ও দরকারি জবাব

সালাহ উদ্দিন শুভ্র :

এত ছোট পরিসরে অজস্র বিষয় হাজির করতে পারাটা কম কথা নয়। পড়ার অভ্যাস আমাদের এখানে নেই তেমন- এটা সত্যি। সব পড়তে হবে এমন কোন কথাও নেই। কিন্তু কিছু কিছু লেখা থাকে না পড়লে মিস হয়ে যায়। সেই মিস করার ক্ষতি ব্যক্তিক নয়, সামষ্টিক। যে অচলায়তনের মধ্যে সমাজ বা সময় থাকে তা থেকে মুক্ত হওয়ার পয়লা উপায় পড়া অথবা শোনা। রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রথম কাজটি লেনিন করে দিয়েছেন লিখে লিখে। তিনি এমনকি রাশিয়ায় অবস্থান না করেও, আন্দোলনের জায়গাগুলোতে না থেকেও লিখে লিখে রাস্তা ঠিক করে দিয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় যেমন আমাদের লোকেরা শুনে শুনে নিজেদের নৈকট্য বাড়িয়ে নিয়েছিলেন, লক্ষ্য ঠিক করেছিলেন, যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। এখনকার সময়ে শোনার তেমন কিছু নেই, পড়ারও নেই। তবে পিনাকী ভট্টাচার্যের বইটি আছে।

কঠিন কঠিন তত্ত্বের বই পড়া বিষয়ে বাংলা ভাষাভাষীদের নাকি অনীহা আছে। তাদের কাছে সেসব বড় নিরস লাগে, অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়। ‘দাঁত ভেঙ্গে যায়’। তবে তারা বোধহয় পিনাকী ভট্টাচার্যের লেখা না পড়েই কথাগুলো বলেন। কারণ তিনি মূলত তত্ত্বই করেন। আর সেগুলো অপ্রাসঙ্গিক তো নয়ই বরং ঘরের আলাপ বলতে গেলে। আর দাঁত ভাঙ্গার তো প্রশ্নই আসে না, উল্টো মাড়িতে জোর পাবেন তর্কের জন্য। তার তর্কের প্রধান গুণ তা রক্তপাতহীন। রাজনৈতিকভাবে অনেকটা সঠিক।

পিনাকী’র এত প্রসংশা করছি তার লেখা ‘মুক্তিযুদ্ধ, ধর্ম, রাজনীতি ও অন্যান্য প্রসঙ্গ’ বইটি পড়ে। পিনাকী ভট্টাচার্য নামটি পরিচিত হলেও তার লেখার সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ কালেভদ্রে কখনো ঘটলেও স্মৃতিতে নেই। তবে তিনি বাংলা ব্লগ মহল্লায় আর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ বিতর্কিত। বিভিন্ন অভিধা তিনি পেয়ে থাকেন। কিন্তু তার এই বইটি পড়ে আমার চমকই জাগল। মনে হলো কেন এতদিন পড়িনি। কত বই-ই তো আমরা না পড়ে থাকি। সেখানে পিনাকীর বই পড়তেই হবে কেন?

পড়ার জরুরতটা কোথায় তা পিনাকী’র বই থেকে হুবহু তুলে দিয়ে দলে টানার চেষ্টা করি আগে। পিনাকী লিখেছেন- ‘বাংলাদেশে প্রচলিত ব্যবস্থায় আমরা দেখি একটা নিদারুণ পণ্যকেন্দ্রিকতা। এখানে সবকিছুই পণ্য। এমনকি ভোটও। বাংলাদেশে ভোটের অবাধ কেনাবেচা হয়। পণ্যমূল্যে নির্ধারিত হয় কোনো সম্পর্ক বা আইডিয়া বিকাবে কি না। এই অবস্থা অনেক চেষ্টা করে তৈরি করা হয়েছে। এই অবস্থা তৈরির পেছনে আছে বাংলাদেশের উঠতি ধনিক-শ্রেণির প্রত্যক্ষ চেষ্টা। তারাই ভেতর থেকে সমাজকে আদর্শহীন করে তুলে সম্পদকে একমাত্র কাম্যবস্তু করে তুলেছে। কারণ এই অবস্থাই তাদের সামাজিক এবং রাজনৈতিক ক্ষমতাকে নিরঙ্কুশ করতে পারে। দুর্নীতির অনুপার্জিত সম্পদে কেনা যাবে সব আনুগত্য। এ অবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে হলে মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে রুডিমেন্টারি বা দৈনন্দিন পর্যায়ে আটকে রাখতে হবে। এই অবস্থায় মানুষের কাছে শুধু শরীরের শ্রম পাওয়া যাবে-চিন্তা পাওয়া যাবে না।‘ (পৃ- ৩০)

