বৃহস্পতিবার, ২১শে নভেম্বর, ২০২৪ ইং
কমাশিসা পরিবারবিজ্ঞাপন কর্নারযোগাযোগ । সময়ঃ বিকাল ৩:১০
Home / ঘর-সংসার / নববি পথে গড়ে উঠুক আদর্শ পরিবার ও সমাজ!
Market called Souq Waqif in Doha. Qatar

নববি পথে গড়ে উঠুক আদর্শ পরিবার ও সমাজ!

মুহাম্মদ নাজমুল ইসলাম :

পরিবার শুধু একটি উত্তম সামাজিক প্রতিষ্ঠানই নয়, বরং ইসলামের দৃষ্টিতে পরিবার হলো একটি পবিত্র সংস্থা। পরিবারের সুখ, শান্তি এবং সবার পারস্পরিক সম্পর্ক ছাড়াও রয়েছে একটি আইনগত ও সামাজিক দিক। নৈতিক চরিত্র গঠনের প্রকৃষ্ট ক্ষেত্র হলো পরিবার। আর পরিবারের স্বচ্ছতায়ই গড়ে উঠে একটি সুন্দর সমাজ। সামাজিক সম্পর্ক সৃষ্টি ও বৃদ্ধি হয় পরিবারকে কেন্দ্রকরে। পবিত্র কুরআনুল কারিমে পারিবারিক সদস্যদের মুহসিনীন বা প্রাচীর ঘেরা দুর্গে অবস্থানক সুরক্ষিত লোকজনের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ইসলামে পরিবার শুধু স্বামী-স্ত্রী এবং সন্তানের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। পরিবারের পরিসর আরও ব্যাপক। নিকটাত্মীয়, পপাড়াপড়শিও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। তাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক, দয়া, করুণা এবং সহানুভূতি তো আছেই, বাড়তি সঙ্গে সঙ্গে দায়িত্বশীলতা প্রশ্নও জড়িত। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে পূর্ণ সহযোগিতা ও স্নেহ-ভালোবাসার বন্ধনের ওপর নির্ভর করে পারিবারিক জীবনের সুখ-শান্তিও সর্বাঙ্গীণ উন্নতি; স্বামী-স্ত্রী নিজ নিজ কর্তব্য পালন করে চললে পারিবার অনেকাংশে সুখ ও শান্তিতে ভরে ওঠে। স্বামী স্ত্রী’র প্রভাবই পড়ে স্বীয় সন্তান-সন্ততি -এর ওপর। ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় পরিবারই হল মানুষগড়ার মূল কেন্দ্র এবং সমাজ গঠনের প্রধান ভিত্তি। এ জন্য পরিবার গড়ার ব্যাপারে ইসলাম বিশেষভভাবে যত্নবান হওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা দাম্পত্য জীবন গঠনের পূর্বশর্ত হিসেবে স্বামীর জন্য বিবাহের আগে স্ত্রী ও সন্তানের ভরণপোষণের জোগানদেয়ার যোগ্যতা অর্জন করার কথা বলেছেন। পারিবারিক জীবনে প্রবেশ করার আগেই একজন পুরুষের উচিত তার স্ত্রীর ও ভবিষ্যৎ বংশধরদের ভরণপোষণ করার মতো আর্থিক সচ্ছলতা অর্জন করা। মহান আল্লাহপাক বলেন- ‘আর সন্তানের পিতার দায়িত্ব যথাবিধি তাদের (মা ও শিশুর) ভরণপোষণের ব্যবস্থা করা।’ (সূরা বাকারা, আয়াত-২৩৩)। এ আয়াতের ব্যাখ্যায় মুফতিয়ে আজম মুফতি মুহাম্মদ শফী (রহ·) বলেন, এ আয়াত দ্বারা এ কথা বোঝানো হয়েছে, শিশুকে স্তন্যদানকারী মাতার দায়িত্ব, আর মাতার ভরণপোষণ ও জীবন-ধারণের অন্যান্য দায়িত্ব বহনকরবে পিতা। তাছাড়া  সুরায়ে বাকারায় বলা হয়েছে, ‘মায়েরা তাদের সন্তানদের পূর্ণ দু’বছর দুধ পানকরাবে।’ মাতা-পিতার ওপর সন্তানের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার হচ্ছে, একটি নির্দিষ্টবয়সে তার জন্য আলাদা শয়নের ব্যবস্থা করা। মহানবী (সা·) বলেন, ‘তোমাদের সন্তানদে রবয়স যখন সাত বছর হয়, তখন তোমরা তাদের নামাজের জন্য আদেশ করো।’ আর দশ বছর বয়স হলে তাদের নামাজের জন্য জুর  তাগিদ দাও। নমনামাজ পড়তে না চাইলে প্রয়োজনে  তাদের বিছানা আলাদা করে দেবে।
