এবনে গোলাম সামাদ :
ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯) তার বহুলপঠিত বাংলা ব্যাকরণে বলেছেন,মানুষ্য জাতি যে ধ্বনি-সকল দ্বারা মনের ভাব প্রকাশ করে, তাহার নাম ভাষা। সাধারণতঃ কোনও দেশের বা দেশবাসী জাতির নাম অনুসারে ভাষার নাম হইয়া থাকে। বাঙ্গালী জাতি যে ভাষা ব্যবহার করে, তাহার নাম বাঙ্গালা ভাষা। অন্য দিকে ডক্টর সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় (১৮৯০-১৯৭৭) তার বিখ্যাত জাতি, সংস্কৃতি ও সাহিত্য নামক প্রবন্ধে বলেছেন, বাঙালি জাতি বলিলে, যে জনসমষ্টি বাংলা ভাষাকে মাতৃভাষারূপে বা ঘরোয়া ভাষারূপে ব্যবহার করে, সেই জনসমষ্টিকে বুঝি। অর্থাৎ দেশের নামে জাতি, না জাতির নামে দেশ, সেটা নিয়ে থাকছে প্রশ্ন।
ড. শহীদুল্লাহ ও ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় দুজনেই ছিলেন খ্যাতনামা ভাষাতাত্ত্বিক। দুজনেই লিখেছেন নামকরা বাংলা ব্যাকরণ। কিন্তু একজন বলেছেন, দেশের নামানুসারে হয়েছে বাঙালি জাতির নাম, আর একজন বলেছেন ভাষার নামানুসারে হয়েছে, অথবা হতে হবে বাঙালি জাতির নাম। অর্থাৎ দেশ ও জাতি এই নিয়ে সৃষ্টি হতে পারছে জটিলতা। যে জটিলতা আমরা এখনো কাটিয়ে উঠতে পেরেছি বলে মনে হয় না। কিন্তু বাংলা ভাষাভাষী মানুষ যে অঞ্চলে বাস করে তার সবটাকেই একসময় যে বাঙ্গালা অথবা বঙ্গ বলা হতো তা কিন্তু নয়। মাইকেল মধুসূদন দত্ত (১৮২৪-১৮৭৩) তার শর্র্মিষ্ঠা নাটকের প্রস্তাবনায় লিখেছেন:
অলীক কুনাট্য রঙ্গে মজে লোকে রাঢ়ে বঙ্গে
নিরখিয়া প্রাণে নাহি সয়।
মধুসূদনের শর্মিষ্ঠা নাটক প্রকাশিত হয় ১৮৫৮ খ্রিষ্টাব্দে। এ থেকে বোঝা যায় যে ঊনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগেও রাঢ় ও বঙ্গকে ঠিক এক দেশ বলে মনে করা হতো না। যদিও ভাষার দিক থেকে গড়ে উঠেছিল ঐক্য। ঢাকাবাসীরা একসময় মাইকেল মধুসূদন দত্তকে একটা অভ্যর্থনা প্রদান করে। এই অভ্যর্থনার উত্তরে তিনি বলেন- ‘আমার সম্বন্ধে আপনাদের আর যে কোন ভ্রমই হউক, আমি সাহেব হইয়াছি, এ ভ্রমটি হওয়া ভারী অন্যায়। আমার সাহেব হইবার পথ বিধাতা রোধ করিয়া রাখিয়াছেন। আমি আমার বসিবার ঘরে ও শয়ন করিবার ঘরে এক একখানি আর্শি রাখিয়া দিয়াছি, এবং আমার মনে সাহেব হইবার ইচ্ছা যেমনি বলবৎ হয়, অমনিতে আর্শিতে মুখ দেখি, আরো, আমি শুদ্ধ বাঙ্গালি নহে, আমি বাঙ্গাল, আমার বাটি যশোহর।’ মাইকেলের এই উক্তি থেকে আর একটি জিনিসও স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, সে সময়ে বাঙ্গাল ও বাঙালিকে ঠিক এক করে দেখা হতো না। মধুসূদন নিজেকে বাঙ্গাল বলে পরিচয় দিতে গৌরববোধ করছেন। ভাষার নামে যদি জাতি বোঝাতে হয়, তবে বাংলাভাষী জাতিকে বোধ হয় বাঙালি না বলে বাঙ্গাল বলাই অধিক যুক্তিযুক্ত হবে। এখানে আমরা দেখছি যে, বক্তৃতার মঞ্চে দাঁড়িয়েও মধুসূদন সাধু বাংলা ভাষায় বক্তৃতা দিচ্ছেন। তাই ঐতিহাসিক দিক থেকে প্রমিত বাংলা বলতে গেলে চিহ্নিত করা উচিত সাধু বাংলা গদ্যকে। যেটাকে এখন করা হচ্ছে না। বরং সাধু বাংলা গদ্যকে এখন সরকারিভাবে নাকচ করাই হয়েছে। এখন প্রমিত বাংলা বলতে বোঝানো হচ্ছে কলকাতার কথিত বাংলাকে। কিন্তু এই বাংলায় কলকাতার কথিত বাংলায় সাধারণ মানুষ কথা বলে না। এটা বর্তমান বাংলাদেশের কোনো অঞ্চলেরই মানুষের মুখের ভাষা নয়।
কলকাতা আমাদের রাজধানী নয়। কলকাতার বাংলাকে আদর্শ করে বর্তমান বাংলাদেশের ভাষার শ্রীবৃদ্ধি কতটা হতে পারবে, সেটা নিয়ে তাই দেখা দিচ্ছে সন্দেহ। আমরা অসুবিধায় পড়ছি ছিলাম, ছিলেম না ছিলুম লিখব, সেটা নিয়ে। অসুবিধায় পড়ছি অভ্যাস লিখব না লিখব অভ্যেস। উপরে লিখব না লিখব ওপরে। কোন উচ্চারণকে গ্রহণ করব প্রমিত হিসেবে। আর কারাই বা সেটা করে দেবেন ঠিক।
বাংলা গদ্যের ইতিহাস নিয়ে এখনো যথেষ্ট গবেষণা হয়নি। তবে যতটুকু হয়েছে তা থেকে আমরা জানছি যে, পর্তুগিজ খ্রিষ্টান মিশনারিরা সর্বপ্রথম সাধু বাংলা গদ্যে বই লিখে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারে ব্রতী হন। আর তারা এই সাধু গদ্য লেখা শেখেন ঢাকার ভাওয়ালগড় অঞ্চল থেকে। অর্থাৎ ঢাকার ভাওয়ালগড় অঞ্চলে একটা প্রাঞ্জল বাংলা গদ্যের ধারা বিদ্যমান ছিল। যার থেকে বলা যায় সাধু বাংলা গদ্যের উদ্ভব হতে পেরেছিল পূর্ব বঙ্গে; পশ্চিম বঙ্গে নয়। পর্তুগিজরা বাংলায় আসে ১৫১৭ খ্রিষ্টাব্দে। তারা প্রথম বাংলায় আসে চট্টগ্রাম অঞ্চলে। চট্টগ্রামে গড়ে তোলে একটা বড় নৌবন্দর। যাকে তারা বলত পোর্তগ্রন্দ বা বড় বন্দর। পর্তুগিজরা ঢাকার কাছে তেজগাঁওয়ে তাদের বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে। এবং সেখানে তারা প্রার্থনার জন্য ১৫৯৯ খ্রিষ্টাব্দে গড়ে একটি গির্জা। যা এখনো টিকে আছে। পর্তুগিজ পাদ্রি মানুএল দ্য ওসাম্পুসাঁও পর্তুগিজ ভাষায় বাংলা ব্যাকরণ রচনা করেন এবং সঙ্কলন করেন বাংলা-পর্তুগিজ শব্দকোষ। যাতে করে পর্তুগিজ মিশনারিরা বাংলা শিখে বাংলাদেশে খ্রিষ্টধর্ম প্রচার করতে পারে। মানুএল দ্য নিজেই খ্রিষ্টধর্ম প্রচারের জন্য Crepar Xaxtrer Orthbhed, কৃপার শাস্ত্রের অর্থভেদ। মানুএল-এর এই বইটি এবং তার পর্তুগিজ ভাষায় লেখা বাংলা ব্যাকরণ ও বাংলা-পর্তুগিজ শব্দকোষ ১৭৪৩ খ্রিষ্টাব্দে পর্তুগালের রাজধানী লিসবনে ছাপা হয়। এদের সব ক’টিকেই পাওয়া গেছে। তাই এখন আর মনে করা উচিত নয় যে, কলকাতা, ফোর্ট উইলিয়াম কলেজে প্রথম হতে পেরেছিল বাংলা গদ্যের সূচনা। যদিও এখনো ছাত্রদের বাংলা গদ্যের ইতিহাস পড়াতে যেয়ে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা চর্চার ওপরই দেয়া হচ্ছে অধিক গুরুত্ব।
বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের ইতিহাস নিয়েও যথেষ্ট গবেষণা হয়নি বরং এই গবেষণাকে এড়িয়েই যাওয়া হচ্ছে। একসময় মনে করা হতো বাংলাদেশে মুসলমানের সংখ্যা বেশি। কেননা তথাকথিত নিচু বর্ণের হিন্দুরা গ্রহণ করেছিল ইসলাম। কিন্তু বর্তমানে বাংলাভাষী মুসলমানের রক্তের গ্রুপ বিশ্লেষণ করে দেখা যাচ্ছে যে, তার হার মিলছে তথাকথিত উচ্চবর্ণের হিন্দুদেরই সঙ্গে বেশি (D.K. Sen. The Racial Compositions of Bengalis, in Indian Anthropology. pp. 193-220. Edt. T.N. Madan and Gopala Sarana. Asian Publishing House. London 1962)। বৌদ্ধ পাল রাজাদের রাজত্বকালে মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার সঙ্গে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ বাণিজ্যিক স¤পর্ক গড়ে উঠেছিল। বৌদ্ধ বণিকেরা এই অঞ্চল থেকে বৌদ্ধ অধ্যুষিত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ব্যবসাবাণিজ্য করতে যেতেন। আবার ওই অঞ্চল থেকেও বাংলাদেশে আসতেন অনেকে ব্যবসাবাণিজ্য করতে। কিন্তু হিন্দুরা সমুদ্রপথে ওই অঞ্চলে আর ব্যবসাবাণিজ্য করতে যেতেন না। কেননা, তারা মানতে শুরু করেন মনুর বিধান। মনুর বিধানে সমুদ্রযাত্রা নিষিদ্ধ। কিন্তু বৌদ্ধদের ক্ষেত্রে এ রকম কোনো নিষিদ্ধ ছিল না। তারা অনেক সহজেই সমুদ্রপথে যেয়ে বিভিন্ন দেশের সঙ্গে ব্যবসাবাণিজ্য করতে পারতেন। খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীর প্রারম্ভ থেকে বর্তমান মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় আরব মুসলিম বণিকদের মাধ্যমে ব্যাপকভাবে ইসলাম প্রচার শুরু হয়। মালয়েশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় দলে দলে বৌদ্ধ ইসলাম গ্রহণ করেন। বাংলাদেশেও দলে দলে বৌদ্ধরা করেন ইসলাম গ্রহণ। বাংলাদেশের জনসমাজের এখন যে এত বেশি মুসলিম আধিক্য দেখা যায়, তার একটি কারণ হলো বৌদ্ধদের ইসলাম গ্রহণ। এই রকমই এখন মনে করেন অনেকে। এ পর্যন্ত আদি বাংলা ভাষার নমুনা হিসেবে ধরা হয় চর্যাপদকে। চর্যাপদের গানগুলো রচনা করেছিলেন বৌদ্ধ সিদ্ধাচার্যরা। এই ভাষায় জল শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি ব্যবহৃত হয়েছে পানি। লক্ষ করার বিষয়, বাংলার