প্রথমত মনের দিক থেকে রাজনীতিটাকে চিনতে শেখা, বুঝতে পারা- এই বিষয়টা আমাদের সমাজে বিরল। একে অন্যের প্রতিপক্ষ, উপরি উপরি যা দেখা যাচ্ছে ঘটনা সেটাই, এভাবে বিচারে আমরা অভ্যস্ত। অনেক জমায়েত, অনেক হট্টগোল, শোরগোলের ভেতরে সঙ্গোপনে লুকিয়ে থাকা যে মনোজগত তা খুঁজে বের করার চেষ্টা কই। থাকলেও তাকে সঠিকভাবে খুঁজে পাওয়ার পথটা কই। সেই পথ পাওয়া গেলেও তাতে হাঁটার তাকত কয়জনের আছে। আমি পড়লাম পিনাকী’র আছে। তিনি অকাট্য। নির্ভীক। অন্তত বইয়ে যে কমিটমেন্ট তিনি রাজনৈতিকভাবে হাজির করেছেন সেখানে তো বটেই।

আরো আছে। সেটার শুরুটাও তার বইয়ের আলোচনা সূত্রেই উল্লেখ করি বরং।  তিনি লিখেছেন, মুখবন্ধেই, বইবিষয়ক কইফিয়তে তিনি জানাচ্ছেন- ‘২০১৩ সাল থেকে যে অস্থির সময় বাংলাদেশকে আচ্ছন্ন করেছে, সেই সময়ের কিছু টুকরো টুকরো বিতর্ক উঠে এসেছে এই লেখাগুলোতে। ব্লগ ও ফেসবুকে প্রকাশের তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিটি লেখার শেষে। গ্রন্থভুক্ত করার সময় এগুলোর কিছু কিছু ভাষা ও তথ্যগত সম্পাদনা করা হয়েছে। তবে চিন্তা বা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের তেমন কোনো পরিবর্তন করা হয়নি। আমি চেয়েছি সেই সময়ে ঘটে যাওয়া ঘটনা বিষয়ে আমার চিন্তা বা ব্যাখ্যাগুলো হুবহু হাজির থাক।‘

প্রথমত উল্লিখিত সময়ে যেসব ঘটনা ঘটেছে তার চিন্তা ও ব্যাখ্যায় পিনাকী মূল ধারার বাইরের লোক। এর একটা ইঙ্গিত শুরুতেই আছে যে মনের দিক থেকে বিচার করা এবং আসল প্রতিপক্ষ চিনতে পারা আর সেটা বলতেও পারা। কিন্তু কোনো স্থির নির্দিষ্ট চিন্তার কাছে নিজেকে বর্গা দেওয়ার লোকও যে পিনাকী নন তা বুঝাতে এই উদ্ধৃতি দেওয়া। সেই সময়ের চিন্তা ও ব্যাখ্যা পরে পাল্টাতেও পারে। এবং ঘটনার সঙ্গে চিন্তার বদল ঘটে। চিন্তা মানুষের একান্ত নিজস্ব কোনো সম্পদ না। এর সার্বভৌমত্বও তার নেই। ঘটনা যেমন তাকে তাড়িয়ে নিয়ে নিয়ে বেড়ায় বা বেড়াতে চায় চিন্তারও তেমনি বদল ঘটতে পারে। কোন কিছুতে আঁকড়ে ধরে থাকার মধ্যে সমাধান নেই। বরং তালাশ করতে করতে কোনো একটা সমাধানের দিকে যাওয়ার আন্তরিকতা যে আছে তার প্রমাণ চিন্তায় নমনীয় হওয়া। পিনাকী নমনীয়। তবে তার জোর আছে। বাংলাদেশের ইতিহাস বিচারে তিনি কনফিডেন্ট। অন্যের প্রভাব তার মধ্যে আছে, কিন্তু ভুল লাইনের লোক তিনি নন। আর অবিচলও।