হজরত লোকমান (আ·) নিজ পুত্রকে যে মূল্যবান উপদেশ দিয়েছেন পবিত্র কোরআনে, তার উল্লেখ হয়েছে এভাবে- হে বৎস! নামাজ কায়েম কর, সৎকাজের আদেশ দাও, মন্দ ও গর্হিত কাজে নিষেধ কর এবং বিপদাপদে ধৈর্যধারন করো। নিশ্চয়ই এটি দৃঢ়তার কাজ। (সূরা লোকমান, আয়াত-১৭)। প্রতিটি  শিশুরাই নরম মাটির মতো শৈশবে যে মূল্যবোধ ও আদব আখলাকের পরিবেশে বেড়ে উঠবে, শৈশবে তাদের যে পথের দিকে মুখ করে দেয়া হবে তারা সে পথকেই বেছে নেবে।এ পথই তার পরবর্তী জীবনের স্থায়ী রাহনুমা হয়ে যায়। এ কারণে পরিবারই  হচ্ছে একটি শিশুর প্রথমিক বিদ্যালয়। এ সময় মাতা-পিতা নিজেদের অনুসরণীয় ব্যক্ত দিয়ে এবং ধর্মীয় নির্দেশনার মাধ্যমে তাদের প্রতিপালন করবেন। এটাই বাঞ্ছনীয়। হজরত দয়ালনবী (সা.) বলেছেন, পিতা-মাতার ওপর সন্তানের অন্যতম অধিকার হচ্ছে, তাকে উত্তম শিক্ষাদেয়া এবং সুন্দর একটি নাম রাখা। (বায়হাকি শরিফ)। ছোটবেলা থেকেই শিশুর শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। আর তা হতে হবে নিজ ধর্মীয় শিক্ষা। আর এটি প্রতিটি মাতা-পিতার ওপর ফরজ। এই কর্তব্য পালন না করলে গুনাহগার হতে হবে এবং আখেরাতে আল্লাহর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। প্রতিটি শিশুকে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে লালন-পালনের সঙ্গে তার মননশীলতার বিকাশপ্রয়ো এ ক্ষেত্রে অভিভাবককে লক্ষ্য রাখতে হবে, যেন তার বয়স  বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে তারমধ্যে মিথ্যা বলা, নাপাক থাকা, নামাজ না পড়া ইত্যাদি বিষয়গুলো না থাকে। কোনো খারাপ জিনিস তার মাঝে ববিজ না ববুনে। অন্যথায় তা একসময় তার সভাবে পরিণত হয়ে যাবে। এ জন্য চাই সহায়ক পরিবেশ। আলোকিত শিক্ষা এবং দিক্ষা। প্রিয়নবী (সা·) শিশুদের জ্ঞানদানের কথা বলেই ক্ষান্ত হননি; বরং তাদের সাঁতার কাটা, এমনকি তীর চালানো পর্যন্ত শিক্ষা দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
ইসলাম বলেছে, তুমি আয় বুঝে ব্যয় কর। দারিদ্র্য যেমন ইসলাম কামনা করে না, অনুরূপভাবে ইসলাম বাহুল্য বর্জনের নির্দেশও রয়েছে। কারণ সীমাহীন দারিদ্র্য অনেক ক্ষেত্রে মানুষকে কুফরির পথে ধাবিত করে, আবার সীমাহীন প্রাচুর্য পরিবারে অশান্তি ডেকে আনে। অনেক ক্ষেত্রে মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের থেকে সরে নিয়ে যায়।
যখন আরব সমাজ চরম অবস্থায় লিপ্ত ছিল। হত্যা, সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, রাহাজানি, নারী নির্যাতন, অশস্নীলতা-বেহায়াপনা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দ্বন্দ-সংঘাত ও হানাহানি-রেশারেশিতে পঙ্গু হয়ে পড়েছিল সমাজ ব্যবস্থা। শুধুমাত্র মেয়ে সন্তান হিসেবে জন্মগ্রহণ করায় পিতা অপমান বোধ করে জীবিতাবস্থায় মাটিতে পুঁতে রাখত। শিরিক ও পৌত্তিলকতার অভিশাপে সর্বনাশ হচ্ছিলো সভ্য জীবনাতিহাস। মিসর, ভারত, ব্যাবিলন, গ্রীস ও চীনে সভ্যতা সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিল। একমাত্র রোম ও পারস্য সভ্যতার উড্ডয়মান পতাকার ঝাঁকজমকে চোখ ঝলসে দিত। অথচ সে সব নয়নাভিরাম প্রাসাদের অভ্যন্তরে চলত লোমহর্ষক যুলুম ও নির্যাতন। জীবনের ক্ষতস্থান থেকে বের হতো উৎকট দুর্গন্ধ। রাজা ও সম্রা্টগণ খোদা হয়ে জেঁকে বসেছিল। তাদের সাথে আঁতাত করে জনগণের উপর প্রভুত্ব চালাত ভূমি মালিক ও ধর্মযাজক শ্রেণি। জনগণের নিকট থেকে মোটা অংকের কর, খাজনা, ঘুষ ও নজরানা আদায় করত। উপরন্তু পশুর মতো খাটনি