মুসলমান সমাজে পানি শব্দটি প্রচলিত, জল শব্দটি নয়। অর্থাৎ বাংলাভাষী মুসলমানই বহন করে চলেছে আদি বাংলা ভাষার ঐতিহ্য; বাংলাভাষী হিন্দুরা নয়। অথচ এখন চেষ্টা হচ্ছে বিশেষভাবে প্রমিত বাংলা শেখাবার। তাই প্রশ্ন উঠছে, প্রমিত বাংলা বলতে আসলেই কী বুঝতে হবে, সেটা নিয়ে। পূর্ব বাংলার উপভাষাসমূহের ক্রিয়াপদের ব্যবহারের মিল পাওয়া যাচ্ছে সাধু বাংলার সঙ্গে। আমি মনে করি, এখানকার উপভাষার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে হওয়া উচিত প্রমিত বাংলা। কেননা তা হলে বজায় থাকবে ভাষার ধারাবাহিকতা, না হলে ভাষা হয়ে পড়বে অত্যন্ত বেশি রচিত বা কৃত্রিম। রচিত বা কৃত্রিম ভাষা টিকতে চায় না। পরিণত হয় মৃত ভাষায়। ভাষা তৈরি হয় আগে। ভাষার ব্যাকরণ লেখা হয় পরে। বর্তমানে অনেক ব্যাকরণবিদ মনে করেন যে, ব্যাকরণের কাজ কোন ভাষা কিভাবে ব্যবহার করা হবে, সেটা ঠিক করে দেয়া। ব্যাকরণের কাজ হলো একটা ভাষা কিভাবে ব্যবহৃত হয়, সেটা স¤পর্কে ওই ভাষাভাষী মানুষকে সচেতন করে তোলা, যাতে করে সচেতনভাবে মানুষ ভাষাটার ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু প্রমিত বাংলার আন্দোলনকারীরা চাচ্ছেন ভাষা কিভাবে ব্যবহার করতে হবে, সেটাকেই ঠিক করে দেবে, যেটা আধুনিক ব্যাকরণ চেতনার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নয়। আধুনিক ব্যাকরণ চেতনাকে বলা চলে প্রাগমেটিক বা প্রয়োগবাদী, নরমেটিভ বা আদর্শবাদী নয়।
আমরা সাবেক পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক কাঠামোর মধ্যে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার জন্য আন্দোলন করেছিলাম। সাবেক পাকিস্তান আর নেই। বাংলা এখন একটি পৃথক স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রভাষা। এখন আমাদের মূল লক্ষ্য হওয়া উচিত এ ভাষার প্রকাশক্ষমতা বাড়ানো। কিন্তু সেটা না করে আমরা যেন কেবলই ঘটা করে একুশে ফেব্র“য়ারিকে পালন করতে চাচ্ছি। কিন্তু এই পালন করার মধ্য দিয়ে ভাষার উৎকর্ষসাধিত হবে না। ভাষার উৎকর্ষসাধিত হয় কেবল সেটাকে চর্চার মাধ্যমে।
ব্রিটিশ শাসনামলে বাংলা প্রদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা ছিল না। সরকারি ভাষা ছিল ইংরেজি। কিন্তু এই আমলে বাংলা গদ্যের হতে পেরেছে বিশেষ বিকাশ। কেননা, লেখকেরা এই ভাষার মাধ্যমে প্রকাশ করতে চেয়েছেন তাদের মনোভাব। বাংলা ভাষার এই বিকাশের মূলে সরকারি প্রচেষ্টার চেয়ে ব্যক্তিপ্রচেষ্টাই পালন করেছে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা।
লেখক : প্রবীণ শিক্ষাবিদ ও কলামিস্ট