ধর্ম হিসাবে ইসলাম কিম্বা হিন্দুর তুলনামূলক আলোচনার যে ভুল সড়কে আমরা উঠে পড়েছি তাতে পিনাকী নেই। তিনি সাময়িক আলপথে আছে। যা-ই বরং অসাম্প্রদায়িক। সেখানে ধর্মতাত্ত্বিক ব্যাপার নেই। দেশপ্রেম, চেতনা, মুক্তচিন্তা, প্রগতিশীলতার নামে গোঁয়ার আর নিষ্ফলা কোন চেষ্টার মধ্যে তিনি নেই। তার আলোচনা অধিক গণতন্ত্রের দিকে ধাবিত। 

ফলে পিনাকীর স্বভাব হলো চিন্তা করা আর তার গুণ হলো গ্রহণ করতে পারা। ইতিহাস ডিসেকশন করার সময় চোখের জল ঝরতে পারে, কিন্তু সত্যের দিকে আমাদের যেতেই হবে। পিনাকীও সেদিকেই যেতে চেয়েছেন যেমন- ‘সর্বজনীন সত্তার মানুষের তাত্ত্বিক ভিত্তি কী? অস্তিত্বের শর্ত কী? তাত্ত্বিক ভিত্তি আর অস্তিত্ত্বের শর্ত খ্রিষ্ট ধর্ম। আজকে আমরা মানবাধিকার, মুক্ত মানুষের ধারণা, স্বাধীন মানুষের স্বাধীন চিন্তা, এমনকি ইহলৌকিকতা যা- কিছুকে আধুনিকতা বলে জানি এই সব কিছুর গুমর হচ্ছে হেগেলের চিন্তার জগতের এই অসাধারণ উপস্থাপন।

এই একই কাজ করতে চেয়েছে ভারতের চিন্তাবিদেরা। তবে ভার নিম্নকোটির দর্শনে সবল হলেও উচ্চকোটির দর্শনে অতি দুর্বল। ভারতে হেগেলের মতো দার্শনিক ছিল না। দর্শনের চিন্তার দুর্বলতার জন্য ভারতের চিন্তার জগৎ মূলত সাহিত্য আক্রান্ত। হেগেল নেই তাতে কী; রবীন্দ্রনাথের মতো কবি তো ছিলেন। তিনি হেগেলের সেই কাজটি করেছেন। তিনি এক অখণ্ড ভারতীয় সভ্যতার স্বপ্ন দেখেছেন যার আত্মা হবে হিন্দু।‘(পৃ- ৫৫)

মোট কথায় আমাদের সময়ে যত প্রশ্ন হাজির হয়েছে তার প্রায় সবগুলো নিয়ে আলাপ করেছেন পিনাকী। দিয়েছেন উত্তরও। সেখানে কাউকে তিনি ছেড়ে কথা বলেননি।  তার যে দৃষ্টিভঙ্গি, তাতেও গলদ পাবেন না। যেমন- ‘ইসলামিক বিজ্ঞানে পারমাণবিক বোমা হারাম। কারণ সেটা ব্লেম অর্দি। জুলুমের উপায়, প্রকৃতি ও প্রাণবিনাশী। কুমিরের চামড়ার টাই তৈরিও হারাম। কারণ সেটা প্রকৃতি ও প্রাণবিনাশী এবং অপচয়। ইসলামিক বিজ্ঞান প্রাণ ও প্রকৃতি-বিধবংসী নয়। এটা অতিশয় কৌতূহলোদ্দীপক যে ইসলামের স্বর্ণযুগে কেমিস্ট্রিতে মুসলিম বিজ্ঞানীরা পৃথিবী সেরা হলেও তারা ‘বারুদ’ আবিষ্কার করেননি।‘ (পৃ- ৫১)