খাটতে বাধ্য করা হতো। মক্কা ও তায়েফের মহাজনরা সুদী ব্যবসার জাল পেতে রেখেছিল। দাস ব্যবসার অভিশপ্ত প্রতিষ্ঠানগুলো মহা ধুমধামের সাথে চলছিল। মোটকথা মানুষ প্রবৃত্তির গোলামির সর্বনিম্ন স্তরে পৌঁছে গিয়ে হিংস্র হায়েনা ও চতুস্পদ জন্তু-জানোরের মত জীবন-যাপন করছিল। শক্তিধররা দুর্বলদেরকে ছাগল ও ভেড়ার পালের মত নাকে রশি দিয়ে ঘোরাত, আর দুর্বলেরা শক্তিমানদের পদতলে লুটিয়ে থাকত। এহেন পরিস্থিতিতে ৫৭০ খ্রিঃ ১২ রবিউল আউয়ালে সমাজ সংস্কার ও আমূল পরিবর্তনের শেস্নাগান নিয়ে মানবজাতির ত্রাণকর্তা হিসেবে বিশ্বনবী মুহাম্মদ (সা.) এর আগমন ঘটেছিল। যার দেখানো আলোকিত পথে জাতি পেয়েছিলো শান্তির পথ।
রাসূল (সা.) এর জীবনী থেকে যথার্থ উপকারিতা অর্জনের জন্য যে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের জবাব জানা জরুরি তা হলো, রাসূল (সা.) এর সামনে ইস্পিত পরিবর্তনের পরিধি কতদূর? তাঁর কাজের মানদন্ড কি ছিল? সমাজ ব্যবস্থায় তিনি কি আংশিক পরিবর্তন চাইতেন না সর্বাত্মক? তাঁর দাওয়াত কি নিছক ধর্মীয় ও নৈতিকতার সঙ্গে জড়িত ছিল না সার্বিক সমাজ ব্যবস্থার জন্য ছিল? সামাজিক পরিমন্ডলে তাঁর অভীষ্ট লক্ষ্য কি ছিল? এর জবাব আল-কুরআনে সূরা হাদীদের ২৫ নং আয়াতে আল্লাহ রাববুল আলামীন বলেছেন- ‘‘আমি আমার রাসূলকে (সা.) এই উদ্দেশ্যে প্রেরণ করেছি এবং তার উপর কিতাব ও মানদন্ড নাযিল করেছি যাতে মানবজাতি ন্যায় ও ইনসাফের উপর প্রতিষ্ঠিত হয়’’। সুরা আসস-সফ এর ৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে- ‘‘আল্লাহ স্বীয় রাসূলকে (সা.) কে হেদায়েত ও সত্যদ্বীন সহকারে পাঠিয়েছেন যাতে তিনি এ সত্য দ্বীনকে অন্য সমস্ত ধর্ম মত ও জীবন ব্যবস্থার উপর বিজয়ী করে দিতে পারেন। মুশরিকরা তা পছন্দ করুক আর নাই করুক’’। তাহলে বোঝা গেলো ইসলামের দাওয়াতের একমাত্র উদ্দেশ্য হল মানবজীবনকে ইনসাফ ও ন্যায়ের ভিত্তিতে গড়ে তোলা এবং সমাজ ব্যবস্থায় কার্যকরভাবে ভারসাম্য ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠা করা। কুরাইশ ও আরবের অন্যান্য মুশরিকরাতো নিজেদের জাহেলী জীবন ব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাবেই। যে কোন ভাল সেস্নাগান বা ভাল কার্যক্রমই হোক যদি জাহেলিয়াতের ধারক বাহকদের স্বার্থের পরিপন্থী হয় তাহলে বিরোধিতা আসবেই। কিন্তু এই সব বিরোধিতা বা পছন্দ অপছন্দের তোয়াক্কা না করে সকল ধর্মান্ধতা ও জাহেলিয়াতের উপর দ্বীন ইসলামকে বিজয়ী করার কাজ সুসম্পন্ন করতেই হবে। আর ইসলামের দাওয়াতের উদ্দেশ্য যদি এটাই না হতো তাহলে দ্বন্দ্ব-সংঘাত, জেহাদ ও হিজরতের অবকাশতো থাকতো না। জান ও মালের কোরবানীর আহবানতো জানানো হতো না।
তাহলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত পৌঁছা যায় মুহাম্মদ (সা.) শুধুমাত্র নিছক ধর্মের কথা নয় বরং ঘুণে ধরা একটি সমাজকে ভেঙে নতুন আরেকটি সমাজ কায়েমের নিরলস চেষ্টা করেছিলেন যে এই সমাজে শিক্ষা সাহিত্য সংস্কৃতি, অর্থনীতি, রাজনীতি, নেতৃত্ব তৈরি ও বিচার ব্যবস্থা সবই হবে মানবতার জন্য দুনিয়ায় শান্তি ও আখেরাতের মুক্তি।

লেখক : শিক্ষার্থী, দারুল উলুম দেওবন্দ, ভারত।

About Abul Kalam Azad

mm

এটাও পড়তে পারেন

কওমি মাদরাসা কল্যাণ ট্রাস্ট, বাংলাদেশ

খতিব তাজুল ইসলাম ট্রাস্টের প্রয়োজনীয়তাঃ কওমি অংগন একটি স্বীকৃত ও তৃণমূল প্লাটফর্ম। দেশ ও জাতির ...