আরো আছে- ‘দেশভাগের পর রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক প্রতিপত্তি হারানোর মানে সাথে সাথে হিন্দুদের সব পুরানো বয়ানও হারিয়ে অকেজো হয়ে যায়। তাই নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে টিকে থাকার জন্য সে নতুন বয়ান গঠনের সন্ধানে নামে। আর নিধর্মী এক সমাজের অনুমানের ওপর দাঁড়িয়ে সে নতুন বয়ানটা সে হাজির করেছিল যে-প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সে হলো কমিউনিস্ট পার্টি বা এর নাম হলো আজকের সিপিবি।‘ (পৃ-৬১)

এবং এই সিপিবির সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ‘জমিদার বংশের ছেলেরা এবং অভিজাত হিন্দু মধ্যবিত্তরা’। সিপিবি অথবা বাংলার বাম রাজনীতিকে পিনাকী বলছেন শূণ্যের মাঝে কোন এক ঘর তুলে বসে আছেন তারা। মোটা দাগে হিন্দু জাতীয়তাবাদী বাঙালি সংস্কৃতির তারা ধারক এবং এর একটা অংশ আওয়ামীপ্রবণ। কার্ল মার্ক্স তার সময় থেকেই পুঁজিবাদের যে দার্শনিক ভিত, ব্যক্তির মুক্তিপ্রশ্ন, ধর্ম নিরপেক্ষতা, প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক-এসব বিষয়কে মোকাবিলার প্রসংগ তুলেছিলেন। আমাদের বামপন্থীরা তা থেকে বিচ্যুত হয়েছে। তারা পুঁজিবাদের ধোঁয়াশার মধ্যে হারিয়ে ফেলেছে নিজদের। এর যে মনস্তত্ত্ব তাও দেখিয়েছেন পিনাকী। তার বইয়ের উদ্ধৃতি দিয়ে নিজের লেখা ভরিয়ে তোলার ইচ্ছা নাই।

তাই বলছি পিনাকীকে পড়তে হবে। না পড়লেও তার উত্থাপিত বিষয় এড়িয়ে যাওয়া যাবে না। তিনি ঘরের কথাই বলছেন, মনের কথাই বলছেন, সহজ আর প্রাঞ্জল ভাষায় বলছেন। তার লেখায় মাঝে মাঝে ইংরেজি শব্দ এমনভাবে এসেছে যে বুঝা আরো সহজ হয়ে উঠছে কী বলতে চান তিনি।

পিনাকীর বইটি তাই শুধু রাজনীতিতে ইচ্ছুকদের জন্যই নয়। দর্শন, চিন্তা, লেখালেখি, অ্যাক্টিভিস্টদের জন্যও জরুরি। হেগেল থেকে শুরু করে আমাদের সময়ের আলী রিয়াজ পর্যন্ত আছেন তার আলোচনায়। আছেন স্পিনোজা, এমানুয়েল কান্ট, মিশেল ফুকো। পশ্চিমা দর্শন অনেকেই পড়েন কিন্তু সহজ বাংলায় তার ক্রিটিক তুলে ধরার নজির খুব বেশি পাইনি।

পিনাকী ভট্টাচার্যকে আমার তরফে আগাম ধন্যবাদ।

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

তথ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চাইলেন চলচ্চিত্রকর্মীরা!

কমাশিসা ডেস্ক:: তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনুর পদত্যাগ দাবি করেছে চলচ্চিত্রকর্মীদের সমন্বিত সংগঠন ‘চলচ্চিত্র স্বার্থ সংরক্ষণ ...